বহুমাত্রিক অভিনয়শিল্পী ফারজানা ছবি দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে অভিনয়শিল্পের সঙ্গে যুক্ত আছেন। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করে মানুষের ভালোবাসা ও প্রশংসায় ভেসেছেন। সম্প্রতি তিনি একটি সিনেমায় অনবদ্য অভিনয়ের জন্য ‘বাইফা অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করেন। তার দীর্ঘ ক্যারিয়ার, প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি, আগামীর কাজ-সহ নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন আনন্দভুবন সম্পাদক ইকবাল খোরশেদ। তারই চুম্বক অংশ তুলে ধরছেন শেখ সেলিম...
ইকবাল খোরশেদ : অভিনয়ে দীর্ঘসময় পার করছেন। ক্যারিয়ারের যাত্রার বয়েস ২৬ বছর। কোন আকর্ষণে এই যাত্রা শুরু করেছিলেন ?
ফারজানা ছবি : একজন মানুষ কখনোই শিল্পী হয়ে জন্মায় না, কিংবা ছেলেবেলায় বলা যায় না তার ক্যারিয়ার কোন দিকে যাবে। সেই সময় সিদ্ধান্তও নেওয়া যায় না আমি শিল্পী হব। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল, একটু একটু করে শিল্পের বিভিন্ন জায়গায় বিচরণ করে এগিয়েছি। আমার কাছে মনে হয়েছে ব্যক্তির ক্ষমতার চেয়ে, শিল্পের ক্ষমতা আরো বেশি জোরদার। ব্যক্তি যদি মনে করে, আমি এই মাধ্যমে কাজ করব, আর শিল্প যদি তাকে এখানে চায় তবে সে সেখানে কাজ করতে পারবে। আমার ক্ষেত্রে তাই হয়েছে, আমি ছেলেবেলা থেকেই নাচ, গান শিখেছি, ছবি এঁকেছি, লেখালেখি করেছি, সব শিল্প মিলিয়ে দেখলাম অভিনয় শিল্প আমাকে টানে। আমার খুব ইচ্ছে একজীবনে হাজার জীবন বাঁচার। অভিনয় এমন একটি মাধ্যম, একটি জীবনের মধ্যে দিয়ে আমি হাজার জীবনের মধ্যে পরিভ্রমণ করতে পারছি। এক মানুষ হয়ে অন্য মানুষের জীবনে বিচরণ করার অবাধ ক্ষমতা, অবাধ অধিকার এটাই আমাকে আকর্ষণ করেছে অভিনয়ে আসতে।
ইকবাল খোরশেদ : আপনি কয়েকটি মাধ্যমে অভিনয় করেন, বেতার, টেলিভিশন, বড়োপর্দা ওটিটি প্লাটফর্ম। এগুলোর মধ্যে অভিনয়ের কোনো তারতম্য হয় কী না ?
