যোহান সেবাস্তিয়ান বাখ : কাজী দিশু

06 May 2021, 09:06 PM সাহিত্যভুবন শেয়ার:
যোহান সেবাস্তিয়ান বাখ : কাজী দিশু

১৭৬০ সালের জার্মানির লিপ্জিগ শহর। সবার অলক্ষ্যে ফুটপাতের এক বিখারিনি মারা যাচ্ছেন। ভিখারিনির মৃত্যু তেমন নতুন কিছু নয়। তাই কারোই দরকার নেই সেদিকে মনোযোগ দেওয়ার। তবু সেখানে উপস্থিত রয়েছেন দুয়েকজন। তাদের মধ্যে একজন একসময়ে এ ভিখারিনীর পারিবারিক বন্ধু ছিলেন। পেশায় মাংস বিক্রেতা। এই ভিখারিনি ওর মাংসের দোকানের ফুটপাতেই বাস করেছেন গত দশ বছর। এ বন্ধুটির দাক্ষিণ্যেই ফুটপাতে আশ্রয়  পেয়েছিলেন ভিখারিনিটি... তার নাম অ্যানা ম্যাগডালানা বাখ। যোহান সেবাস্তিয়ান বাখ-এর দ্বিতীয় স্ত্রী, তার প্রিয়তমা অ্যানা।

১৭৫০ সালের পরের বছরের ঘটনা আরো করুণ-মর্মান্তিক। বাখ ছিলেন লিপজিগের টমাস চার্চের সংলগ্ন সেন্ট টমাস স্কুলের কয়ার মাস্টার। দীর্ঘকাল সারাদিন পরিশ্রমের পর মোমবাতি জ্বালিয়ে রাতের বেলায় গান স্বরলিপি রচনা করার অভ্যাসের ফলে একটা সময়ে তার চোখের অসুখ হয়েছিল। ডাক্তারদের নিদান ছিলন অস্ত্রোপচার করতে হবে চোখে। ১৭৪৮ সাল, শীতকাল। চোখের অসুখ হওয়ার পরে লিপ্জিগ শহরের অখ্যাত এই কয়ার মাস্টারটিকে খুবই সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। একজন কয়ার মাস্টারের অর্গান বাজানোতে অধিকার নেই। দিনের বেলায় তাই সে সুযোগ নেই। আবার রাতের বেলাতে অর্গান বাজালে অনেকেরই ঘুমের অসুবিধা হয়। অথচ বাখ-এর কাছে সুরই ছিল একমাত্র জীবনীশক্তি। ফলে অকল্পনীয় মানসিক কষ্টে তার দিন যাপন করতে হচ্ছিল। তখন তার বয়স ৬৫। প্রথম স্ত্রী নেই। দ্বিতীয় স্ত্রী অ্যানাই শুধু সর্বক্ষণের সঙ্গিনী। অথচ তার সন্তান সন্ততির সংখ্যা কুড়ি। অবশ্য তাদের মধ্যে দশজন আগেই মারা গেছে। তবু বেঁচে আছে বাকি দশজন এবং তাদের প্রত্যেকে না হলেও কেউ কেউ তো খুবই প্রতিষ্ঠিত। এরকম এক মানসিক এবং শারীরিক যন্ত্রণার মধ্যে বাম চোখে অস্ত্রোপচার করতে রাজি হতে বাধ্য হলেন তিনি। 

অস্ত্রোপচারের দিন ঠিক হলো। আগের দিন রাতে বাখ ভয়ঙ্করভাবে কাকুতি মিনতি করতে লাগলেন যে তাকে একটু অর্গান বাজাতে দেওয়া হোক। বাখ-কে নিয়ে ইতোমধ্যেই চার্চের মধ্যে বেশ অশান্তি হচ্ছিল। কাজ থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন, অথচ অন্য কোথাও যাওয়ার সংস্থান নেই। অগত্যা চার্চের দয়ায় থাকার জায়গাটুকু অন্তত রয়েছে। ফলে চার্চের আশ্রয়ে থাকার জন্যই খুবই সাবধানে সবার মন জুগিয়েই থাকতে হচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে রাতে অর্গান বাজিয়ে অন্যদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালে যে বাসস্থানটুকু আছে তাও হয়ত খোয়াতে হবে। বাখের কাকুতি মিনতিতে তাই অ্যানা খুবই দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলেন। তাছাড়া পরের দিনই অপারেশন। কে জানে অপারেশনের পর আবার কোনো নতুন বিপত্তির উদ্ভব হয়। হয়ত ক্ষতি হতে পারে। ডাক্তাররা সেরকমই ভয় দেখিয়ে গেছে। অনেক ভেবে চিন্তে অ্যানা শেষমেষ মনস্থির করে ফেললেন। না, তার স্বামী জীবনের শেষবেলায় কেবল শুধু একটু অর্গান বাজাতে চেয়েছেন মাত্র, আর কিছু নয়। সে ব্যবস্থা তাকে করতে হবে। 

গভীর রাতে অ্যানা ধীরে ধীরে বাখকে নিয়ে এলেন চার্চের বড় হল ঘরে। বিশাল অর্গান সামনে। শিশুর মতো বাখ অর্গানটি জড়িয়ে ধরলেন। চোখ ফেটে পানি গড়িয়ে পড়ল। তারপর তিনি বাজাতে লাগলেন। অল্প সময়, খুব অল্প সময় মাত্র। তারপর বাজনা শেষ করে, অ্যানাকে বললেন, ‘ঠিক আছে অ্যানা এবার আমি প্রস্তুত।’

পরের দিন চোখের অপারেশন হলো। কিন্তু অস্ত্রোপচারের পরে বাখের সারা শরীর অসাড় হয়ে গেল। অর্থাৎ তিনি পক্ষাঘাত রোগের শিকার হলেন। দু’বছর অসহ্য শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করে অবশেষে বাখ মারা গেলেন ২৮ জুলাই ১৭৫০ সালে। অ্যানার মৃত্যু হয় তারও দশ বছর পরে ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৭৬০ সালে।

সেবাস্তিয়ান বাখ মারা যাওয়ার পর অ্যানাকে চার্চের ঘর ছেড়ে দিতে হয়েছিল। যা কিছু জিনিসপত্র রইল সব বিক্রি করে দিলেন অ্যানা। শুধু বাখের অসংখ্য রচনার পাণ্ডুলিপির স্তূপ তিনি প্রাণে ধরে ফেলে দিতে পারেননি। চেনা-অচেনা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, ছেলেমেয়ে সকলের দরজায় দরজায় তিনি ধন্না দিলেন, নিজের আশ্রয়ের জন্য নয়, শুধু বাখের পাণ্ডুলিপিগুলো যত্ন রাখার জন্য। কিন্তু কেউই শেষ পর্যন্ত সেগুলো রাখতে রাজি হলো না। এতদিনে অ্যানার শেষ বাসস্থানটুকুও চলে গেছে। এখন তিনি ফুটপাথের বাসিন্দা। সে সময়ে লিপ্জিগের এ মাংসেকর দোকানদারটি, যে বাখকে একসময় চিনত গান ভালোবাসতো একটু আধটু, সে দয়াপরায়ণ হয়ে অ্যানার এই পাণ্ডুলিপি স্তূপ নিজের সেলারে রেখে দিতে সম্মত হলো। সেই মাংস ব্যবসায়ীর অনুগ্রহে, তারই দোকানের পাশের ফুটপাতে অ্যানার কেটে যায় আরো দশ বছর। মাংস ব্যবসায়ী তাকে যথাসম্ভব খাবার-দাবার দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে। অবশেষে একদিন অ্যানা ম্যাগডালানা বাখ-এর মৃত্যু হয়, ফেব্রুয়ারি ২৭, সাল ১৭৬০। অ্যানার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাখ-এর যাবতীয় সংগীত রচনার ওপরও যবনিকাপাত ঘটলো। একশ’ বছর পর, এরই মধ্যে লিপিজিগের সেই মহান মাংস বিক্রেতা মার্টিন কোয়েলার মারা গেছেন। 

