পয়লা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব - ইকবাল খোরশেদ

07 Apr 2024, 12:37 PM প্রবন্ধ শেয়ার:
পয়লা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব - ইকবাল খোরশেদ



পয়লা বৈশাখ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দিনটি নববর্ষ হিসেবে পালন করা হয়। পয়লা বৈশাখ বাঙালির সর্বজনীন লোকউৎসব। এ-দিন আনন্দঘন পরিবেশে বর্ষবরণ করা হয়। বাঙালির কাছে পয়লা বৈশাখ বা বছরের প্রথম দিন হলো কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় নববর্ষ উদ্যাপন করা হয়।

লোকবাংলায় নববর্ষ ছিল মূলত কৃষিউৎসব। এ-উৎসবের মূলে কৃষক ও কৃষি। মোঘল শাসনামলে হিজরি সনের ভিত্তিতে বছর গণনা করা হতো। বাংলার কৃষিউৎপাদন ঋতু বদলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ফলে হিজরি সন অনুসারে দিন গণনা করা হলে কৃষকদের ফসলি সন গণনায় সমস্যা হয়। অন্যদিকে কৃষকের কাছ থেকে জমিদারদের খাজনা আদায়েও সমস্যা দেখা দেয়। কৃষক ও জমিদারের সমস্যা দূর করতেই মূলত বাংলা সনের প্রবর্তন করা হয়। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে হুমায়ুনের মৃত্যুর পর মাত্র ১৩ বছর বয়সে রাজসিংহাসনে আরোহণ করেন সম্রাট আকবর। আকবর ১৫৫৬ থেকে ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। সিংহাসনে আরোহণের ২৮ বছর পর সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের ১০-১১ তারিখে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন।

আকবর তার রাজসভার নবরতেœর বাইরে দশমরতœ আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজীকে বাংলা সন প্রবর্তনের দায়িত্ব দেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেউল্লাহ সিরাজীর নেতৃত্বে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তৎকালীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের বর্ষ গণনার রীতি সৌর ও চন্দ্র বৈশিষ্ট্যে সমন্নিত করেন। তিনি একটি কেন্দ্রীয় ইরানি সনের পাশাপাশি বিভিন্ন অঞ্চলের ঋতু ও কৃষিউৎপাদনের দিকে লক্ষ্য রেখে প্রজাদের খাজনা দেওয়ার সুবিধার্থে নানা আঞ্চলিক সনের কাঠামো নির্দেশ করেন। সেই কাঠামো অবলম্বনেই ফসলি সন হিসেবে বাংলা সন চালু হয়। সে-কালের ভারতবর্ষে প্রবর্তিত অন্যান্য ফসলি সনের মধ্যে আমনি সন, বিলায়েতি সন, সুরাসানি সন উল্লেখযোগ্য। আকবরের জীবনীকার আবুল ফজল রচিত ‘আইন-ই-আকবরি’ থেকে জানা যায়, সম্রাট এমন একটি ত্রুটিমুক্ত এবং বিজ্ঞানসম্মত সৌর সনের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্যই আদর্শ হবে। বাংলা সনের মধ্যে তার সে-আকাক্সক্ষা পূর্ণ হয়েছিল। বাংলা সন একেবারে স্বকীয়। প্রথম দিকে ফসলি সন হিসেবে পরিচিতি লাভ করলেও পরবর্তীকালে নতুন এই সনটি বঙ্গাব্দ নামে পরিচিতি পায়।

সে-কালে বাংলা অঞ্চলে ২৪টির মতো সন চালু ছিল। সে-সব সন ছিল রাজা-বাদশাহ, ধর্ম বা সীমিত অঞ্চলের কিন্তু বাংলা সন বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের নামে। আকবরের শাসনামল [১৫৫৬-১৬০৫] থেকেই বাংলায় নববর্ষ পালনের সূচনা। সে-সময় বাংলার কৃষকেরা চৈত্রমাসের শেষ দিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং ভূ-স্বামীর খাজনা প্রদান করতেন। পরদিন অর্থাৎ নতুন বছরের প্রথম দিন ভূ-স্বামীরা তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ-উপলক্ষে তখন মেলা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। ক্রমান্বয়ে পারিবারিক ও সামাজিকজীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে পয়লা বৈশাখ আনন্দময় ও উৎসবমুখী হয়ে ওঠে এবং বাংলা নববর্ষ শুভদিন হিসেবে পালনের রীতি চালু হয়।