ফারজানা ছবি : প্রত্যেকটি শাখার অভিনয়ের প্যাটার্ন ভিন্ন। নিজেকে উপস্থাপনের ধরন ভিন্ন। যদি বেতারের কথা বলি, সেখানে শুধু কণ্ঠ দিয়ে একজন শ্রোতাকে পুরো সিচুয়েশনটা বিশ^াগযোগ্য করে তুলতে হচ্ছে। পুরো অনুভূতিটা কণ্ঠ দিয়ে বুঝাতে হচ্ছে। টেলিভিশনের কথা যদি বলি, টেলিভিশনকে আমরা ড্রয়িংরুম মিডিয়া বলে থাকি। আপনি বসার ঘরে উচ্চকিত অভিনয় করতে পারবেন না। লাউড ভয়েজ এড়িয়ে চলতে হবে, একটা পরিমিত বোধ নিয়ে কাজটা করতে হবে। সিনেমার কথা যদি বলি, এখানে দর্শক টিকেট কেটে সিনেমা দেখতে আসেন, সিনেমায় আপনাকে জীবনবোধ দিতে হবে, সমসাময়িক গল্প, বাস্তবতা বুঝাতে হবে এবং বিনোদন দিতে হবে। গান থাকবে, নাচ থাকবে, যেহেতু এখানে বড়ো অডিটোরিয়ামে আপনাকে কাজ করতে হচ্ছে সেখানে লাউড ভয়েজ দিতে হবে। মঞ্চেও তাই আপনাকে সরাসরি দর্শকের সঙ্গে কনটাক্ট করতে হচ্ছে। দর্শকের চোখে চোখ রেখে সংলাপ বলতে হচ্ছে, সেই সংলাপ দর্শকের মস্তিষ্কে মুহূর্তে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
ওটিটি প্লাটফর্মটা হচ্ছে সমসাময়িক বাস্তব বিষয়গুলোকে তুলে ধরার একটা প্রয়াস। তাই এখানে অবজারভেশন আরো বাড়িয়ে দিতে হবে একজন শিল্পীকে। আমি আমার অবস্থান থেকে যদি বলি যে, চরিত্রটা করছি, সেখানে আগে প্রবেশ করতে হবে, সেই চরিত্রটাকে আগে দেখতে হবে, এককথায় অনেক ডিটেইলস অভিনয় করতে হবে। যখন অভিনয় একদম ডিটেইলস হয়, তখন অভিনয় দর্শকের মনেপ্রাণে পৌঁছে যায়।
ইকবাল খোরশেদ : একজন দর্শক হিসেবে আপনার কাছে জানতে চাই, এই উপমহাদেশেই শুধু সিনেমাতে নাচ গান দেখি, হলিউডের ছবিগুলোতে নাচ গান দেখি না। এমন কী জাপানিজ বা ইরানের ছবিতেও না। শুধু বাংলাদেশ ও ভারতের ছবিগুলোতে দেখা যায়।
ফারজানা ছবি : আমি মনে করি চলচ্চিত্রে ভিন্নতা আছে, একেকটি চলচ্চিত্রের ধরন, সংজ্ঞা, ব্যাখ্যা ভিন্ন। পরিচালক তার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে উপস্থাপনের মাধ্যমে আমাদের যা দেখাচ্ছেন, আমরা তাই দেখছি, এবং একজন চলচ্চিত্রকারকে আমরা রূপকার বলি, কেন রূপকার বলি ? তিনি তার গল্পটা উপস্থাপন করেন নিজস্ব ভাবনা-চিন্তা, মূল্যবোধ ও বিশ^াসযোগ্যতা থেকে। চলচ্চিত্রের ভিন্নতার কারণে কোনো ছবিতে নাচ-গান থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে। বাংলাদেশ-ভারতের ছবিতে নাচ গানের একটি প্রচলন দেখি, সেজন্য পৃথিবীর সবদেশেই আমাদের ছবিগুলোর একটা আলাদা কদর রয়েছে।
ইকবাল খোরশেদ : আমাদের এখানে বিভিন্ন মাধ্যমে যে শিল্প তৈরি করা হচ্ছে, সেটার ফিডব্যাক কেমন পাচ্ছেন ?
ফারজানা ছবি : একদম যে শিল্প হচ্ছে না, এটা বলব না, আমি যদি শিল্পী না হতাম আমাকে এখানে নিমন্ত্রণ করে কথা বলার সুযোগ দিতেন না। আমার কোনো কাজ ভালো লেগেছে বলেই আপনি আমাকে ডেকেছেন, সেই জায়গা থেকে বলব, কিছু কিছু কাজ ভালো হচ্ছে, আবার কিছু কিছু কাজ গড়পড়তা হচ্ছে। আবার কিছু কিছু কাজ মানসম্মত হচ্ছে না বা শিল্পের যে সংজ্ঞা, সেই সংজ্ঞায় কিছু কাজ পড়ছে না।
ফারজানা ছবি : আমি যা দেখাতে চাই বা শোনাতে চাই সেগুলো শিল্পই হতে হবে ?
