তক্ষক -কানিজ পারিজাত

17 Apr 2024, 02:00 PM গল্প শেয়ার:
তক্ষক -কানিজ পারিজাত

ব্যাপারটা ঘটলো রাত থেকেই। ‘তামাকে সুন্দর লাগছে’- কানের সাথে আঠার মতো লেগে থাকা কথাটা একটু পরপর শিহরণের এক ভিন্ন কম্পন তুলে ছড়িয়ে পড়ছে শরীরে, ইশরাত চৌধুরীর শরীরে। কম্পন আর শিহরণের আবেশ ছাপিয়ে মাঝে মাঝে তিনি একটি চেনা শব্দও শুনতে পাচ্ছেন- খসখস খসখস। তার মনে হচ্ছে, কী যেন একটা কু-লী পাকিয়ে আড়মোরা ভাঙছে ভেতরে- শরীরের একদম ভেতরে, কী যেন একটা জেগে উঠতে চায়- অদ্ভুত এক ছন্দ তুলে তুলে। কম্পন আর ছন্দের মিলিত আবেশে প্রথমদিকে ভাঙা-ভাঙা ঘুম আর শেষদিকে একেবারেই নির্ঘুম রাত কাটিয়ে বিছানা ছাড়লেন তিনি। এমনিতে বেলা করে ওঠার অভ্যেস তার, তবে আজ ব্যত্যয় ঘটলো। ভোরেই বিছানা ছাড়তে হলো, বিছানাটা ওকবিনিয়ারের- অফ হোয়াইট কালার চাদর, বালিশ আর নান্দনিক ডিজাইনের কমফর্টার- সবই গত সপ্তাহে গ্রিস থেকে আনা, তবুও অদ্ভুত এক অস্থিরতায় ঘুমটাই হলো না- যদিও রুমের ইন্টেরিয়র ডিজাইন আর ফার্নিচারের ডেকোরেশনে কিছুদিন পরপরই পরিবর্তন আনেন মিসেস ইশরাত। যেকোনো বিষয়ে কিছুদিন যেতে-না-যেতেই কেমন একঘেয়েমি আসে তার- সে মানুষ হোক বা বস্তু। বৈচিত্র্যবিলাসী মন তার- পরিবর্তনে তার আনন্দ, নিত্য নতুন সাজেই তার নেশা, আর তার এই বৈচিত্র্যবিলাসী মনের নেশা ও আনন্দের খোরাক মেটাতে স্বামী সেলিমুজ্জামানের হাতেও আছে অঢেল অর্থ- সোজা ও বাঁকা দুই পথেই আনা।

খাট থেকে নামলেন ইশরাত চৌধুরী, সোজা এসে দাঁড়ালেন ড্রেসিং ইউনিটের বেলজিয়ামের আয়নাটার সামনে। হালকা বেগুনি রঙের নাইটি পরা ইশরাত চৌধুরী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আয়নায় দেখছেন নিজেকে, ষাটোর্ধ্ব শরীরে বিলাস ও আয়েশের প্রলেপ জমতে জমতে খাজ আর বাঁকগুলো নেই, পাহাড়গুলোও অদৃশ্য, সমতলের সাথে মিশে গেছে বহু আগেই। সেদিকে তাকিয়ে কেমন এক অস্বস্তি হয় তার, আরো আগেই সচেতন হওয়া দরকার ছিল। দ্রুত হেঁটে যান ক্লসেটের দিকে, বের করে আনেন থাইল্যান্ড থেকে আনা ঘিয়ে রঙের বেল্ট, নিচ থেকে পা গলিয়ে বেল্ট টেনে তোলেন শরীরের মধ্যভাগ বরাবর, আবার দাঁড়ান আয়নার সামনে- নাহ্ খাড়া পাহাড়গুলো ফিরে আসেনি আর, তবে তীব্র এক পুলক নিয়ে ইশরাত চৌধুরী দেখেন তিনি যেন এখন ফলভারে ভারানত বিশাল এক পেঁপে বৃক্ষ ; যেকোনো সময়ে কাক এসে খুবলে খাবে তার বড়োসড়ো পাকা পেঁপেগুলো। আবারো বাড়ছে কম্পন, একইসাথে এবার যেন তিনি শুনতে পাচ্ছেন চাপা হিস হিস শব্দ- তীব্র পুলকের ঢেউ এসে চোখ বন্ধ করে দেয় ঈশরাত চৌধুরীর, হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠে, আবেশের ছন্দপতনে বিরক্ত ইশরাত চৌধুরী ফোনটা হাতে তুলে নেন- সারাহ, তার বান্ধবি, সারাহ জামানের ফোন। ইশরাত চৌধুরী ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে সারাহর একশ্বাসে বলা কথাগুলো এসে কানে লাগে-

‘এই ইশু, স্যরি, সকালে তোমার ঘুম ভাঙালাম, নেক্সট উইকে যাচ্ছ তো ?

-কোথায় যেন ?

ইশরাত চৌধুরীর কথা শেষ হবার আগেই সারাহ জামান বলে ওঠেন-

কেন, এলিগেন্ট লেডিস ক্লাবের পার্টিতে, কেন মনে নেই, মিসেস রব নাকি পুরো পার্টির হোস্ট একাই হবেন, ভাবতে পারো ?

মিসেস রবের নাম শুনে ভ্রু কুঞ্চিত হয় মিসেস ইশরাতের।

-এটা যেন কিসের সেলিব্রেশন ?

আরে ওই যে, মহাখালির পেছনে ছোট বস্তিটায় আমরা যে ক্লাবের সবাই মিলে একটা টিউবওয়েল বসিয়ে দিলাম, ভাবতে পারো, বসালাম সবাই মিলে আমরা, আর ক্রেডিটটা নেবে ওরা। তবে, ওটা বিষয় নয়, তুমি কী কালারের আউটফিট পরছো সেটা জানতেই ফোন দিলাম-

-ওদের এস্টিমেটেড বাজেট কত জেনেছো কিছু ?

চোখ সরু সরু করে জানতে চান মিসেস ইশরাত।

-কত আর হবে, ছয় বা সাত লাখ হবে হয়ত

-হুম

চিন্তিত গলায় বলেন মিসেস ইশরাত।

-যত যাই করুক, তোমার স্প্রিং সেলিব্রেশন পার্টি-কে ওরা ছাড়াতে পারবে না কিছুতেই, যে সাজ দিয়েছিলে না, এখনো চোখে লেগে আছে! বাই দ্যা ওয়ে, এখনো বললে না তো কী কালার পরছো ? দেখো, আগেরবার তো ব্রাউন বলে পার্পেল পরেছিলে এবার কিন্তু সত্যিটা বলো ভাই, আমি তোমার সাথে ম্যাচিং অথবা কনট্রাস্ট পরবো, তারপর হঠাৎ যেন মনে পড়ায় তাৎপর্যপূর্ণ এক হাসি দিয়ে বলে ওঠেন,

-ও হ্যাঁ, তোমাদের সেই ওয়াহিদ হায়দারও আসবে তার ‘ভাঙা সুটকেস’সহ!

