পারিবারিক পরিচয়
নাওগাঁ জেলা শহর থেকে দীঘলির বিল পার হয়ে ৭ কিলোমিটার দক্ষিণে দুবলহাটি রাজবাড়িটি অবস্থিত।
দুবলহাটি জমিদার বংশের আদিপুরুষ ছিলেন শ্রী জগৎরাম রায়। তিনি লবণ ও গুড়ের ব্যবসয়ী ছিলেন। শ্রী জগৎরাম রায় ভারতের উত্তর প্রদেশ থেকে ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে নদীপথে পূর্ববঙ্গের বারবাকপুর পরগনায় আসেন। স্থানীয় খয়রা নদীতে তার নৌবহর অবস্থান করে ব্যবসা করত। জনশ্রুতি রয়েছে একদিন রাতে রাজ-রাজেশ্বরী দেবী স্বপ্নে শ্রী জগৎরাম রায়কে দেখা দেন এবং খয়রা নদীর জলের তলদেশ থেকে তুলে তার মূর্তি মন্দিরে স্থাপন করে পূজা প্রবর্তন করার নির্দেশ দেন। এরপর শ্রী জগৎরাম রায় খয়রা নদীর জলে ভাসমান পদ্মপাতার নিচ থেকে দেবীর মূর্তি উদ্ধার করে মন্দিরে স্থাপন করেন। শ্রী জগৎরাম রায় মন্দির স্থাপন করে জাঁকজমকসহকারে রাজেশ্বরী দেবীর পূজা শুরু করেন। রাজেশ্বরী দেবীর কৃপায় অল্প দিনের মধ্যেই বণিক শ্রী জগৎরাম রায় অনেক ভূসম্পত্তির মালিক হয়ে যান। এরপর বসবাসের জন্য শ্রী জগৎরাম রায় দুবলহাটি অঞ্চলের বিলের মধ্যে একটি ছোটো জঙ্গল পরিষ্কার করে বসবাস করতে শুরু করেন। ভারতবর্ষে তৎকালীন মুঘল শাসক দুবলহাটির ধনাঢ্য বণিক শ্রী জগৎরাম রায়ের বিশাল ভূসম্পত্তির খবর জানতে পেরে নবাব মুর্শিদকুলি খানকে খাজনা আদায়ের নির্দেশ দেন। বারবাকপুর পরগনার ফসলি জমি তেমন ছিল না। বেশিরভাগ অঞ্চলই ছিল জলাভূমি। এ অঞ্চলের হাওড়, বাওড়, বিল ও ঝিলে প্রচুর কৈ-মাছ পাওয়া যেত। সেকারণে বণিক শ্রী জগৎরাম রায় শস্য ও অর্থের পরিবর্তে রাজস্ব হিসেবে কৈ-মাছ দেওয়ার প্রস্তাব করেন। তার এই প্রস্তাবে মুঘল সম্রাট বিস্মিত হলেও বাস্তবতা বিবেচনা করে বণিক শ্রী জগৎরাম রায়ের প্রস্তাবে সম্রাট সম্মতি প্রদান করেন। এরপর থেকে দুবলহাটির জমিদারেরা প্রতিবছর নবাবের মাধ্যমে মুঘল সম্রাটকে ৮০ কাহন অর্থাৎ ২৫৬০০টি কৈ-মাছ রাজস্ব হিসেবে প্রদান করতেন। ভারতবর্ষে যতদিন মুঘল শাসন ছিল ততদিন দুবলহাটি জমিদারদের জন্য এই রাজস্ব প্রথাটি বহাল ছিল।
শ্রী জগৎরাম রায়ের দুই ছেলে ছিল। কৃষ্ণরাম রায় ও রঘুরাম রায়। শ্রী জগৎরাম রায়ের মৃত্যুর পর দুই ছেলের মধ্যে জমিদারি ভাগ হয়ে যায়। জমিদারির নয়-আনা পান বড়ো ছেলে কৃষ্ণরাম রায় আর ছোটো ছেলে পান সাত-আনা। জমিদারি ভাগ হওয়ার পর কৃষ্ণরাম রায় বলিহারের নিকট মৈনম গ্রামে এবং রঘুরাম রায় দুবলহাটি গ্রামে বসতি স্থাপন করে জমিদারি করতে থাকেন। কিছুকাল পরে শ্রী জগৎরাম রায়ের বড়ো ছেলে কৃষ্ণরাম রায় নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। এই অবস্থায় কৃষ্ণরাম রায়ের বিধবা স্ত্রী পার্শ্ববর্তী বলিহার ও দামনাশ অঞ্চলের দুই জমিদারের নিকট নয়-আনা জমিদারি বিক্রি করে দেন।