ফারজানা ছবি : আমরা কখনো সমসাময়িক গল্প বলছি, সেটা কী আমরা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে করছি ? তা কিন্তু নয়। কিন্তু সমসাময়িক গল্পটা বলছি, বোধের জায়গাটা পরিষ্কার হওয়া জরুরি। আমি সমসাময়িক চরিত্রে অভিনয় করছি কিংবা একটি ঐতিহ্যবাহী চরিত্রে অভিনয় করছি, সব যে উচ্চমানের শিল্প হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু আমার বোধের জায়গাটা পরিষ্কার করতে হবে।
ইকবাল খোরশেদ : আপনি অনেক ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন, অভিনয় করতে গিয়ে কি কখনো মনে হয়েছে এটা খুবই চ্যালেজিং ?
ফারজানা ছবি : শিল্প এবং নির্মাণ দুটো ভিন্ন শব্দ। আমরা কখনো কখনো দুটোকে মিলিয়ে ফেলি। আমরা যখন মেধা, চর্চা, জ্ঞান দিয়ে কোনো কিছু সাজাই তখন এটা শিল্প। সব নির্মাণ যে শিল্প হতে হবে এমন কোনো কথা নেই, আবার সব শিল্পকে নির্মাণ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া ধৃষ্টতা আমাদের জন্য ঠিক নয়।
আমি যখন নতুন একটি চরিত্রে কাজ শুরু করি, আমার মনে হয়, আজকেই আমি প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছি, প্রতিটি চরিত্র আমার কাছে নতুন, চ্যালেঞ্জিং এবং আমি যখন ক্যামেরার সামনে দাঁড়াই, প্রথমে আমি পরিচালকের কাছে, আমার চরিত্র চিন্তাধারা সবকিছু সমর্পণ করি, আমি চাই আমার পরিচালক আমাকে পরিচালিত করুক। তার মেধা মনন, চিন্তাধারা থেকে আমি যদি কিছু না কিছু শিখে যেতে পারি, সেটাই আমার জন্য অনেক বড়ো পাওয়া। আসলে আমরা অর্থের মূলে যে পারিশ্রমিক পাই সেটা কিছুই না, এটা এখন আছে, একসময় থাকবে না। কিন্তু আমাদের মন মস্তিষ্ক যা কিছু আহরণ করে সেটাই আমাদের সত্যিকার অর্থে উপার্জন। অর্থ নানাভাবেই উপার্জন করা যায়।
বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে ‘সীমানা পেরিয়ে’ নাটকে আমি বুদ্ধি ও শারীরিক প্রতিবন্ধী শিউলি চরিত্রে অভিনয় করেছি। সেই নাটকে অভিনয়ের জন্য সমালোচনা বিভাগে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছি। এই নাটকে অভিনয় করার আগে আমি ওই চরিত্রের মেয়েটির বাড়ি ধুপখোলায় যাই, সেখানে সারাদিন থাকার পরও মনে হলো একদিনে এই চরিত্রে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। আমি সেই মেয়েটির বাবা-মাকে বুঝিয়ে তাকে আমার বাসায় নিয়ে আসি, তার সাথে সাতদিন থেকেছি, একসঙ্গে খেয়েছি, ঘুমিয়েছি মাঝরাতে সে আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে তার জীবনের গল্প বলেছে। একসাথে কয়েকদিন থাকার পর এই চরিত্রে আমি অভিনয় করলাম। শুধু তাই নয়, এই মেয়েটি ৮-১০ বছর বয়েসে কেমন ছিল, সেটা জানার জন্য আমি আর একজন ৮-১০ বছরের প্রতিবন্ধী মেয়ের সাথে থেকেছি। আমি কিন্তু পুরস্কার পাওয়ার আশায় এই চরিত্রটি করিনি। চেষ্টা ছিল চরিত্রটি বাস্তবে রূপদান করার। এই কাজগুলো যখন করি, আমার কাছে তখন পাহাড় সমান চ্যালেঞ্জ। আমার চেষ্টা থাকে যে চরিত্রটি করি সে মানুষটিকে যেন আমি দেখতে পাই। কখনো কখনো সেই চরিত্রে অভিনয় করে দেখতে পাই, আবার কোনো কোনো চরিত্র দেখতে পাই না। যে চরিত্রটি আমি কল্পনায় দেখতে পাই, সেই চরিত্রটি আমি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারি।
ইকবাল খোরশেদ : যে প্রতিবন্ধী মেয়েটির চরিত্রে আপনি অভিনয় করলেন, সেই মেয়েটি যদি বাস্তবে না থাকত তাহলে আপনি কী করতেন ?
