ইউরোপের ১৫০ দিন : সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

20 Oct 2024, 02:22 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন : সৈয়দা তাসলিমা আক্তার


[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


আমাদের প্রাচ্য অঞ্চলে জাতিগত এবং ধর্মীয় একটা বিভেদ সূক্ষ্ম কাঁটার মতো বিধে আছে, যা মাঝে মাঝেই আমাদের যন্ত্রণা দেয়। অন্যদিকে প্রাশ্চাত্যে ধর্মীয় বিভেদ এতটা প্রকট না হলেও জাতিগত বিভেদ এবং বর্ণবাদ সেখানে জিইয়ে আছে যুগ যুগ ধরে। এটা যে নিভৃতে নীরবে আছে তা নয়। অনেকটা প্রচ্ছন্নভাবেই আছে, বিশেষ করে কালো চামড়ার প্রতি তাদের অবজ্ঞা ও বিরক্ত মনোভাব মাঝে মাঝেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রকাশ হয়ে যেত, আর সেই কারণেই হয়ত আমার অবচেতন মনে তাদের সম্পর্কে একটা ভীতি বা অনাস্থার মনোভাব তৈরি হয়েছে। কেন বলছি ? আমরা এবার যার রাইড শেয়ার করছি তিনি সম্ভবত নাইজেরিয়ান ; আগে জানা ছিল না বলেই গাড়িতে উঠে একটা ধাক্কা খেলাম। আস্তে করে ইরফানকে জিজ্ঞেস করলাম, কোনো সমস্যা হবে না তো ? একে তো রাত তার ওপর লম্বা একটা পথ, আমার প্রাচ্য মনসিকতায় ভীতি সঞ্চার হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু ভাতিজা আশ্বস্ত করল। যা হোক, ইতোমধ্যে আমরা লুক্সেমবার্গ ছাড়িয়ে এসেছি। আগেই বলেছি, আজ আকাশের চাঁদ যেন পূর্ণদৃষ্টি দিয়ে পৃথিবী দেখছে। পথের নিয়ন আলোর সাথে পাল্লা দিয়ে সে তার জ্যোতি ছড়াচ্ছে। এর মধ্যেই চালকের সাথে ইরফানের আড্ডা জমে উঠেছে। বলা হয়নি, প্রাশ্চাত্যের লোকজন যতটা ইন্ট্রোভার্ট মধ্যপ্রাচ্যের লোকজন ঠিক ততটাই আমোদী ও এক্সট্রোভার্ট। এদের কথা বলার ধরনেও রয়েছে একটি সহজাত সারল্য, যদিও প্রথম দেখায় একটা আড়ষ্টতা কাজ করে। আমি পুরো পথ মধ্যরাতের ইউরোপ দেখে কাটিয়েছি মাঝে মাঝে ইরফান আর চালকের আলাপচারিতার কিছু কিছু আমার কানে আসছে, সময় কেটে যাচ্ছে। তদের কথোপকথনে জানলাম, ভদ্রলোকের বাস প্যারিসে, কর্মসূত্রে লুক্সেমবার্গে আসা ; শিফটিং ডিউটি, যখনই কাজ শেষ হয় তখনই তিনি প্যারিসে ফিরে যান, কেননা লুক্সেমবার্গে জীবন-যাপন-ব্যয় অত্যাধিক, যাতে তার পোষায় না। আজ রাত দশটা পর্যন্ত তার ডিউটি ছিল।