নামটা শুনেই বুকের ভেতর একটা বাড়ি এসে লাগে ইশরাতের, ফোনটা রাখার আগে বলেন,

-আউটফিটের কালারটা এখনো ঠিক করিনি, ফাইনাল করে তোমাকে জানাবো!

ফিরে তাকান আবার আয়নার দিকে, এবার নজর যায় নিজের সরু সরু চোখ দুটোর দিকে বড়ো বড়ো ভাসা ভাসা চোখ নয়, তবুও কী যেন এক ভাষা আছে তার চোখে- ভিন্ন এক ভাষা, আর সেই ভাষার বিশেষ গুণেই জীবনে বহু অসাধ্যকে সাধন করে চলেছেন তিনি- বহুবার তীব্র এক পুলক জেগে উঠছে ইশরাত চৌধুরীর চোখে, কানে এসে লাগছে বুলগারির ঘ্রাণ মেশানো গরম নিঃশ্বাস-

স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন কাল রাতে মিসেস ফারজানার বাসায় পার্টিতে তার কাছে এসে কানের কাছে ফিসফিস করে বলা ওয়াহিদ হায়দারের সেই কথাটা,

‘তোমাকে সুন্দর লাগছে’!


-প্রেসার ঠিক আছে ম্যাম ?

গুলশানের অভিজাত স্পা সেন্টার ‘হার গ্লামার অ্যান্ড স্পা’-এর নান্দনিকভাবে সাজানো সারিসারি কেবিনের একটিতে চোখ বন্ধ করে উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন মিসেস ইশরাত। আলো-আঁধারিতে টুংটাং বেজে চলা পিয়ানোর সুর আর চারিদিকের ভেসে আসা হারবাল এসেন্সের ঘ্রাণে আবেশে চোখ বুজে আছেন তিনি। তার অনাবৃত শরীরে জলপাই তেল আর হারবাল এসেন্স মাখানো শক্ত আঙুলগুলো নিপুণ ভঙ্গিমায় খেলতে খেলতে পিঠ ছুঁয়ে এসে থেমেছে ঘাড়ের ঠিক পেছনে- ইউলার আঙুল, পাহাড়ি মেয়ে ইউলা, অন্য মেয়েদের চেয়ে তার হাতটা শক্ত আর পুরুষালি, তাই তাকেই বেশি পছন্দ মিসেস ইশরাতের। বডি ম্যাসাজ, মাড রেপ, কোলাজেন ফেসিয়াল, এন্টি এজিং ফেসিয়াল সবই করান তিনি- ইউলার হাতে। বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘাড়ের ঠিক পেছনে বিশেষ নৈপুণ্যে চাপ দিয়ে আবারো প্রশ্ন করে ইউলা-

-প্রেসার কি আরো বাড়াবো ম্যাম ?

হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়েন আবেশে চোখ বুজে থাকা মিসেস ইশরাত। খেলছে ইউলার আঙুল পিঠ বেয়ে নামছে নিচে, আরো নিচে।

খেলেছেন ইশরাত চৌধুরীও- সারাজীবন ধরে খেলেই চলেছেন তিনি, জীবন তার কাছে এক খেলার মাঠ ; রেসে খেলে জেতাই তার নেশা। ইউলার হাত পৌঁছে গেছে ইশরাত চৌধুরীর গোড়ালিতে। গোড়ালি ধরে পা ভাঁজ করে এনে অদ্ভুত এক ঘূর্ণি দিলো সে- আহ্, কী আরাম! হ্যাঁ এমন ঘুর্ণি তো তিনিও দিয়েছেন জীবনে বহুবার, বহুজনের সামনে। প্রথম ঘূর্ণিটা দেন মিল্লাতের সামনে। একই পাড়ার মিল্লাত তখন সদ্য ম্যাট্রিক শেষ করে কলেজে ঢুকেছে। স্কাউট দলের সদস্য মিল্লাত খেলায়ও ভালো ; শখের বসে প্রাইভেট পড়ায় তার চাচাতো বোন রুবিকে। একই বাড়িতে বসবাস করা রবি ও ইশরাত সবে ক্লাস সেভেনে উঠেছে। স্কুলের স্পোর্টস প্রতিযোগিতা চলছিল, ক্লাসে ভালো করা রুবি খেলায়ও ভালো করেছে, প্রথম দিনের প্রতিযোগিতাশেষে দড়ির লাফ ও দৌড়ে ফার্স্ট হয়ে বাড়ি মাতিয়ে তুলল রুবি ; রুবি, রুবি...। চারিদিকে শুধু রুবিরই জয়জয়কার। ভেতরে কেমন একটা চাপ অনুভব করেছিল কিশোরী ইশরাত। শেষ বিকেলের দিকে একটা ক্রিম কালার রংবেরঙের কুন্দন বসানো জর্জেট টপস আর নেভিব্লু স্কার্ট পরে সোজা গিয়েছিল সহপাঠী নীতাদের বাসায়। নীতা মিল্লাতেরই ছোটো বোন, বারেবারে মিল্লাতের সামনে ঘূর্ণি দিয়ে আসে বয়সের তুলনায় বাড়ন্ত ইশরাত। তার ছোটো কিন্তু লাইনার টানা চোখে কিছু একটা ভাষা ছিল, সে ভাষা সহজেই পাঠ করতে পেরেছিল মিল্লাত। আর তাই তো পরদিন স্কাউট সদস্য হিসেবে খেলায় ভলান্টিয়ারের দায়িত্ব পালনের সময় মিল্লাত বিস্কুট দৌড়ের প্রতিযোগিতায় দড়ির একপ্রান্ত ধরে নাড়ানোর সময় কৌশলে বিস্কুটসহ দড়িটা নিচু করে নামিয়ে দেয় ইশরাতের মুখ বরাবর আর সুযোগের অপেক্ষায় থাকা ইশরাত বিস্কুট লুফে নিয়ে রুবিকে পরাজিত করে প্রথম স্থান অধিকার করে নেয়। ইশরাতের আরো দুটো খেলায় ভলান্টিয়ারের দায়িত্ব সেদিন মিল্লাতই নিয়ে নিয়েছিল, ইসরাতেরও ঝুলি ভরে উঠেছিল পুরস্কারে।

