ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

07 Apr 2024, 12:13 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

[পর্বে প্রকাশিতের পর]


প্যারিসে এসে ডিজনিল্যান্ডে যাবো না, তাই কি হয় ? যদিও প্রথমে আমার একটু আপত্তি ছিল যে, এ ধরনের অ্যামিউজমেন্ট পার্কে সাধারণত শিশুরাই বেশি উপভোগ করে, আমি সেখানে গিয়ে কী করবো ? কিন্তু আমার কাজিন নাছোড়বান্দা, তার মতে প্যারিসে এসে ডিজনি না দেখে দেশে ফিরে গেলে তার নাকি মান থাকবে না। যাই হোক, ভাইয়ের মান রাখতে এক সকালে খাবার-দাবার প্যাক করে মোটামুটি সারাদিনের জন্য সদলবলে ডিজনির পথে রওনা হলাম। দল বলতে আমার ভাইয়ের পরিবার আর আমি মোট পাঁচজন। ডিজনির গেটে পৌঁছে টিকেটের জন্য কিউতে দাঁড়িয়ে এর দাম শুনে আমার তো আক্কেলগুড়–ম, পারলে তখনই আমি পিঠটান দিই। কিন্তু সবুজ ভাইয়ের (কাজিন) অতি উৎসাহে তা আর সম্ভব হলো না। সামনে ক্রিসমাস তাই ভ্রমণ পিয়াসীদের আনাগোনা চোখে পড়ার মতো। এখন মনে করতে পারছি না ঠিক কী কারণে যেন সেদিন ডিজনি নির্ধারিত সময়ের আগেই বন্ধ হয়ে যাবে আর এদিকে আমরা পৌঁছুতে পৌঁছুতে বেলা এগারোটা বাজিয়ে ফেলেছি। তাই অনেকটা তাড়াহুড়া ছিল, সবটা কাভার করতে পারবো কি না এই আশঙ্কাও ছিল। তবে, ঢোকার মুখেই চমৎকার একটি দৃশ্যের সাথে পরিচয় ঘটালো। সেদিন ছিল মিকি মাউস প্যারেড শো, প্রায় আধঘণ্টাব্যাপী চলা এই শোটা শিশুদের জন্য তো বটেই বড়োদের কাছেও এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। বিস্ময় আর মুগ্ধতায় আধঘণ্টা সময় যেন নিমিষেই কেটে গেল।

এরপর আমরা ডিজনিল্যান্ডের ম্যাপ দেখে বাছাই করছিলাম কোন দিক থেকে শুরু করবো। তবে যে রাইডের কাছেই যাচ্ছিলাম সেখানেই বিশাল লাইন। এর মধ্যেদিয়ে গুটিকয়েক রাইডে শিশুদের চড়িয়ে নিয়ে আমরা চলে গেলাম ডিজনিল্যান্ডের ফ্রন্টটিয়ার সেকশনে এটি একটি থিম বেজড সেকশন। বলা হয়নি পুরো ডিজনিল্যানডটি মূলত চারটি বিশেষায়িত বিভাগে বিভক্ত। ফ্রন্টটিয়ারল্যান্ড, ফ্যান্টসিল্যান্ড, আ্যাডভেঞ্চারল্যান্ড এবং ডিসকভারিল্যান্ড। ফ্রন্টটিয়ার সেকশনটিতে অন্যান্য সেকশনের তুলনায় আপত ভিড় কম থাকায় আমরা এখান থেকেই শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রথমেই বিগ থান্ডার মাউন্টটেইন ট্রিপে যাবো বলে লাইনে দাঁড়ালাম। এটি একটি রোলার কোস্টার, স্টেশনের আদল বেশ অদ্ভুত ; দেওয়া হয়েছে ভুতুড়ে ইফেক্ট তবে দেখে সত্যিই বলেই ভুল হয়। কোস্টারটি বেশ আঁকাবাঁকা, উচুনিচু পথ বেয়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছুলে আসলেই গা কেমন ছমছম করে ওঠে। বড়োদেরই কেমন আস্বস্তি হয় আর শিশুদের তো ভয় পাওয়া খুবই স্বাভাবিক। তবে, এই ভয়ের মধ্যে একটি রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ রয়েছে। এরপর আমাদের গন্তব্য থান্ডার মোসা রিভার বোট ল্যান্ডিং, সামুদ্রিক জাহাজের আদলে তৈরি সাড়ে তিনশো যাত্রী ধারণক্ষমতাসম্পন্ন মলি ব্রাউন নামের জাহাজটি পর্যটকদের পানিপথে বিগ থান্ডার মাউন্টনেইন পরিভ্রমণ করিয়ে আনে। প্রচীন বাষ্পীয় ইঞ্জিনের নকলে জাহাজ বেশ শব্দ করেই জেটি ছাড়লো। প্রকৃতিকে কাছ থেকে দেখবো বলে প্রায় সবাই, আমরাসহ অন্যান্য পর্যটকগণ জাহাজের ছাদে চলে যাই। কৃত্রিম বন, ছোটো ছোটো কৃত্রিম দ্বীপ তার পাশ দিয়ে বয়ে চলা খাল / নালা ধরে এগিয়ে গেলেই দেখা মেলে নানান বন্যপ্রাণীর কিছু জীবন্ত আর কিছু কৃত্রিম। যেমন, বানর, হরিণ শাবক, নানান জাতের পাখি, শাপ এসবই কিন্তু বাস্তব ; এর পাশাপাশি রয়েছে ভয়ংকর সব বন্যপ্রাণীর রেপ্লিকা যা হঠাৎ দর্শনে জীবন্ত বলেই মনে হয়। মাঝে মাঝে প্রচীন জনপদের টুকরো চিত্রের সাথে পরিচয় ঘটে। যদিও পুরো বিষয়টি সাজানো তবু মনে হচ্ছিল যেন সত্যি সত্যি আমরা সমুদ্রপথে গভীর অরণ্য ছাড়িয়ে যাচ্ছি।

