মাঝখানে শূন্য বয়ে যায় -মনি হায়দার

17 Apr 2024, 02:08 PM গল্প শেয়ার:
মাঝখানে শূন্য বয়ে যায় -মনি হায়দার


বিশ্বাস করুণ, একমুহূর্তের জন্যও আপনার অমর্যাদা করবো না, আমার সকল অনুরাগ একত্র করে আপনাকে ভালোবাসবো, সুখি করবো... সোনালি এ´প্রেস ব্যাংক পিএলসির ডিএমডি মিস জুলেখা জুঁই হাত ধরে অফিসের চতুর্থ গ্রেডের কর্মী শোভন রায়হানের প্রবল আকুতির সঙ্গে।

শোভন রায়হানের শরীরের সকল শক্তি বোধ বুদ্ধি হারিয়ে গেছে। বসে আছে অনিন্দ্য সুন্দরী জুলেখা জুঁইয়ের সামনে, খুব কাছাকাছি। জুলেখা জুঁই সাধারণত শাড়ি পরেন না কিন্তু আজ পরেছেন। শরীরের রং হালকা সাদা কিন্তু লাল রক্তাভ। মাথার উপর থেকে একরাশ বব কালোজামের চুল ঘাড়ের উপর পড়েছে। সবুজ কালারের জমিনে লাল পাড়ের শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে পরেছে ব্লাউজ। ব্লাউজের বিপরীত রংয়ের ব্রা শরীরের কোমল সুন্দরকে প্রকাশ করছে সুন্দরের ছন্দে। কানে সবুজ রংয়ের গোল দুটি ঝুমকো দুলছে থির থির...। চোখ দুটি প্রজাপতির পাখনায় পিটপিট করছে টলোমলো আনন্দে।

সাত বছর আগে শোভন রায়হান সোনালি এক্সপ্রেস ব্যাংকে এসএসসি পরীক্ষার পর ঢুকেছিল পিওন হিসেবে। সমাজে বেঁচে থাকতে হলে পড়াশোনা দরকার, বুঝতে পেরেছিল শুরুতেই। গ্রামে পিতা কৃষক। নিজেদের জমি খুবই কম। নিজের একবিঘা জমির সঙ্গে অন্যের জমি বরগা চাষ করে সাহেব আলী সংসার চালান। দু’টি মেয়ে দু’টি ছেলে সংসারে। শোভন বড়ো সন্তান। সাহেব আলী শত অভাবের মধ্যে চাইতেন ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করুক। সেই সূত্রে শোভন খেয়ে-না-খেয়ে স্থানীয় উজানগাঁও হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে দূর সম্পর্কের এক মামার সূত্রে ঢাকায় আসে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে চাকরির আবেদন করে এবং সফল শোভন। পিওনের চাকরিটা মন দিয়ে করতে শুরু করে। সকাল ন’টায় অফিস শুরু হয়ে কখনো কখনো বড়ো স্যারদের জন্য রাত ন’টা পর্যন্তও থাকতে হয়েছে। থেকেছে এবং নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করায় অফিসে একটা অবস্থান তৈরি করে নিতে সময় লাগেনি। মেসে গিয়ে রাতে পড়াশোনা করেছে। দু’বছর পর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ প্রমোশন দিয়ে ডেক্সে বসায়। বেতনও বাড়ে। বাড়িতে নিয়মিত বাবাকে টাকা পাঠায়। সাহেব আলী আরো গোরু কিনেছেন। কয়েক কাঠা জমি কবলা করে আয় বাড়িয়েছেন। সাহেব আলীর সংসারে ধীরে ধীরে সুখের ডানা মেলতে শুরু করে পুত্র শোভনের কল্যাণে। পরের দু’বছর পর শোভন রায়হান ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে যায়। কর্তৃপক্ষ শোভনের সাধনায় মুগ্ধ। ওকে প্রমোশন দিয়ে ডিএমডি জুলেখা জুঁইয়ের ব্যক্তিগত সহকারী পদে নিয়োগ দেয়।

