অসমাপ্ত আত্মজীবনী : উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অনন্য দলিল -ইকবাল খোরশেদ

18 Mar 2021, 02:46 PM অন্যান্য শেয়ার:
অসমাপ্ত আত্মজীবনী : উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অনন্য দলিল -ইকবাল খোরশেদ

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা জীবনীমূলকগ্রন্থ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তাঁর পারিবারিক পরিচিতি এবং তাঁর ব্যক্তিজীবন ও রাজনৈতিকজীবন, ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট গঠন, সে-সময়ের সামগ্রিক রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি ছবির মতো ফুটে উঠেছে। বইটিতে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তি ও রাজনৈতিকজীবনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ গঠন, পাকিস্তান আন্দোলন, পূর্ব- বাংলা তথা বাংলাদেশের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের বৈষম্যমূলক আচরণের অনেক কথাও অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় প্রকাশিত। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে বইটি ২০১২ সালে প্রথম প্রকাশ হয় ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ অত্যন্ত সুখপাঠ্য, প্রয়োজনীয় ও জীবনঘনিষ্ঠ এক গ্রন্থ। ভাষার ব্যবহার ও শব্দ প্রয়োগ, স্মৃতিচারণ, ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক ঘটনার বর্ণনা স্থান-কাল-তারিখের উল্লেখ- সব দিক থেকেই বইখানি অনন্যসাধারণ। বই পড়লে মনেই হয় না লেখক কেবলই একজন প্রাজ্ঞ, জনদরদি রাজনৈতিক নেতা, মনে হয় তিনি একাধারে ইতিহাসবেত্তা, লেখক, রাজনীতিক, গল্পকথক, কবি ও নির্ভীক সাংবাদিক। অসমাপ্ত হলেও একজন দেশপ্রেমিক রাজনীতিকের আত্মজীবনী জানার ক্ষেত্রে এ-গ্রন্থ একটি উজ্জ্বল মাইলফলক। তাঁর আত্মজীবনী শুধু একজন রাজনীতিকের স্মৃতিকথা নয়, উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অনন্য দলিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজবন্দি হিসেবে কারাগারে থাকার সময় বইটি রচনা করেন। বইটিতে একদিকে ব্যক্তি হিসেবে শেখ মুজিবের চিন্তার মগ্নতা গভীরভাবে রূপায়িত হয়েছে, অন্যদিকে সে-সময়ের পটভ‚মিতে নিজের রাজনৈতিক জীবনও সমান গুরুত্বের সাথে উপস্থাপিত। পাশাপাশি তিনি চোখ রেখেছেন জগতের নানান দিকে। খুঁটিনাটি নানান বৃত্তান্ত এবং নিজের অনুভবের সারাৎসারে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ হয়ে উঠেছে অনন্য। বইটিতে কেবল একজন রাজনীতিবিদের দৃষ্টিভঙ্গিই নয়, লেখকের দায়িত্বও ফুটে উঠেছে। ফলে বলা যায়, রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে শিল্পের সুষমা- এটিই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা।

