রং খোঁজে স্বপ্নের আঙিনা : আশরাফ হোসেন

12 Jul 2021, 03:37 PM অন্যান্য শেয়ার:
রং খোঁজে স্বপ্নের আঙিনা : আশরাফ হোসেন

পুবাকাশে প্রভাত আলো ছুঁই ছুঁই, আকাশে নানা বর্ণের রং - আর তার ভাব সূর্যকে আলিঙ্গন করার অপেক্ষায় মেঘেদের আঁকুতি আঁধার থেকে বেরিয়ে আসা। আলোর রংগুলো কী উজ্জ্বল হয়ে ফাগুনের মৃদু বাতাসে পুরোনো স্মৃতিকে দুলিয়ে যায় হৃদয়ের আঙিনায়। বিছানা থেকে খড়খড়ি জানালার পাটাতন খুললেই প্রকৃতির এই প্রেম যেন মনকে ব্যাকুল করে তোলে। আকাশে পাখিদের কিচিরমিচির উড়োউড়ি নানা ঢঙে নৃত্যরত অবয়বগুলো সাদা মেঘের স্তূপ হয়ে ওঠে। কখনো তা বালুর পাহাড় কখনো বা মেঘের আত্মীয় হয়ে ভেসে বেড়ায়। সময় যত এগুতে থাকে আলোর রংও ততই স্পষ্ট এবং উজ্জ্বল হয়ে আসে চোখের সীমানায় আবার আলোছায়ায় মিলায়ে যায় কোনো দিগন্তে, পাখিরা তখন হয়ে ওঠে এক বিস্ময়, রং হয় অনুষঙ্গ, গোটা জীবনটা হয়ে ওঠে আনন্দের উৎস। জানা অজানার ঘূর্ণয়মান বিষয় দল বেঁধে উড়ে চলে দিগন্ত থেকে অনন্তে, যেখানে মানুষ ও প্রকৃতি একাকার হয় একটি কেন্দ্রে। ঘুরেঘুরে ফিরে আসে বারবার চিন্তার মণিকোঠায় আবার ফেরার তাগিদ থাকে উৎসমূলে। এই পাখির সঙ্গে যেন মানুষের একটা অন্ত্যমিল পাওয়া যায়। নীল আকাশজুড়ে সাদা বকেরা যখন উড়ে চলে দিগন্তে দূর থেকে তা যেন একঝাঁক মেঘেদের ভেলা মনে হয়। কখনো কখনো তা যেন সীমার মধ্যে অসীম হয়ে মিশে যায়। জানালার পাটাতন বেয়ে রোদ নেমে আসে অন্দরে চায়ের কাপে ঠোঁটের আদর লেগে যায়। কণ্ঠ বেয়ে যকৃত উষ্ণতা পায়। দেহটা যেন সজীব হয়ে ওঠে ঘনঘন ‘রং চায়ে অমৃত আস্বাদন। খড়খড়ির লোহার সিকগুলো বন্দি পাখিদের কথা মনে করিয়ে দেয়। আগের দিনে পায়রা, টিয়া বা তোতা পাখিদের দিয়ে মানুষ খবর আদান-প্রদান করত। পাখিরাই প্রকৃতির ভালো-মন্দ সকল ঘটনার অগ্রিম আভাস পেত আবার সেই পাখিদের দেখেই মানুষেরা উড়তে চাইল পাখা মেলল কিন্তু পাখিরা হিসেব বুঝল না ও রাখলও না। মৌলিক শিল্পীরা পাখির এই কাজটি রপ্ত করে নিল। অর্থের কথা ভাবল না, হিসেবের কথা ভাবল না। সৃষ্টির নেশায় মাতাল হলো স্বপ্ন দেখল স্বপ্ন বুনল স্বপ্ন ছড়ালো। 

শিল্পী স্বপন সরকারও তার স্বপ্ন ছড়াতে শুরু করলেন তাও প্রায় ৩০ বছর হয়ে গেল। বাবা সরকারি চাকরিজীবী মা গৃহিণী ছয় ভাই এক বোনের সংসারে স্বপন পঞ্চম। জীবন যাপন সাধারণ বিলাসিতা নেই বললেই চলে। সদালাপি, দারুণ রসিকও বটে, বিয়ে থা করেননি। সেই অর্থে চিরকুমার বলা যেতে পারে। 

