ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

15 Jul 2024, 03:05 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন  -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


নেদারল্যান্ড থেকে ফিরে এসে দুটো অলস দিন কাটানোর পরপরই আমি আবার স্পেন আর পর্তুগাল ভ্রমণের পরিকল্পনায় লেগে গেলাম। আসলে আমার এক বন্ধু যে কিনা তখন ঝঃৎবহমঃযবহ প্রজেক্টের আওতায় ইংলান্ডের স্কটল্যান্ডে মাস্টার্স করছিল, সেময় তাদের ছুটি থাকায় বন্ধুদের নিয়ে একটি গ্রুপ ট্যুরে বেশ কিছু দেশ ভ্রমণে ছিল। মূলত তাদের সাথে সময় মিল করে আমি স্পেন আর পর্তুগালের টিকেট কেটে নিলাম। এদিকে আমার ভাতিজাও বলছিল আমরা কোথাও বেড়াতে যাব, যাব যাব করে দিনও ফুরাচ্ছিল, তাই হঠাৎই সে [ভাতিজা ইরফান] ‘উঠ ছুড়ি তোর বিয়ের মতো’ বলে উঠল, তাসলিমা ‘ফুনি’ চলেন ঘুরে আসি। কোথায় যাওয়া যায়, কীভাবে যাওয়া যায় এ রকম কোনো পূর্ব-প্রস্তুতি ছিল না। তৎক্ষণাৎ আমরা ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়লাম, ইরফানই আসলে মূল পরিকল্পনাকারী, এবারে আমরা ব্যাকপ্যাক ট্যুর করব। পরদিনই যাত্রা শুরু, প্রথমে বেলজিয়াম এরপর সেখান থেকে জার্মানি, আপাতত এটুকুই প্ল্যান।

পরদিন যথাসময়ে আমি বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে গেলাম, তখনো ইরফানের খবর নেই, আমার কাজিন আমাকে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দিতে এসে সে ইরফানকে না দেখে মহাচিন্তিত, এদিকে আবার তাকে ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না। কাজিনের কথায় আমিও চিন্তিত হয়ে পড়লাম, তার ধারণা ইরফান হয়ত এখনো ঘুমুচ্ছে। শীতের সকাল, বেলা সাড়ে সাত বাজে কিন্তু মনে হচ্ছে যেন নিশুতি রাত। আমি আর আমার কাজিন পায়চারী করছি। হাতে সময়ও বেশি নেই, ঘড়ির কাঁটা বলছে আর মিনিট দশেকের মধ্যেই বাস ছেড়ে যাবে। কিন্তু কী আর করা। ইলাভেন্থ আওয়ারে ইরফান হন্তদন্ত হয়ে বাস স্টপে হাজির, এরপর সবুজভাই [কাজিন] আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। আমরাও বাসে চড়ে বসি।

এই প্রথম লং রোডে দোতলা বাসে ভ্রমণ করছি, যাত্রার আগে ভেবেছিলাম বাস জার্নি না জানি কেমন হয়, অবশ্য এর পেছনে কারণও ছিল, আমরা ফ্রান্স থেকে বেলজিয়াম যাচ্ছি অথচ বাস ভাড়া মাত্র ১০ টাকা [১০ ইউরো]। এতো অল্প টাকায় এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাচ্ছি ভাবতেই অবাক লাগে, না ! বাসে উঠে আমরা অনেক খালি সিট থেকে নিজেদের পছন্দমতো সিট বেছে নিলাম। আস্তে আস্তে দিনের আলো ফুটছে আমরা যেতে যেতে ভোর থেকে সকাল হওয়া দেখলাম। সকালে সূর্যের প্রথম আলো যখন পৃথিবীতে পড়ে তখন পৃথিবীকে খুব নিস্পাপ মনে হয়। শহর বা গ্রাম এখানে কোনো ভেদাভেদ করে না। ভোর সব সময়ই সুন্দর আর নির্মল। যেতে যেতে আমরা প্রকৃতির নির্মলতাকে উপভোগ করছিলাম। ইরফান এর মধ্যে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিল। একে তো খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হয়েছে তার ওপর এই দৃশ্য তার এত চেনা যে, তার আগ্রহের মাত্রা কম থাকাই স্বাভাবিক। ইরফান নিজেও খুব ট্রাভেল করতে পছন্দ করে, সুযোগ পেলেই সে এখানে সেখানে ছুট দেয়। জার্নিতে আমি কখনোই ঘুমুতে পারি না, রাতের বেলার যাত্রা পথও আমার নির্ঘুম কাটে, আর এর এখন তো সকাল। তবে, এটা আমি খুব উপভোগ করি। পথ, মানুষ, প্রকৃতি দেখতে দেখতে লম্বা একটা সময় কাটিয়ে দেওয়ার সাথে সঞ্চিত হয় ভাবনার খোরাক, জানা হয় অনেক কিছু।

