ভালোবাসার লালগোলাপ -ইকবাল খোরশেদ

08 Feb 2021, 03:12 PM অভোগ শেয়ার:
ভালোবাসার লালগোলাপ -ইকবাল খোরশেদ

‘গোলাপ ছিঁড়িয়া কেহ কি পেরেছে হাসি তার কেড়ে নিতে ?/ধুলোয় পড়েও হাসি ফোটে তার পাপড়িতে পাপড়িতে।’ -জালালউদ্দিন রুমি

গোলাপ নিয়ে দেশে-দেশে কালে-কালে মুখে-মুখে রটেছে কত না গল্প, কত না উপকথা। দুনিয়াজুড়ে নানা রঙের গোলাপ ফুটলেও বেশিরভাগ উপকথা গড়ে উঠেছে লালগোলাপ নিয়ে। সব উপকথার সারকথা লালগোলাপ হলো ভালোবাসার প্রতীক।

প্রেমিকা ভিনাস তার প্রেমাস্পদ অ্যাডিসনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার বাসনায় অধীর পায়ে অভিসারে যাচ্ছিলেন এক কাঁটাবনের মধ্যদিয়ে। ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে হাঁটার সময় কাঁটার আঘাতে তার পা থেকে রক্ত ঝরে। সেই রক্তই ফুটে ওঠে লালগোলাপ হয়ে। 

অন্য উপাখ্যানে পাওয়া যায় এর বিপরীত ভাষ্য, অ্যাডিসনকে শিকারীর বেশে বনে ঘুরতে দেখে গ্রিকপ্রেমদেবী আফ্রোদিতি তার প্রেমে পড়েন এবং প্রেমাস্পদের সঙ্গ লাভের উদ্দেশে স্বর্গ ত্যাগ করে মর্ত্যরে বনে ঘুরতে থাকেন। কথাটা আফ্রোদিতির আরেক প্রেমিক রণদেবতা অ্যারেসের কানে গেলে ঈর্ষাকাতর অ্যারেস বুনোশূকরের বেশে অ্যাডিসিনকে আক্রমণ করে হত্যা করেন। ক্ষতবিক্ষত অ্যাডিসনের শরীর থেকে ঝরেপড়া রক্ত থেকে জন্ম নেয় লালগোলাপ।

কেউ বলেন, ভিনাসের সৌন্দর্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে তার প্রতিদ্ব›দ্বীরূপে গোলাপ সৃষ্টি করেন সিবিল। আবার কেউ বলেন, প্রেমের দেবতা কিউপিডের হাসির মূর্তরূপই হলো গোলাপ। আরেক দল বলেন, ঊষাদেবী অরোরার কেশবিন্যাসের সময় ঝরে পড়েছিল গোলাপ।

অন্য গল্পমতে গোলাপের আর্বিভাব হয় এক কুমারীর প্রার্থনায় ; ঘটনাটা বেথেলহেমের। ওই কুমারীকে অন্যায়ভাবে জীবন্ত দাহ করতে গেলে তিনি বিধাতার উদ্দেশে প্রার্থনায় বসেন। প্রার্থনা মঞ্জুর হলে বিধাতা লেলিহান কাঠের টুকরোগুলোকে লালগোলাপে আর অপ্রজ্বলিতগুলোকে সাদাগোলাপে পরিণত করেন।

আরেক গল্পে আছে, গোলাপ স্বর্গেই ফুটেছিল, তবে সাদাগোলাপ। গোলাপের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে ইভ তাকে চুম্বন করতে গেলে সাদাগোলাপটি লজ্জায় লাল হয়ে যায়, ফুটে ওঠে লালগোলাপ। 

আরব্য উপাখ্যানে আছে, পদ্মফুল রাতে ঘুমায় বলেই দিবানিশি ফুটে থাকার জন্য বিধাতা সাদাগোলাপ সৃষ্টি করেন। গানের পাখি বুলবুল ভালোবেসে গোলাপটিকে আলিঙ্গন করতে যায় এবং কাঁটার আঘাতে আহত হয়, তার রক্তে রঞ্জিত হয়ে সাদাগোলাপটি লালগোলাপ হয়ে যায়। 