মা ভালো আলপনা করতেন, কুটিরশিল্পের অনেক ধরনের কাজই ওনার রপ্ত ছিল ভালো। সেখান থেকেই সচেতনভাবে জড়িয়ে পড়েন শিল্পের এই কঠিন সাধনায়, বিরানব্বইয়ে গ্রাজুয়েশন করেন। শান্ত স্বভাবের এই মানুষটি ডানপিটে ছিলেন না কখনোই। ফুটবল খেলা ছিল নিত্যসঙ্গী। এছাড়া মাছধরা, পুকুরে স্নান ন করা, বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত আড্ডা মারা এর কমতি ছিল না। সদালাপি ও রসিক হওয়াতে অল্পতেই মানুষকে খুব কাছের করে নিতে পারেন এবং নেনও। তিনি মানুষের উপকার করতে খুবই আগ্রহী, নিজের ক্ষতি করে হলেও যাতে অন্যের উপকার হবে তা করতে তিনি পিছপা হন না। এখানে অনেকটা তার বাবার মতো দানশীল হয়ে উঠেছেন। শিল্পী স্বপন সরকার তার কাজের প্রতি বড্ড বেশি আন্তরিক, একাগ্র ওযত্নশীল। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের মানুষকে নিয়েই তার যত কাজ।

আকার ও আকৃতিতে মানুষের অনস্তিত্বের যে বিন্যাস তার রূপের যে ব্যঞ্জনা তা বিমূর্ত হয়ে ধরা দেয় শিল্পীর দৃষ্টিতে। তিনি অস্তিত্বের সঙ্গে অনস্তিত্বের রূপ খুঁজে বেড়ান আবার অস্তিত্বের মাঝেও তিনি এক অদৃশ্য আবহ খুঁজে পান। 

আমরা যে তানপুরার সুর শুনি, তা একযান্ত্রিক ছোঁয়ায় জেগে ওঠে, আমাদের কানে সুর ভাসে। তানপুরাটা দেখা যায়, তার সুর না যায় দেখা না যায় ছোঁয়া। অথচ অস্তিত্ব বিরাজমান। এমন করেই যে, ওই তানপুরায় সে সুর রয়েছে জড়িয়ে তা তানপুরাটারই প্রাণস্বরূপ যা তার অবয়বে ধরে আছে। 

আকার, আকৃতি আর অন্তর্ভাব এই তিনে মিলেই ফুটে উঠল মাধুরী। স্বপন সরকারের দৃষ্টিতেও এভাবেই মাধুরী দেখা পায় অনস্তিত্ব-তে যখন অস্তিত্বের আভাস দেখে। বাতাস উড়ে গায়ে অনুভূত হয়, তাকে না যায় দেখা না যায় ছোঁয়া। যখন ধুলো উড়িয়ে নিয়ে যায় বাতাস। ধান গাছের আগায় দুলিয়ে দেয় বাতাসের ঢেউ তখন বাতাসের অবয়ব ভেসে যায় চোখের জানালায়, এখানেই আকার ফুটে ওঠে নিরাকারের মধ্য দিয়ে নিত্য নতুন ফর্মে। আর সেখানেই খুঁজে পান প্রাণের গতি। তার কাজে খুঁজে পাই ত্রিমুখী ভাবের গতি। যেখানে কালের বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার কাজে জ্যামিতিক কোনো বিশিষ্ট ত্রিভুজনা আঁকলেও ত্রিমুখী যে ত্রিকাল ছুঁয়ে যায়, গতির মধ্যদিয়ে তা স্পষ্টই প্রতীয়মান বিমূর্তভাবে। ভাবকে সংযোজন করেছেন একটা অভাব বোধ মেনে। এ যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুখের বেদনা। 