ফারজানা ছবি : খুব সুন্দর একটি প্রশ্ন, যেখানে আমার আত্মপক্ষের একটা জায়গা রয়েছে। সব চরিত্র আমরা দেখতে পাই না বা বাস্তব হয়ে ধরা দেয় না। এমন অনেক চরিত্র রয়েছে, যেমন একটি নাটকের চরিত্রে আমি আমার সন্তানকে খুন করি। এটা কিন্তু আমার দেখা চরিত্র নয়, কল্পনাতেও এই চরিত্র আসে না, আমি আমার সমস্ত চেষ্টা দিয়ে কাজটা করেছি, নাটকে এমন চরিত্রে কাজ করে অনেক সময় আমরা স্বাভাবিক হতে পারি না। আমি যখন কল্পনাশক্তি দিয়ে সেই চরিত্রটি ভাবছি, আমার মনে দারুণভাবে প্রভাব ফেলছে। এটা আমার শরীরের জন্যও রিসিভ করা কঠিন। এই রকম চরিত্র যখন করি কল্পনায় চরিত্রটি আঁকি।
মাঝে মাঝে এমন চরিত্র করতে গিয়ে মনে হয় সেই চরিত্রটি আমার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এই বুঝি আমাকে প্রশ্ন করবে, তুমি যে আমার চরিত্রটি নিয়ে হেপোক্রেসি করলে তুমি তো আমাকে দেখনি, আমার জীবনের মধ্যে দিয়ে গেলে আমার জীবন কোন অবস্থায় যাওয়ার জন্য আমি এই কাজগুলো করেছি ? তাহলে তো তুমি আমার উপর অন্যায় করলে, জাস্টিস হলো না আমার ওপর। এইরকম ভয় করে মাঝে মাঝে ঘুমাতে পারি না।
ইকবাল খোরশেদ : এটা কী কখনো আপনার সহশিল্পীর সঙ্গে শেয়ার করেছেন ?
ফারজানা ছবি : কখনো এইভাবে শেয়ার করিনি। কিন্তু কিছু পরিচালকের সঙ্গে শেয়ার করেছি। আজ আপনার সঙ্গে শেয়ার করলাম। আজকে আপনার সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছে, যারা এইসব চরিত্রে অভিনয় করেন তাদের সঙ্গে এই আলোচনাটা করব। অভিনয়ের সঙ্গে মাঝে মাঝে এমনভাবে ইনভলব হয়ে যাই, যখন আমি কাজ করে বাড়ি ফিরে আসি, বাড়ির লোকেরা আমাকে চিনতে পারে না, কখনো কখনো সহজভাবে নিতে পারে না। কিছুদিন আগে আমি ফ্রাইডে নামের একটি ওয়েব ফিল্মে অভিনয় করেছি। এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য সম্প্রতি ‘বাইফা’ সম্মাননা অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি। এটা পেয়ে আমি সন্তুষ্ট কারণ এই ছবিতে রাহেলা চরিত্রে অভিনয় করে মনে হয়েছে আমি সত্যিই রাহেলাকে দেখতে পেয়েছিলাম। যে চরিত্রের জন্য আমি রাহেলা হতে না পারি, সেই চরিত্রের জন্য পুরস্কার পেলে সন্তুষ্টি আসে না। ভেতরে ভেতরে পোড়ায়। রাহেলা চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে আমি এতই