প্যারিস থেকে ব্্রাসেলসের দূরত্ব¡ বাসে তিন ঘণ্টা ত্রিশ মিনিট। আমরা প্রায় ঠিক সময়ের মধ্যেই বেলজিয়ামে পৌঁছে গেলাম। বেলজিয়ামে আমাদের এবারে ট্যুরটি বেশ মজার, আমরা বেশিরভাগ সময় পায়ে হেঁটে বেড়িয়েছি, মাঝে-সাঝে ট্রাম বা বাসে উঠেছি। সেদিন প্রায় সারাবেলাই থেমে থেমে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল। তবে, তা কোনোভাবেই আমাদের পায়ে চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। ইরফানের সাথে বেড়াতে এসে আরেকটা বিষয় জানা হলো, বলা যায় শেখা হলো, সে বাস বা ট্রেন অথবা প্লেন যাই হোক-না-কেন নেমেই প্রথমে কাছাকাছি কোনো একটা কফিশপে ঢুকে সেখান থেকে শহরের একটা ব্রোশিউর নেয়, আগে খেয়াল করিনি এখন জানলাম এবং এরপর থেকে খেয়ালও করলাম যে, প্রায় অধিকাংশ মাঝারি মানের কফিশপেই এ ধরনের ব্রোশিউর থাকে, অথবা স্টেশন বা টার্মিনাল থেকেও এটা সংগ্রহ করা যায়। যা বলছিলাম, কফির পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে সে ব্রোশিউরটি ভালোভাবে পড়ে নেয়, তারপর হাঁটতে শুরু করে। বিষয়টা বেশ ইন্টারেন্টিং, কাজেরও বটে।

এবারে ভ্রমণ পরিকল্পনায় আমি কোনোরকম ভূমিকাই রখিনি, কোনোধরনের প্রভাবও রাখতে চাইনি, ভাতিজা যেভাবে প্ল্যান করেছে আমি সেইমতো তার পরিকল্পনার অংশ হয়ে গেছি। এটাও একটা মজার অভিজ্ঞতা, যারা আমাদের হাত ধরে হাঁটতে শিখেছে এখন আমরাই তাদের হাত ধরে হাঁটছি। বেলজিয়ামের বাস স্টপটি দেখে আমার নিজ দেশের কথা মনে পড়ে গেল, বেশ কিছু ভবঘুরে এখানে সেখানে বিছানা পেতে শুয়ে আছে, উইরোপে এসে এ ধরনের দৃশ্যের সাথে পরিচয় এটাই প্রথম। বাস স্টপ থেকে বের হয়ে আমি আর ইরফান প্রথমেই একটা কফিশপ কাম রেস্টোরেন্টে ঢুকলাম, খুব সকালে বের হয়েছি, ক্ষিদে তো লেগেছেই তাই হালকা কিছু খেয়ে তারপর কফি পান করতে করতে পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে নিলাম। কফিশপ থেকে বেরিয়ে প্রথমে মেট্রোতে চড়ে আমরা শহরের ইনফ্রান্টি মেমোরিয়াল অ্যান্ড জাস্টিজ প্যালেস [ওহভধহঃৎু গবসড়ৎরধষ ধহফ ঔঁংঃরপব চধষধপব]-এর সামনে চলে গেলামÑ বৃষ্টি¯œাত পুরো চত্বরটি বেশ চমৎকার, নিরিবিলি এই জায়গাটিতে বেশ কিছুক্ষণ সময় থেকে গল্প করতে করতে এগুতে থাকলাম, এরপর মোটামুটি পুরোটা সময়ই আমরা হেঁটে চলেছি। আমাদের গন্তব্য নির্ধারিত ছিল না, বরং চলতি পথে কোথাও থামতে ইচ্ছে হলে আমরা থামছিলাম অথবা জিরোতে ইচ্ছে হলে জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। যেমন যেতে যেতে আমরা স্কয়ার ডি মিউজ [ঝয়ঁধৎব উব গববঁং]-এ এসে থামলাম এটি ব্রাসেলসের সিটি পার্ক, যেখানে প্রকৃতির বর্ণিল রঙের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে নানান আকৃতির ভাষ্কর্য। যদিও এখন ইউরোপে পুরাদস্তুর শীত, কিন্তু বেলজিয়ামে যেন শরৎ এখনো থমকে আছে। ঝরা পাতার গালিচায় পা ফেলে আমরা আরো খানিকটা পথ এগিয়ে গেলাম। শহরের এদিকটা আবার বেশ ঝা চকচকে, হাঁটতে হাঁটতে আমরা বিশাল এক ভবনের সামনে এসে থামলাম, যার স্থাপত্যশৈলী নজরকাড়া এবং নান্দনিক। সামনে ইউরোপের প্রায় সব দেশের পতাকা উড়ছে, প্রথমে ভেবেছিলাম বুঝি দেশের প্রথম সারির কোনো হোটেল অথবা কোনো কনসুলেট ভবন, না পড়ে জানলাম এটা ইউরোপীয় পার্লামেন্ট এর সদর দপ্তর। খুব অবাক হলাম এখানে প্রবেশে কোনো বাধা না পেয়ে। আমরা এর উন্মুক্ত চত্বরে ঢুকে পড়লাম, না ভেতরে যাইনি, কেননা কোনো প্রয়োজন ছিল না তো, বাইরে থেকে দেখে নিয়ে দু’একটা ছবি তুলে আবার হাঁটতে শুরু করলাম।

