কালী : রুধির পিয়াসী নারী -কাজী দিশু

17 Apr 2024, 02:04 PM গল্প শেয়ার:
কালী : রুধির পিয়াসী নারী -কাজী দিশু


আমি জানি কখন, কীভাবে সেই ভয়ঙ্কর স্বপ্নের সূচনা হয়েছিল। আমি জানি সেই দুঃস্বপ্নের অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ। বিরামহীন সেই স্বপ্ন। বিনা দ্বিধায় মেনে নেওয়া ছাড়া আর গত্যন্তর নেই, বাধ্য হয়েই আমাকে তাই বশ্যতা স্বীকার করে নিতে হয়েছে। যতদিন বাঁচবো ভয়াবহ স্মৃতি আমার সঙ্গী। কিন্তু অস্বাভাবিকতাকে আমি কখনোই মেনে নিতে পারছি না।

রক্ত আমায় উষ্ণতা এনে দেয়, ব্যবহার করা ছুরিটার শাণিত অংশ আমার মাঝে মুক্তির উল্লাস জাগায় আর মৃত্যুকে মনে হয় সুখের। কী আশ্চর্য ! যা কিছু ভয়ংকর, আমায় তা আনন্দ দেয়। কোনোদিন আমি রক্তপাত সইতে পারতাম না, - জীবজন্তু বড়ো বেশি ভালোবাসতাম, আমি একজন শান্তশিষ্ট ভদ্রলোক, শিশুদের শিক্ষক- হ্যাঁ আমি প্রতিজ্ঞা করেই বলতে পারি নিজের সত্য পরিচয়ই দিয়েছি। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ, কয়েক মাস ধরে, সময় আমার কাছে অর্থহীন একটা শব্দ। সেই যে আমাকে সেই ঘন তরল পদার্থটি খাওয়ানো হয়েছিল :- হ্যাঁ সমস্ত ব্যাপারটাই যেন একটা ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মতো- এর মাঝে রয়েছে দুর্জ্ঞেয় একটা রহস্য। এই কি ভারতীয় অতীন্দ্রিয়বাদ। পাশবিকতা আর নৃশংসতা !

হাঁ, একটি মেয়ে। শান্ত, শক্তিমতী, রহস্যময়ী ভারতীয় নারী। সুন্দর আর স্বপ্নালু তার আয়ত চোখের সুনীল দৃষ্টি। একটা ফুলের মতোই সে যেন তার দেশের দুঃখ দারিদ্র্যের মাঝে ফুটে উঠেছে। আর আমাকে টেনে নিয়ে গেছে পাশবিকতা আর রক্তের ভয়াবহতার মাঝে- আমাকে সে উপহার দিয়েছে অনেকগুলো দুঃস্বপ্নের রাত ! এখন আমার মনে হয় সে যখন বলেছিল তার নাম কালী তখনই আমার সন্দেহ করা উচিত ছিল, অন্তত একটুও যদি ইতস্তত করতাম। আমি জানতাম হিন্দুদের কাছে কালী ধ্বংস আর মৃত্যুর দেবী, মাতৃত্বের প্রতীক। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমি মেয়েটির সৌন্দর্য আর নম্রতায় মুগ্ধ হয়েছিলাম, আমার মনটা সম্পূর্ণ অধিকার করেছিল সে, আর বিজয়িনী সেই নারীর নামটিও বড়ো মধুর লেগেছিল।

প্রায় ছ’মাস আগে [আগস্ট ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দ] কলকাতার এক উষ্ণ সকালে কালীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। সানফ্ল্যানসিস্কোর এক প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা করতাম আমি। ভারতবর্ষে বেড়াতে যাব বলে বেশ কয়েক মাসের ছুটি নিয়েছিলাম। আমি শৈশব থেকেই ভারতের প্রাচীনত্ব, ধর্ম, অতীন্দ্রিয়বাদ এবং সুমহান সমন্বয় ও উদাসীন ভারতবাসীর প্রতি আমার ছিল সীমাহীন আকর্ষণ। জুন মাসের এক ঝলমলে বিকেলে বিমানে আমি কলকাতায় পৌঁছালাম। আর ঠিক তার পরের দিন সকালে ওল্ড কোট হাউজ স্ট্রিটের সরকারি পর্যটন দফতরের কাছে কালীর সঙ্গে আমার দেখা হয়।