ইনভলব ছিলাম, আমার জীবনসঙ্গীর সঙ্গে একটু জটিলতা হচ্ছিল। তাকে আমি বুঝিয়েছি তন্ময়, রাহেলা চরিত্রে আমি অভিনয় করেছি, আমি শুধু রাহেলা ছিলাম সেখানে। তোমার সামনে বসে আছে ‘ছবি’। এটা তাকে বোঝাতে আমার দীর্ঘ সময় লেগেছে। ছবিটি যখন প্রিমিয়ার হয়, সেই প্রিমিয়ারে আমার জীবনসঙ্গী এসে ছবিটি দেখে কেঁদেছিলেন। রাহেলাকে তিনি কোনোভাবেই মাথা থেকে বের করতে পারছিলেন না। তখন আমি তাকে একটি বিষয়ে আশ^স্ত করেছিলাম, আমি যদি সৎভাবে রাহেলা হওয়ার চেষ্টা করে থাকি, তাহলে এই সততায় কোনো-না-কোনোভাবে সম্মাননা এনে দেবে। সেটা আমি তোমাকে উৎসর্গ করব। রাহেলা চরিত্রের জন্য ‘বাইফা অ্যাওয়ার্ড’ আমাকে সম্মাননা দিয়েছে এবং তখন আমার পুরস্কার আমার মা ও স্বামীকে উৎসর্গ করি।
ইকবাল খোরশেদ : আপনার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছিল শিল্পীর জীবন কখনো সহজ হয় না, নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে তাকে যেতে হয়।
ফারজানা ছবি : একদম ঠিক বলেছেন। মোহাম্মদ হোসেন জেমীর একটি ছবি করতে আমি গিয়েছি যুমনা নদীতে যেখানে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে, আমার কোলে দেড় মাসের এক শিশু তাকে আমি নিরাপত্তার জন্য বুকে ঝাপটে ধরে রেখেছি। সেসময়ে আমার ঘরে এক সন্তান এসেছে। তাকে রেখে শুটিং করতে যমুনা নদীতে যাই, সেই সময় আমার সন্তানের বয়েস মাত্র দেড় মাস। তার প্রচ- জ্বর ও চিকেন পক্স উঠেছে। তাকে রেখে আমাকে সেই কাজটি করতে হয়েছে। কাজের ক্ষেত্রে আমি কমিটেড। কোলের শিশুর মুখে আমার নিজের শিশুর মুখ প্রতিস্থাপন করেছি। একজন শিল্পীর জীবন ভীষণ কঠিন এবং অনেক সংগ্রামের।
ইকবাল খোরশেদ : আর কী কী স্ট্রাগল করতে হয় ?
ফারজানা ছবি : কখনো কখনো দেখা যায় একটি চরিত্রের জন্য আমি প্রস্তুতি নিয়ে সেটে গিয়েছি, সেটে গিয়ে দেখি সেই প্রস্তুতিটা তাদের নেই। আর একটি হচ্ছে, আমি যেভাবে চরিত্র নিয়ে ভেবেছি আমার ডিরেক্টর অন্যভাবে ভেবেছেন। তখন আর একটা স্ট্রাগল। শিল্পীদের সবাই বুঝতে পারে না। যে মানুষগুলো আমার পরিবারে আছেন আমার বন্ধু-স্বজন, তারা যে আমাকে বোঝার চেষ্টা করেন, তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
ইকবাল খোরশেদ : আপনি অভিনয়ের পাশাপাশি লেখেন, লেখার অনুপ্রেরণা কোথা থেকে পেলেন ?