অতীতে নববর্ষ ছিল একান্তই কৃষিভিত্তিক উৎসব। এ-উৎসব ‘আমানিউৎসব’ নামে অভিহিত। আমানিউৎসবের লক্ষ্য ছিল কল্যাণ ও পারিবারিক কৃষির সমৃদ্ধি কামনা। এ-পারিবারিক উৎসবের আচার সম্পন্ন করতেন বাড়ির কর্ত্রী। সারাবছরের শান্তি-সুখ-সমৃদ্ধি এবং উৎকৃষ্ট ফসল ফলানোর আশা-আকাক্সক্ষায় পালন করা হতো এ-কৃষিউৎসব। এ-উৎসব উপলক্ষে গ্রামবাংলার কৃষকপরিবারে চৈত্রসংক্রান্তির রাতে গৃহিণীরা ‘আমানি’ প্রস্তুত করতেন। একটি বড়ো মাটির হাঁড়িতে বেশি পরিমাণ পানির মধ্যে আতপচাল আর কাঁচা আম ভেজানো হতো এবং ওই হাঁড়িতে কচিপাতার একটি আমগাছের ডাল রাখা হতো। নতুন বছরের প্রথম ভোরে গৃহিণী বাড়ির সবাইকে জাগিয়ে তুলে রাতে ভেজানো চাল খেতে দিতেন এবং সবার গায়ে আমের ডাল দিয়ে ওই হাঁড়ির জলের ছিটা দিতেন। চালভেজানো হাঁড়ির জল ঘরের চারপাশেও ছিটিয়ে দেওয়া হতো। বিশ্বাসমতে, এতে শরীর ঠান্ডা থাকে, সারাবছর ফসলের উৎপাদন ভালো হয় এবং গৃহে সুখ ও শান্তি বিরাজ করে। এ-দিনে সবাই ভালো খাবার-দাবারের আয়োজন করে। লোকবিশ্বাস এই যে, বছরের প্রথমদিন ভালো খেলে সারাবছরই ভালো খাওয়া যাবে।

অতীতে নববর্ষের আরেকটি মূল উৎসব ছিল হালখাতা। এটি পুরোপুরিই একটি অর্থনৈতিক ব্যাপার। গ্রামে-গঞ্জে-নগরে ব্যবসায়ীরা নতুন বছরের শুরুতে তাদের পুরনো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। এ-উপলক্ষে তারা নতুন-পুরাতন খদ্দেরদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন শুরু করতেন। এ-অনুষ্ঠানটি খুব সীমিত আকারে এখনো কোথাও কোথাও চালু আছে।

নববর্ষউৎসব বাংলার গ্রামীণজীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। নববর্ষে গ্রামীণ জনপদের মানুষ ঘর-বাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখে, ঘরের জিনিসপত্র ধোয়ামোছা করে এবং সকালে গোসল করে ; পূত-পবিত্র এ-দিনটিতে ভালো খেতে, ভালো থাকতে এবং ভালো পরতে পারলে তারা ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক বলে মনে করে। নতুন বছরের প্রথম দিনে ঘরে ঘরে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীরা আসেন। মিষ্টি-পিঠা-পায়েসসহ নানা রকমের লোকজ খাবার তৈরির ধুম পড়ে যায়। পরস্পর নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় চলে। প্রিয়জনকে উপহার দেওয়ার মাধ্যমেও নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় হয়, যা শহরাঞ্চলে এখন বহুল প্রচলিত।

নববর্ষের মূল আকর্ষণ বৈশাখিমেলা। মেলার আমেজে নববর্ষ উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। সর্বজনীন বৈশাখিমেলা বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে বসে থাকে। কোথাও তিনদিন কোথাও পাঁচদিন আবার কোথাও-বা সাতদিন ধরে চলে বৈশাখিমেলা। লোকজ এ-সব মেলায় জাতি-ধর্ম-বর্ণ-বয়সভেদে সবধরনের লোক কেনা-বেচা করে। বৈশাখিমেলায় স্থানীয় কৃষিজাতপণ্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাতপণ্য, কুটিরশিল্পজাতসামগ্রী, সবধরনের হস্তশিল্প ও মৃৎশিল্পজাতসামগ্রী পাওয়া যায়। এ ছাড়াও শিশু-কিশোরদের খেলনা, নারীদের সাজ-সজ্জার সামগ্রী ; বিভিন্ন লোকজ খাদ্যদ্রব্য যেমন : চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা নানা প্রকার মিষ্টান্নসহ বিচিত্র দ্রব্য-সামগ্রীর সমারোহ থাকে। মেলায় বিনোদনেরও ব্যবস্থা থাকে। পুতুলনাচ ; নাগরদোলা ; সার্কাস ; বায়োস্কোপ ; যাত্রাপালা, লোকসংগীত, জারি, সারি, গম্ভীরা, বাউলগান, নাটক ; চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়।

বাংলাদেশের যে-সব স্থানে বৈশাখি মেলা বসে সে-সব স্থানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সাভার, রংপুরের পায়রাবন্দ, দিনাজপুরের ফুলছড়ি, ঘাট এলাকা, মহাস্থানগড়, কুমিল্লার লাঙ্গলকোট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মহেশপুর, খুলনার সাতগাছি, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, সিলেটের জাফলং, মণিপুর, বরিশালের ব্যাসকাঠি, বাটনাতলা, গোপালগঞ্জ, মাদারিপুর, টুঙ্গিপাড়া, মুজিবনগর প্রভৃতি।

ঢাকার কাছাকাছি শুভাঢ্যার বৈশাখিমেলা, টঙ্গির স্বানকাটা মেলা, মিরপুর দিগাঁও মেলা, সোলারটেক মেলা, শ্যামসিদ্ধি মেলা, ভাগ্যকুল মেলা, কুকুটিয়া মেলা এবং রাজনগর মেলা উল্লেখযোগ্য। দিনাজপুরের ফুলতলি, রানিশংকৈল, রাজশাহীর শিবতলির বৈশাখি মেলাও ব্যাপক জনপ্রিয়।

কালের বিবর্তনে নববর্ষউৎসবের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক পুরনো রীতি-আচার বা উৎসবের বিলুপ্তি ঘটেছে, আবার যুক্ত হয়েছে অনেক নতুন উৎসব। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে ‘পুণ্যাহ’ উৎসবেরও বিলুপ্তি ঘটেছে। সে-কালে পয়লা বৈশাখ ছিল জমিদারদের পুণ্যাহ’র [পুণ্যকর্ম] অনুষ্ঠানের পক্ষে শাস্ত্রমতে প্রশস্ত বা উপযুক্ত দিন। জমিদার কর্তৃক প্রজাদের কাছ থেকে নতুন বছরের খাজনা আদায় করার দিন ছিল পয়লা বৈশাখ। ঢাকার ঘুড়ি ওড়ানো এবং মুন্সিগঞ্জের গোরুর দৌড় প্রতিযোগিতা ছিল একসময় নববর্ষের অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান। পূর্বোক্ত দুটিসহ ঘোড়দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, পায়রা ওড়ানো, নৌকাবাইচ বহুরূপীর সাজ ইত্যাদি গ্রামবাংলার জনপ্রিয় খেলা বর্তমানে আর তেমন একটা দেখা যায় না।

পুরনো বছরের বিদায় এবং নতুন বছরের বরণ উপলক্ষে বাংলাদেশের পাহাড়ি আদিবাসীরা তিনদিনব্যাপী বর্ষবরণউৎসব সেই আদিকাল থেকে পালন করে আসছে। বাংলা নববর্ষ ও চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয়-সামাজিক উৎসব ‘বৈসাবি’ হলো সবচেয়ে বড়ো উৎসব। চাকমাদের কাছে এ-উৎসব ‘বিজু’, মারমাদের কাছে ‘সাংগ্রাই’ এবং ত্রিপুরাদের কাছে ‘বৈসুক’ বলে পরিচিত হলেও গোটা পার্বত্য অঞ্চলে এটি ‘বৈসাবি’ নামেই অভিহিত। ‘বৈসুক’, ‘সাংগ্রাই’ ও ‘বিজু’ এ-নামগুলোর আদ্যাক্ষর নিয়ে ‘বৈসাবি’ শব্দের উদ্ভব। বিদায়ী বছরের শেষ দু’দিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিন,- এই তিনদিন মূলত ‘বৈসাবি’ পালন করা হয়। মারমা আদিবাসীরা নববর্ষের দিন ঐতিহ্যবাহী ‘পানিখেলা’র আয়োজন করে থাকে। পানি তাদের কাছে পবিত্রতার প্রতীক। এদিন মারমা তরুণ-তরুণীরা পরস্পরের গায়ে পানি ছিটিয়ে নিজেদের পবিত্র ও শুদ্ধ করে নেয়। পাহাড়িদের মাঝে এই পানিউৎসব অত্যন্ত জনপ্রিয়।

পাহাড়িরা ‘বৈসাবিউৎসব’ তিনটি ভাগে পালন করে। প্রথম দিনটির নাম ফুলবিজু। এদিন শিশুকিশোরেরা ফুল তুলে ঘর সাজায়। দ্বিতীয় দিনটি হলো ‘মুরুবিজু’। এদিন নানা রকম সবজির সমন্বয়ে একধরনের নিরামিষ রান্না করা হয়, যার নাম ‘পাজন’। এটি ‘বৈসাবি’র অন্যতম বৈশিষ্ট্য এবং এটিই ‘বৈসাবি’র মূল অনুষ্ঠান। ‘বৈসাবি’ উপলক্ষে পাহাড়িরা নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী পিঠা ও মিষ্টান্ন তৈরি করে। এ-উপলক্ষে আদিবাসীরা বিভিন্ন খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলার আয়োজন করে। এদিন অতিথিদের জন্য সবার ঘরের দরজা উন্মুক্ত থাকে। হ ছবি : সংগ্রহ