যে ফুল ফোটে তার আকৃতি ও আকার আর তার অন্তর্নিহিত ভাব দেখি বুঝি কিন্তু এই দুইয়ে মিলে যে তিনে পরিষ্ফুটিত হয় মাধুরী, তা একমাত্র রূপদক্ষরাই উপলব্দি করতে পারে। বাকিরা সুন্দর বলেই পরিতৃপ্ত। যেকোনো মৌলিক সৃষ্টির বেসিক শুধু একা একটি মানুষের জন্য সবার জন্য নয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছিল আমার গান সবার জন্য নয়। পিকাসো যখন নতুন কাজ করতেন, নতুন সৃষ্টি করতেন সেটা কারো সামনে আঁকতেন না। সেই মুহূর্ত কারো সামনে প্রকাশও করতেন না। গভীর কোনো মৌলিক সৃষ্টি সবার জন্য নয়। মৌলিক সৃষ্টির মুহূর্তটুকুর আবিষ্কারক মূলত শিল্পী। কারণ, আবিষ্কারক তার সত্তাকে বিলীন করে দেয় কর্মে নিজেকে এক সাধনার মধ্য দিয়ে সমর্পিত করেন পরমাত্মার কাছে। তখন শিল্পী নিজের চাওয়াপাওয়াকে নিঃশেষ করে দেয় সৃষ্টির মাঝে। এখানে তিনি প্রেরণা পান। আর প্রেরণা হলো আনন্দ লোকের, অতীন্দ্রিয় লোকের, অবিনশ্বর  এক জগতের। 

যিনি ঐশী প্রেরণায় মৌলিক সৃষ্টির নেশায় উন্মত্ত। তিনি সেই বিরল মুহূর্তের ক্ষণস্থায়ী সত্তা যা অনন্ত লোকের সেই সংজ্ঞাতীত পরম ব্রহ্মের অংশ। আর এই কর্মগুণেই তিনি নিবেদিত কর্মী হিসেবে সমাজে কবি এবং শিল্পী বলে পরিচিতি লাভ করেন। এছাড়া বেশির ভাগ সময় জুড়েই তিনি সাধারণ একজন আবিষ্কারক রং ও শব্দের। প্রেরণা সৃষ্টির কোনো অংশ নয়। এটা বিধাতার অচঞ্চল শাশত রূপের অংশ। এই প্রেরণা কবি বা শিল্পীর অন্তরে মুহূর্তের জন্য আলো জেলে দিয়ে অন্তর্হিত হয়। সেই মুহূর্তেই কবি এবং শিল্পী সে-ই অদ্বৈত সত্তার অংশবিশেষ। কোনো মৌলিক শিল্পীই এর ব্যতিক্রম নন। 

শিল্পী স্বপন একাডেমিক শিল্পচর্চার শেষান্তে একাগ্র মনোযোগী হয়ে ওঠেন তার নিজস্ব শৈলী [Style] তৈরিতে। স্বপন তার স্বপ্নের ক্যানভাসে আঁকতে গিয়ে স্বভাব পরম্পরা স্বকীয়তা হারান না। কারণ, তিনি জানেন স্বভাবজ্ঞান না থাকলে আর্ট দুর্বল এবং কৃত্রিম হয়ে ওঠে। ঐতিহ্যে অধিকার না থাকলে স্থাণু ও কাঁচা বিষয়টি রয়ে যায় আর নিজস্বতা না হলে অন্য সব থাকলেও আর্ট ঠিক প্রাণ পায় না। 

স্বপন সরকার খুব তীক্ষè দৃষ্টিতে দেখেন সমাজ রাষ্ট্রের তথা বিশ্বের  বাস্তবতাকে। এই বাস্তবতাকে তিনি রূপায়ণ করেন তার ক্যানভাসে বিমূর্ত আঙ্গিকে যেখানে একইসঙ্গে উঠে আসে ধর্ম, রাজনীতি সামাজিকতা এবং দৈনন্দিন সাংসারিক বিষয়াদি এবং মানুষ ও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি। শিল্পীর কাছে সবই মূর্ত। কারণ, তিনি দেখে তা নিয়ে ভাবেন, আবার দেখেন। অনুভব করেন, হৃদয়াঙ্গম করেন। উপলব্দির চরম শিখরে নিজেকে উপনীত করেন। নিজস্ব বোধ-কে জাগ্রত করেন পরিবর্তন পরিবর্ধন এবং পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে। 