ফারজানা ছবি : লেখার অনুপ্রেরণা আমার জীবনের দেখা থেকে, সেটাও সৌভাগ্য হয়েছে আমার অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। নানা জার্নি বিভিন্ন লাইফ, এই জার্নিগুলো আমাকে একটু একটু করে আলোড়িত করেছে। আমার দেখা জীবন থেকে যে জীবন দর্শন সংগ্রহ করেছি সেটা আমার লেখায় সহযোগিতা করেছে অনুপ্রেরণা দিয়েছে, সেইসাথে আমার পরিবারের মানুষগুলো বিশেষ করে আমার বাবা চাইতেন আমি লিখি, বাবার খুব পড়ার অভ্যাস ছিল, আমার বড়ো ভাইও প্রচুর পড়তেন। বাবা বলতেন, মানুষের কাছে না গেলে মানুষ চেনা যায় না। জীবনের মাঝে না গেলে জীবন দেখা যায় না। বাবা আর একটি কথা বলতেন, জীবনে সবাই তোমাকে ছেড়ে গেলেও লেখা তোমাকে কখনো ছেড়ে যাবে না। এবং তাই হয়েছে। প্রকৃতিবাদ, নিয়তিবাদ বলে একটি কথা প্রচলিত, প্রকৃতি আমাদের পরিচালনা করে নিয়তি কখনো কখনো অনিবার্য। আমার ক্ষেত্রে তেমন অলৌকিকভাবে ঘটে যায়। লেখা আমার অলৌকিক শক্তি ; অলৌকিক জীবন আচরণ। আমার সেজোভাই তো আমাকে লিখতে দেখলেই খুশি হয়ে যায়। মা চেয়েছেন আমার সব চেষ্টা শুদ্ধ হোক। আমার মায়ের বয়েস ৮০, তিনি কতটা প্রগতিশীল বলে শেষ করা যাবে না। মাও চান আমি লিখি। আমাকে আর একজন মানুষ সবসময় সাপোর্ট করে আসছেন। তিনি হলেন আমার জীবনসঙ্গী তন্ময় সরকার। তার সাপোর্ট না পেলে আমার এগিয়ে চলা এতটা মসৃণ হতো না।
ইকবাল খোরশেদ : অভিনয়শিল্পী না হলে ছবি কী হতেন ?
ফারজানা ছবি : সম্ভবত ডাক্তার হতাম। যদিও এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। কারণ, একটি অবস্থানে থেকে অন্য একটি অবস্থানে কীভাবে যেতাম বলতে পারি না। সময় নির্ধারণ করে দেয় কী করব ? কেন বললাম ডাক্তার হব, আমার পরিবারের ইচ্ছে ছিল। পড়াশোনায় ভালো ছিলাম বিধায় পরিবার চাইত আমি ডাক্তার হই। কিন্তু ওই যে, ব্যক্তির ক্ষমতার চেয়ে কর্মের ক্ষমতা অনেক বেশি। আমাকে আমার কর্মই পরিচালনা করেছে, আমি কোন দিকে যাব!
কেবলমাত্র শিল্পের মধ্যে বিচরণ করাই শিল্পবোধ নয়। জীবন সবচেয়ে বড়ো শিল্প। সংসার একটি শিল্প।
ইকবাল খোরশেদ : কথা বলাও একটি শিল্প-
ফারজানা ছবি : আমরা প্রত্যেকেই নিজের কথা বলতে চাই। কথায় মুক্তি আছে। আজ আপনার সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছে, অনেক কথাই বলা হয়নি বা কখনো সেই প্রসঙ্গ আসেইনি। আপনার সাথে কথা বলে ভেতরে ভেতরে মুক্তির স্বাদ পাচ্ছিলাম। সেজন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
‘আনন্দভুবন’ দীর্ঘদিনের একটি চেনা পত্রিকা। আমি যখন ক্যারিয়ার শুরু করেছি, তখন থেকেই এই নামটির প্রতি শ্রদ্ধা ছিল, ভালোবাসা ছিল। আমাকে নিয়ে আনন্দভুবন বিভিন্ন সময়ে অনেক লেখা লিখেছে। আমি কৃতজ্ঞ পত্রিকাটির কাছে।
ইকবাল খোরশেদ : ধন্যবাদ। একজীবনে আপনি হাজার জীবন উদ্যাপন করুন। আপনার আগামী দিনগুলো আরো আলোকিত হোক। ঈদের অগ্রিম শুভেচ্ছা।
ফারজানা ছবি : আনন্দভুবন-পাঠকদের জন্যও রইল ঈদের অগ্রিম শুভেচ্ছা