আমি সঙ্গে সঙ্গেই সে কী করে, কী তার কাজ বুঝতে পারলাম। লাইসেন্সপ্রাপ্ত নয় এমন একজন গাইড সে, আর ট্যুরিস্ট অফিসে ঢোকার আগে থাকতেই সে ভ্রমণকারীদের ধরে ফেলে এবং তাদের তদারক করতে শুরু করে। সে সরকারি আফিসের সঙ্গে যুক্ত নয়, সেজন্য আমার প্রথম থেকেই সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু রঙিন শাড়ির ঘেরাটোপে জ্বলজ্বল করছিল মেয়েটির পুরুষ্টু যৌবন। তার চুল আলকাতরার মতো কালো, দাঁতগুলো সাদা মটরদানার মতো নয়নলোভন, কফি রঙের নাতিস্থল রসাল ঠোঁট, উজ্জ্বল, উত্তেজক মদির দুটি চোখ, টসটসে টোল খাওয়া কপোল, উন্নত নাক, ধারালো চিবুক, উত্তুঙ্গ-উদ্ধত দু’টি বুক, সরু কোমর, প্রশস্ত নিতম্ব আর ভারতীয় নারীদের তুলনায় যথেষ্ট ফর্সা- এক কথায় বলতে গেলে তার- যৌবনবতীর শরীরের খাঁজে খাঁজে উষ্ণতা আর রূপের বন্যা। আমিও একজন অবিবাহিত সুশ্রী বলিষ্ঠ তরুণ, বুদ্ধিদীপ্ত যুবক- তাই আমাকে তার অপছন্দের কোনো কারণ নেই।

সে দ্রুত পায়ে শান্ত সতেজ সুস্মিত মুখে আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল- ‘সুপ্রভাত, মহাশয় ! আমি কি আপনাকে কলকাতা দেখাতে পারি ?’ শাড়ি পরা কোনো ভারতীয় যুবতীর মুখে এত স্পষ্ট, এত সুন্দর ইংরেজি উচ্চারণ শুনে অবাক হলাম।

বলা বাহুল্য দ্বিরুক্তি প্রকাশ না করে হাসতে হাসতে আমি বললাম- ‘হ্যাঁ দেখার ব্যাপারে আপনার সাহায্য পেতে চাই।’ আর দুর্ভাগ্যক্রমে এখানেই আমি ভুল করে ফেললাম।

ট্যুরিস্টদের কলকাতায় কী কী দ্রষ্টব্য তার একটা তালিকা সে তুলে ধরলো, যাতে গাইড হিসেবে তার নৈপুণ্য এবং যোগ্যতার বিষয়ে আমার কোনো সংশয় না জাগে। ‘তাছাড়া আমার পারিশ্রমিকও কম’ শ্যাসপেনের বুদবুদের মতো বর্ণালি হাসিতে তার মুখটি হয়ে উঠেছিল রমণীয়-আকর্ষণীয়।

স্বল্পক্ষণের এই পরিচয়েই আমাদের ভেতর সুন্দর একটা বোঝাপড়া হয়েছিল- আমাদের মাঝে পারস্পরিক ভালো লাগার একটা স্রোত বয়ে গিয়েছিল। অনাদিকালের হৃদয় উৎস থেকেই যেন উত্থিত হয় ভালো লাগার এই তরঙ্গ- মানব জীবনের সূচনা থেকেই নারী-পুরুষ এই প্রবাহের শিহরণ অনুভব করে। ইচ্ছে জেগেছিল রূপসী সেই নারীকে স্পর্শ করি।

পর্যটকদের আকর্ষণীয় স্থানগুলোর নাম করতে গিয়ে বারবার সে কালীমন্দিরের নাম করছিল। এটি হয়তো তার মনের মতো জায়গা। তাকে খুশি করার জন্য আমি কালীমন্দিরে যেতে রাজি হলাম। তাছাড়া বলিদানের ব্যাপারটা কাগজেই পড়েছিলাম- স্বচক্ষে সেটা দেখার ইচ্ছে ছিল আমার। যখন আমরা কথা বলতে বলতে মন্দিরের দিকে এগুচ্ছিলাম তখন যেন সে আরো বেশি সুন্দরী হয়ে উঠেছিল। পেশাদারি ছলনা ত্যাগ করে সে যেন আমার আপনজন হয়ে উঠল।

কালীর সঙ্গে দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যেই নিজেকে পরিচালিত করতাম। এই প্রথম, আমি আবেগের বশ্যতা স্বীকার করে সাংঘাতিক ভুল করে ফেললাম। ভারতীয় এক সুন্দরী যুবতীর সঙ্গে বিদেশি কোনো পুরুষকে যেতে দেখলে সকলেরই কৌতূহল জাগা স্বাভাবিক। কিন্তু ট্যুরিস্ট অফিসের এক কর্মচারীর নির্দেশ অগ্রাহ্য করে আমি কালীকে পথপ্রদর্শক রূপে বেছে নিয়েছিলাম।

মন্দিরটির সঠিক অবস্থিতি আমার মনে নেই। যতদূর মনে পড়ে কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ডালহৌসি স্কোয়ারের কিছুটা দূরে আমি কালীমন্দিরটি দেখছিলাম। মনে পড়ে সেই অপরূপার সঙ্গে ট্যাক্সিতে আমি যাচ্ছিলাম।

আঁকাবাঁকা পথ, গলি-গুঁজি, গোরু, রিকশা, ধুতি-পরা পুরুষ, শাড়ি-পরা মেয়ে এইসব দেখতে দেখতে একসময় আমরা ঝকমকে অলংকৃত সেই কালীমন্দিরে পৌঁছালাম।