তিনি মানুষের ছুটে চলা দেখেন জানা অজানা গন্তব্যের পথে। যেখানে অর্থ বৈভব ও খ্যাতির দৌরাত্ম্য। এ ছুটে চলা কোথায়? কে কার আগে যাচ্ছে। প্রতিমুহূর্তে পরিবর্তন হচ্ছে। প্রতিমুহূর্তে বদলাচ্ছে রং! ভেঙে যাচ্ছে জীবন ও জীবনের প্রক্রিয়া। ভাষা সংস্কৃতির পরিবর্তন হওয়াটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু সে পরিবর্তনটা কি শালীন! এতে ভেঙে যাচ্ছে কি মানসিকতা ভেঙে পড়ছে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের মানসিক অবকাঠামো  দ্রুতগামী ট্রেন নিয়ন্ত্রণ হারায়। খুব ধীর বা খুব দ্রুত কোনোটাই পরিমিতির মধ্যে পড়ে না, এ কেবলই পরিমিতিহীন। এখানে শিল্পী স্বপনের পরিমিতিবোধ বড্ড টনটনে। তাই তার গতি স্বপ্নময় ও সুপরিমেয়। বিষয় যেখানে ভাঙনের পথে সময়কে সেখানে ধরেছেন তুলির ডগায় নান্দনিক কৌশলে। পৃথিবীর এ অস্থির সংকটময় সময়কে বেঁধেছেন রঙিন চাদরে, লিভিং অবজেক্টাকে কখনো নন লিভিং, আবার নন লিভিং-কে লিভিংয়ে বদল করেছেন। শিল্পী সবার মতো দৌড়াননি। তিনি নিয়ন্ত্রিত গতিতে হেঁটেছেন। নিজেকে চিনে নিতে তারই পাশে হেঁটেছে তারই ছায়া নিরাকার বস্তু হয়ে। From একটা Essence যার প্রকাশ একটা ইমেজের। যার মিল থাকে না From বারবার আসে যায়। তিনি সেই রূপই আঁকেন। সময়কে গতির সঙ্গে ছেড়ে দেননি, স্পেস দিয়েছেন। সম্পর্ক ও তার সম্বোধনে রেখেছেন আলো-আঁধারির খেলা। তিনি বস্তুর রূপ আঁকেননি, এঁকেছেন ভাবের লীলা, যা অনির্বাচনীয়। তার রং ও রেখা অনুভূতির অনুভবে উৎসারিত। তার ছবিতে রেখা ও রঙের ভাঁজে নিগুঢ় সরলতা এবং একনিষ্ঠ প্রেম উৎভাসিত হয়েছে যা উদ্যাপন করা যায় না বরং প্রাণের অন্দরে নোঙর ফেলে শব্দহীন রঙের ভাঁজে, সময়কে অতিক্রম করে অবনত চিত্তে। 

ছবির কথা

একটি সিঁদুর লাল রং, এই রং ঠিক কতটা অর্থবহ করা যায় কতরূপে রূপায়িত হয় যতটা নেতিবাচক, ততটাই ইতিবাচক হয়ে উঠে শিল্পীর চিন্তায়, যুদ্ধ হতাহত খুন এর মধ্যে লুকিয়ে থাকা লালকে বুনেছেন মায়ের সিঁদুর এঁকে যেখানে আমরা আশ্রয় খুজি, যেখানে আমরা শান্ত হতে পারি। মায়ের মাথার সিঁদুর যেন শান্তির প্রতীক হয়ে আসে আবার এই একই রং মা দুর্গার চলে যাওয়ার বেদনাকে অর্থবহ করে। স্বপনের ‘সেল্টার’ শীর্ষক পেইন্টিং এ লাল রঙের ব্যঞ্জনা দর্শকের কাছে এভাবেই উপস্থাপন করেছেন। 

শিল্পী স্বপন তার কাজে সময়ের সঙ্গে স্পেস তৈরি করেছেন। মানুষ ও তার সম্পর্কের টানাপোড়েনে প্রবাহমান গতির অনুরণন দেখেছেন পাখির উড়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। নীলাকাশে সাদা পায়রা উড়ে গেলে যে কত আভাস রেখে যায় চলে যাওয়া রেখায় এবং অতীতকে বর্তমানে টেনে নানা স্পেস নির্মিতিতে স্বপন অনবদ্যতা প্রকাশ করেছেন। স্বপনের কাছে নীল রং যতটা কাছের ততটাই দূর দেশের, ঘন কুয়াশার নীলের যে ঘোর থাকে সেই একই নীল নদীর বুকে ঢেউ তরঙ্গে আপন হয়ে ধরা দেয়। আর তাই শিল্পী স্বপন স্বপ্নের নানা রঙে নিজেকে নিমগ্ন রাখেন। আর পরিবার প্রতিবেশী সমাজ তথা মানুষের সুখ, দুঃখ আনন্দ বেদনাকে ধারণ করে তার সৃষ্টির সূক্ষ্ম ভাঁজে ভাঁজে  । লেপে যান রং ও রেখার নানা বর্ণ।

শিল্পী স্বপনের ছবি প্রায় সবগুলোই শিরোনামহীন। তিনি নাম দিয়ে দর্শক-কে বেঁধে দিতে চান না। দর্শক-কে দিয়েছেন স্বাধীনতা। 

পাওয়া না পাওয়ার যন্ত্রণা, বেদনা যেন টগবগিয়ে ছড়িয়েছে আগুনের দগ্ধ লাল শিখায়। সামাজিক তীব্র সংকট ও সমাজের মুক্ত চিন্তার বহিঃপ্রকাশ না থাকায় একজন শিল্পীর শিল্পী হয়ে ওঠা এ-সমাজে ভীষণ দুরূহ বিষয় তা স্পষ্ট প্রতীয়মান। তার এ ক্যানভাসে লালের আবরণ ভেদ করে মিডেলটার্ম কম্পোজিশনে দিগন্তে এঁকেছেন এই সামাজিক প্রেক্ষাপটের যন্ত্রণা। শিল্পী স্বপন সরকারের এই বিমূর্ত চিত্রকলায় মানুষের কাক্সিক্ষত সত্যবস্তুর দ্বৈত টানাপোড়েন যে কতটা তীব্র হতে পারে তা তার ছবির রং ও রেখায় সাবলীল ভাষা বোদ্ধা দর্শকদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। 

তার আরেকটি ছবি যেন মনের আয়না। যেখানে পাখির অবয়বের সঙ্গে মিশে আছে মানুষের মুখ। নীল এবং কালো রঙের আচ্ছাদনে একক ছায়ার সন্নিবেশ ঘটেছে যাতে নিজের ছায়ারই এক প্রতিবিম্ব। যদিও ছবির মধ্যে চাঁদ ও পাখির মিলন বিহার চলেছে আধো ছায়ায় ভর করে। কিন্তু রূপক অর্থে ডায়গোনালি মানুষের মুখের অবয়ব বুঝিয়ে দেয় তার নিজের মনের আয়নার কথা। যেখানে শতরূপে রূপায়িত হয় মানুষ। 

প্রতিজন মানুষ ছুটে চলে তার গন্তব্যে। এমনই শত শত ছুটে চলাকে রং ও রেখায় একটি বিন্দুতে ধরেছেন স্বপন। তার কাছে এই বিন্দুটি হচ্ছে মানুষের জীবন যাপনের একটি লক্ষ্য মাত্র। বিশ্বজগতের এই বৃহৎ বৃত্তকে এক এক জনের জন্য এক একটি বিন্দু। ধীরে ধীরে মানুষ অর্জন করে শিক্ষা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা। তারই আলোকে শিল্পী স্বপনের এ রকম বহু ছবি রয়েছে যা মানুষের জীবন ধারণের সময়ে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম চিন্তাকে কেন্দ্র করে বৃহৎ কিছুর স্বপ্ন দেখায়। আর তাই শিল্পী মানুষকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে তার আপন ক্যানভাসে রং ও বর্ণের পিপাসায়। 

এখানেই চিত্রকর একা একেবারেই একা হয়ে যান, সব কিছু থেকেও যেন এক বিরাট শূন্যতা ভর করে। নিরাকার হাওয়ায় আকার খুঁজে নেন ধানের ক্ষেতে, বাতাসের ঢেউয়ে আর নদীতরঙ্গে। এভাবেই দিনের পর দিন নৌকায় পাল তুলে কখনো বা পাল লাগিয়ে বেয়ে যান নদীর বুকে অজানার পথে। স্রোত কখনো পক্ষে কখনো বিপক্ষে তবু রঙে ভিজিয়ে রাখেন নিজের বানানো ব্রাশ আর বিমূর্ত ক্যানভাস। শিল্পী স্বপনের ছবি একাই ঘুরে বেড়ায় দেশ-বিদেশের প্রদর্শনী কক্ষে। সব সময তিনি যান না। ছবির এই একা বেড়ানো শিল্পীর যেন বেদনার সুখ হয়ে ওঠে। স্বপন বেয়ে চলে গন্তব্যহীন কোনো এক পথে। যেখানে অনেক শিল্পীরাই হেঁটেছেন, তেমন পথে। আমরা শিল্পী ‘স্বপন সরকারের’ সাফল্য কামনা করছি। 

লেখক : ভাস্কর্য ও চিত্রশিল্পী