নিজের প্রতি পাভেল রায়হান খুবই কৃতজ্ঞ। বলা যায়, আজ যেখানে এসে পৌঁছেছে, সেই পৌঁছানোর পেছনে নিজের লড়াই, সাধনা আর একাগ্রতার কোনো তুলনা নেই। মেসের বন্ধুরা যখন সিনেমা হলে, কিংবা স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলায় তুমুল আনন্দমুখর সময় কাটাচ্ছে, সেই সময়ে রুমের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে পড়েছে শোভন। প্রতিজ্ঞা ছিল, পিতাকে মুক্তি দেবে, নিজেও মুক্তি গ্রহণ করবে।

চমৎকার সময় যাচ্ছে শোভন রায়হানের। খুবই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ জুলেখা জুঁই। সবকিছু আপডেট চান, নিখুঁত থাকতে পছন্দ করেন। আবার ব্যক্তিগত কোনো সমস্যা হলে খুব মানবিক জায়গা থেকে অনুভব করার চেষ্টা করেন। এ তো মাস তিনেক আগে শোভনের মা ও বাবা ঢাকায় এসেছিলেন, প্রথমত বেড়াতে। দ্বিতীয়ত সামান্য চিকিৎসার জন্য। তৃতীয়ত ছেলে এখন রাজপুত্র, টুকটুকে একটা বৌ দরকার- সে বিষয়ে কথা বলতে চান পুত্রর সঙ্গে। ডিএমডিকে বলতেই বিনাবাক্যব্যয়ে তিন দিনের ছুটি দিয়ে দিলেন। এমন বসের সঙ্গে কাজ করেও আনন্দ আছে। অফিসে জুলেখা জুঁইয়ের বিশাল রুমের পাশেই ছোটো রুম শোভনের। খুবই সাজানো। মাঝে মধ্যে দুপুরের খাবার একসঙ্গেই খান জুলেখা জুঁই। নিজেই ডাকেন, এসো আমরা একসঙ্গে খাই।

যদিও ডিএমডির সঙ্গে খানা খাওয়ায় একধরনের আনন্দ আছে কিন্তু ভয়ও আছে। ভয় এবং আনন্দ নিয়ে দুটো বছর কাটিয়ে দেয় শোভন রায়হান সোনালি এক্স্রপেস ব্যাংক পিএলসির ডিএমডির সঙ্গে। কিন্তু গতকালই বিকেলের দিকে জুঁই ডাকলেন রুমে। সামনে দাঁড়াইতেই বললেন, বসো।

সামনের চেয়ারে বসলেও জুলেখা জুঁই হাতের কাগজ দেখছেন, সই করছেন, কম্পিউটারে মেইল চেক করছেন। এরকম তো করেন না ডিএমডি। রুমে ঢুকলেই চটপট আদেশ দেন, ওটা করো, ওটা করো। ফাইল নিয়ে যাও। এই ফাইল দিয়ে দাও এমডির ডেক্সে। কিন্তু এখন....

কম্পিউটারে মেইল চেক করতে করতে তাকান শোভনের দিকে, ম্যাম ডেকেছিলেন আমাকে!

চেয়ারে রাখলেন শরীর জুলেখা জুঁই, ডেকেছিলাম ?

মাথা ঝাকায় শোভন, জি ম্যাম।

আগামীকাল সন্ধ্যার পরে আপনার কোনো কাজ আছে ?

একমুহূর্ত চিন্তা করে শোভন, না ম্যাম। কোনো কাজ নেই আমার।

গুড। ড্রয়ার খুলে একটা কার্ড বের করে বাড়িয়ে ধরে, এটা একটা রেস্টুরেন্ট। ধানমন্ডির শেখ কামাল রোডের মাঝ বরাবর। দশ তলা বিল্ডিংয়ের ছয় তলায়। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ চলে আসবে।

ম্যাম, কোনো অনুষ্ঠান ?

হাসেন ডিএমডি জুলেখা জুঁই মিষ্টি করে লাল লিপস্টিক চর্চিত দুই ঠোঁট ফাঁক করে, না না, কোনো অনুষ্ঠান নয়। আসলে বুঝতে পারবে।

কিন্তু শেখ কামাল রোড !

ধানমন্ডির সাতাশ নাম্বার রোডটার নামই শেখ কামাল রোড।

দাঁড়ায় শোভন রায়হান, জানে কাজ শেষ হয়ে যাবার পর একমুহূর্তও থাকা উচিৎ নয় বসের সামনে, আমি ম্যাম ?