দেবালয়ের অভ্যন্তরে ঐশ্বর্যের দীপ্তি আর প্রবেশদ্বারে নিরন্ন ভিক্ষুকের হাহাকার। সাহেব দেখে, অনেকে পয়সার লোভে মাছির ঝাঁকের মতো আমায় তারা ঘিরে ধরলো। কিন্তু আমার সঙ্গে কালীকে দেখে, কেঁপে ওঠে, মুখ নিচু করে সরে গেল সবাই। বিস্মিত হলাম। কালীর কিন্তু কোনো ভাবান্তর হলো না, টুশব্দটিও করলো না সে। তার কারণে ভিখারিদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে ভালোই লাগছিল। অথচ আজ আমি আমার সেদিনের বোকামির জন্য নিজেকেই অভিশাপ দিই। অশিক্ষিত ভিখারিগুলোও তাকে বুঝতে পেরেছিল আর কী লজ্জা! আমি কালীকে চিনতে পারলাম না।

কালী ভিড়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলল। সে একজন বিধর্মী ধনী বিদেশির গাইড বলেই সম্ভবত তীর্থযাত্রীরা নিকটবর্তী দোকান থেকে কেনা মালা আর নৈবদ্য তাদের কালী মায়ের চরণে অর্পণ করে দ্রুত চলে গেল। আর আমার পথপ্রদর্শকের দেবীর প্রতি জ্বলন্ত অনুরাগ, শ্রদ্ধা এবং ভক্তি দেখে আমি অবাক হলাম। মনে হলো দেবী কালী আর মানবী কালী যেন মিলে মিশে এক হয়ে গেছে। কেমন যেন অস্বস্তি-উদ্বেগ আমাকে গ্রাস করছিল।

কালী ধ্বংসের দেবতা, শিবের স্ত্রী। এক আশ্চর্য সৃষ্টি ! ভয়ঙ্কর তার রূপ। ত্রিনয়নী, চতুর্ভুজ. নৃমু-মালিনী, স্বর্ণালি পাঁচ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট নৃত্যরতা সেই মূর্তির হাঁ করা মুখ, ঝুলন্ত জিভ, গলায় জড়ানো একটি রুপোর সাপ আর তার পদতলে শায়িত একটি মৃতদেহ। দেবী রুধির পানে রত। তার মুখ আর বুক রক্তাক্ত। প্রসারিত দু’টি বাহু বর আর অভয় দিচ্ছে। অপর দু’টি বাহুর একটিতে খাঁড়া আর একটিতে নরমু-।

কালি মূর্তি দেখে আমার ভয়, উত্তেজনা, বিরক্তি আর কৌতূহল জাগলো। কিন্তু আমার সঙ্গিনীর ধ্যান-তন্ময় প্রশান্ত রূপ দেখে বিহ্বল হলাম। মনে হলো আমাদের কাছ থেকে দূরে চলে গেছে সে। মাটির এই পৃথিবীর সঙ্গেও যেন তার কোনোই সম্পর্ক নেই। জীর্ণতা, মালিন্য আর দারিদ্র্যে ঘেরা এই মন্দিরে আত্মা আর পরমাত্মার মতো দুই কালী যেন এক হয়ে গেছে।

আমি যদি মন্দির ত্যাগের জন্য অস্থির হয়ে না পড়তাম, যদি তাকে না ডাকতাম তাহলে সে যুগ যুগ ধরে এখানেই পড়ে থাকতো। আমার ডাকে ধীরে ধীরে সে মোহনিদ্রা থেকে জেগে উঠলো। দেবীর উদ্দেশে সে যেন কি একটা বললো, তারপর নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার সঙ্গে মন্দির ত্যাগ করলো। কালী আমার দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল- ‘খুবই সুন্দর, না ?’ তারপর অনেক দূর থেকে ভেসে এল তার কণ্ঠস্বর- নিজেই যেন সে নিজেকে বলছে, ‘প্রচ- শক্তিমতী ও।’

এ এক অতিপ্রাকৃত অলৌকিক পথ আর এ পথে প্রবেশ করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না। একটা অদ্ভুত আবেশের আবর্তে আমি যেন সম্মোহিত ! কালীর ভাব-ভঙ্গি তখনো বিস্ময়ের জন্ম দিচ্ছিল। সে কি মর্ত্যরে কোনো মানবী ? স্বর্গের দেবী ? দেয়াসিনি ? অপদেবতা ? কে সে ? ‘আমরা এখন যাগ-যজ্ঞ-হোম আর বলি দেওয়া দেখবো’- কালী বলল।

মন্দির প্রাঙ্গণের সামনে একটা দেওয়াল বরাবর কালী এগোচ্ছিল। আমি হাঁটছিলাম তার পিছু পিছু। সে যেন ভুলেই গিয়েছিল যে আমি তার সঙ্গে রয়েছি।

আমি ভাবতাম বলিদান ব্যাপারটা সম্ভবত সুবুদ্ধি-সম্পন্ন আবেগহীন কোনো অনুষ্ঠান হবে- পথে-ঘাটে যে মারামারি, খুনোখুনি, রক্তারক্তির ঘটনা ঘটে অন্তত তার থেকে স্বতন্ত্র হবে। কিন্তু হায় ! ঘটনাটি ঘটার সপ্তাহখানেক পরেও কালরাত্রির সে দুঃস্বপ্ন তিলতিল করে আমায় মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে- ফিরিবার পথ নাই ! অবাক হই এই ভেবে যে রূপসী কলকাতায় কত কি দেখার রয়েছে আর আমি কিনা সেই মেয়েটির ফাঁদে। ছাগবলি দেখতে এলাম কালী মন্দিরে। বিধির বিধান ছাড়া আর কি-ই-বা বলবো ?