বড়ো ভাইয়ের মৃত্যুর কয়েক বছর পর ছোটো ভাই রঘুরাম রায়ও মৃত্যুবরণ করেন। রঘুরাম রায়ের মৃত্যুর পর তার ছেলে রঘুনাথ রায় জমিদারি লাভ করেন। রঘুনাথ রায়ের মৃত্যুর পর তার ছেলে পরমেশ্বর রায় দুবলহাটির জমিদারি লাভ করেন। পরমেশ্বর রায়ের দুই ছেলে ছিল। বড়ো ছেলে শিবনাথ রায় এবং ছোটো ছেলে কাশীনাথ রায়। জমিদার পরমেশ্বর রায়ের মৃত্যুর পর তার বড়ো ছেলে শিবনাথ রায় জমিদারি লাভ করেন। শিবনাথ রায়ের মৃত্যুর পর তার ছেলে কৃষ্ণনাথ রায় উত্তরাধিকার সূত্রে জমিদারি লাভ করেন।
ইতোমধ্যে ইংরেজরা ভারতবর্ষের শাসন ক্ষমতা দখল করে। ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী রাজস্ব আদায় বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করার মধ্য দিয়ে জমিদারি প্রথার প্রচলন করে। তখন রাজা শ্রী জগৎরামের পরবর্তী বংশধর শিবনাথ রায়ের ছেলে শ্রী কৃষ্ণনাথ রায় ১৪ লক্ষ ৪ শত ৯৫ টাকায় লর্ড কর্নওয়ালিসের নিকট থেকে দুবলহাটি জমিদারির পত্তনি নেন। ইংরেজ শাসকেরা তাকে চৌধুরী উপাধি প্রদান করে। জমিদারি লাভের পর শ্রী কৃষ্ণনাথ রায় চৌধুরী ৫ একর জমির উপর বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করেন। স্থলপথে রজবাড়িতে যাতায়াতের জন্য তিনি দিঘলী বিলের মধ্য দিয়ে ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি রাস্তা নির্মাণ করেন। শ্রী কৃষ্ণনাথ রায় চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার পুত্র শ্রী নরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী জমিদারির দায়িত্ব পান। তিনি বাড়ি নির্মাণের অবশিষ্ট কাজ সম্পন্ন করেন। বাড়িটির সাতটি আঙ্গিনায় সাতটি ভবন ছিল। এই সাতটি ভবনের মধ্যে একটি ভবন ছিল চারতলা বাকিগুলো তিনতলা ও দোতলা বিশিষ্ট। শয়ন কক্ষ, অতিথি কক্ষ, প্রার্থনাকক্ষ, খাবারের হল, গৃহকর্মীদের থাকার ঘর ও বৈঠকখানাসহ বিশাল রাজবাড়িটিতে তিন শতোর অধিক কক্ষ ছিল।
শ্রী নরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার পুত্র শ্রী আনন্দনাথ রায় চৌধুরী উত্তরাধিকারসূত্রে জমিদারি লাভ করেন। কোনো পুত্রসন্তান না থাকায় তার মৃত্যুর পর স্ত্রী শ্রীমতী মঞ্জরি রায় চৌধুরী জমিদারির দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। তিনি জমিদারি পরিচালনায় দক্ষতা দেখান। তার সময়ে দুবলহাটি জমিদারির সীমা বিস্তৃত হয়। শ্রীমতী মঞ্জরি রায় চৌধুরী স্বামীর ইচ্ছায় হরনাথ রায়কে দত্তকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। শ্রীমতী মঞ্জরি রায় চৌধুরী ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে দত্তকপুত্র হরিনাথ রায়কে জমিদারির দায়িত্ব অর্পণ করেন। দুবলহাটি জমিদারদের মধ্যে হরনাথ রায় চৌধুরী বেশ সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তার সময়ে বগুড়া, দিনাজপুর, রাজশাহী এবং সুনামগঞ্জ, ফরিদপুর-সিলেটের অনেক [পরগনা ও মৌজায়] অঞ্চলে দুবলহাটির রাজাদের জমিদারি বিস্তার লাভ করে। সে-সময়ে উল্লিখিত অঞ্চলগুলো থেকে সাড়ে চার লক্ষ টাকা বার্ষিক রাজস্ব আদায় হতো। জমিদার হরনাথ রায় চৌধুরী প্রজা হিতৈষী ও শিক্ষানুরাগী ছিলেন। তিনি প্রজাদের চিকিৎসার জন্য জমিদার বাড়ির ঠিক পশ্চিম পাশে ‘দাতব্য চিকিৎসালয়’ স্থাপন করেন। পানীয় জলের চাহিদা মেটাতে রাজ্যজুড়ে অসংখ্য দিঘি ও পুকুর খনন করেন। প্রজা কল্যাণে অনেক জনহিতকর কাজের জন্য ব্রিটিশ প্রশাসন ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে তাকে রাজা উপাধিতে ভূষিত করে এবং ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে তাকে রায় বাহাদুর উপাধি প্রদান করে। রাজা হরনাথ রায় চৌধুরীর দুই ছেলে ছিল। বড়ো ছেলে ঘনদানাথ রায় চৌধুরী এবং ছোটো ছেলে ক্রীঙ্কাতীনাথ রায় চৌধুরী। বড়ো ছেলে ঘনদানাথ রায় চৌধুরী দুই কন্যা সন্তান রেখে মৃত্যুবরণ করলে রাজা হরনাথ রায়ের ছোটো ছেলে ক্রীঙ্কাতীনাথ রায় চৌধুরী জমিদারি লাভ করেন। তিনি ছিলেন এই বংশের শেষ জমিদার। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির আগ পর্যন্ত তিনি জমিদারি করেন। তিনি ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে জমিদার বাড়ির অদূরে পিতা হরনাথ রায় চৌধুরীর নামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ‘দুবলহাটি রাজা হরনাথ উচ্চ বিদ্যালয়’ নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠাটি এখনো সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। এছাড়াও তিনি রাজশাহী সরকারি কলেজের জন্য জমি দানসহ মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দির ও মাঠের জন্য অনেক জমি দান করেন। রাজা ক্রীঙ্কাতীনাথ রায় চৌধুরীর তিন সন্তান ছিল। সমরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী, বীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী ও অমরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী।
প্রত্মতাত্ত্বিক ঐতিহ্য
নাওগাঁ শহর থেকে দীঘলির বিলের মধ্য দিয়ে ৭ কিলোমিটার পথ পার হলেই রাস্তার ডান পাশে প্রথমেই চোখে পড়বে ‘রাজা হরনাথ রায় চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়’। বিদ্যালয়ের উল্টো পাশে দেয়ালঘেরা বিশাল মাঠ। এরপরই চোখে পড়বে দুবলহাটি রাজবাড়িটি। ৫ একর জমির উপর নির্মিত রাজবাড়িটি দু’টি অংশে বিভক্ত। বাড়িটির সামনের অংশটি বহির্মহল। এই অংশটি রাজকার্য বা জমিদারি পরিচালনার জন্য ব্যবহার করা হতো। রাজবাড়ির পেছনের অংশটি অন্দরমহল। অন্দরমহলে রাজপরিবার বসবাস করতেন।
বাড়িটির উত্তর দিকে রয়েছে প্রধান প্রবেশদ্বার। রাজবাড়ির সাম্মুখভাগের দোতলা ভবনটির নিচে কাঠের তৈরি বিশাল প্রবেশদ্বারটির অবস্থান। ভবনের সম্মুখভাগের শীর্ষদেশে বেশ কয়েকটি নান্দনিক নারী ভাস্কর্য ছিল। বিভিন্ন সময়ে দুর্বৃত্তরা ভাস্কর্যগুলো ভেঙে ফেলেছে। রাজবাড়ির বহির্মহলে অতিথিশালা, নহবতখানা, ডাকঘর, খাদ্য গুদাম, অস্ত্রাগার, সৈনিকদের কক্ষ, থিয়েটার হলসহ দাপ্তরিক কাজের জন্য বেশ কয়েকটি কক্ষ ছিল।