পুরস্কার মিল্লাতও পেয়েছিল ইশরাতের কাছ থেকে ; ছাদের কোনায় পানির ট্যাংকির চিপায় ক্রিম রোল আর গরম গরম ড্যানিশ খাওয়ার ফাঁকে ঠোঁটের উষ্ণতা, শরীরের আলিঙ্গন! বেশ লেগেছিল ইশরাতের। তবে, সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছিল হেরে যাওয়া রুবির পেঁচার মতো মুখটা। ওই পেঁচামুখটা দেখতেই মিল্লাতকে আরো দেড় বছর টেনে চলেছিল ইশরাত। তবে, মিল্লাত উষ্ণতার স্বাদ আর একটু বাড়িয়ে গভীর করার আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে চলে যায়, ইশরাতেরও ততদিনে মিল্লাতে রুচি উঠে যাওয়ায় ভিন্ন কিছু খুঁজতে নেমে পড়ে সে।

টুং করে আওয়াজ হলো ফোনে, মেসেঞ্জারের আওয়াজ! চমকে ওঠেন মিসেস ইশরাত। ওয়াহিদ হায়দার নয় তো! খেলায় পারদর্শী ইশরাত ধাপগুলো চেনেন, জানেন ; কাল রাতে ওয়াহিদ হায়দারের গরম নিঃশ্বাস কানে এসে লাগার পরই পরবর্তী মাইনটা পুঁতে ফেলেছেন তিনি- আর সে মাইন যে সফলভাবে বিস্ফোরিত হয়েছে তার প্রমাণ মেসেঞ্জারের এই টুং আওয়াজ। আজ সকালে বিউটি অ্যাপস-এ নিজের খুবই আবেদনময়ী কামজ চাহনি দেওয়া একটা ছবি প্রোফাইল পিকচার করেছেন তিনি। তার কিছু প্রাক্তন ও বর্তমান ভক্তকুল সেখানে লাইক কমেন্টের বন্যা বইয়ে দেবে। ওয়াহিদ হায়দারও সেখানে লাইক দেবে তবে কমেন্ট ছাড়া, কমেন্ট সে দেবে মেসেঞ্জারে, একান্তে- সিক্রেট মেসেঞ্জারে লিখবে- হ্যাঁ লিখেছে তো, শিহরণে কেঁপে ওঠেন মিসেস ইশরাত। ওয়াহিদ হায়দারের লেখা জ্বলজ্বল করছে- ‘এক্সসিলেন্ট, ইউ আর লুকিং গর্জিয়াস, হট অ্যান্ড সেক্সি’! তারপর লাল রঙের হার্ট চিহ্ন কয়েকটা। শিহরিত ইশরাত ইউলা-কে থামিয়ে ফোন হাতে নিয়ে লিখে দেন, ‘থ্যাংক ইউ সো মাচ, একটু বাইরে আছি, রাতে ফ্রি থাকবো, এরপর তিনিও কয়েকটা হার্ট চিহ্ন পাঠিয়ে দেন, লাভ সিম্বল! সাথে সাথেই রিপ্লাই দেন ওয়াহিদ হায়দার- “ওহ্ সিওর, দেন উই ক্যান টক অ্যাট নাইট, টিল দেন স্টে সেইফ”। আবারো কয়েকটা হার্ট চিহ্ন পাঠিয়ে দেন। ফোনটা নামিয়ে রাখেন মিসেস ইশরাত। কেমন একটা শিহরণ আসছে মনে, মন বেয়ে শিহরণ ছড়িয়ে পড়ছে সারাশরীরে, ইউলা তাকে উপুড় থেকে চিৎ করে শুইয়ে দিয়েছে। পেছনে ম্যাসাজ শেষ, এখন জলপাই তেল মাখানো শক্ত আঙুলগুলো খেলবে সামনের দিকে। ওয়াহিদ হায়দারের সাথে খেলার দানটা অবশ্য সেলিমই সাজিয়ে দিয়েছিল। সেলিমের কিছু দাপ্তরিক ফিন্যান্সিয়াল ঝামেলা ও আইনি জটিলতা ছিল। কী করবে বেচারা সেলিম, প্রতিমাসে ইশরাতের গুলশানে অভিজাত রেস্টুরেন্টে দু-তিনবার বুফে পার্টি, কিছুদিন পরপরই দেশ-বিদেশের রিসোর্টে ভ্রমণ, বিএমডাব্লিউ, হোন্ডা, হেরিয়ার-এর মতো নতুন নতুন ব্র্যান্ডের গাড়ি, অভিজাত এলাকায় ট্রিপলেক্স বাড়ি, বিলাসী জীবন যাপনের খোরাক জোগাতে সেলিমকে সোজা ও বাঁকা দু পথেই হাঁটতে হয়েছে, চাক ভেঙে মধু খেতে গেলে মৌমাছি তো হুল ফোটাবেই, দু-চারটে বিষকাঁটা তো পায়ে ফুটবেই! সেলিমেরও হুল ফুটেছে, কাঁটা বিঁধেছে পায়ে, আর সেইসব হুল ও বিষকাঁটা মুক্ত হতেই ওয়াহিদ হায়দারের সাহায্যের প্রয়োজন। ওয়াহিদ সেলিমের থেকে জুনিয়র হলেও লবিং লিঁয়াজো শক্ত ও ভালো, দু-একটা বিষয় ছাড়া ইতিবাচক ইমেজ আছে তার, সেই ওয়াহিদের সাহায্য পেতেই ইশরাত-কে খেলার মাঠে নামিয়ে ছিল সেলিম। ইশরাতও সেলিমকে সাহায্য করতে নেমেছিল কোমর বেঁধে। তবে, সেলিমের আড়ালে খেলাটা সে একটু ভিন্নভাবে খেলে ফেলেছে। অনেক ঝামেলা থেকেই মুক্ত এখন সেলিম, হয়েছে বিষকাঁটা মুক্তও- তবে, ইশরাত আর মুক্ত হতে পারেনি খেলা থেকে! তার জীবনে দেখা সেরা খেলোয়াড় ওয়াহিদ, এমন জমজমাট খেলা এর আগে কোনোদিনও খেলেনি ইশরাত, সত্যিই এই খেলায়, এই রেসে তাকে জিততেই হবে, জয় করতে হবে সত্তর বছর বয়সী পেটানো শরীরের ধোপদুরস্ত পোশাকে বুলগারি, সাফারির ঘ্রাণ ছড়িয়ে পথচলা, লেডি কিলার ওয়াহিদ হায়দারকে।

আবারও শিহরণ, একধরনের ভিন্ন কম্পন উঁকি দিচ্ছে ইশরাত চৌধুরীর শরীরে। ওপর থেকে নিচে নামছে ইউলার আঙুল, একটা নির্দিষ্ট জায়গায় এসে সন্তর্পণে থেমে যায় সে, খুব আস্তে করে প্রশ্ন করে- ম্যাসাজ তো প্রায় শেষ, স্ট্রেস রিলিজ করবেন কি ম্যাম ?

বাতাসে হারবাল এসেন্সের ঘ্রাণ, টুংটাং করে বেজে চলেছে বাম্বু ফ্লুট... আবেশী ইশরাত ভেতরে টের পাচ্ছেন ভিন্ন এক কম্পনের ডঙ্কা ; তার কেবিনের বাইরেই লেখা আছে, ‘জাস্ট ক্লোজ ইউর আইস, অ্যান্ড ডু হোয়াটেভার ইউ লাইক’ চোখ বন্ধ ইশরাত ইশারায় হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়েন- কম্পন চাই তার, ভিন্নমাত্রার চূড়ান্ত এক কম্পন!


সন্ধ্যা থেকেই কয়েক রাউন্ড ঘুর্ণি দিয়েছেন ইশরাত চৌধুরী, অভিজাত সাজে সজ্জিত ষাট ও সত্তরের কোটায় বিচরণ করা মানুষগুলোর চোখের সামনে- এলিগেন্ট লেডিস ক্লাবের পার্টিতে। গতযৌবন পুরুষগুলোর নড়ে চড়ে ওঠা আর গতযৌবনা নারীগুলোর হিংসাতুর চাহনিই তাকে বলে দিয়েছে যে, কাজ হয়েছে! যদিও তিনি নিজেও চৌষট্টি ছুঁই-ছুঁই, শরীরও যথেষ্ট স্থূল, মুখের নিচেও ঝুলে থাকা ডাবল চিনের সমৃদ্ধ সমাহার ; তবুও হাস্য লাস্য আর অভিনব অভিজাত সাজসজ্জা দিয়ে প্রতিবারই তিনি মাত করে দেন- আজও যে মাত করেছেন তার প্রমাণ তার বর্তমান আর প্রাক্তন ভক্তকুলের সন্তর্পণে ফেলা কামজ চাহনিগুলো- বেশ উপভোগ করছেন তিনি। তবে, সবচেয়ে বেশি উপভোগ করছেন মিসেস রবের আমচুর হয়ে যাওয়া মুখটা। হালকা ক্রিম আর পার্পেল শেডের অভিজাত কাজের বিদেশি শিফন শাড়ি, বালিদ্বীপ থেকে আনানো বিশেষ ডিজাইনের অলংকার, অস্ট্রেলিয়ান অভিজাত ডিজাইনের পার্স- সব মিলিয়ে তাকে সবার থেকে আলাদা করে দিয়েছে, আরও একটু আলাদা হতে চুলে দিয়েছেন তিনি ভিন্ন এক লেয়ার কাট, মুখেও করে এসেছেন গোল্ডি পার্লি ফেসিয়াল, স্বামী সেলিমকেও পরিয়ে এনেছেন তারই শাড়ির রঙের ম্যাচিং শার্ট- সবমিলিয়ে আজ তার কাছে দাঁড়াতে পারছে না কেউ আর- মিসেস রব তো আগেই ধুলিস্যাৎ। যদিও পার্টিতে অভিনব আলোকসজ্জা, কিছু গেমস, বেশ কিছু ইভেন্টস রেখেছিল বেচারারা- একটি কম বয়সী বোতলফিগার মেয়ে স্লিভলেস হাত আর অর্ধ উন্মুক্ত শরীরে টাইটফিটেড ডলার বসানো সিলভার কালার গাউন পরে গান গাইছে ক্লাবের স্টেজে, ইংরেজি আর হিন্দি মিলিয়ে ঝিলিয়ে গাইছে মেয়েটা, আয়োজনটা ভালোই করেছিল মিসেস রব- তবুও ইশরাতের কাছে তাকে হারতেই হলো, ভেবেই হাসি পায় তার।

-আমরা কি ফুরিয়ে গেছি ? নো, নেভার!

পাশের টেবিল থেকে মিসেস রেবেকার কণ্ঠ ভেসে আসে। তাকে ঘিরে আছে কয়েক জন। রেবেকা ইয়াসমিন একটি কলেজে পড়াতেন, সত্তরের বেশি বয়স, প্রচুর পড়েন, প্রচুর কাজ করেন, অনেক জানেন, স্বামী ডাকসাইটে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন- সবাই সমীহ করে চলে তাদের, তাকেই এলিগেন্ট লেডিস ক্লাবের প্রেসিডেন্ট করা হয়েছে। ওয়েটারের হাত থেকে পানীয় নিচ্ছে সবাই। আবার কথা বলছেন তিনি-

-‘পঁয়তাল্লিশ, পঞ্চাশ পেরোলেই নারীরা বুড়ি’- এটা একটা ভুল ধারণা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সাজানো ছক, নিজেদের বহুগামীতার সুযোগ নিতেই ওরা এইসব প্রবাদ আর মিথ্যে প্রচারণা চালিয়েছে যুগে-যুগে, আর বোকামেয়েগুলো ওদের এইসব মিথ্যে প্রচারণার শিকার হয়েছে। নতুন নতুন কচি নারীর স্বাদ আস্বাদনে এমন ভিন্ন চক্রান্ত করে গেছে পুরুষেরা। আমাদের এসব বুঝতে হবে, পঞ্চাশ বা ষাট পেরোলেই নারীর জীবন থেমে যেতে পারে না। নারীরা গণিতবিদ, বিজ্ঞানী, পলিটিশিয়ান ; চন্দ্রাভিযানে যাচ্ছে, সিটিজেন অব গ্যালাক্সি হচ্ছে- আমাদেরও কাজ করতে হবে, মনে রাখার মতো কাজ...

মিসেস নাসরিন হঠাৎ বলে ওঠেন,

-আপনি ঠিক বলেছেন ম্যাম, এসব ওই বদচরিত্রের পুরুষগুলোর সাজানো মিথ্যে কথা, কই ষাটের পরে পুরুষেরা তো থেমে নেই, ওরা তো ঠিকই সুগার ড্যাডি সেজে দু’চারটে কচি মেয়ে পুষছে, আর আমাদের বানিয়ে রেখেছে বৃদ্ধা, আসলে কি আমরা বৃদ্ধা হয়ে গেছি ? কখনোই না!

তাকে থামিয়ে দিয়ে মিসেস সোহেলি বলেন-

-আরে, গত কয়েক বছরে আমরা যেভাবে জেগে উঠেছি, আমরা যে ফুরিয়ে যাইনি, এটা আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি, এটা একটা জাগরণ, এটা আমাদের রেনেসাঁ..!

-হ্যাঁ,

তাদের সাথে কণ্ঠ মেলান সারাহ জামান -

-হ্যাঁ, ম্যাম, বিউটি আর স্পা তে এখন তো আমাদেরই দেখা যায়, কম বয়সী মেয়েরাও আমাদের সাথে পেরে উঠছে না আর, তাছাড়া আমাদের বয়সী এলিগেন্ট নারীরাও কিন্তু এখন সুগার মাম্মি হচ্ছে-

-আহ্, এটা কী বললে! বেশ বিরক্ত হন মিসেস রেবেকা ইয়াসমিন।

-সেই তো বৃত্তের মধ্যেই চিন্তা করলে, তোমরা নারীরা কেন নারীদেরই শত্রু ভাবো ? এটাও পুরুষের সাজানো ছক, তোমাদের একে অন্যের শত্রু ভাবতে শিখিয়েছে, এসব সংকীর্ণ চিন্তা থেকে বের হয়ে আসো, মাইন্ড ব্লকেজ থেকে ফ্রি হতে হবে, ওরা খারাপ হলে, তোমরাও কেন খারাপ হবে ? আজকের পার্টিতে তোমাদের কারো লেখা গ্রন্থের পাঠ উন্মোচন হতে পারত, সেটা আরো অভিজাত হতো, বই এক ধরনের আভিজাত্য, শিল্প বা সৃষ্টি মানুষকে অভিজাত করে, তোমরা কি মনে করো, শুধু পোশাকেই অভিজাত হয়, তা তো হয় না.. নেভার-

মিসেস রেবেকা আরো কিছু বলছিলেন ; তবে, এবার বিরক্ত লাগায় সরে আসেন মিসেস ইশরাত। কেমন হাঁসফাঁস লাগছে তার, মিসেস রেবেকার আশেপাশে গেলেই এমন লাগে তার, টেরেসের দিকে একটু হেঁটে আসতে হবে, তার চোখ আবার ক্লাবের ঢোকার দরজায় যায়- অনেকটা সময় পেরিয়েছে, ওয়াহিদ হায়দার এখনো আসেননি। তার সাজ কি ব্যর্থ হয়ে যাবে ? অস্থির হন মিসেস ইশরাত।

ওয়াহিদ হায়দারের স্ত্রী শাহানাও এলিগেন্ট লেডিস ক্লাবের সদস্য, যদিও তাকে দেখে মোটেও এলিগেন্ট লেডি বলে মনে হয় না- সাদামাটা পোশাক, তার উপরে হিজাব। ওয়াহিদ হায়দারের সাথে একেবারেই বেমানান, সারাহ ওর নাম দিয়েছে ‘ভাঙা সুটকেস’। সারাহর ভাষায়, “যেসব পুরুষ লেডিকিলার হয়, ওদের স্পাউজরা এমন ভাঙাচোরাই হয়, কী করবে বলো ? স্বামীকে তো আর বাঁধতে পারে না, আটকাতেও পারে না, স্বামীর পাশে থেকে এসব সইতেও পারে না, তখন ওরা ভেতরে ভেতরে জ্বলতে জ্বলতে পুড়তে পুড়তে পোড়াকাঠের মতো হয়ে যায়- আগুন নিভে যায়, তবুও পোড়া ধোঁয়া বের হতেই থাকে- এজন্যই অমন বিষণœ মুখে ভাঙাচোরা হয়ে কোনায় বসে থাকে। এদের স্বামীরা নিজেরা ফিটফাট অথচ ক্যারি করছে ‘ভাঙাচোরা সুটকেস’- ভাবতে পারো ? হেসেছিল সারাহ জামান।

সারাহ-কে বুঝতে না দিয়ে সেদিন ওয়াহিদের বিষয়ে আগ্রহী ইশরাত জানতে চেয়েছিলেন,

-এমন কী করে ওয়াহিদ হায়দার ?

বিস্মিত সারাহ চোখ বড়ো বড়ো করে বলেছিল-

-তাও জানো না ? সারাদিন শুধু পার্টি আর সাজসজ্জা নিয়েই থেকো না, এদিকেও একটু খোঁজখবর রাখো, প্রতিবছর ‘পারফেক্ট ম্যান’ ক্লাবের সেরা হ্যান্ডসামের তকমাটা তারই ; পোশাকে যেমন হ্যান্ডসাম, মনেও তেমনি। বয়স তার কাছে পরাজিত, ষোলো থেকে বাহাত্তর সবাই হুমড়ি খায় তার ওপর, ভালো খেলোয়াড়, খেলে সে নারীদের নিয়ে। ইতিবাচক ইমেজ খাটিয়ে বিভিন্ন নারীর বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে দেয়- ব্যস কৃতজ্ঞ নারীরা তার কাছে নতজানু হয়, পাগল হয় তার জন্য, সেও মজা পায়! এটাই তো আনন্দ, জয় করার আনন্দ! নিজেকে সফল ভাবার আনন্দ!

জয়ের নেশায় কেঁপে উঠেছিলেন ঈশরাত চৌধুরীও, প্রতিপক্ষ খেলোয়াড় পোক্ত না হলে খেলে কীসের আনন্দ ? তারও চাই আনন্দ, সবাইকে ডিঙিয়ে হায়দারকে জয়ের আনন্দ!

হিন্দি আরো একটি গান ধরেছে মেয়েটি, বেশ মিষ্টি সুর-

“মাই হার্ট ইজ বিটিং,

কিপস অন রিপিটিং,

আই এম ওয়েটিং ফর ইউ”

বিখ্যাত ‘জুলি’ সিনেমার জনপ্রিয় হিট গান...

সত্যিই বিটিং হচ্ছে তারও ওয়াহিদ হায়দারের জন্য...

সারাহর উল্লসিত কণ্ঠ শোনা যায়, “হ্যাল্লো, ওয়াহিদ ভাই, আরে আপনাকে তো পুরাই নায়ক ওয়াহিদ মুরাদের মতো লাগছে...”

চমকে ওঠেন ইশরাত চৌধুরী, শিহরিত হয়ে দেখেন ক্লাবের দরজা দিয়ে ঢুকছে স্যুটেড-বুটেড ওয়াহিদ হায়দার।


গভীর রাত। ট্রিপলেক্স বাড়ির দোতলায় নিজের রুমে মেরুন রঙা পিচ্ছিল সচ্ছ নাইটি পরে ফোনটা সামনে নিয়ে বসে আছেন মিসেস ইশরাত। যেকোনো সময় মেসেঞ্জারে আসবে কল। ওয়াহিদ হায়দারের ভিডিও কল, এমন কল তো রাতেই আসে, রাত যত গভীর হয়, চেনা পৃথিবীর নর-নারীরা ততই ব্যাকুল হয় ; একে অপরকে চিনতে চিনতে, জানতে জানতে আকুল হয়ে ঢুকে পড়ে অচেনা এক জগতে।

আকুল হয়ে ঘুমাচ্ছে সেলিমও- নাক ডেকে ডেকে, তার পাশের রুমে। নাহ্, ইশরাতকে কোনোদিনই সেলিমের সামনে বা পেছনে করা কোনো কাজের জন্যই জবাবদিহি করতে হয়নি। আসলে সেলিমের সব কাজে বুদ্ধি দিয়ে পাশে পাশে থেকে তার আস্থাটা অর্জন করতে পেরেছে ইশরাত। তবুও মাঝে মাঝেই মনে হয়, স্থূল শরীরের থপথপ করে হাঁটা সেলিমেরও দু-চারটে পোষা কচি হরিণী নেই তো ! তা না হলে ইশরাতের বিষয়ে এত বছর ধরে এত নির্লিপ্ত আর এত নিরুত্তাপ হয় সে কী করে ?

উপর দিয়ে নিরুত্তাপ ভাব অবশ্য শাহানাও দেখায়- তবে ভেতরে ভেতরে ক্ষোভের তীব্র উত্তাপ। সে উত্তাপের আঁচ পেয়েছে ইশরাত নিজেও। সেলিমের পাতানো খেলার অংশ হিসেবে শুরুতে শাহানার সাথেই বন্ধুত্ব করেছিল ইশরাত চৌধুরী। তারপর কয়েক ধাপ পেরিয়ে পারিবারিক বন্ধুত্ব- মাঝে মাঝেই একে অন্যের বাসায় দাওয়াত, নিজের হাতে তৈরি কাচ্চি বিরিয়ানি, ফলের ঝুড়ি কিংবা বিদেশ থেকে আনা গিফট নিয়ে হাজির হতো সেলিম-ইশরাত দম্পতি, চলতো গল্পের বাহার। শাহানার পরিবেশিত খাবারে কামড় দিতে দিতে আত্মম্ভরি ওয়াহিদ শোনাতো নানা সফলতার গল্প, শাহানাও শোনাতো গল্প, ওয়াহিদের আড়ালে হতাশার আর ব্যর্থতার! ইশরাতের কাঁধে মাথা রেখে শুনাত নিজের স্বামীর অবিশ্বস্ততার আর বহুগামীতার গল্প। শাহানার সেসব ব্যর্থতা আর হতাশার গল্প শুনতে শুনতেই শিহরিত ইশরাত জেনে যায় ওয়াহিদ হায়দারকে জয় করার গোপন সূত্র। সেলিম আর শাহানার আড়ালে সেসব সূত্রের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন তিনি সফলভাবে- আর তার ফলাফল : তিন তিনটে কম বয়সী নারীকে পরাজিত করে ইশরাত চৌধুরী, হ্যাঁ, এই ষাটোর্ধ্ব ইশরাত চৌধুরীতেই মজেছেন বয়সকে পরাজিত করা, পেটানো শরীরের, ধোপদুরস্ত পোশাকে চলা, লেডিকিলার ওয়াহিদ হায়দার।

ফোনটা বেজে ওঠে- শিহরিত ইশরাত চোখে কামজ ভাব ফুটিয়ে তোলেন...

-ওয়াও, তোমাকে তো খুবই হট লাগছে, ইউ আর অন ফায়ার!

প্রশংসায় আরো একটু ঝুঁকে বসেন ইশরাত, বুকের গভীর পর্যন্ত কৌশলে দেখিয়ে দেন হায়দারকে...

চোখে মুগ্ধ ভাবে এনে হায়দার বলে ওঠেন-

-“ওয়াও, রিয়েলি ইউ আর এক্সট্রিমলি হট, ড্যাম হট, হট অ্যান্ড ভেরি ভেরি সেক্সি।”

মৃদু ভলিউমে ওয়াহিদ হায়দার চালিয়ে দিয়েছেন পুরনো দিনের একটি হিন্দি গান

-“এক হাসিন শ্যাম কো, দিল মেরা খো গায়া”...

প্রায়ই কাজটা করেন তিনি, বাইরে থেকে কথার আওয়াজ যাতে ভালো বোঝা না যায়, তার জন্য প্লেয়ারে গান বাজিয়ে রাখেন...

-কামজ হাসি দিয়ে চোখ নাচিয়ে প্রশ্ন করেন ইশরাত, শাহানা কি ঘুমিয়েছে ?

একটু শ্রাগ করেন ওয়াহিদ হায়দার,

-নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে আছে ওর রুমে, তাহাজ্জুদ পড়তে উঠে যাবে, কিছু সময় পরই, আমরা কিন্তু তখন ফিসফিস করে কথা বলব-

এজন্যই ওয়াহিদকে এত ভালো লাগে ইশরাতের। তার প্রাক্তনেরা ইশরাতেরই টাকায় ফুর্তি করে, দিনভর প্রেম করে, রাতে ঘরে ফিরে বউয়ের কোলে গুটিসুটি মেরে ঘুমাতো।

ওয়াহিদ তা নয়, তার টেরিটোরিতে শাহানার কোনোই এন্ট্রি নেই। একেবারেই ঝাড়া হাত-পা ওয়াহিদ। তার সাথে খেলা যায় যেকোনো খেলা- কানামাছি থেকে গোল্লাছুট, ম্যাজিক কার্পেট থেকে রোলার কোস্টার!

-সেলিমও ঘুমাচ্ছে নিশ্চয়ই ? হায়দারের পাল্টা প্রশ্নের উত্তরের ক্যামেরার দিকে শরীরটা আরেকটু ঝুঁকিয়ে দিয়ে চোখে তাৎপর্যপূর্ণ চাহনি ফুটিয়ে ইশরাত বলেন-

-হ্যাঁ কিছু সময় পরেই আমাকে ডাকবে হয়ত,

-হোয়াট ? হেই, একটা কথা বলি, বিরক্ত মুখে বলে ওঠেন হায়দার-

-প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড, হি ডাজন্ট ডিজার্ভ ইউ, ওর শরীরটা কেমন ভারি, কেমন থলথলে, তোমার সাথে যায় না, “ইউ আর সো হট অ্যান্ড সেক্সি”-

চোখে রহস্যময় এক চাহনি দিয়ে বলেন ইশরাত-

আমরা কিন্তু এখনও অ্যাক্টিভ, একটি রাতও আমার থেকে রেহাই নেই সেলিমের, জ্বলছে চোখ, জ্বলছে হায়দারের।

এমন করে তিনিও জ্বলে উঠেছিলেন বান্ধবি দিলরুবার হ্যান্ডসাম প্রেমিক ডেন্টিস্ট সাজ্জাদকে দেখে, তাদের জুটির সফল প্রেমের গল্প ইশরাতের কয়েক রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছিল, আর তাই তো সাজ্জাদের দেব পাহাড়ের চেম্বারে কলেজ পড়ুয়া ইশরাত ছুটে যেতেন বারবার দাঁতের ব্যথার ওসিলায়, ব্যাথার উৎস খুঁজে পেত না সাজ্জাদ। তবে, প্রোসিডিওরের চেয়ারে টাইট ফিটেড ড্রেস আর গলার কাছে ওড়না ওঠানো অর্ধশায়িত ইশরাত যে তার ঘাম ছুটিয়ে দিত তা ঠিকই বুঝতে পারত ইশরাত... এখনও বুঝতে পারছেন- জ্বলছে হায়দারের চোখ, ইশরাতের বলা অসম অলীক গল্পের উষ্ণ মোহজালে আটকে যাচ্ছে সে, আটকাক, আরো ভালো করে আটকাক- ইশরাত চায় চোখের মতই ওয়াহিদের বুকটাও জ্বলুক, ইশরাতের জন্যই!

একটি পুরনো ধাঁচের পাঁচতলা বাড়ির সামনের রাস্তায় গাড়িতে বসে আছেন ইশরাত চৌধুরী, ভাড়া করা উবার গাড়ি, খেলার রাউন্ড দিতে গিয়েই একবার ড্রাইভার সুলেমানকে আবিষ্কার করেন, পোষ মানিয়ে নিয়েছেন একে নিজের সাথে, প্রয়োজনে মাঝেমধ্যেই গোপনে ডেকে নেন।

অভ্যস্ত সুলেমানও ম্যাডামের ইশারা বোঝে, গাড়িটা পার্ক করে কাচ তুলে দিয়ে নেমে গেছে সে। কালো কাচ- বাইরে থেকে ইশরাত চৌধুরীকে দেখা যাচ্ছে না। তবে, তিনি ঠিকই দেখতে পাচ্ছেন, তার নজর বাড়িটার পাঁচতলার দিকে, নাহার চৌধুরীর ফ্ল্যাট! একসময়ের কলেজের টিচার, ভালো নৃত্যশিল্পীও ছিলেন, বয়স সত্তরের ওপরে, তবে মনের বয়স এখনও একুশ। নান্দনিক ভঙ্গিমায় শাড়ি পরেন, চুলে ফুল গোঁজেন, ছোটখাটো গড়নের ফর্সা নাহার চৌধুরী তার থেকে এগিয়ে আছেন শরীরের গাঁথুনি দিয়ে, নৃত্যশিল্পী ছিলেন, শরীরটা নৃত্যের ছন্দে বাঁধা! ডিভোর্সি ও একাকি- এই নারীতেই মজেছেন ওয়াহিদ হায়দার! জ্বলে পুড়ে ছারখার ইশরাত!

সব তো ঠিকই ছিল, নিয়মিত গভীর রাতে কথা, সেলিম না থাকলে বাসায় এসে হায়দারের লম্বা সময় ধরে থাকা, একে অন্যের বাসায় যাওয়া, মাঝে মধ্যেই এখানে ওখানে বিশেষ করে সিনেপ্লেক্সের অন্ধকারে মুভি দেখার ফাঁকে ফাঁকে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা- সবই তো ঠিকঠাক চলছিল। মাঝে শুধু দুই সপ্তাহের জন্য বিদেশে গিয়েছিলেন ইশরাত চৌধুরী মেয়ের কাছে, দূরে গেলেও ভাইবারে হোয়াটসঅ্যাপে ঠিকই তো যোগাযোগ ছিল- এত এত প্রতিরক্ষা প্রাচীর পেরিয়ে নাহার চৌধুরী কী করে ঢুকে পড়ল সেটাই ইশরাতের মাথায় ঢুকছে না।

ব্যাপারটা তিনি ধরতে পারেন বিদেশ থেকে ফেরার পর, কথা বলতে গেলে হায়দার বিভিন্ন বাহানায় তাড়াতাড়ি কেটে দেয়, কখনো-বা বলে তার বিদেশ থেকে বিজনেস কল এসেছে, কখনো-বা বলে ছেলেমেয়ের ফোন, ইশরাতের বিষয়ে আর যেন আগ্রহ নেই হায়দারের, সংক্ষিপ্ত কথা শেষ করেই হারিয়ে যান, অভিজ্ঞ ইশরাত ঠিকই বোঝেন, মিথ্যের জাল বুনে চলেছে হায়দার, সেই জালের সুতোর উৎস খুঁজতেই সারাহকে কিছু বুঝতে না দিয়ে খবর সংগ্রহের কাজে লাগান, সব খবরের ডিপো সারাহ ঠিকই খবর নিয়ে হাজির হয়, মিস্টার হায়দার-কে দেখা গেছে ‘গ্লোরিয়া জিন্সের স্মোকিং জোনের অন্ধকারে নাহার চৌধুরীর সাথে বসা’!

তারপর দুই দিন সুলেমানকে নিয়ে দিনভর হায়দারকে ফলো করছেন তিনি, আজ হাতেনাতে প্রমাণও পেলেন! সকাল ১১টাতেই এসে ঢুকেছে হায়দার, নাহার চৌধুরী বাসায়, এখনও বের হয়নি।

জ্বলছে ইশরাত, দাউ দাউ করে জ্বলছে, এমন করেই জ্বলে উঠেছিল সে, যেদিন দিলরুবা এসে ইশরাতকে শাসিয়েছিলো... কেন সে ঘন ঘন যায় সাজ্জাদের চেম্বারে! আর সেই জ্বলুনি থেকেই গিয়েছিল ইশরাত তার পরদিনই দেব পাহাড়ে, চেম্বারের পুরনো রড বসানো জানালায় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দিলরুবার অপমান নিয়ে সাজ্জাদের কাছে যখন কাঁদছিল সে, তখনই কী যেন একটা বাগানে খসখস করে, হিসহিস শব্দের সাথে সাথে একটু পরই তিনি আর সাজ্জাদ দেখেন সেই দূর্লভ দৃশ্য, দুটো সাপের সঙ্গম!

অবশেষে দিনভর অপেক্ষার অবসান, বেলা চারটার দিকে হায়দারের গাড়িটি বের হয় নাহার চৌধুরীর গেট থেকে, গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল আবার, দরজা খুলে নামলেন হায়দার, ওপরে তাকালেন, পাঁচতলার ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে। নভি ব্লু কালার নাইটি পরা ছোটখাটো গড়নের ফর্সা নাহার চৌধুরী-

জ্বলন্ত চোখে ইশরাত চৌধুরী দেখেন হাত উঁচু করেছে হায়দার নাহারের উদ্দেশে, বিদায় নেওয়ার সময় এমন করে তো ইশরাতের উদ্দেশেও হাত তুলতেন, নাহার চৌধুরীও ওপর থেকে ঠোঁটে হাত ছুইয়ে উম্মা উম্মা দিচ্ছেন ফ্লাইং কিস।

জ্বলছেন ইশরাত, জ্বলুনি ছড়িয়ে পড়ছে সারাশরীরে, কী যেন একটা ফোঁস-ফোঁস করছে তার ভেতরে, কিছু একটা জেগে উঠতে চায় যেন, দিতে চায় ছোবল...!

বেরিয়ে গেল ওয়াহিদ হায়দারের গাড়ি..

ক্রুদ্ধ ইশরাত বসে রইলেন কালো কাচ তোলা গাড়িতে- একা!


ঢাকা থেকে দূরের এক রিসোর্ট- বেশ নির্জন। তবে, নান্দনিক। সেলিমকে ভিন্ন বাহানা আর ভিন্ন জায়গার কথা বলে সেখানেই একাকী এসেছেন ইশরাত চৌধুরী, সুলেমানকে নিয়ে! অপেক্ষায় আছেন, ওয়াহিদ হায়দারের আসার! গত কয়েক মাসে নিজের অনেকটাই পরিবর্তন এনেছেন তিনি। মুখে পিলিং করিয়েছেন, চিবুকে করেছেন ভি শেইপ আর চুলে কেরাটিন! কয়েককেজি ওজন কমাতে ডায়েটও করেছেন- ঘরে হেঁটেছেন, বাইরে হেঁটেছেন, পার্কে রোজ ঘাম ছুটিয়ে দিয়েছেন ২০-৩০ টি করে চক্কর!

চক্কর তিনি হায়দারকে ঘিরেও দিয়েছেন, ঘনঘন কামজ চাহনি মাখা ছবি দিয়ে, প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তন করেছেন, নিজের আবেদনমাখা ছবি পাঠিয়েছেন মেসেঞ্জারে, আর সবচেয়ে তুখোড় যে কাজটি করেছেন তা হলো, পার্টিতে গিয়ে হায়দারকে দেখিয়ে দেখিয়ে হায়দারেরই শত্রু রায়হান সাহেবের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছেন! রায়হানের সাথে ঘনিষ্ঠ ছবিও পাঠিয়েছেন হায়দারের মেসেঞ্জারে। ব্যস, আত্মম্ভরি হায়দার জ্বলে উঠেছে, শত্রুর থেকে নিজের সম্পত্তি উদ্ধারে সতর্ক হায়দার ফেরত আসা বলের মতোই আবার এসেছে ফিরে ইশরাতের কোর্টে; এ কয়দিনে খেটেখুটে জোরালো প্রতিরক্ষা দেয়াল তুলেছেন ইশরাত, নাহারের জন্য। হায়দারের দরোজা চিরতরে নাহারের জন্য সিলগালা আঁটতেই আজকের এই নির্জন আয়োজন!

ডিপ বটল গ্রিন নাইটি পরেছেন ইশরাত, রিসোর্টের রুমটাও বেশ কোজি আর গ্রিন, চারিদিকে চোখজুড়ানো সবুজের বাহার, বিছানায় ছিটানো ফুলের পাপড়ি, রুমের একপাশে বাঁশের কাঠি আর সবুজ লতা দিয়ে নান্দনিক ডিজাইনে ঘেরা আবরণের ওপাশে রাউন্ড শেইপ বাথটাব, পাশেই মেঝেতে সারি সারি ক্যান্ডল লাইট আবেশি সুবাস ছড়িয়ে জ্বলছে... রুমে খুব মৃদু লয়ে পিয়ানোর সুর বাজছে, ফুলের পাপড়ি আর গোলাপজল মেশানো ঈষদুষ্ণ বাথটাবের জলে একটু পরেই নেমে পড়বেন ইশরাত, হায়দারকে নিয়ে- আকণ্ঠ ডুববেন!

হ্যাঁ, সেদিন সাপের সঙ্গম দেখে বিহ্বল সাজ্জাদ যেমন করে খেই হারিয়ে তার মাঝেই ডুবে গিয়েছিল, তেমনি হায়দারকে নিজের মাঝে ডুবিয়ে ফেলবেন আজ!

বাইরে থেকে জুতোর শব্দ ভেসে আসছে- শিহরিত ইশরাত এগিয়ে যান- সাফারির ঘ্রাণ ছড়িয়ে হায়দার ঢুকছে -নিবিড় উষ্ণ আলিঙ্গনের পর কম্পিত শিহরিত ইশরাতের চিবুক ধরে হায়দার বলে ওঠেন-

আই এম সো লাকি দ্যাট আই গট ইউ- ! সত্যি তুমি এসে আমার জীবন ধন্য করেছ...!


হঠাৎ করেই ঘটলো, ইশরাত চৌধুরীর সাথে রাউন্ড শেইপ বাথটাবে আকণ্ঠ ডোবার আগেই ডুবে গেলেন ওয়াহিদ হায়দার, ইশরাতের অলীক গল্পের বাস্তব চরিত্র সাজার প্রয়াসে ওয়াশরুমে গিয়ে তেজী হবার ওষুধ খেয়েছিলেন, হঠাৎ, বুকে ব্যাথা করছে তার, চাপচাপ ব্যথা, বামদিকে, সাথে অসহ্য শ্বাসকষ্ট। ডুবে যাচ্ছেন হায়দার-লেডি কিলার ওয়াহিদ হায়দার!

ঢাকার পথে ছুটে চলেছে সুলেমানের গাড়ী, অপ্রস্তুত আর বিপর্যস্ত ইশরাতকে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি থেকে বাঁচার উপায় সুলেমানই দেখিয়েছে, হাইওয়ে ধরে ছুটে চলেছে কালো কাচ তোলা গাড়ি পেছনের সিটে অর্ধচেতন হায়দারকে নিয়ে। ইশারায় নিজের ফোনটা চেয়েছেন হায়দার, পাননি। শাহানা আর প্রবাসী সন্তানদের মুখগুলো মনে পড়ছে হায়দারের, একটু অক্সিজেন চাই, চাই একটু আলো... আধোচেতনে একটু আলো খুঁজছেন তিনি!

অন্ধকার খুঁজছেন ইশরাত চৌধুরী, ঘন কালো অন্ধকার।

ছুটে চলা গাড়ির ভিড় এড়িয়ে অন্ধকারে নির্জন ঝোঁপ খুঁজছেন তিনি! ঝোঁপ দেখলেই নির্জন অন্ধকারে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে হবে ওয়াহিদ হায়দারকে...!

অন্যায় এক অন্ধকারের খোঁজে ছুটে চলেছে ইশরাত চৌধুরীর কালো কাচ তোলা গাড়ি। হ

অলঙ্করণ : মনিরুজ্জামান পলাশ