ভয়ে-ত্রাসে ছাগগুলো কাঁপছে। নিশ্চয়ই তারা বুঝতে পেরেছে তাদের মৃত্যু আসন্ন। ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে ডাকছে- তাদের চোখ যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে। নৃশংস ঘাতক পাঁঠাগুলোকে একের পর এক টানতে টানতে হাঁড়িকাঠের দিকে নিয়ে চলেছে। ঘাতকের জামা কাপড় রক্তাক্ত, এমন কি লোকটির দাড়িও হতভাগ্য পশুর রক্তে লাল। এখানে সেখানে ছড়ানো ছিটানো এই রক্ত কলকাতার রাস্তা-ঘাটে ফেলা পানের পিকের কথা মনে করিয়ে দেয়। ভক্তেরা দেবীর কাছে উৎসর্গ করার জন্য রোদে ঝলমল সকালে ছাগলগুলো এনেছিল। এখন তাদের হাঁড়িকাঠে বলি দেওয়া হচ্ছে। ঘাতক খাঁড়া দিয়ে গলা কাটছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে। ভক্তেরা মন্ত্র পড়ছে। ছিন্নমু- থেকে নির্গত রক্ত তারা তাম্রপাত্রে ধরছে আর কপালে রক্ত তিলক আঁকছে। তারপর বলি দেওয়া ছাগল তারা বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে মাংস খাওয়ার জন্য। কালী বললো, ‘ভারতে কোনো খাদ্যই ফেলা যায় না।’

বধ্যভূমি ছিল রক্ত¯œাত এবং মাছিতে ভর্তি। একদল কুকুর বারবার আসছিল আর রক্ত চাটছিল- মাঝে মাঝে ঘাতকের পৈশাচিক হুংকারে ভয় পেয়ে পালাচ্ছিল। বলিদানের এই দৃশ্য দেখে আমি যুগপৎ বিস্মিত আর বিমোহিত হয়েছিলাম। এই আমার সঙ্গিনী কালীকে দেখে মনে হয়েছিল সে-ই যেন উৎসর্গীকৃত পশুটিকে সাদরে গ্রহণ করছে।

সে সময়েও যদি বুঝতে পারতাম ! একটুও যদি সন্দেহ জাগতো ! বলিদান পর্ব সমাপ্ত হলে আমিই প্রথম সে স্থান ত্যাগ করার জন্য চঞ্চল হয়ে উঠেছিলাম। কালী কিন্তু নির্বিকার। আমি উদ্যোগী না হলে সে বোধহয় এখানেই থেকে যেত।

ট্যাক্সি ধরার জন্যে আমরা যখন বাইরে এলাম, কালী তখন চুপ করে ছিল। ধীর এবং আভিজাত্য ম-িত দৃপ্ত ভঙ্গিতে হাঁটছিল সে। অবাধ্য বাতাসের দৌরাত্ম্যে তার শাড়ির আঁচল একটু খসে পড়েছিল। চোখ দু’টি তার সুনীল স্বপ্নে আচ্ছন্ন, অন্যমনস্ক হয়েছিল সে। অবশেষে তার সুরেলা কণ্ঠস্বর এলো কানে- ‘এতক্ষণ মন্দিরে থাকার জন্য আপনি কি আমার ওপর বিরক্ত হয়েছেন ?’

‘হ্যাঁ কিছুটা একঘেয়ে লাগছিল ঠিকই।’ আমি বেশ খানিকটা মোহগ্রস্তও হয়ে পড়েছিলাম।

বিদেশে এসে ভদ্র অতিথির পশুবলির এহেন দৃশ্যে বিরক্তি জাগাই স্বাভাবিক। কালী যেন আমার মনোভাব বুঝতে পারল। বলল, ‘সত্যি। বেশিরভাগ বিদেশি পশুবলির দৃশ্যে ভয় পায়, বিরক্ত হয়।’

আমি বললাম, ‘আমি কিন্তু গড়পড়তা বিদেশির মতো নই।’

আমার এই কথা শুনে [জানি না আনন্দের আতিশয্যে কি না] সে এমন একটা কা- করেছিল আজও আমি তা ভুলতে পারিনি। কালী তার নরম হাতে আমার মণিবন্ধ ছুঁয়েছিল। তার এই সামান্য স্পর্শে আমার সারাশরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছিল। আমি বুঝতে পারলাম, সে কি বোঝাতে চেয়েছিল। ঈশ্বর না করুন ... হয়ত তাই।

মৃদু হাসিতে অপরূপ হয়ে উঠেছিল তার মুখ। সে বললে, ‘অতীতে ছাগল নয়, মানুষ বলি দেওয়া হতো।’