বাড়িটিতে প্রবেশ করলেই দেখা যাবে বহির্মহলের সম্মুখভাগের ভবনের দুই পাশের নিচতলায় অনেকগুলো কক্ষ রয়েছে। এর দু’টি কক্ষে রাজার সৈনিকেরা সার্বক্ষণিক অবস্থন করত। পাশের একটি কক্ষ অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। অস্ত্রাগারের পশ্চিম পাশ-সংলগ্ন বড়ো কক্ষটি খাদ্যগুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পূর্ব দিকের একটি কক্ষে ডাকঘরের কার্যক্রম পরিচালিত হতো। পূর্বপাশের বাকি কক্ষগুলো জমিদারদের দাপ্তরিক কাজে ব্যবহৃত হতো। রাজবাড়ির উত্তর-পূর্ব কোণে একগম্বুজবিশিষ্ট তিনতলা একটি নহবতখানা রয়েছে। নহবতখানাটি এখনো ভালো অবস্থায় টিকে আছে। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রতিদিন নহবতখানা থেকে বাঁশির সুর ভেসে আসত।
বহির্মহলের সম্মুখভবনের দোতলায় তিনটি কক্ষ রয়েছে। মাঝখানের বড়ো কক্ষটি দরবার হল এবং দুই পাশের কক্ষদু’টি অতিথিদের বিশ্রাম কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। প্রবেশদ্বারের দোতলা ভবন পার হলেই বহির্মহলের খোলা আঙ্গিনা। খোলা আঙ্গিনার পশ্চিম পাশে থিয়েটার হল। থিয়েটার হলের পেছনের কক্ষটি ছিল শিল্পীদের সাজঘর হিসেবে ব্যবহৃত হতো। স্থাপত্যরীতি দেখে মনে হয় থিয়েটার হলটি পরবর্তীসময়ে ইংরেজ শাসনামলে নির্মাণ করা হয়েছিল। বাড়িটির বহির্মহলের খোলা আঙিনার পূর্বপাশে একটি দোতলা ভবন ছিল। ভবনটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। ধ্বংসাবশেষের কিছু চিহ্ন এখনো বিদ্যমান।
প্রবেশদ্বার দিয়ে জমিদারবাড়িতে ঢুকে সোজা দক্ষিণ দিকে অন্দরমহল। অন্দরমহলের চারদিকে ৪টি বিশাল আকৃতির ভবন ছিল। মাঝখানে প্রশস্ত উঠান। অন্দরমহলে প্রবেশ করলেই উত্তর দিকে দোতলা ভবন। এই ভবনের দোতলায় এখনো ওঠা যায়। দক্ষিণ দিকে চারতলা ভবনটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় টিকে আছে। পশ্চিম দিকে দোতলা ভবন। পূর্ব দিকেও একটি দোতলা ভবন ও সংলগ্ন দুর্গামন্দির ছিল। পূর্ব দিকের এই ভবন ও দুর্গামন্দিরটি এখন আর নেই। অন্দরমহলের দক্ষিণ দিকের চারতলা ও পশ্চিম দিকের দোতলা ভবন দু’টি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। চারতলা ভবনটি যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। দুবলহাটি বিশাল রাজবাড়িটির বহির্মহল ও অন্দরমহলের ভবনগুলোতে মোট ৩৫০টি কক্ষ ছিল। ভবনের প্রতিটি কক্ষে একাধিক কাঠের দরজা জানালা ছিল। প্রতিটি দরজা জানালার চৌকাঠ ও পাটাতন এখন আর নেই। তিনটি ভবন কোনোভাবে কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে আছে। এখনো প্রতিদিন রাতের অন্ধকারে দুর্বৃত্তরা অরক্ষিত রাজবাড়িতে ঢুকে মেঝে ও দেয়াল খুঁড়ে ইট এবং ছাদ থেকে লোহার টানাগুলো খুলে নিয়ে যাচ্ছে। আশপাশের বাড়িগুলো লক্ষ্য করলে কিছু বাড়ির দেয়ালে রাজবাড়ির প্রাচীন ইটগুলো চোখে পড়বে। এছাড়াও রাজবাড়ির অনেক জায়গাতে বিনা বাধায় ইচ্ছেমতো বাড়িঘর দোকানপাট তুলে যে যার মতো দখল নিয়েছে ।