লিপ্জিগের জিওয়ান্ডহাউস অর্কেস্ট্রার কনডাকট্যর ফেলিক্স মেলডেলেসনের খুব একটা আগ্রহ ছিল না লিপজিগ শহরের প্রতি। তার ইচ্ছে ছিল স্বপ্নের শহর বার্লিনের অর্কেস্ট্রাতে কাজ করা। কিন্তু স্যাক্সানির রাজা স্বয়ং তার নাম প্রস্তাব করে পাঠিয়েছেন। যত্ন করে ডেকেছে লিপ্জিগের অর্কেস্ট্রা বোর্ড অব ট্রাস্টি। নিয়োগপত্র পেয়ে ফেলিক্স খুব একটা খুশি হননি। কোথায় বার্লিন আর কোথায় লিপজিগ। কিন্তু তার বউ সিসেল শুনেই কেন যেন মন্ত্রব্য করেছিল, ‘হয়ত ঈশ্বরের ইচ্ছা এটাই ফেলিক্স লিপজিগেই যাক।’ অগত্যা ফেলিক্স কিছুদিন লিপ্জিগে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। একটা সময় সিসেলের কাছে স্বীকার করেন, তার নিজেরও মনে হয়েছিল যে ঈশ্বরই হয়ত তাকে জোর করে লিপ্জিগের দিকে ডেকে নিচ্ছেন।

এবং তার প্রমাণিত হলো। সেদিন ফেলিক্স দম্পতি একসঙ্গে বাড়িতে ফিরছিল, ধূসর সন্ধ্যা নেমে আসছে। ফেলিক্স ক্লান্ত বোধ করছিল। কিন্তু সিসেলের মাংসের দোকানটা ঘুরে যাওয়া দরকার। কয়েক মিনিটের ব্যাপার তাই ফেলিক্স আপত্তি করলো না। মাংসের দোকানে তখন ভিড়। কোয়েলারের মাংস লিপ্জিগে খুবই বিখ্যাত। মুহূর্তের মধ্যে নিঃশব্দে মাংস কাটা হচ্ছে। কাগজ জড়িয়ে খরিদ্দারকে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একটু আগে বুঝি মাংস মোড়ানোর কাগজ ফুরিয়ে গেছে। মার্টিন কোয়েলারের পুত্রবধূ ছুটে গেছে বাড়ির ভেতরের সেলারে রাখা কাগজের স্তূপ থেকে কিছু কাগজ নিয়ে আসতে, সিসেল দোকান ঘুরে ঘুরে সাংস পছন্দ করছে, আর ফেলিক্স অলসমনে লক্ষ্য করছিল মার্টিন-এর বউয়ের কাজ-কারবার। হঠাৎ যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো ফেলিক্স মেনডেলেসন। সারা শরীর বেয়ে ঘাম ঝরতে লাগলো, ওর সমস্ত রোমকূপে অভূতপূর্ণ শিহরণ চোখ দু’টি বিস্ফারিত।  বিস্মিত দৃষ্টিতে ফেলিক্সের নজরে পড়ল, মার্টিন কোয়েলারের পুত্র বউয়ের নিয়ে আসা নতুন কাগজের পাঁচাটার ওপর। হলদে হয়ে যাওয়া কাগজের পাঁজাটার একদম ওপরের পাতাটায় লেখা রয়েছে : ‘দ্য প্যাশন অব আওয়ার লর্ড, অ্যাকোর্ডিং টু সেন্ট ম্যাথু বাই যোহান সিবাস্তিয়ান বাখ।’ সময়টা হলো খ্রিষ্টাব্দ ১৮৬০। 

যোহান সেবাস্তিয়ান বাখ জন্মেছিলেন জার্মানির স্যাক্সনির অঞ্চলের আইসনাখে ১৬৮৫ সালের ২১ মার্চ। যোহান অ্যাবোনিয়াস বাখ আর এলিজাবেথ ল্যামারহার্টের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান তিনি। পিতা ছিলেন আইসনাখের টাউন কনসার্টের যন্ত্রবাদক। বাখের বয়স যখন দশ, তখনই মায়ের মৃত্যু হয়, অল্প কিছুদিনের মধ্যে বাবাও মারা যান। সংসারের সব দায়িত্ব পড়ল বড়ভাই যোহান ক্রিস্টোফারের উপর।

প্রথম জীবনে সংগীতের তালিম তিনি পেয়েছিলেন যোহন পাসবেলের কাছে। বাখের কণ্ঠস্বর ছিল চমৎকার- সুরেলা। মধুর কণ্ঠস্বরের কারণেই মাত্র পনেরো বছর বয়সে তিনি একটা চাকরি পেয়ে যান। চাকরিটা নিতে তিনি বাধ্য হন সাংসারিক কারণে। তবে তার সংগীত রচনার শুরু সেই পনেরো বছর বয়স থেকেই।

বাইশ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করলেন, ১৭০৭ সালে। কনে পারিবারিক আত্মীয়া মেরিয়া বারবারা। দীর্ঘ তের বছর স্থায়ী হয়েছিল এই বিয়ে। ১৭২০ সালে মেরিয়া বারবারা হঠাৎই মারা যান। বড় অসহায় হয়ে পড়েন বাখ। তখন তার বয়স পঁয়ত্রিশ। শোকে তাপে, সংগীত রচনার সৃষ্টি যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে পড়লেন। মেরিয়া মারা যান ১৭২০ সালের ৭ জুলাই। বছর খানেক পেরোতে না পেরোতে দ্বিতীয়বার বিয়ে না করে থাকতে পারলেন না ; বাখ বিয়ে করলেন অ্যানা ম্যাগডেলেনাকে। সেটা সাল ১৭২১।

ইতোমধ্যে বহুবার কর্মক্ষেত্র বদল করতে হয়েছিল বাখ নানা শহরে চাকরি করার পর অবশেষে ১৭২৩ সালে লিপ্জিগে আসেন। আর সেখানেই থেকে যান সাতাশ বছর। আমৃত্যু।

সিবাস্তিয়ান এমন একটা সময়ে জন্মেছিলেন যখন সংগীতকে সমাজে তেমন সম্মানজনক পেশা হিসেবে কেউই ভাবতে পারতেন না। তার ফলে একদিকে মানুষ পরিচয়ে এবং নিজের সম্মান আর অর্থ উপার্জনের জন্য তাকে রুখে দাঁড়াতে হতো, তেমনি আবার সংগীতের মর্যাদা রক্ষার জন্যও তাকে লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছিল। চাকরি জীবনে এই দুটি দিক একালেও বজায় রাখা নিদারুণ কষ্টসাধ্য সে বিষয়ে কারো মনে কোনোরকম সন্দেহের অবকাশ নেই। 

জার্মানির অনেক শহরেই চাকরি করেছেন তিনি, কোথাও তাকে নিয়ে অসুবিধায় পড়তে হয়নি কর্তৃপক্ষকে। কাজের ব্যাপারে চিরকালই বাখ ছিলেন অত্যন্ত কর্তব্যনিষ্ঠ এবং বিনয়ী। আত্মসচেতন ছিলেন অবশ্যই স্পর্শকাতরও কম নন। কিন্তু বৃহত্তর আদর্শ, মহত্ত¡র সৃষ্টিশীল রচনার প্রতি একান্ত আনুগত্য, কূপমড‚কতার বেড়াজাল থেকে মুক্ত করেছিল তাকে। সংগীতশিল্পী হিসেবে তার যে অবিসংবাদী স্থান, উপযুক্ত সবরকম গুণের কোনোটারই কম ছিল না বাখের রচনায় সৃজনে। হয়তো তার থেকে বেশি কিছুটা ছিল। সেটা রোমান্টিসিজম। কিংবা দুর্দান্ত প্যাশন। প্রজ্ঞার বিনয় আর জ্ঞানের অনুসন্ধান ছিল তার সহজাত। কিন্তু শত বৈরীতার মধ্যে, শত কষ্টের মধ্যেও আপোস করেছেন কদাচিৎ। আপনভোলা এই সাত্তি¡ক শিল্পী পাগলের মতো সংগীত রচনা করেছেন সুদীর্ঘ পঞ্চশ বছর- অক্লান্তভাবে। কিন্তু তা নিয়ে প্রচার করার মতো মানসিকতা তার একেবারেই ছিল না। জীবনের সায়াহ্নে অন্ধত্ব ছিল তার অভিশাপ। চার্চ কর্তৃপক্ষ প্রথমেই তার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল তার সংগীত। অর্গান বাজানো বাখের জন্যে নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। তার কাছে জীবনের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ছিল অর্গান। অথচ অর্গান থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল।