আমি মাথা নাড়লাম। সে ভেবেছিল মানুষ বলি হতো শুনে জঘন্য পাশবিকতার বিরুদ্ধে আমি নিন্দামুখর হয়ে উঠবো। যখন কোনো প্রতিবদাই করলাম না আমি, তখন সে আবার হাসলো- সেই মোহিনী হাসি। আমি স্পষ্টই দেখেছিলাম, তৃষিত হয়েছিল তার উজ্জ্বল চোখ দু’টি। মনে হচ্ছিল সে-ই যেন দেবী, সে যেন আমাকে গ্রাস করতে চায়।

ও বলল, ‘আপনাকে পেয়ে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম।’

কোনো কথা না বলে আমরা পাশাপাশি হাঁটছিলাম। একবার তার পৃথুল নিতম্বের কোমল ছোঁয়া লেগেছিল। আসঙ্গ লিপ্সায় আমার শরীরে যেন আগুন জ্বলতে লাগল। একটা ট্যাক্সি আমাদের পাশ দিয়ে দ্রুত চলে যাওয়ায় আমাকে সে বলল, ‘কালীর আরও অনেক কিছুই আমি আপনাকে দেখাবো। কারণ আমার নামও কালী।’

‘কালী !’

‘হ্যাঁ। কালীর নামানুসারে আমার নামও কালী।’

আবার সেই মায়াবী মোহনীয় হাসিতে তার সুন্দর মুখটি দীপ্ত হয়ে উঠল। বললে, ‘বলেছি না আগে কালীর সামনে মানুষ বলি দেওয়ার রীতি ছিল। দেবীরা এখনও মানুষ পছন্দ করেন।’ একটু হেসে সে আবার কথা শুরু করে, ‘আপনি আমার ঘরে একটু আসবেন ?’ ঠিক বলতে পারবো না কালীর বাড়ি পৌঁছে আমি পাঁঠার ডাক শুনেছিলাম কি না, মন্দিরের সেই যন্ত্রণাকিষ্ট পশুর করুণ আর্তনাদ তখনো আমার কানে লেগেছিল।

ট্যাক্সি থেকে নেমে কালী আমায় অপরিচ্ছন্ন সংকীর্ণ এক গলির ভেতর নিয়ে এলো। গলিটা এতই সরু যে একটা মোটামুটি গোরু সামনে পড়ায় তাকে পথ ছেড়ে দিতে আমাদের আবার রাস্তায় এসে উঠতে হয়েছিল। অবশেষে পৌঁছলাম কালীর বাসায়। বাড়িটার দেওয়াল বাঁশ আর পলকা কাঠের, ছাদ টালির। ঘর নয় তো, একটা খুপরিতে বাস করে সে। একটা খাটিয়া কাঠের পায়াযুক্ত মলিন একটি সোফা, দু’টি বেতের চেয়ার একটা টেবিল, রংচটা দাগলাগা চেয়ার এবং একটি বাতি ছিল সেই ঘরে।

খুপরিতে ঢুকে সর্বাগ্রে সে বাতিটা জ্বালিয়েছিল। পরিষ্কার আলোতে দেখা গেল ঘরের একটা কোণ পর্দা দিয়ে ঢাকা।

‘একটু বসো। তোমার জন্যে এক গ্লাস শরবত নিয়ে আসি।’- মিষ্টি হেসে কথাটা বলেই কালী পর্দার আড়ালে চলে গেল। একটু পরেই কালো মতো ঈষদুষ্ণ একগ্লাস পানীয় সে আমার হাতে তুলে দিল। ঠিক সেই সময় খুব কাছে একটা ছাগল ডেকে উঠেছিল। আমি ভাবলাম, আশ্চর্য হবার কী আছে ! এটি নিশ্চয়ই কোনো প্রতিবেশীর ছাগল। পশুটির ডাকে মনে মনে আমি খুব বিরক্ত হয়েছিলাম। আমার চোখের সামনে ভাসছিল মন্দিরে ছাগবলির সেই নির্মম-নৃশংস দৃশ্য।

‘তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।’- তার গলার আওয়াজে হুকুমের ইঙ্গিত।

‘আর তোমার কই ?’

‘আমি পরে খাবো।’

পানীয়র স্বাদটা বিদঘুটে। ঝাঁঝালো আর খড়ির মতো। মিল্ক অব ম্যাগনেসিয়ার মতো ভারি। লবণাক্ত। মদ নয়।

‘এটা কী ?’- প্রশ্ন করি।

‘এটা একধরনের শরবত। কেবল তোমার জন্য। সবটা খেয়ে ফেল। খুব ভালো জিনিস।’