সেই সকাল থেকে চলছি তো চলছি, দুপুর পার হতে চলল,ঘড়িতে সময় বেলা তিনটে, ক্লান্ত হইনি কিন্তু ক্ষিদেকে আর উপেক্ষা করা যাচ্ছে না, তাই এখন গন্তব্য কোনো খাবারের দোকান, ইউরোপের মোটামুটি সব জায়গায় হালাল খাবারের দোকানগুলো একটু খুঁজেপেতেই নিতে হয়, নতুনদের জন্য ক্ষেত্রবিশেষে এটা বেশ ঝক্কির কাজ হয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু ইরফানের কাছে এগুলো অনেকটা হাতের তালুর মতো চেনা। আমরা একটা তার্কিশ দোকনে চলে গেলাম, খাবারের অর্ডার করে ফ্রেস হয়ে খাবারের জন্য আপেক্ষা করতে করতে পরর্বতী কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে নিচ্ছিলাম। আসলে তখনো পর্যন্ত আমি জানি না যে, আমরা জার্মানিতে কীভাবে যাব, ইরফান বলেছিল যে, আমরা রাইড শেয়ার করব, আমি ভেবেছিলাম সম্ভবত উবার টাইপ কিছু হবে। পরে জানালাম না এটা আক্ষরিক অর্থেই রাইড শেয়ার, আমরা এমন এক জায়গায় অপেক্ষা করব যেখান থেকে কেউ আমাদের তার রাইডের অংশ করে নেবে। বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করার দরকার আছেÑ আমার যার গাড়িতে যাব, তিনি ইংল্যান্ড থেকে জাহাজে এসে এখানকার কোনো বন্দরে নেমেছেন, যার গাড়ি সেই বন্দরে আছে, সেখান থেকে তিনি ড্রাইভ করে জার্মানিতে যাবেন তার প্রেমিকার সাথে ইউকএন্ড কাটাতে, তিনি বেলজিয়াম হয়ে যাবেন, আমরা এখানকার কোনো এক জায়গা থেকে তার সঙ্গী হব, বিনিময়ে আমরা তাকে কিছু টাকা দেব [খরচ শেয়ার করব]। আর এই পুরো বিষয়টি নির্ধারিত হয় একটি অ্যাপস-এর মাধ্যমে যা ‘ব্লাব্লা’ নামে পরিচিত।  [চলবে]