একথা অবশ্য মানতে হবে : বাখ যখন বেঁচে ছিলেন তখন তিনি অর্থ বা ক্ষমতায় আসীন না হলেও তাকে অশ্রদ্ধা করার সাহস শুধু অসামাজিক বা সমাজবিরোধী কিংবা শিল্পরস বিরোধী যারা তাদেরই ছিল। অন্য কারো নয়। তবে এক্ষেত্রে একজন প্রতিভাবান ধ্রুপদী শিল্পীকে রক্ষা করবার যে গুরু দায়িত্ব সমাজের থাকে ; সমাজ সেই দায়িত্ব কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল। বাখের মৃত্যুর পর তার স্ত্রীকে ফুটপাতে আশ্রয় নিতে হয়। মাংস বিক্রেতা মাটিন কোয়েলার ছাড়া বাখের সমস্ত জীবনের অমানুষিক পরিশ্রমের ফসল, রচিত সংগীতের পাণ্ডুলিপি একজনও নিজের কাছে রেখে নিতেও রাজি হয়নি। 

তিনশো বছর পরে ভূগোল এবং ইতিহাস আর দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে সারা পৃথিবী জুড়ে বাখ যেভাবে গৃহীত হয়েছে, সমাদৃত হয়েছে, তার হাজার ভাগের এক অংশও তিনি তার জীবদ্দশায় পাননি। বর্তমানে তাকে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগীতশিল্পীর মর্যাদা দিতে দ্বিধা করবেন এমন মানুষ পৃথিবীতে খুব কমই আছে।

এক গতানুগতিক সংগীতের পরিবেশে বাখ জন্মেছিলেন। সংগীতের ইতিহাস বাখের আগে ছিল এক একঘেয়ে ঐতিহ্য। সেবাস্তিয়ান বাখ, সম্মক বিবেচনায়, অক্লান্ত পরিশ্রম এবং মৌলিক চেতনা-প্রতিভার সাহায্যে স্থিতাবস্থায় বিপ্লব এনেছিলেন, ভেঙে দিয়েছিলেন নিয়মের নিগূঢ়। পাশ্চাত্য সংগীতে গতি এসেছিল তার পরই। ‘প্রিন্সিপাল স্বহন্সি’ আর ফর্ম-এর প্রাচীন ঐতিহ্যের এক অপূর্ব সমন্বয় সাধনের কৃতিত্ব তিনি ছিলেন অসাধারণ। সেই যে তিনশো বছর আগে তিনি পরীক্ষা নিরীক্ষার উত্তরের জানালা খুলে দিলেন, সে পর্ব অনুসৃত হচ্ছে অদ্যাবধি। নতুন ভাবনা চিন্তাও মিশে যাচ্ছে সেখানে প্রত্যেকদিন। 

গান ভালোবাসে এমন পরিবারেই জন্মেছিলেন বাখ। ১৭৩৫ সালে বাখ তার পরিবারের ইতিহাস সংগ্রহ করে একটা খসড়া তৈরি করেছিলেন, নাম দিয়েছিলেন ‘অরিজিন অফ দ্য মিউজিকাল ফ্যামিলি।’ তবে তার পূর্বপুরুষেরা সংগীতের জগতে খ্যাতিমান হলেও সংগীত রচনার বগতে পা বাড়াননি কখনো। সেবাস্তিয়ান বাখই প্রথম যিনি সংগীত রচনা করতে অগ্রসর হন। বাখের সন্তানেরা  উইলহেলস ক্রেডিম্যান, কার্ট  ফিলিপ ইম্যান্নায়ন বা যোহন ক্রিস্টিয়ান সংগীতজ্ঞ হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন তেমনই তার পূর্বপুরুষদের যোহান ক্রিস্টোফার, যোহান মাইকেল এবং যোহান লাউইসও খ্যাতি কম পাননি। বাখের সন্তানদের মধ্যে যোহান ক্রিস্টিয়ানকে তো ইংল্যান্ডের বাখ বলে অভিহিত করা হতো।

