মির্জাপুরের ঐতিহ্যবাহী মহেড়া জমিদারবাড়ি : মোশাররফ হোসেন

03 Jun 2025, 01:44 PM অন্যান্য শেয়ার:
মির্জাপুরের ঐতিহ্যবাহী মহেড়া জমিদারবাড়ি : মোশাররফ হোসেন

টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর উপজেলায় মহেড়া জমিদারবাড়িটি অবস্থিত। মহেড়া জমিদারবাড়ির পূর্ব পুরুষগণ কলকাতা শহরের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ছিলেন। তারা লবণ ও পাটের ব্যবসা করতেন। ব্যবসায়ী সূত্রে পূর্ব-বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁদের যাতায়াত ছিল। ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর এলাকার জমিদারি কিনে নেয়। জমিদারি লাভের পর মহেড়া গ্রামে একটি বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুসারে কয়েক বছরের মধ্যে আট একর জমির উপর দোতলাবিশিষ্ট চারটি বিশাল সুরম্য অট্টালিকাসহ আরো কয়েকটি একতলা ভবন ও মন্দির নির্মাণ করা হয়। মহেড়া জমিদারবাড়ির প্রধান চারটি অট্টালিকা মহারাজ লজ, আনন্দ লজ, চৌধুরী লজ ও কালীচরণ লজ পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে সারিবদ্ধভাবে এখনো সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। জমিদারবাড়িটি এখন পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।

মহেড়া জমিদারবাড়িটির প্রধান চারটি অট্টালিকা দক্ষিণমুখি। পশ্চিম দিকের অট্টালিকাটি মহারাজ লজ নামে পরিচিত। দোতলা ভবনটির উভয় তলায় ছয়টি করে মোট বারটি কক্ষ রয়েছে। ভবনটির সামনে ছয়টি পিলার বা স্তম্ভ নিচ থেকে দোতলার ছাদে গিয়ে মিশেছে। ভবনটির দোতলার মাঝ বরাবর খোলা বারান্দা, নকশা করা রেলিং এবং ছাদের উপরে মিনারসদৃশ ছোটো ছোটো টাওয়ারগুলো অট্টালিকাটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে।

ভবনটির উত্তর পাশে দুর্গা ও নাটমন্দির ছিল। ভবনটিতে জমিদার গজেন্দ্র কুমার রায়চৌধুরী সপরিবারে বসবাস করতেন। তিনি ব্রিটিশ শাসনামলে কলকাতা হাইকোর্টের সম্মানিত বিচারক [Honorary Magistrate] ছিলেন। গজেন্দ্র কুমার রায়চৌধুরী শৌখিনভাবে পশু পালন করতেন। তিনি অট্টালিকার পাশে জমিদার বাড়ির আঙ্গিনায় একটি মিনি চিড়িয়াখানা গড়ে তোলেন। তাঁর চিরিয়াখানার সংগ্রহে ছিল বাঘ, হরিণ, ময়ূর, নানা প্রজাতির ঘোড়া ও পাখি। নান্দনিক নকশাখচিত মহারাজ লজটি এখন পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের দেশি বিদেশি প্রশিক্ষকদের ডরমিটোরি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

মহারাজ লজের পূর্ব পাশের অট্টালিকাটি আনন্দ লজ। দোতলাবিশিষ্ট এই ভবনটির নিচতলা ও দোতলায় ছয়টি করে মোট বারটি কক্ষ রয়েছে। আনন্দ লজের সামনের গোলাকার স্তম্ভ বা খামগুলো নিচ থেকে দোতলার ছাদে গিয়ে মিশেছে। খামের পেছনে ভবনের মাঝ বরাবর খোলা টানা বারান্দা, ভবনের দুই পাশের বর্ধিত ঝুলন্ত বারান্দা ও ছাদের উপরের মিনারসদৃশ ছোটো ছোটো টাওয়ারগুলো অট্টালিকাটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। জমিদার বকুল রায়চৌধুরী ও রাধিকা লাল রায়চৌধুরীÑ দুই ভাই বসবাস করতেন। বকুল রায়চৌধুরী যাত্রাপালা, নাটক, পালাগানসহ সাংস্কৃতিক কর্মকা- নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। রাধিকা লাল রায়চৌধুরী সুদর্শন পুরুষ। ব্রিটিশ শাসনামলে সমগ্র ভারতবর্ষে তিনি দ্বিতীয় সুপুরুষ হিসেবে সরকার কর্তৃক নির্বাচিত হন। আনন্দ লজ ভবনটি বর্তমানে পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রশাসনিক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

আনন্দ লজের পূর্ব পাশেই চৌধুরী লজ। দোতলাবিশিষ্ট এই অট্টালিকার নিচতলায় চারটি এবং দোতলায় চারটি করে মোট আটটি কক্ষ রয়েছে। এই ভবনটির সামনে নিচ থেকে টানা স্তম্ভ ও ছাদের উপর মিনারসদৃশ ছোটো ছোটো টাওয়ার রয়েছে। জমিদার সুধীর কুমার রায়চৌধুরী চৌধুরী লজে বসবাস করতেন। এই ভবনটিও বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার করছেন।