এরপরই আমরা চলে যাই ডিজনিল্যান্ডের আ্যাডভেঞ্চারল্যান্ড সেকশনে, এটিও একটি কাল্পনিক বা রূপকথার জগৎ, যেখানে আফ্রিকা থেকে প্রাচ্য হয়ে ক্যারাবিয়ান অঞ্চলের দুঃসাহসিকতার গল্পের দৃশ্যমান উপস্থাপন ছিল। এর মূল আকর্ষণ পাতালপুরির পাপেট সা¤্রাজ্য, পাপেটের সাথে সাউ›ড ইফেক্ট দিয়ে অতিবাস্তব কল্পনার জগতটির বাস্তব রূপ ফুটিয়ে তোলার চমৎকার প্রয়াস ছিল। ছিল আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের গল্প। জলদস্যুদের দুঃসাহসিক সমুদ্রযাত্রা, গুপ্তধন লুণ্ঠনসহ নরবলির মতো ভয়াবহ সব গল্প। ছোটো নৌকায় করে সরু অন্ধকার জলপথ দিয়ে চলতে চলতে মনে হচ্ছিল যেন আমরা ভুল করে সত্যি সত্যি জলদস্যুদের সীমানায় ঢুকে পড়েছি, যেখানে বিশ্বাসঘাতকের শাস্তি মৃত্যুদ- আর বহিরাগতের সাজাও নিশ্চয়ই কঠোর, একটা গা ছমছমে অনুভূতি কাজ করছিল। তবে, জলপথে এ যাত্রাটি আমার এত উপভোগ্য ছিল যে, আমি / আমরা দুই দুইবার এই পথে ভ্রমণ করেছি।

আ্যাডভেঞ্চারল্যান্ড সেকশনের পুরোটাই কিন্তু পাতালপুরি ছিল না, আমরা আলো-আধারীর গুহা ছেড়ে বাইরে আসতেই ঝলমলে সূর্যের আলো কাঠের সাঁকো পথ ধরে চলে গেলাম আফ্রিকার সাফারিতে, এরপর ছিল ডিজনি গার্ডেন, যেখানে কাল্পনিক ফুলের কৃত্রিম বাগান, বাগানে চলতে চলতে সন্ধান মেলে টি-হাউজের। এই পর্যন্ত এসে আমরা বিশ্রামের জন্য থামলাম। সাথে করে আনা খাবার খেয়ে কিছুটা জিরিয়ে নিলাম, কেননা এরপর আমরা যাবো ডিসকভারিল্যান্ডে, যা শিশুদের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। আর স্বাভাবিকভাইে সেখানে ভিড়টাও বেশি হবে। তাই একটু রিচার্জ হয়ে নেওয়া ।

আগেই বলেছিলাম, আজ কোনো এক বিশেষ কারণে ডিজনিল্যান্ড অন্যান্য দিনের তুলনায় আগেই বন্ধ হয়ে যাবে এ-কারণে ডিসকভারিল্যান্ডে ভিড়টা স্বাভবিকের তুলনায় বেশিই ছিল, এতো ভিড় পেরিয়ে আমরা আদৌও কোনো রাইডে উঠতে পারবো কি না আমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। কেননা, এদিকে বেলা ফুরোবার নোটিশ দিয়ে দিনের আলো কমতে শুরু করছে। যদিও আমার ডিসকভারিল্যান্ডের কোনো রাইডেই ওঠার ইচ্ছে ছিল না। কারণ, এগুলো মারাতœক পর্যায়ের ভয়াবহ, আর টাকা খরচ করে কলজে শুকিয়ে যায় এমন ভয় পেতে আমি রাজি না। কিন্তু ভাতিজা সলোর অতি আগ্রহ আর ভাইয়ের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত রাজি হতেই হলো।

ডিসকভারিল্যান্ডে বিশেষ বিশেষ রাইডে বয়সের সীমা নির্ধারিত থাকায় সুপ্ত (ভাতিজা ছোটোটি) বেশ কিছু রাইডে চড়া থেকে বাদ পড়লো, যে কারণে ভাবিও আর এগোল না, অগত্যা আমি আর ভাতিজা সলো দুজনেই রওনা হলাম। সলো বেশ উচ্ছ্বসিত, মনে কোনো ভয়-ডরের লেস মাত্র নেই, এদিকে আমার কলিজা শুকিয়ে মরুভূমি। প্রথমেই আমরা স্টার ট্যুর নামে একটি ট্যুরের অংশ হয়েছিলাম যা স্টার স্পিড নামে এক বাহনে আমাদের তারাদের জগৎ ঘুরিয়ে আনে। দ্বিতীয় রাইডটিও ছিল স্পেস শিপ-জাতীয় কিছু। অনেকটা রোলার কোস্টারের আদলে, এটি এতই দ্রুতগতিসম্পন্ন্ ছিল যে, মনে হচ্ছিল সত্যি সত্যিই আমরা পৃথিবী থেকে ছিটকে যাচ্ছি। সত্যি বলতে কি আমি শেষ অবধি চোখ খোলা রাখতে পারিনি। এই রাইডটির নাম ছিল স্টার ওয়ার হাইপারস্পেস মাউন্টটেইন। যখন মাটিতে নামলাম মনে হলো জানে পানি পেলাম। এরপর কিছুক্ষণ সবাই মিলে Bazz Lightyear Laser Blust লেখা একটি বিশাল হলরুমে ঢুকলাম এর ভেতর লম্বা লাইন পেরিয়ে বেশ কিছু দরজা অতিক্রম করে আরেকটি হলরুমে প্রবেশ করলাম যেখানে বিভিন্ন ইফেক্ট দেওয়া ছিল। এটি মূলত ছোটো শিশুদের একটি ইভেন্ট আমরা বড়োরা এখানে শুধুই দর্শক। যেহেতু সুপ্ত এর আগে দুইটা রাইডে উঠতে পারেনি তাই সে বেশ বিমর্ষ ছিল এখানে এসে তার খুশি আর দেখে কে ! বেশ খানিকটা সময় এখানে কাটিয়ে আমরা যখন বাইরে বেরিয়ে এলাম তখন রীতিমতো অন্ধকার ; যদিও ঘড়ির কাঁটা সবে তিনটার ঘর অতিক্রম করলো, যাই হোক, আমরা ধীরে ধীরে পার্কিংয়ের দিকে এগুতে থাকলাম এর মধ্যেই দেখি মূল ফটকের কাছে ফায়ার ওয়ার্ক আর লেজার শো চলছে, চমৎকার এ আয়োজন মিস করার কোনো মানেই হয় না, তাই শো-এর পুরোটাই উপভোগ করলাম। এরপর ফিরতেই হয়, আগেই বলেছিলাম, আজ ডিজনি আগেভাগেই এর দরজা বন্ধ করবে। অবশ্য আমাদেরও আর ঘুরে বেড়ানোর এনার্জি নেই। অগত্যা পার্কিংয়ের পথই সই। তবে, গাড়িতে উঠে ডিজনির ম্যাপে চোখ বুলিয়ে হিসাব-নিকাশ করে দেখলাম, আমরা সারাদিনে ডিজনির এক চতুর্থাংশও দেখতে পারিনি। অবশ্য এতে আমাদের কোনো হাতও ছিল না ; একে তো শীতের বেলা, তার ওপর আজই ডিজনি অনিবার্যকারণ বশত আগেভাগে বন্ধ হতে হলো। যদিও আমরা বিষয়টি আগে জানতাম না, তবে জানলেও যে খুব বেশি লাভ হতো তাও না। কেননা, আমার ইউরোপে থাকার মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে, সামনে প্রতিটি দিনই গুনেগুনে খরচ করতে হবে। তাই যা পেলাম তাই বা মন্দ কী ! [চলবে]