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে। এটি লেখা হয়েছে ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে যখন তিনি কারারুদ্ধ। আত্মজীবনীর শুরু হয়েছে তাঁর জন্মের সময় থেকে ; পাশাপাশি এসেছে পিতৃপুরুষের কথাও। আর বইটি শেষ হয়েছে ১৯৫৫ সালের ঘটনাবলি দিয়ে। আত্মজীবনীটি বঙ্গবন্ধু শেষ করতে পারেননি। কিন্তু সরল প্রাঞ্জল ভাষায় নির্মোহ ভঙ্গিতে ঘটনাবলির বর্ণনা থাকার কারণে, সময়ের ঐতিহাসিক বিবরণ থাকার কারণে পাঠক তরতর করে এগিয়ে যেতে পারেন। মনে হয় যেন ঘটনাগুলো এই মাত্র ঘটছে, চোখের সামনে। আর এখানেই একজন প্রাজ্ঞ লেখক হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের কৃতিত্ব। জীবনী লেখার পটভূমি তিনি উল্লেখ করেছেন বইয়ের শুরুতে : ‘বন্ধুবান্ধবরা বলে, “তোমার জীবনী লেখ।” সহকর্মীরা বলে, “রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাগুলি লিখে রাখ, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।” আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, “বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী।” বললাম, লিখতে যে পারি না ; আর এমন কী করেছি, যা লেখা যায়। আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে ? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকুই বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটুত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।’ তাঁর রাজনীতির দর্শন রাজনীতির আদর্শ এখানেই প্রোথিত। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ জুড়েই আছে তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ। এক জায়গায় লিখেছেন, ‘আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে, ততদিন দুনিয়ার মানুষের উপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না।’ এখানে নিজের জীবনদর্শনের এমন অনেক প্রসঙ্গ আছে, যা থেকে একজন ব্যক্তিকে সহজে বোঝা যায়। তরুণ বয়স থেকেই তিনি অসাম্প্রদায়িক চিন্তার মানুষ ছিলেন। তাঁর একটি অসাধারণ উদ্ধৃতি এমন : ‘১৯৩৮ সালের ঘটনা। শেরে বাংলা তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং সোহরাওয়ার্দী শ্রমমন্ত্রী। তাঁরা গোপালগঞ্জে আসবেন। বিরাট সভার আয়োজন করা হয়েছে। এগজিবিশন হবে ঠিক হয়েছে। বাংলার এই দুই নেতা একসাথে গোপালগঞ্জে আসবেন। মুসলমানদের মধ্যে বিরাট আলোড়নের সৃষ্টি হল। স্কুলের ছাত্র আমরা তখন। আগেই বলেছি আমার বয়স একটু বেশি, তাই স্বেছাসেবক বাহিনী করার ভার পড়ল আমার উপর। আমি স্বেছাসেবক বাহিনী করলাম দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে। পরে দেখা গেল, হিন্দু ছাত্ররা স্বেছাসেবক বাহিনী থেকে সরে পড়তে লাগল। ব্যাপার কি বুঝতে পারছি না। এক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম, সেও ছাত্র, সে আমাকে বলল, কংগ্রেস থেকে নিষেধ করেছে আমাদের যোগদান করতে। যাতে বিরূপ ‘সম্বর্ধনা’ হয় তারও চেষ্টা করা হবে। এগজিবিশনে যাতে দোকানপাট না বসে তাও বলে দেওয়া হয়েছে। তখনকার দিনে শতকরা আশিটি দোকান হিন্দুদের ছিল। আমি এ খবর শুনে আশ্চর্য হলাম। কারণ, আমার কাছে তখন হিন্দু মুসলমান বলে কোন জিনিস ছিল না। হিন্দু ছেলেদের সাথে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল। একসাথে গান বাজনা, খেলাধুলা, বেড়ান- সবই চলত।’ এই উদ্ধৃতি থেকে পাঠকের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তিনি যে তার বিভিন্ন বক্তৃতায় অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে বলতেন তা সেই ছেলেবেলা থেকেই তার মধ্যে প্রোথিত ছিল। সংবিধানের চারটি মূলনীতি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ। জীবন দর্শনের মৌলিক চেতনায় বঙ্গবন্ধু আবাল্য ছিলেন দীপ্ত মানুষ। বইয়ের অনেক জায়গায় প্রকৃতির বর্ণনা আছে। তাঁর টুঙ্গিপাড়ার শৈশব-কৈশোরের জীবন এই প্রকৃতির মধ্যে বেড়ে উঠেছেন। বোধ করি, এ-কারণেই প্রকৃতির বর্ণনা তাঁর রচনার একটি বড়ো দিক। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত লেখা। পুরো বইয়ে তিনি ধারাবাহিকভাবে নিজের চিন্তার সঙ্গে সমসাময়িক ঘটনা তুলে ধরেছেন । বিরতিহীনভাবে টানা লেখায় কোথাও ছন্দপতন নেই। পাঠক জানার আগ্রহে উৎসুক থাকেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এই বইয়ের যেকোনো জায়গা থেকে পড়তে শুরু করলে কোনো-না-কোনো ঘটনা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা পকিস্তানিদেও অত্যাচার নির্যাতন সম্পর্কে জানা যায়। উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এমন একটি অসামান্য দলিল উপহার দেওয়ার জন্য মুজিবশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই আনন্দক্ষণে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি জানাই সশ্রদ্ধ অভিবাদন।