দুবলহাটি রাজবাড়ির উল্টো পাশে দক্ষিণ দিকে ঘাট বাঁধানো বিশাল একটি দিঘি রয়েছে। দিঘিটি একসময়ে খয়রা নদীর অংশ ছিল। খয়রা নদী ও বিলের মধ্য দিয়েই রাজবাড়িতে যাতায়াতের পথ ছিল। এখনো দুবলহাটি অঞ্চলের চারদিকে দীঘলি বিল, ঘুঁটের বিল, তালতলী বিল ও সুয়োরমারি বিলসহ বেশ কয়টি বিল দৃশ্যমান। একসময়ে বিলের বুক চিরে খয়রা নদী প্রবাহিত হতো। খয়রা নদীটি এখন আর নেই। রাজবাড়ির সামনে যে বাঁধানো ঘাট রয়েছে তার দুই পাশে দু’টি ছোটো মঠ রয়েছে। জনশ্রুতি আছে, এই মঠ দু’টিতে দু’জন সন্ন্যাসী সারাক্ষণ ধ্যান করতেন।
দুবলহাটির জমিদারেরা প্রজাদের পানীয় জলের জন্য অনেক দিঘি খনন করেন। রাজবাড়ির আশেপাশে এখনো ১৬টি দিঘি দৃশ্যমান। উল্লেখ্য যে, রাজবাড়ির অন্দরমহলের পূর্বপাশে নারীদের ব্যবহারের জন্য একটি দেয়ালঘেরা দিঘিও ছিল।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারতবর্ষ বিভক্তির পর হিন্দু জমিদারেরা ভারতে চলে গেলেও দুবলহাটির জমিদার ক্রীঙ্কাতিনাথ রায় চৌধুরী সপরিবারে দেশে থেকে যান। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে জমিদারিপ্রথা বিলুপ্তির আগে পর্যন্ত তিনি জমিদারি করেন। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দুবলহাটিতে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দুবলহাটি রাজবাড়িটি দখলে নেয় এবং জমিদার ক্রীঙ্কাতিনাথ রায় চৌধুরীর ছেলে সমরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরীসহ কয়েকজনকে হত্যা করে। ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় পরিবারের অধিকাংশ ভারতের কলকাতায় চলে গেলেও শ্রী রবীন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী থেকে যান। তিনি ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দের স্থানীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে দুবলহাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। এখন তিনি নওগাঁ শহরের একটি ভাড়া বাসায় একাকী বাস করছেন।
হিন্দু জমিদারদের ফেলে যাওয়া বাড়িগুলোকে পাকিস্তান সরকার ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে শত্রু-সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত হলে মালিকানা ফিরে পেতে রাজবংশের উত্তরসূরী শ্রী রবীন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী মামলা করেন।
প্রায় তিনশো বছর প্রাচীন নওগাঁ জেলায় দুবলহাটি রাজবাড়ির ভবনগুলোর স্থাপত্যরীতিতে মিশ্রকলা লক্ষ্য করা যায়। প্রথমদিকে দেশীয় স্থাপত্যরীতি অনুসরণ করা হলেও শেষের দিকে ইংরেজ শাসনামলে ইউরোপীয় রীতি অনুসরণ করা হয়েছে। নির্মাণ কাজে লাল ইট, চুন, সুরকি, গাব ও সুপারির কষ ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়াও লোহা ও সেগুন কাঠের ব্যবহারও লক্ষ্য করা যায়।
বর্তমানে দুবলহাটি রাজবাড়িটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। যেকোনো সময়ে ভবনগুলো ভেঙে পড়তে পারে। দুবলহাটি রাজবাড়িটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শন। সংস্কার করলে গড়ে উঠতে পারে দর্শনীয় পর্যটনকেন্দ্র এবং রক্ষা পেতে পারে মূল্যবান একটি প্রাচীন নিদর্শন।
লেখক : গবেষক, লেখক ও টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাতা