পলিসিস্টিক ওভারি বা পিসিওডি প্রতিরোধ করবেন যেভাবে : চাই ভেতর থেকে সুস্থতা -ডা. মুসাররাত সুলতানা [সুম

10 Jun 2021, 02:24 PM স্বাস্থ্যভুবন শেয়ার:
পলিসিস্টিক ওভারি বা পিসিওডি প্রতিরোধ করবেন যেভাবে : চাই ভেতর থেকে সুস্থতা -ডা. মুসাররাত সুলতানা [সুম

আধুুনিকতার ছোঁয়ায় বিশ্ব যত উন্নত হচ্ছে, ততই যেন বেড়ে যাচ্ছে রোগব্যাধি। দূষিত পরিবেশ, বিশ্বায়নের যুগে কর্মব্যস্ততা আর আধুনিক ও যন্ত্রনির্ভর জীবনযাপনের হাত ধরে বিশেষ করে নানা রোগ দেখা দিচ্ছে মেয়েদের শরীরে। এমন অনিয়ন্ত্রিত জীবনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে খাওয়াদাওয়ার অনিয়ম। এসবের যোগফলে ডিম্বাশয়ে দেখা দিচ্ছে একাধিক সিস্ট। চিকিৎসার পরিভাষায় এর নাম ‘পলিসিস্টিক ওভারি’ বা ‘পিসিওডি’।


পলিসিস্টিক ওভারিয়ান

‘পলি’ কথার অর্থ ‘বেশি’। চিকিৎসকরা বলছেন, ৬ মিলিলিটার পর্যন্ত ওজন হতে পারে এই সিস্টগুলোর। প্রতি ডিম্বাশয়ে ১২-১৫টা সিস্ট আকছারই দেখা দেয়। ভারি শরীর যেমন এই রোগ ডেকে আনে, তেমনই ডায়াবেটিক হলে ও খুব বেশি পরিমাণে বাইরের খাবার খেলে এর আশঙ্কা বেড়ে যায় আরো কয়েক গুণ। কিন্তু এই পিসিওডি নিয়ে বাংলাদেশের নারীরা যথেষ্ট সচেতন নন।

চিকিৎসকদের মতে, এই রোগ যত না শারীরিক কারণে হয়, তার চেয়েও বেশি হয় অসচেতনতা থেকে। আজকাল কর্মব্যস্ত যুগের দোহাই দিয়ে মেয়েরা নিজস্ব খাওয়া-দাওয়া ও ওজন কমানোর দিকটা ভেবেও দেখেন না। জিমে গেলে বা শরীরকে টোনড রাখলেই কেবল হবে না, চাই ভেতর থেকে সুস্থতা। গর্ভধারণের সময় আজকাল বেশিরভাগ মেয়েকেই এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তবে ছোটো আকারের সিস্ট অতটা ক্ষতিকর নয়। কিন্তু গর্ভাবস্থায়ও সিস্ট বাড়তে থাকে। তাই সিস্টের লক্ষণ দেখা দিলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।


এই সিস্ট কী ক্ষতি করে

ছোটো ছোটো টিউমারের আকারে দেখতে এই সিস্টগুলো তরল বা অর্ধতরল উপাদান দিয়ে তৈরি। চিকিৎসকের মতে, দুটি ঋতুচক্রের মাঝে একটি ডিম্বাণু এসে হাজির হয় জরায়ুতে। কিন্তু ডিম্বাশয়ে সিস্ট থাকলে ডিম্বাণু সম্পূর্ণ হতে পারে না ও ডিম্বাশয় ছাড়িয়ে জরায়ুর দিকে এগোতেও পারে না। এদিকে শুক্রাণু নিষিক্ত হওয়ার জন্য এসে পড়লেও তার উপযুক্ত ডিম্বাণুকে সিস্টের ভিড়ে খুঁজেই পায় না। ফলে একটা সময়ের পর বিনষ্ট হয়ে যায়।

এই রোগে সাধারণত স্বাভাবিক সময়ে অভ্যন্তরীণ কোনো ব্যথা হয় না বা বাহ্যিক কোনো চিহ্ন থাকে না বলে অনেকেই এই রোগ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামান না। তবে পিরিয়ডের সময় ব্যথা বা স্তনে ব্যথা হওয়ার অন্যতম একটি কারণ পলিসিস্টিক ওভারি। সিস্টের আকার বড়ো হলেও নানা সমস্যা হয়। তখন চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে ওষুধ খাওয়াও জরুরি। এই অসুখের বাড়াবাড়িতেই অনেক সময় কোমরে টানা ব্যথা, অনিয়মিত ঋতুচক্র এবং নিয়মিত সেক্সের সময় ব্যথাও হতে পারে।


এই সিস্ট কেন হয়

১. অনিয়মিত ও তেল-মশলাদার বাইরের খাবার বেশি মাত্রায় খাওয়া এই অসুখের অন্যতম কারণ 

২. ওজন নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারা ও সে বিষয়ে উদাসীনতাও এই অসুখ ডেকে আনে

৩. এন্ড্রোমেট্রিওসিস, গর্ভধারণের সময় নানা হরমোনজনিত সমস্যা, হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হওয়া থেকেও এই অসুখ দানা বাঁধে

৪. মূত্রনালির সংক্রমণ থেকেও ওভারিতে সিস্ট হতে পারে


কোন বয়সে সিস্ট বেশি বিপজ্জনক

সদ্য পিরিয়ড শুরুর পর মেয়েদের মধ্যে এই সমস্যা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে ভারি চেহারার মেয়েরাই বেশি আক্রান্ত হয়। এরপর ২০-৩০ বছরের সময়, অর্থাৎ যাদের বিয়ের পর থেকেই সন্তান ধারণের সমস্যা ও অনিয়মিত পিরিয়ড অথবা পিরিয়ডের সময় নানা জটিলতা লক্ষ্য করা গেলে এই অসুখে আক্রান্ত কি না তা নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা হয়। তবে সবসময় যে পিরিয়ড অনিয়মিত হবে বা ব্যথা থাকবেই এমন কোনো কথা নেই। এছাড়া ৩৫-৪০ বছরের মধ্যে ওজন বেশি, খাওয়াদাওয়ায় অনিয়ন্ত্রণ এই অসুখ ডেকে আনে। জীবনযাত্রা পরিবর্তন ও খাওয়াদাওয়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এই রোগের প্রাদুর্ভাব অনেকটা কমানো যায়।

চিকিৎসা

রোগ ও রোগীর ধরন বুঝে চিকিৎসা শুরু করা হয়। সব সময় ওষুধ লাগে এমনটা নয়। বরং প্রাথমিক অবস্থায় ওজন কমিয়ে ও বাইরের খাওয়াদাওয়া বন্ধ করলেই অনেক সময় সমস্যা নির্মূল হয়। তবে এই রোগের চিকিৎসায় প্রথম থেকেই মেয়েদের গর্ভধারণে যাতে সমস্যা না হয়, সে দিকটা নজরে রেখেই চিকিৎসা করা উচিত। ওষুধের প্রয়োজন পড়লে বুনিয়াদি স্তরে ক্লিটোরাল এনলার্জমেন্ট রোধ করাটাই চিকিৎসকদের কাজ। এছাড়া এন্ড্রোজেনিক ওভার অ্যাকটিভিটি টেস্ট, হরমোনাল চিকিৎসা, লিপিড প্রোফাইলের স্তর সব কিছু দেখেশুনে চিকিৎসা শুরু করেন চিকিৎসকেরা।

একটা বয়সের পর ওষুধে না কমতে চাইলে এন্ড্রোমেট্রিয়াল বায়োপসি করা প্রয়োজন হতে পারে। জীবনযাত্রা পরিবর্তন ও খাওয়াদাওয়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এই রোগের প্রাদুর্ভাব অনেকটা কমানো যায়। নিয়মিত আধা ঘণ্টা হাঁটাহাঁটি, শরীরচর্চা করলে প্রাথমিকভাবে এই রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। নিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রার পাশাপাশি ওষুধ নিয়মিত খেলে ভয় থাকে না। তারপরেও যদি সমস্যার সমাধান না হয় তবে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকেরা। 

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রেডিওথেরাপি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল