নরসুন্দর ও নূরজাহান

15 Jul 2021, 12:47 PM সারেগারে শেয়ার:
নরসুন্দর ও নূরজাহান

উপমহাদেশীয় সাহিত্যে ছোটোগল্পের অন্যতম সার্থক রচয়িতা সাদাত হাসান মান্টো। শৈশবে বাউন্ডেলে স্বভাবের মান্টো ব্রিটিশ-ভারতের অমৃতসরে অনুবাদ সাহিত্য রচনায় হাত পাকিয়েছেন। বলা চলে, তার হাত ধরেই উর্দু সাহিত্যে ভিক্টর হুগোর পরিচয়। এমন আরো কিছু গ্রন্থ অনুবাদ করে ফিল্মের তীর্থস্থান তৎকালীন বোম্বে [মুম্বাই] পাড়ি জমান। সেখানে বিনোদন ম্যাগাজিন ‘পেইন্টার’-এ কাজ শুরু করেন। একইসঙ্গে চলে ছোটোগল্প রচনা। ওই সময় রেডিওতে সমানভাবে কাজ করেছেন। সে সুবাদে বেশকিছু চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্য রচনা করে অবস্থান শক্ত করেন। এ সময় তিনি ‘খান্দান’ [১৯৪৫] ছবির চিত্রনাট্য লেখেন। শওকত হোসেন রিজভী পরিচালিত ছবিটিতে সুরসম্রাজ্ঞী নূরজাহান প্রাণের বিপরীতে অভিনয় করেন। অর্থাৎ মান্টো-নূরজাহান প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। যদিও এর আগে দু’জন পরস্পর নামের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। বিশেষ করে নূরজাহান তো তখন দক্ষিণ এশীয় পোস্টার গার্ল। যার কন্ঠের জাদুতে হিন্দি সিনেমা প্রাচুর্য পেয়েছিল। তিনি একে একে ‘বড় মা’, ‘জিনাত’, ‘গাঁও কি গৌরী’, ‘আনমল গাঁধি’ এবং ‘জগনু’ করে অবিভক্ত ভারত মহাদেশে সম্রাজ্ঞীর আসন অলঙ্কৃত করেছেন। এ সময় তাকে ঘিরে অনেক রকম রহস্য, কথা-উপকথা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে। তার সেই সব কিছু ঘটনা সংকলন করে মান্টো লিখেছেন ‘স্মৃতিতে নূরজাহান’। দ্য ডন অবলম্বনে আনন্দভুবনের পাঠকদের জন্য মান্টোর লেখা থেকে অনুবাদ করে পত্রস্থ করা হলো।

মান্টো তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন- আমার মনে হয় নূরজাহানকে আমি প্রথম দেখেছি ‘খান্দান’ ছবিতে, যদিও ওই সময় তাকে বেবি বলে ডাকা হতো। কিন্তু বিশ্বাস করুন মোটেই তাকে আমার কাছে বেবি বলে মনে হতো না; বরং তার শরীরী ভাষা ছিল একজন পূর্ণাঙ্গ তরুণীর।

ওইদিনগুলোতে সিনেমাপ্রেমী মানুষের মাঝে নূরজাহানকে নিয়ে অনেক রঙ্গরস দেখা যেত। তবে তা মোটেও শরীর বা চেহারা নিয়ে নয়। এটা একেবারেই তার সুললিত কন্ঠ নিয়ে। সেহগালের পর নূরজাহানের কণ্ঠই আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষিত করেছে। তার ছিল বিশুদ্ধ স্বরের ঐন্দ্রজালিক কণ্ঠ। মনে হতো সে ইচ্ছা করলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পারতেন। পরবর্তী সময়ে নূরজাহানের সেই কণ্ঠে  তারুণ্যে আবেদন না থাকলেও নূরজাহান ছিলেন ‘নূরজাহান-ই’। যদিও ওই সময়ের কিছু পরে ব্রিটিশ-ভারতের লতা মুঙ্গেশকর তার জাদুকরি কণ্ঠে  বিশ্বকে

মাতিয়ে রেখেছিলেন, তার মানে এই নয় নূরজাহানের ঐশ্বরিক কন্ঠকে ছাপিয়ে। স্বতন্ত্র কণ্ঠে দু’জনেই ভক্তকুলকে মুগ্ধ করেছেন। যেহেতু এই নিবন্ধে নূরজাহান আলোচ্য বিষয়, তাই তাকে ঘিরেই আজকের এই স্মৃতিচারণা আলোকপাত করা হবে।