ভদ্রলোক বেশ স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছিলেন, মনে হচ্ছিল আমরা যেন উড়ে চলেছি। দু’ধারের দৃশ্যপট এত দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছিল যে, বেশিক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা যাচ্ছিল না। এর মাঝে ইরফান প্রশ্ন করে বসল, এত স্পিডের জন্য জরিমানা গুনতে হবে না ? স্বাভাবিকভাবেই তার ফাইন হওয়ার কথা। চালকের উত্তর শুনে আমরা দু’জনেই থ, বাঙালির বুদ্ধিও যেন এখানে হার মানলো। সাধারণত ইউরোপের রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের উপস্থিতি খুব একটা চোখে পড়ে না, তারপরও কেউ সহজে ট্রাফিক আইন ভাঙে না ; এটা ভাববার কোনো কারণ নেই যে, তারা সকলেই খুব সুশৃঙ্খল এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আসলে সিস্টেমের কারণে তারা আইন বা নিয়ম মানতে বাধ্য। তবে, নিয়ম ভাঙা বোধহয় মানুষের সহজাত স্বভাব, ইউরোপের অধিবাসীরাও এর ব্যতিক্রম নয়। আসল কথায় আসি, ভদ্রলোক [রাইডার] যেহেতেু নিয়মতি প্যারিস থেকে লুক্সেমবার্গ যাতায়াত করেন এবং এই দুই শহরের দূরত্বও নেহায়েত কম না। তার প্রতিদিনের জীবন-যাপনে সময়ের সাশ্রয়ও দরকার, তাই তিনি নিজে নিজে যে কৌশল অবলম্বন করেছেন তা হলো তিনি তার গাড়িতে একটি ক্যামেরা সেন্সর লাগিয়েছেন। আমরা চলতে চলতে বেশ কয়েকবার একটা বিচিত্র শব্দ শুনতে পেলেও বিষয়টি তেমন আমলে নিইনি। আসলে সেটি ছিল সেন্সরের সিগনাল, অর্থাৎ ক্যামেরার অস্তিত্ব পাওয়া গেলেই সেন্সরটি সিগনাল দেয়। এখানে সময় নির্ধারণ করা আছে, ক্যামেরা অতিক্রম করার আগেই সিগনালটি বেজে ওঠে আর চালক তার গতিসীমা স্বাভাবিক পর্যায়ে নামিয়ে আনেন। জরিমানা থেকে বাঁচতে এই কূট-কৌশল, তবে তার বলার ভঙ্গিতে আত্মতৃপ্তি ছিল, মনে হলো যেন সে বেশ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। যদিও এরপর ক্ষানিকক্ষণ ইরফান আর আমি দু’জনেই চুপ করেছিলাম, বিমূঢ়তা কাটতে সময় লেগেছিল।

আমরা ভোর সাড়ে তিনটায় প্যারিস পৌঁছেছি। যেহেতু রাইডার আমাদের শহরের একটি নির্দিষ্ট পয়েন্টে নামিয়ে দেবে তাই আমরা আমাদের সুবিধামতো একটি লোকেশন ঠিক করে নিয়েছিলাম। সেখানে আগে থেকেইে আমার কাজিন [সবুজ ভাই] অপেক্ষা করছিল, আমি কাজিনের সাথে রওনা হলাম। আগেই বলেছি, আমি প্যারিসে আমার কাজিনের বাসায় থাকছি। আর ইরফান তার বাসায় চলে গেল। বাসায় ফিরে সবুজ ভাই রাতে খাবার খাওয়ার কথা বললে আমি এত রাতে কিছু খাবো না বলে ফ্রেশ হয়ে ঘুমুতে গেলাম। পরদিন বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠলাম, প্যারিসের আকাশ যথারীতি মেঘলা, ডিসেম্বেরের শেষ সময়ে এটাই হওয়ার কথা। আমরা যারা গ্রীষ্ম প্রধান অঞ্চলের মানুষ তাদের কাছে এটা খুবই বিরক্তিকর একটা বিষয়। একে তো ঠান্ডা তার ওপর বৃষ্টির ঘ্যানঘ্যানানি। আজ বিকেলে ইরফানের এ বাসায় আসার কথা, তার জন্য ভাতিজাদের আনন্দের শেষ নেই। আমি যে কাজিনের বাসায় আছি তার দুই ছেলে সলো আর সুপ্ত। সলো বড়ো তার সাথে ইরফানের বেশ সখ্য ; কারণ, তার ছোটো বেলার সময় ইরফান এ বাসায় কাটিয়েছে তাই তাদের দু’জনের [চাচাতো ভাই] ভাবটা চোখে পড়ার মতো। সলো কিছুক্ষণ পরপর এসে আমাকে প্রশ্ন করছে ইরফান এখনো আসে না কেন ? ইরফান কখন আসবে ? তার প্রতীক্ষার প্রহর যেন কাটতেই চাচ্ছে না। অবশ্য আমিও অপেক্ষা করে আছি, ইরফানের সাথে আমার কিছু দরকার আছে। আগেই বলেছি, আমি স্পেন আর পর্তুগালের টিকেট কেটেছি। আমার এক বন্ধু যে কি না তখন Strengthen প্রজেক্টের আওতায় ইংলান্ডের স্কটল্যান্ডে স্মাতকোত্তর করছিল, সে সময় তাদের ছুটি থাকায় বন্ধুদের নিয়ে একটি গ্রুপ ট্যুরে বেশ কিছু দেশ ভ্রমণে ছিল। মূলত তাদের সাথে সময় মিল করে আমার টিকেট কাটা। পরে অবশ্য তার প্ল্যান বাতিল হওয়ায় আমি কিছুটা দ্বিধায় পড়ে যাই, আমার কী করা উচিত, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। অবশ্য ইরফান আমাকে প্রতিনিয়ত সাহস দিয়ে যাচ্ছে আমি যেন যাই, এটা অবশ্যই একটা ভিন্নর্ধমী অভিজ্ঞতা হবে। ইরফানের ইচ্ছে ছিল আমার সাথে যাওয়া কিন্তু তার পাসপোর্টের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় তার পক্ষে তখন বিমানে ভ্রমণ করা সম্ভব ছিল না। আর প্যারিস থেকে স্পেন ও পর্তুগালের দূরত্ব বিবেচনয় বাসে ভ্রমণ বেশ কষ্ট ও সময় সাপেক্ষ বিষয় ছিল। এসব চিন্তা করে একবার পর্তুগাল ও স্পেন যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করি, আবার পরক্ষণেই ভাবি যাই না, কী আর হবে ? ওদিকে কাজিনও ঘ্যানঘ্যান করছে কী দরকার একা যাওয়ার ? চাচা [মানে আমার বাবা] শুনলে রাগ করবেন। বাসার কারো সাথে বিষয়টা শেয়ার করতে না পেরে আমারও অস্বস্তি হচ্ছিল, অবশেষে আমার সেজো বোনকে ফোন করি, সে বেশ আগ্রহী হয়ে আমাকে উৎসাহ দিল। আর ইরফান তো গত তিনদিন যাবৎ আমাকে মটিভেট করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শেষমেশ সাহস করেই ফেললাম। আজ ২২ ডিসেম্বর ২৩ তারিখ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আমার ফ্লাইট, প্রথমে স্পেনের বার্সিলোনা তারপর পর্তুগালের লিসবন। রাতে খাওয়ার পর আমি আর ইরফান ল্যাপটপ নিয়ে বসে গেলাম, দুজনে মিলে এয়ার বিনবি আর বুকিং ডটকম ঘেটে পর্তুগাল আর স্পেনের হোটেল বুকিং নিশ্চিত করলাম। এরপর শুরু করলাম লাগেজ গোছানো, প্রায় রাত্রি ভোর করে ঘুমুতে গেলাম। 

পরদিনও বেলা করে ঘুম ভাঙল, নাশতা করতে করতে প্রায় সাড়ে বারোটা। এরপর আবার সবকিছু চেক করলাম কোনো কিছু বাকি রইলো কি না, আসলে একা ট্রাভেল করছি বলে হয়ত অবচেতন মনে একটু খচখচানি ছিল। যদিও দেশে আমি বিভিন্ন জায়গায় একা ভ্রমণ করে অভ্যস্ত। ইউরোপেও করেছি ; তবে, গন্তব্যে পরিচিতজন ছিল। এই প্রথম কোথাও যাচ্ছি যেখানে চেনা-জানা কেউ নেই। অজানা শহর আর অচেনা মানুষের ভিড়ে নিজের মতো করে পুরো ভ্রমণ পরিকল্পনা সাজাতে হবে, যদিও প্রযুক্তি এখানে বিশ^স্ত বন্ধুর মতো পাশে ছিল। কেউ কি বলেছিল না নিজে নিজেই নেট ঘেটে বের করেছিলাম এখন মনে করতে পারছি না, ‘ভিজিট এ সিটি’ নামের একটি অ্যাপে বিশে^র সকল শহরের পরিচিতি, পরিবহণ, বিশেষত্ব সবই দেওয়া আছে ; আমার পরবর্তী ভ্রমণে এই অ্যাপটি সত্যিই বন্ধু হয়েছিল।

আমরা বোধকরি বিকেল পাঁচটায় বাড়ি থেকে বের হয়েছি, কিন্তু সেদিন প্যারিসের রাস্তায় অত্যাধিক জ্যাম থাকায় টেনসনেই পড়ে গেলাম, ফ্লাইট ধরতে পারব তো ! আমার কাজিনের চোখেমুখেও চিন্তার ছাপ। তার চিন্তার কারণ অবশ্য একাধিক, ঠিক সময়ে এয়াপোর্টে পৌঁছাতে পারব কি না এটা তো আছেই তার ওপর আমি একা ট্রাভেল করছি এটাও তার চিন্তার কারণ। ঘুরেফিরে সেই একই কথা, চাচা শুনলে রাগ করবেন। আমি তাকে আশ^স্ত করলাম বার্সেলোনা পৌঁছে আমি বাবা-মার সাথে কথা বলে নেব, আর যদি কোনো কারণে আমার বার্সেলোনায় একা বেড়াতে ভালো না লাগে অথবা আমি যদি অসুবিধা বোধকরি তবে ফিরতি যে ফ্লাইটে টিকেট পাব তাতেই ফিরে আসব। [চলবে]