যে আকস্মিক ও দৈব ঘটনার মধ্যে বাখ রচিত সংগীতের শেষ খণ্ডটি [প্যাশন] লিপ জিগের অখ্যাত এক মাংস বিক্রেতার চিলেকোঠা থেকে উদ্ধার করেছিলেন ফেলিক্স মেলডেলেসন তার রূপায়ণের গল্পটিও চমকপ্রদ। মৃত্যুশয্যায় ফেলিক্স বলেছিলেন, ‘যদি আমার গানের শেষ রেশটুকুও কালের গতিতে মুছেও যায়, ভবিষ্যতের মানব সভ্যতাকে আমাকে মনে রাখতে হবে। তার কারণ আমি জেকব লাডউইড ফেলিক্স মেলডেলেসন একজন ইহুদি- আমি খ্রিষ্টানদের তাদের সবচাইতে সার্থক সংগীত উপহার দিতে সমর্থ  হয়েছিলাম।’

ফেলিক্স মেলডেলেসনের একনিষ্ঠতা তুলনাহীন। সংগীতের প্রতি বাখের জন্যে তার অনুরাগ কিংবদন্তিতুল্য।  ফেলিক্স তার জীবনে বাখের ‘প্যাশন’ সংগীত রূপান্তরিত করতে যে সংগ্রাম, কৃচ্ছ্র সাধনা ও ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন তা ভাবতেও বিস্মিত হতে হয়। সে গান গাওয়ার ব্যবস্থা করার বিরুদ্ধে বাধা এসেছিল সমাজের সর্বস্তর থেকে। মূলত ইহুদিদের দিক থেকেই বেশি। মজার কথা হলো সে গান প্রথম অনুষ্ঠিত হয়েছিল সংগীতবিশারদ, সংগীতশিল্পীদের নিয়ে নয়, করতে হয়েছিল চারশোজন অখ্যাত চাষী অনুচরদের নিয়ে। এমন কি সে কাজ করতে বাধা এসেছিল প্রচুর। কিন্তু বাখের ‘প্যাশন’ ঠেকানো যাইনি। তারপর সেই গান যেই শুনেছে- পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তের যে কোনো মানুষ সে মুগ্ধ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বারবার শুনতে চেয়েছে সেই গান। এখন আর সিবাস্তিয়ান বাখকে ভালো লাগা মন্দ লাগার প্রশ্ন পৃথিবীতে নেই। বাখ এখন একটি অভিজ্ঞতা একটা অবসেশন, যে একবার শুনেছে তার আর পরিত্রাণ নেই তার সুরের মুগ্ধ মূর্চনায় হারিয়ে যাওয়া ছাড়া। 

বাখ মারা গেলেন। সংগ্রামের একটা অধ্যায় সম্পূর্ণ হলো। মৃত্যুর সময় তার শেষ কথা ছিল : ‘হে ঈশ্বর, তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক।’ সেন্ট জন কবরখানায় তাকে সমাহিত করা হয়েছিল। কয়েক বছর পর একটা নতুন রাস্তা তৈরি করার প্রয়োজনে সেই গোরস্থান ভেঙে ফেলা হয়। সে ডামাডোলে বাখ-এর সমাধিটিও সরানো হয়। আর সিবাস্তিয়ান বাখ হারিয়ে গেলেন চিরতরে, তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। মানুষের দৃষ্টি থেকে দূরে থাকলেও মানুষ তাকে ভোলেনি, এখনো এবং আগামীতেও তার সৃষ্ট অমৃত সংগীত জনগণের হৃদয়ে স্বর্গীয় সুধা বর্ষণ করছে ও করবে।

মানুষের আত্মার প্রক্ষালন ও চিত্তশুদ্ধির তরে সঞ্জীবনী অমৃতধারা সংগীত। পি ত কিংবা পেশাজীবী সংগীতজ্ঞ থেকে শুরু করে অতি সাধারণ মানুষ যারা এই বিরূপ বিশ্বে নিয়ত বঞ্চিত-বিবিক্ত, সকলেরই হৃদয়ের গভীর গভীরতম অন্ধকার উপত্যকা শত শত বছর ধরে যে সব সংগীতস্রষ্টা আলোকিত করেছে, করছে-করবে তিনি তাদেরই মাঝে একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্রষ্টা।

সংগীতাকাশের অনেক উজ্জ্বল তারার মধ্যে, জীবিতকালে বঞ্চিত-উপেক্ষিত কালের বিচারে বন্দিত-নন্দিত একটি জ্বলজ্বলে নক্ষত্রের নাম “যোহান সেবাস্তিয়ান বাখ।”