সে আমার পাশে বসে, আমার দিকে কমনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ঢকঢক করে পানীয়টা গিলে ফেললাম। ফাঁকা গ্লাসটি মাটিতে নামিয়ে রাখলাম। কালী আমার কাছ ঘেঁষে বসলো। সে তাকিয়ে আছে- চোখ দিয়ে যেন মধু ঝরে পড়ছে। আমার গালে তার ঠোঁটের ভেজা স্পর্শ অনুভব করলাম। তার নিঃশ্বাসে বইছে সৌরভ, তবে কিছুটা তপ্ত আর দ্রুত তার নিঃশ্বাস। আমার গলায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সে বলল, ‘লক্ষ্মীটি খুব খুশি হয়েছি।’ সে তার শাড়িটা একটু টানলো। ঝকমক করে উঠলো তার যৌবনপুষ্ট ফর্সা দু’টি পায়ের গোছ। মনে হচ্ছিল কালীর সমস্ত শাড়িটা যেন অপসৃত হচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছিল তার সারা শরীর চুমুতে ভরে দি, সে হাসলো। এবারের হাসিটা কেমন যেন রহস্যময়। দৃষ্টিটাও কেমন যেন কুটিল, সে বলল, ‘তোমায় এবার আসল কালী দেখাবো। একটু বসো। এখুনি আসছি আমি।’ আবার সে পর্দার আড়ালে চলে গেল।

শুরু হয়েছে অদ্ভুত শরবতের প্রতিক্রিয়া। আমার দেহ-মনে পরিবর্তনের স্রোত বয়ে গেল। আমি কাঁপছিলাম। মাথা ঘুরছিল। একটা উষ্ণতা অনুভব করছিলাম বিশেষ করে পেটে। শূন্যে ভাসতে ভাসতে স্বপ্নময় এক কল্পলোকে পৌঁছলাম। দুনিয়াটা, সারাশহর, বাড়িঘর, এই ছোটো খুপরি যেখানে আমি বসে আছি সবই যেন ঘুরছে। হঠাৎ কখন যেন ঘুর্ণন থেমেও যাচ্ছে। আমার বোধ, বুদ্ধি সবকিছু যেন লোপ পাচ্ছে। আবার তা ফিরে ফিরে আসছে।

বিশ্বভ্রহ্মা-ের ঘূর্ণনের হয়ে আমিও যেন বনবন করে ঘুরছি, উপরে উঠছি, ভাসছি। এ এক নতুন জীবন, নতুন জগতে যেন প্রবেশ করেছি। সেখানের সবকিছুই সুন্দর- মনোহর। সেই সুধা পান করে ক্রমে ক্রমে আমি যেন দেবতা হয়ে উঠলাম। আমার ঘ্রাণশক্তি তীব্র হলো। নাম-না-জানা কত ফুলের সুগন্ধ এলো নাকে। অজানা অনেক সৌরভের মাঝে হঠাৎ একটা চেনা গন্ধ পেলাম- পাঁঠার গায়ের সেই গন্ধ। কিন্তু সে গন্ধটা আর আমার কাছে উৎকট মনে হলো না। নিজেকে মনে হচ্ছে সর্বশক্তিমান! ঈশ্বর। আমিই কি শিব ? আমারই সৃষ্ট প্রাণীরা দলবেঁধে এসেছে আমার কাছে। আমি তাদের ত্রাণকর্তা। আমি ওদের আশীর্বাদ করছি।

পর্দা ঠেলে সেই মানবী, কালীর ভয়ঙ্কর বেশ ধরে আমার কাছে এলো। তার হাতে কালো কুচকুচে একটি ছাগশিশু। পশুটি তার উদ্দেশ্যে বলি দিতে হবে- কালীর আদেশ। ছাগলটি গ্রহণ করলাম আমি- সেইসঙ্গে কসাইয়ের একটি শাণিত ছুরিও আমার হস্তগত হলো। কোনো কিছুই আর আমার অস্বাভাবিক বলে মনে হলো না। রক্তই উষ্ণতা এনে দেয়। রক্তই শান্তি। রক্তই সুখ। সে সময়ে ঠিক এরকম একটা অনুভূতিই হয়েছিল আমার।

দেবীর সাজে সেজেছে সে। জানি না কেন কালী নিজেকে এভাবে সজ্জিত করেছে। মন্ত্র-তন্দ্রের দেশ ভারতে বোধহয় সবকিছুই সম্ভব। নকল দু’টি হাত লাগিয়েছে সে। প্রসারিত দু’টি বাহু বর আর অভয় দিচ্ছে। এরপর দু’টি বাহুর একটিতে খাঁড়া আর একটিতে নরমু- [যেটি ভারতে অত্যন্ত সহজলোভ্য]। গলাতে মালা ছিল, কানেতে তার ঝলমল করছিল দুল। হা করেছিল সে, কালী দেবীর মতোই জিভ বের করেছিল সে। তার শ্রীঅঙ্গও ছিল অনাবৃত। নাভিদেশ থেকে পিঁপিলিকার সারির ন্যায় লোমরাজি নি¤œাভিমুখী হয়ে গেছে। শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে তেল মেখেছিল সে, বাতির সোনালি আলোয় তার সারাদেহ উজ্জ্বল আর তেল চিকচিকে লাগছিল। ঝকঝক করছিল তার পুরুষ্টু যৌবনের অনবদ্য ফসল স্ফীতকায় দু’টি স্তন-যার চূড়ায় বেদানার দানার মতো টসটসে বোঁটা। গভীর নাভি, কমনীয় তলপেট আর তৃষ্ণাকাতর লোভন নিতম্ব। কালীমূর্তিধারী কালীর নগ্ন যৌবনবতী শরীরের ঘ্রাণে গরম হয়ে উঠেছিল আমার রক্ত। আমার দেহ-মনে শঙ্কা, শিহরণ। শংকিত সেই ছাগশিশুটির উষ্ণতা অনুভব করছিলাম আমি। আসন্ন মৃত্যুর আঁচ পেয়ে মানুষের মতো যন্ত্রণা ভোগ করছিল সেটি। আমার কিন্তু সেই নিরীহ পশুটির প্রতি কোনো করুণা হলো না। মনে হলো জন্ম থেকেই এই ছাগল ছানাটি তো মায়ের জন্য বলি প্রদত্ত।