ভক্তকুলের কাছে নূরজাহানের একটি শব্দ তাকে সীমাহীন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। তাই আমি নিশ্চিত নূরজাহান আর তার গান নিয়ে এমন অনেক গল্প চর্চিত হয়েছে যা পরবর্তীসময়ের নূরজাহানভক্তবৃন্দকে আন্দোলিত করবে। সমসাময়িক এমন অনেক গল্প ছড়িয়ে আছে যা তাকে অন্যগ্রহের বলে মনে হতে পারে। এমন দু’-একটি ঘটনা আজ এই নিবন্ধে উল্লেখ করব।


যখন আমি বোম্বেতে [মুম্বাই] বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে চিত্রনাট্যকার হিসেবে ব্যস্ত সময় পার করছি। তখন একবার আমার স্ত্রী নূরজাহানের প্রসঙ্গটি তোলেন। বলেন, একান্তভাবে নূরজাহান তো আগেও একবার আমাদের বাসায় এসেছেন কিন্তু আমার বন্ধুরা তাকে একবার সরাসরি দেখতে চাইছেন। জবাবে স্ত্রীকে আশস্ত করে জানালাম- তিনি অবশ্যই আবার আসবেন। সেই ভাবনা থেকে নূরজাহানের স্বামী পরিচালক শওকত হোসেন রিজভীকে প্রসঙ্গটি বলতে তিনি জানালেন অবশ্যই যাবে। যাহোক, নূরজাহান আমার বাসায় এলেন। এখানে উল্লেখ করতে দ্বিধা নেই - আমার সময়ে অনেক বিখ্যাত সব অভিনেতা-অভিনেত্রী বা শিল্পীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সখ্য গড়ে উঠলেও নূরজাহানকে ছাপিয়ে কাউকে এত উদার আচরণ আর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হতে দেখিনি। তার হাসি, স্পষ্টবাদিতা, মেজাজ সবই যেন ভিন্ন ছাঁচে গড়া। তার ব্যাপারে যে কখনো আমার প্রশ্নের উদয় হয়নি তাও নয়; যেমন শওকত আর তার দাম্পত্যজীবনকে লৌকিক বলেই মনে হতো। তাছাড়া ঢাকা থেকে আগত এক তরুণী অভিনেত্রীকে চড়ের ঘটনায় বেশ সমালোচিত হন নূরজাহান। শওকতের কথামতো নূরজাহান আমার বাসায় এলেন, উপস্থিত সকলের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। নূরজাহানকে পেয়ে সকলে আমার কথা ভুলেই গেল অগত্যা তাদের রেখে আমি সরে যাওয়ার চেষ্টা করি এ কারণে যেন তারা স্বতর্স্ফূতভাবে ভাব ব্যক্ত করতে পারেন। কিন্তু বাধ সাধলেন আমার স্ত্রী। তিনি নূরজাহানকে একটি গান পরিবেশনের অনুরোধ জানাতে বললেন। অগত্যা কি আর করা আমিও রাখঢাক না রেখে নূরজাহানকে গান গাওয়ার অনুরোধ করলাম। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে গলা ভালো নেই এই অজুহাতে তিনি প্রত্যাখ্যান করলেন। আমি নাছোড়বান্দা এতটুকু বুঝতে পারি নূরজাহানের কন্ঠ সামান্যতেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে তেমন নয়, তাই তাকে বললাম ‘আমি আপনাকে হাজার বার গাইতে শুনেছি, কিন্তু এই মানুষগুলো আপনার কন্ঠ শোনার জন্য মুখিয়ে আছে তাই তাদের এই মুখিয়ে থাকার ব্যাপারটি আপনাকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়া উচিত’। এ কথায় কাজ হলো তিনি বিখ্যাত উর্দু গীতিকবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের ‘আজ কি রাত সাজ-ই দর্দ না ছেড়’ গাইতে শুরু করলেন। সেই কণ্ঠ আজো আমার কানের কাছে গুণগুণিয়ে যায়।

নূরজাহানের অসংখ্য গুণগ্রাহী রয়েছে। আমি অনেক বাবুর্চিকে দেখেছি তাদের রান্নাঘরে নূরজাহানের ছবি টাঙিয়ে রাখতে। খাবার প্রস্তুত করার সময় নূরজাহানের গান উচ্চস্বরে গেয়ে উঠতে। অনেক গৃহপরিচারিকাকে দেখেছি যারা নওমী, নার্গিস কিংবা কামিনি কোশানের নাম জানে না কিন্তু তারা নূরজাহানের প্রেমে বুঁদ। তারা যেখানেই নূরজাহানের ছবি দেখে সেখান থেকে তা কেটে এনে ট্রাঙ্কে সাঁটিয়ে রাখে ; একপলক দেখে চক্ষুস্বাদ মেটায়। একইভাবে নূরজাহানের সমালোচকদের বিরুদ্ধে এই ভক্তকুলের অবস্থান ছিল যুদ্ধাংদেহী!