ওকে! প্রশ্রয়ের হাসি ডিএমডি জুলেখা জুঁইয়ের মুখে। রুমের বাইরে এসে নিজের রুমে ঢোকে শোভন। বসে নিজের চেয়ারে। কেন এই তিলোত্তমা রেস্টুরেন্টে ডেকেছেন ম্যাম ? নিজের মনে চিন্তা করে শোভন কিন্তু কোনো ক্লু আবিষ্কার করতে সমর্থ হয় না। মনে মনে হাসে, উঁচুতলার মানুষদের নানা ধরনের উদ্ভট পরিকল্পনা থাকে, অফিসের বড়ো বড়ো স্যারদের সহকারীদের কাছ থেকে জেনেছে।

পরের দিন যথাসময়ের দশ মিনিট আগেই উপস্থিত হয় শোভন রায়হান হোটেল তিলোত্তমায়। পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে প্যান্ট শার্ট জুতো পরেছে। লম্বা একহারা গড়নের শোভন রায়হানকে সুপুরুষ মনে হয়। কিন্তু শোভনের আগেই হাজির জুঁই। শোভন বুঝতে পারে, আমার জন্য ম্যাম অপেক্ষা করছেন। ইতোমধ্যে রেস্টুরেন্টে লোকজন আসতে শুরু করেছে। ওকে দেখে এগিয়ে আসেন জুলেখা জুঁই, তুমি এসেছো ?

জি ম্যাম, শোভন আসায় জুঁই ম্যাম কেন এত আনন্দমুখর, বুঝতে পারে না শোভন রায়হান।

চলো, কর্নারের ওই টেবিলটায় বসি।

জুঁই ম্যামের পেছনে পেছনে কয়েকটা টেবিল পার হয়ে লেকের ধার ঘেষে একটা টেবিলে বসেন জুলেখা জুঁই। সামনে বসে শোভন। জুলেখা জুঁই শাড়ি পরেছেন। অথচ অফিসে কখনোই শাড়ি পরেন না। সালোয়ার- কামিজই তিনি পরিধান করেন। চোখে দিয়েছেন কাজল। ঠোঁটে লাল লিপিস্টিক। দারুণ লাগছে কিন্তু সরাসরি তাকাতে লজ্জা পাচ্ছে শোভন।

টেবিলে রাখা শোভনের ডান হাত হঠাৎ স্পর্শ করেন জুঁই ম্যাম, তোমাকে নার্ভাস লাগছে কেন ? আমি কী বাঘ, তোমাকে খেয়ে ফেলবো ? ইজি হয়ে বসো।

বসছি তো ম্যাম ! এদিক ওদিক তাকিয়ে প্রশ্ন করে শোভন, ম্যাম আর কেউ নেই আপনার অতিথি ?

হাসেন জুলেখা, আজকে তুমিই আমার অতিথি।

অবিশ্বাস্য লাগে শোভন রায়হানের, আমি আপনার অতিথি ?

হ্যাঁ, তুমিই আমার আজকের অতিথি, মিষ্টি হাসেন জুঁই।

শোভনের মাথায় ধরছে না, আজকের এই মুহূর্তের দৃশ্য। এই দৃশ্য বাস্তব ? ঘটছে আমার জীবনে ? আমার বস বিশিষ্ট সুন্দরী, ঢাকা শহরের কয়েকটা ফ্ল্যাটের মালিক, সোনালি এ´প্রেস ব্যাংকের ডিএমডির অতিথি আমি ? নিশ্চয়ই আমি কোনো অপরাধ করেছি...

শোভন ! কোমলকণ্ঠে ডাকেন জুলেখা জুঁই।

জি ম্যাম !

ম্যাম ম্যাম করছো কেন ? এটা তো অফিস না। এখানে এসেছি তোমার সঙ্গে গল্প করতে। তুমিই তো জানো, আমার কোনো বন্ধু নেই। আমি একা একজন মানুষ।

কিন্তু আমি তো আপনার বন্ধু না ম্যা...

ঠিক আছে, আমরা একে অপরের বন্ধু না, কিন্তু বন্ধু হতে কতোক্ষণ, তিনি শোভনের ডান হাতটাকে আরও কোমলে জড়িয়ে ধরেন, শোনো তোমার সঙ্গে এই মুহূর্তটা তৈরি করবার জন্য আমি একবছর ধরে মনে মনে প্রস্তুতি নিয়েছি। কতভাবে মনে মনে তোমার সঙ্গে গল্প করেছি, কথা বলেছি, তুমি জানো না।

শোভন চিনতে পারছে না, সামনে হাত ধরে বসে থাকা এই অনিন্দ্য সুন্দরীকে। সোনালি এক্সপ্রেস ব্যাংক পিএলসির ডিএমডি জুলেখা জুঁই কী সত্যি আমার সামনে ? আমার ডান হাত ধরে আছেন কোমলের মোহনীয়তায় ? কিন্তু কেন ?

ম্যাম!

শোনো শোভন, একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করেন জুঁই, আমি বড়ো অভাগা একজন মানুষ। তুমি বা চারপাশের লোকেরা দেখে আমার কত শান শওকত ক্ষমতা প্রভাব প্রতিপত্তি, ভাবে আমি সুখের স্রোতে ভেসে চলা এক নারী। কিন্তু আমি নিঃস্ব এক মানুষ। কেউ নেই আমার। ইউনিভার্সিটিতে পড়বার সময়ে মেধাবী ক্লাসমেট মাহজার মুকুলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক তৈরি হয়। আমরা দু’জনে এক সঙ্গে থাকি, আডডা দিই, গল্প করি, ক্লাশ করি। সুখে, দারুণ সুখে সময় কেটে যায়। দু’জনেই পড়ি অর্থনীতিতে। ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করেই ঢুকে গেলাম একটা প্রাইভেট কলেজে। মুকুল দুই বছরের একটা স্কলারশিপ নিয়ে চলে গেল অস্ট্রেলিয়ায়। দুই পরিবারে কথা হলো, একবছর পর একমাসের ছুটি পাবে, সেই সময়ে দেশে এসে বিয়ে করে নিয়ে যাবে আমাকে। কিন্তু মুকুল আর কোনোদিন আসেনি। জেনেছি, অস্ট্রিলিয়ার এক মেয়েকে বিয়ে করে সেখানেই সেটেল্ড। না, আমি কাঁদিনি, কিন্তু শোভন, অসম্ভব কষ্ট পেয়েছি। একা একা কষ্ট কাটিয়ে ওঠার পর অনুভব করলাম, তীব্র অপমান। আমাদের বন্ধুরা পরিচিতজনেরা দূর থেকে অকারণে শ্লেষের তীর ছুড়তে থাকে। বাবা, তুমি জানো শোভন, ছিলেন সরকারের বড়ো আমলা। দাদার আমলেই ঢাকার ধানম-িতে আমাদের বিশাল জায়গা। কোনোদিন অভাব কি বুঝিনি অর্থ ও প্রাচুর্যের। কিন্তু ...

সামনে এসে দাঁড়ায় ওয়েটার।

নিজেকে সামলে নিয়ে তাকান শোভন রায়হানের দিকে, কী খাবে ?

ম্যাম আমি তেমন কিছু খাবো না।

কেন ?

এমনিই। ইচ্ছে করছে না।

সেটা কী হয় ? তুমি আমার প্রিয় মেহমান। আমন্ত্রণ করে এনেছি, না খেলে আমি কষ্ট পাবো।

ঠিক আছে, বার্গার আর কোল ড্রিংকস দিন, ওয়েটারকে বলে শোভন।

ওকে স্যার, ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে যায়।

শোভন রায়হানের ডিএমডি সৌন্দর্যের কুসুম জুলেখা জুঁই কাঁদছেন ! জীবনে অনেক নাটক দেখেছে শোভন, অনেক গল্প উপন্যাস পড়েছে কিন্তু আজ নিজেই উপন্যাসের একটা অধ্যায়ের সাক্ষী হতে চলেছে। কী করবে, কী বলবে, বুঝে উঠতে পাছে না ও। ভাবছে, ম্যাম আরো কিছু বলবেন আমাকে ? কী বলবেন ? আমি কী ম্যামকে রেখে চলে যাবো ? পরিচিত কেউ যদি দেখে ফেলে ? বিশেষ করে অফিসের কেউ দেখলে... সামনে এক অনিন্দ্য সুন্দরীকে রেখে শোভন রায়হান চাকরির জন্য প্রার্থনা করছে। সব ধ্বংস হোক কিন্তু চাকরি...