চৌধুরী লজের উত্তর-পূর্ব পাশে কালীচরণ লজ নামে আরো একটি অট্টালিকা রয়েছে। ভবনটির সামনের অংশ একতলাবিশিষ্ট এবং পেছনের অংশ দোতলাবিশিষ্ট। এই ভবনটিতে জমিদার কালীচরণ সপরিবারে বসবাস করতেন। কালীচরণ লজের একতলা ভবনটিকে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর জাদুঘর করা হয়েছে। পেছনের দোতলা ভবনটি জাদুঘরের দাপ্তরিক কাজে ব্যবহৃত হয়।

মহেড়া জমিদার বাড়ির প্রধান চারটি অট্টালিকা মহারাজা লজ, আনন্দ লজ, চৌধুরী লজ ও কালীচরণ লজের আলাদা আলাদা কাচারি [কাছারি]-ভবন রয়েছে। প্রতিটি কাচারিভবন একতলাবিশিষ্ট এবং দাপ্তরিক কাজের জন্য প্রতিটি কাচারিভবনে বেশ কয়েকটি কক্ষ রয়েছে। এছাড়া কাচারির ভেতরে ও পাশে নায়েব, গোমস্তাসহ অন্যান্য কর্মচারীদের থাকার জন্য একাধিক কক্ষের ব্যবস্থা ছিল।

চৌধুরী লজের পেছনে এবং কালীচরণ লজের পশ্চিমে রয়েছে অতিথিশালা ও রানিমহল। অতিথিশালায় অতিথিদের জন্য এবং রানিমহলে জমিদারদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা ছিল। রানিমহলের উত্তর দিকে রয়েছে রানিপুকুর। রানিমহল থেকে সরাসরি রানিপুকুরে যাওয়া আসার পথ রয়েছে। জমিদার বাড়ির অন্দরমহলের নারীরা রানিপুকুরে গোসল [স্নান] করতেন।

রানিপুকুরের সামান্য পশ্চিমে এবং মহারাজ লজ ও আনন্দ লজের কিছুটা উত্তর দিকে পাসরা নামে আরো একটি পুকুর রয়েছে। এই পুকুরে জমিদার বাড়ির পুরুষ সদস্যরা গোসল [স্নান] করতেন।

মহেড়া জমিদার বাড়ির প্রতিটি অট্টালিকা দক্ষিণমুখি। অট্টালিকাগুলোর কিছুটা দক্ষিণ দিকে বেষ্টনী ও দু’টি প্রবেশদ্বার রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব দিকের প্রবেশদ্বারের উপরে সিংহমূর্তি রয়েছে। বেষ্টনী ও অট্টালিকার মাঝখানের জায়গায় নানারকম ফুলের বাগান বাড়িটির শোভা বর্ধন করেছে। মহেড়া জমিদার বাড়ির সম্মুখভাগে রয়েছে ‘বিশাখা সাগর’ নামে ঘাট বাঁধানো আয়তাকার দিঘি।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর আক্রমণে মহেড়া জমিদারবাড়ির কূলবধূসহ পাঁচজনকে হত্যা করে ও ব্যাপকভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর আক্রমণের মুখে জমিদারবাড়ির সদস্যরা বাধ্য হয়েই স্থানীয় লৌহজং নদী পথে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেন। হানাদার বাহিনীর এই আক্রমণের কয়েক মাসের মধ্যে মুক্তিবাহিনী পাল্টা আক্রমণ করে হানাদার বাহিনীকে বিতাড়িত করে বাড়িটিতে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন করে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর কিছুদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল জমিদারবাড়িটি। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে ক্ষতিগ্রস্ত জমিদারবাড়িটি সংস্কার করে পরবর্তীসময়ে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর প্রশিক্ষণ স্কুল স্থাপন করা হয়। এরপর ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে প্রশিক্ষণ স্কুলটিকে বাংলাদেশ পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে রূপান্তরিত করা হয়।

মহেড়া জমিদারবাড়ির প্রধান চারটি অট্টালিকা মহারাজ লজ, আনন্দ লজ, চৌধুরী লজ ও কালীচরণ লজের নকশা ও নির্মাণশৈলীতে ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতি অনুসরণ করা হয়েছে। বিশেষ করে রোম, বাইজেন্টাইন ও স্পেনের করডোভা নগরীর স্থাপনার সাথে মহেড়া জমিদারবাড়ির অট্টালিকাগুলোর স্থাপত্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। এ-ছাড়াও কাচারিভবন, অতিথিশালা ও রানিমহলের নির্মাণশৈলীতে ইন্দো-ইউরোপীয় রীতি পরিলক্ষিত হয়। জমিদারবাড়ির বিলুপ্ত মন্দিরগুলো দেশীয় স্থাপত্যরীতিতে নির্মাণ করা হয়েছিল।

টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুরে নান্দনিক নকশাখচিত সুরম্য মহেড়া জমিদারবাড়িটি দেশের অন্যতম পুরাকীর্তি। 

লেখক : গবেষক, লেখক ও টেলিভিশ নির্মাতা