নিরাবরণ কালী একটা ছোটো মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে অস্পষ্ট, জড়ানো গলায় বলল, ‘আমিই মহাশক্তিময়ী কালী, মৃত্যু আর বিনাশের দেবী। আমি সকলের জননী।’ তার উন্নত সুডৌল বুক ফুলে ফুলে উঠছিল।- আমি বললাম, ‘হে দেবী ! উৎসর্গিত এই ছাগশিশুটিকে গ্রহণ করুন।’ নিরীহ সেই পশুটিকে বিবস্ত্র মানবী কালীর সামনে বলি দিলাম। আমার মনে হলো এর চেয়ে মহৎ কাজ আমি জীবনে আর করিনি।

কিন্তু এই ঘটনার ফলেই আমার জীবনব্যাপী দুঃস্বপ্ন, এই ঘটনাই আমায় মানসিক যন্ত্রণায় পীড়িত করে, ক্রমে ক্রমে আমাকে পাগল করে তুলল। কোনোদিন ভাবিনি অলৌকিক আর দুর্বিষহ এই ইতিবৃত্ত লিখে রেখে যেতে হবে।

ছাগশিশুটিকে বলি দেবার পর থেকেই আমার জীবনে মানসিক যন্ত্রণা, পাপবোধ, ঘৃণা, ভয়, উদ্বেগ তীব্রভাবে দেখা দিলো। টাটকা গরম রক্ত যখন আমার হাত বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় জামা-প্যান্টে পড়তে লাগল তখন আমার মোহনিদ্রা, স্বপ্নাচ্ছন্ন অবস্থা উপলব্ধ হয়েছিল। মনে হচ্ছিল ছাগলটির সঙ্গে আমি আমাকেও যেন ফালি ফালি করে কেটে ফেলেছি। বলি দেওয়া ছাগশিশুটির ছিন্ন মু- হাতে নিয়ে অসহায়, উন্মত্ত এক দানবীর পদতলে যেন আমি এসেছিলাম। কমলা রঙের ঝকঝকে যৌবনে উদ্ভাসিত, উল্লসিত সেই নারী আমার সামনে দাঁড়িয়েছিল, বিজয়িনীর মতো- নারকীয় আহ্লাদে তার শরীরে জেগেছিল রোমাঞ্চকর তরঙ্গ।

শেষ পর্যন্ত কীভাবে যে সেদিন হোটেলে এসে পৌঁছেছিলাম মনে নেই। যখন আমি আমার প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি করলাম তখন প্রচ- একটা মানসিক সংঘাত আমাকে অবশ, অসাড় আর অবসন্ন করে তুলেছিল। মনে পড়ছে আমার রক্তাক্ত হাত আর হতভাগ্য সেই পশুটির ছটফটানি দেখে উন্মত্তের মতোই আমি কালীর সেই খুপরি থেকে ছুটে পালিয়েছিলাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাথরুমে বসে দু’হাতের রক্ত ধুয়েছিলাম, সেইসঙ্গে মন থেকে ঘৃণা, ভয় আর পাপ মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আমি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছিলাম।

সানফ্লানসিস্কোতে ফিরে আজও আমার মন থেকে সই ভয়-ঘৃণা আর পাপ দূর করতে পারিনি। শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়েছি। রক্তাক্ত এই হাত নিয়ে নির্দোষ নির্বিরোধ ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মেলামেশাও অসম্ভব। তাই কোনো কাজ না করে একা ঘরে বসে থাকি। মদের পর মদের বোতল খালি করি। রাতের পর রাত জেগে থাকি। রাতের নির্জনতায় সুদূর সানফ্লানসিস্কোয় আমার ঘরে বসে আমি পাঁঠার ক্ষীণ আর্তনাদ শুনি, কালীকে দেখতে পাই, তার গায়ের মিষ্টি মায়াবী গন্ধ আমার ঘ্রাণেন্দ্রিয় চঞ্চল করে, তপ্ত হয়ে ওঠে আমার যৌবন, সহবাসের উদগ্র কামনা জাগে। কামনা বাসনা বিতৃষ্ণা মেশানো এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া আমার আত্মাকে কুরে কুরে খায়।