শোভন! মা মারা গেছেন আট বছর আগে, বাবা একলা এখন। বয়স হয়েছে, হাঁটতে পারেন না। সারাদিন রুমে থাকেন। বাবাকে দেখে, আমি ভয় পাচ্ছি। অনেক বিয়ের প্রস্তাব এসেছে, মন্ত্রীর ছেলে, রাষ্ট্রদূত, দেশের বিশাল ব্যবসায়ীর ছেলে, ব্যবসায়ী এসেছে কিন্তু আমি ফিরিয়ে দিয়েছি। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, জীবনে বিয়ে করবো না। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছি। একলা জীবনকে আমি ভীষণ ভয় পাই।

ম্যাম, কাকে বিয়ে করবেন ?

তোমাকে, জুয়েখা জুঁই দুহাতে আকড়ে ধনের শোভনের দুই হাত, আমি তোমাকে কখনো ছোটো করবো না। অপমান করবো না। শুধু তুমি গত দুই বছরে যেভাবে অফিসের নানা ঝড় ঝাপটা থেকে সামলে নিয়েছো, অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তুমিই আমার উপযুক্ত স্বামী, মুখের দিকে আকুতি ভরা দৃষ্টি রাখেন জুলেকা জুঁই, আমাকে ফিরিয়ে দিও না শোভন।

আ আ আমি কী বলবো, বুঝতে পারছি না ম্যাম!

আমি তোমার জুলেখা, আমি তোমার জুঁই, ম্যাম না। আমি তোমাকে আমার মতো আগলে রাখবো। তোমার যাতে অমর্যাদা না হয়, আমি...

মরিয়া হয়ে বলে শোভন রায়হান, এটা হয় না ম্যাম!

কেন ?

আমার চেয়ে আপনার বদনাম হবে অনেক বেশি। অফিসে বিশ্রী তিক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হবে আপনার জন্য।

আমি সব ভেবেছি, ভেবেই তোমাকে বিয়ে করতে চাই। যদি বলো তোমার বাবা মায়ের কাছে যেতে হবে, আমি যাবো। ওনারা আমার মুরুব্বি, আমি পায়ে ধরে তোমাকে চাইবো।

কিন্তু আমাকে নির্বাচন করলেন কেন আপনি ? বিস্ময়ে কেঁপে ওঠে শোভন রায়হান ? কেন আমাকে...

তুমিই তোমার শ্রম নিষ্ঠা আর মর্যাদায় আমাকে জয় করেছো শোভন। বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আমি অনেক খুঁজেছি, হঠাৎই একদিন মনে হলো, তুমি হতে পারো আমার যোগ্য পাত্র। যেদিন আমি অফিসে অসুস্থ হয়েছিলাম, তুমি কী যতœটা যে করলে, হাসপাতালে নিয়ে গেলে, আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে ভর্তি করালে, দুই দিন হাসপাতালে প্রায় সর্বক্ষণ আমাকে পাহারায় রাখলে, আমি সেদিনই সিদ্ধান্তি নিয়েছি... তুমিই আমার যোগ্য পাত্র। তুমি আমার বন্ধু।

আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র!

সেই দায়টুকু সুচারুভাবে কে আজকাল পালন করে ? তোমার উপর অফিসের কোটি কোটি টাকায় কাজ দিয়ে আমি নির্ভার থাকতে পারি, জানি শোভন যথা সময়ে কাজটা করবে। আমি কখনো তোমার উপর রাগ করবো না, আমি তোমাকে ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখবো। তুমি ছাড়া আমার সামনে কেউ নেই, তীব্র আকুতি ঝরে জুলেখা জুঁইয়ের কণ্ঠে।

আমি আপনার অধীনে একজন কর্মচারী মাত্র। আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হলে আপনার বন্ধুরা উপহাসে অশ্রদ্ধায় বিষাক্ত করে তুলবে আপনার জীবন, মরিয়া হয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করে শোভন রায়হান।

হাসেন জুলেখা জুঁই, আমার বন্ধুদের কথা বলছো ? ওরা এক একটা মাকাল ফল। ফোনে, ইনবক্সে আমার সঙ্গে দূরে নির্জনে সময় কাটানোর প্রস্তাব করে। বুঝতে পারছো, ওরা কতোটা কীট নরকের ? আর তোমাকে বিয়ে করে একটা প্রতিশোধও নিতে চাই।

জুলেখা জুঁইয়ের কমনীয় কিন্তু নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে থাকে শোভন রায়হান, কীসের প্রতিশোধ নিতে চায় আমার ম্যাম আমাকে বিয়ে করে ?

আমি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, অষ্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাহজার মুকুলকে দেখাতে চাই, তথাকথিক শিক্ষিত মানুষদের চাইতে সাধারণ মানুষ, কম লেখাপড়া জানা মানুষ অনেক মানবিক, অনেক বেশি দায়িত্বশীল। তুমি আমার জীবনে প্রতিবাদের একটি মহাবৃক্ষ হয়ে বেঁচে থাকো। আমি তোমাকে আমার জীবনের ধ্রুব করে রাখবো শোভন! আকুল আকুতিতে ভেঙে পড়েন জুলেখা জুঁই।

সঙ্গে সঙ্গে বিশিষ্ট কৃষক সাহেব আলী আর বৈরভী খাতুনের পুত্র শোভন রায়হান সিদ্ধান্ত নেয়, আর যাই হোক- সামনে লোভনীয় জীবনের হাতছানি। সোনালি এক্সপ্রেস ব্যাংকের ডিএমডিকে বিয়ে করলে হয়ত আর্থিকভাবে ভালো থাকবো, একধরনের সাজানো গোছানো পালিশ জীবনযাপন করবো কিন্তু আমি আমাকে হারিয়ে ফেলবো। জীবনে এত লড়াই করলাম কেন ? আমার আমির জন্য তো ! আমি ম্যামের মনোবাসনার গিনিপিগ হবো না কখনোই...।

ম্যাম জুলেখা, আপনি তো আপনার চিন্তা এবং প্রকল্প আমাকে বললেন। এবং এই প্রকল্প নিয়ে আপনি অনেক দিন ভেবেছেন. আমাকেও তো আপনি ভাবনার সুযোগ দেবেন, জীবন তো ফোলানো বেলুন নয়, জীবন এক মস্ত রেলগাড়ি।

মিষ্টি হাসেন জুঁই, অবশ্যই ভাববে। বিয়ে তো ছেলেখেলা নয়, সারা জীবনের সিদ্ধান্ত। কিন্তু আমি জানি, আজকের এই সময়ের পর আমাকে ছাড়া তুমি বিকল্প কিছুই ভাবতে পারবে না।

হাসে শোভন, দেখা যাক ম্যাম, ভাবনার ফল কী আসে। উঠুন, অনেক রাত হয়েছে, প্রায় সাড়ে নটা। চলুন, আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।

হাসেন জুঁই, দেখো তুমিই তোমার দায়িত্ব তুলে নিয়েছো।

চলুন বাসায়, দুজনে ধানমন্ডির তিলোত্তমা রেস্টুরেন্টের লিফট বেয়ে নিচে নেমে আসে। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে এসে দরজা খুলে দাঁড়ালে, জুলেখা জুঁই গাড়িতে ওঠার আগে গভীর আয়াত চোখের সকল প্রেম আর অনুরাগে তাকান শোভন রায়হানের দিকে, আসি!

জি ম্যাম ! গাড়ির দরজা বন্ধ করে দেয় শোভন রায়হান।

কালো রঙের বিশাল মার্সিডিস গাড়িটি রেস্টুরেন্টের পার্কিং এরিয়া থেকে বের হয়ে প্রধান সড়কে পড়বার সঙ্গে সঙ্গে শোভন রায়হান, সোনালি এক্সপ্রেস ব্যাংকের ডিএমডির অফিস সহকারী শরীর দুলিয়ে আকাশ বাতাস মাটি প্রকম্পিত করে বিকট হাসিতে ফেটে পড়ে। চারপাশের লোকজন ওকে হাসতে দেখে বিস্ময়ে বিপন্নবোধে আক্রান্ত হতে থাকে।

যেতে যেতে কেউ একজন মন্তব্য করে, আহারে লোকটা বুঝি পাগল হয়ে গেল!

অলঙ্করণ : মনিরুজ্জামান পলাশ