আমার বাসার পাশেই নূরজাহানের এক অন্ধভক্ত থাকেন। নূরজাহানের নামেই যার দিনের শুরু আর রাতের অন্ধকার নামে। ভক্তটি দেখতেও মাশাল্লাহ চোখ ফেরানো যায় না। তাই মাঝে মাঝে নিজের কাছেই অবাক লাগে নূরজাহানের মাঝে এই সুদর্শন কী এমন পেলেন যে, নূরজাহান বলতেই তিনি অজ্ঞান?

তার কাছে নূরজাহান মানেই সব ছবিতে তাকে থাকতে হবে। নূরজাহান নেই মানে সেগুলো পানসে ছবি। মাকে ওই ভক্ত প্রায়ই বলত, নূরজাহান ছাড়া সে এ-জীবনে আর কাউকে চায় না! তার এমন কথায় ভক্তের দাদা মিয়া জামালউদ্দিন একদিন নূরজাহানের স্বামী শওকতের সঙ্গে দেখা করে বলেন, দেখুন আপনার স্ত্রীর এক পাগল ভক্ত আছেন। আমার ভয় হয় সে যে কোনোদিন নূরজাহানকে নিয়ে না ভেগে যায়! 

তার এমন কথার জবাবে কৌতূহলী শওকত জানতে চাইলেন কে সেই ভক্ত ? 

জবাবে মিয়া সাহেব মুচকি হেসে বলেন -সে আমার নাতি।

শওকত সাহেব : বয়স কত ?

মিয়া সাহেব : মায়ের কোলেই তার সময় কাটে, বয়স চার বছর চলছে।

পরবর্তী সময়ে নূরজাহান এই কাহিনি শুনে হেসে খুন ;  সিদ্ধান্ত নেন এই পাগল ভক্তকে একনজর দেখে আসবেন। ওই ভক্ত দাদার কাছ থেকে সব শুনে অপেক্ষা করত একদিন নূরজাহান তার কাছে আসবে, তাকে বিয়ে করবে। সেই স্বপ্নের গভীরে বিরক্তিহীন রাত কাটতো।

খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, নূরজাহানের এমনই আরেক ভক্তের কথা জেনেছি। এই ভক্ত ছিল রীতিমতো সুদর্শন তরুণ। পেশায় নরসুন্দর। সে অবিরাম নূরজাহানের গান গাইত, ছবির সংলাপ আওড়াত। 

একদিন তার এক বন্ধু তাকে বলল ‘তুমি কি আসলেই নূরজাহানের প্রেমে পড়েছ?

নরসুন্দর : এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ আছে ?

তখন তার আরেক বন্ধু নূরজাহানের প্রতি তার অনুরাগের প্রমাণ চাইল।

নরসুন্দর : নূরজাহানকে ভালোবাসি, এটা বিশ্বাস করাতে কি করতে হবে আমাকে ?

বন্ধু : তোমার কি জানা আছে নূরজাহানের সেই প্রেমিক শাহিন ওয়ালার কথা; যিনি প্রেমের পরীক্ষা দিতে নিজের শরীরের মাংস কেটে কাবাব বানিয়ে নূরজাহানের হাতে দিয়েছিল ? তুমি কি তার মতো কিছু করতে পারো ?

এমন কথা শুনে কোনো উত্তর না দিয়ে নরসুন্দর ধারালো একটা ক্ষুর বন্ধুর হাতে দিয়ে শরীরের যেখান থেকে খুশি মাংস কেটে নিতে বলে। 

বন্ধু সত্যি সত্যি তাই করেছিল। তারপর হাসপাতালে যখন নরসুন্দরের জ্ঞান ফেরে তখন তার কণ্ঠে একটাই শব্দ উচ্চারিত হয় ‘নূরজাহান’। 

অনুবাদ : আহমেদ তেপান্তর