কালীর ঘর থেকে কলকাতার হোটেলে ফিরে সেদিন রাতে এবং তার পরের দিন রাতে সামান্য একটু ঘুমিয়েছিলাম আর তারপরই ভয়ঙ্কর সব দুঃস্বপ্নে ঘুম থেকে জেগে উঠতাম। ভয়াবহ সেই স্মৃতি মুছে ফেলার অনেক চেষ্টা করেছিলাম- কিন্তু নিদ্রায় এমন কি জাগরণেও আমি ভয় পেতাম। এইভাবে কাটতে লাগলো একের পর এক রাত।

ভারতে বেশ কিছুদিন থাকার ইচ্ছে ছিল। তা আর হলো না। শেষ পর্যন্ত সময় সংক্ষেপ করে সানফ্লানসিস্কোতে ফিরে যেতে হলো। দুঃস্বপ্নের কবল থেকে মুক্ত হবার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু মুক্তি পাইনি। নিরুপায় হয়ে ঘুমের ওষুধ খেতে লাগলাম। কিন্তু রহস্যময়ী সেই নারীর নিরাবরণ যৌবন আর মিশকালো সেই ছাগলের আনাগোনা স্তব্ধ হলো না। সবসময়ই আমার মনে হতো হাতে রক্ত লেগে আছে। কলকাতার সেই রক্তের দাগলাগা প্যান্ট শার্ট তো কবেই ফেলে দিয়েছি। এখনকার পরিধেয় বস্ত্রে রক্ত লাগবে কী করে ! বেশি মাত্রায় মদ খেতে লাগলাম। দুঃস্বপ্নের কিন্তু বিরাম নেই, স্মৃতি ঘুরে ফিরে শুধু আমাকে ভয় দেখায়।

অবশেষে আমি যন্ত্রণা-মুক্তি এবং সাময়িক শান্তির একটা পথ খুঁজে পেলাম। গতানুগতিক দুঃস্বপ্ন কাটলো বটে কিন্তু পথটি নিঃসন্দেহেই ঘৃণ্যা এবং ভয়ঙ্কর। আর কী আশ্চর্য ! যা কিছু পাশবিক আর ভয়ঙ্কর- সেইসব কাজ কত অনায়াসে, অক্লেশে করে যাই। যখনই অতিমাত্রায় মানসিক সংঘাত শুরু হয়, তখনই সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে আত্মনিয়োগ করি। সাইকাট্রিস্টের চিকিৎসাধীনে থেকেও কোনো সুফল পাইনি। অবশেষে চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনা শেষে তার নির্দেশে অদ্ভুত এই কাজটি করবো বলে মনস্থির করলাম। এবং কাজটি করলাম। প্রথমে আমি কিছুটা আরাম অনুভব করেছিলাম। কলকাতায় কালীর সঙ্গে দেখা হবার পর এই প্রথম ঘুমালাম। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তিতেই কেবল আমার ঘুম আসে- দুঃস্বপ্নের সমাধান খুঁজে পেয়েছিলাম এইভাবে। কিন্তু চতুর্থ রাত্রিতে সমস্ত আতঙ্ক, ঘৃণা, পাপবোধ আবার আমায় ঘিরে ধরলো।

আবার পশুবলির পর যন্ত্রণার হাত থেকে সাময়িকভাবে মুক্তি পেলাম। আমি বুঝেছি শান্তি পেতে, ঘুমাতে হলে যতদিন বাঁচবো আমাকে বর্বরোচিত এই কাজ করে যেতে হবে। রহস্যময়ী সেই মেয়ে, সেই কালীই আমায় এই ঘৃণ্য কাজটি করায়। কতবার প্রশ্ন জেগেছে মেয়েটি কে ? মানবী ? দেবী ? ডাকিনী ? কে সে ?

আমার জীবনের সব আশা আকাক্সক্ষা, সমস্ত স্বপ্ন-ভবিষ্যৎ, আশু বসন্তের শুকনো পাতার মতো সরে গেছে। আমার আর যেন কোনো অস্তিত্বই নেই। আমি হারিয়ে গেছি- ফুরিয়ে গেছি। বাথরুমে বাথটবে পা ডুবিয়ে বসে থাকি আমি। টবে বাঁধা থাকে ছাগল, ছুরিটা হাতে নিই। ছাগলের গলায় ছুরি বসাতে চাই। আর স্পষ্টই দেখি কালী দাঁড়িয়ে আছে সামনে। তার স্বেদাপ্লুত দুরন্ত যুবতী শরীরের সোঁদা গন্ধে ঘ্রাণেন্দ্রিয় অবশ হয়ে আসে। আহা মুহূর্তের জন্যে সেদিন যদি তার তপ্ত দেহ সরোবরে অবগাহন করতে পারতাম। চুমুতে ভিজিয়ে দিতে পারতাম তার সুরভিত বরাঙ্গের প্রতিটি রোম এবং কূপ! হ


মার্কিন লেখক জন ডিমক কীফাউভার রচিত

‘কালী : দ্য ব্লাড থ্রাস্টি ওম্যান’ গল্পের ছায়া অবলম্বনে

অলঙ্করণ : মনিরুজ্জামান পলাশ