আরেক রূপকথায় আছে, করিন্থের রূপসী রানি রোদান্তে একদঙ্গল প্রেমিকের অবিরাম উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে ডায়নাদেবীর মন্দিরে আশ্রয় নিলে ডায়নার পূজারীর দল রূপে মুগ্ধ হয়ে দেবীর বদলে রোদান্তের পূজা শুরু করে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ডায়নার ভাই অ্যাপেলো রূপসী রোদেন্তাকে গোলাপ আর প্রেমিকদের পোকামাকড়ে পরিণত করেন।  

গোলাপের উপকথা ছেড়ে এবার এর ইতিহাসের কিছু খোঁজ-খবর নেওয়া যাক :  বলা হয়, পৃথিবীতে মানুষের আর্বিভাব দশ লাখ বছর আগে। আর গোলাপের সূচনা ধরা হয় তিনশ’ থেকে ছয়শ’ বছর পূর্বে। প্রাকৃতিক গোলাপের জন্ম পশ্চিম এশিয়ার ফ্রিজিয়ায়, যার ভৌগোলিক অবস্থান বর্তমান ইরাক-তুরস্কের সীমান্তের দুইপাশজুড়ে। আর আধুনিক গোলাপের জন্ম ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলে। প্রকৃতপক্ষে এশিয়ার কাছ থেকে গোলাপটি পেয়ে নিজেদের উদ্ভাবনী প্রতিভাযোগে ইয়োরোপীয়রা একে পরিণত করেছে অনিন্দ্যসুন্দর আধুনিক গোলাপে। 

এশিয়া থেকে গোলাপ প্রথমে যায় ইয়োরোপের গ্রিসে এবং স্থান পায় গ্রিকদের মনে ও মগজে। এরপর গোলাপ যায় রোমে এবং স্থান পায় তাদের বাগানে, প্রাত্যহিক জীবনে। রোমানরা কোনো কিছুকেই মনেপ্রাণে ভালোবাসতে পারেন না, তারা ভালোবাসেন দেহমনে। গোলাপের প্রতি তাদের আসক্তির শারীরিক দিকটি ছিল ইতিহাসে নজিরবিহীন। রোমের বিত্তবানেরা গোলাপের ওপর হাঁটতেন, বসতেন, সঙ্গম করতেন এবং ঘুমাতেন। এমনকি গোলাপ তারা খেতেনও- গোলাপের মধু, গোলাপের পুডিং, পিঠেপুলি, হালুয়া রুটি। পান করতেন গোলাপের সুরা, স্নান করতেন গোলাপের জলে। রোমের পতনের সঙ্গে খতম হয়ে যায় রোমানদের গোলাপপ্রীতিও। শুরু হয় গোলাপের দুর্দিন, এই দশা কাটিয়ে খ্রিস্টসভ্যতা জয় করতে গোলাপের লেগে যায় প্রায় চারশ’ বছর। এরপর অবশ্য লালগোলাপ সম্মানিত হয় যিশুর শোণিতের প্রতীকরূপে এবং সাদাগোলাপ মেরির কুমারিত্বের। খ্রিস্টান চার্চের আশ্রয়ে মধ্যযুগের দুর্দিন কাটিয়ে গোলাপ তার আধুনিক লালনকারীদের দেখা পায়। এ-সময়ে ইংরেজ-ফরাসিদের সাধনায় নবজন্ম লাভ করে গোলাপ। 

ইংরেজ-ফরাসিদের গোলাপপ্রীতির বৈশিষ্ট্য রোমানদের বিপরীত। গোলাপের প্রতি তাদের প্রীতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধামিশ্রিত। গোলাপের গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন সম্রাজ্ঞী জোসেফিন। তাঁরই উদ্যোগ ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ঊনিশ শতকের ফ্রান্স বিশ্বের গোলাপরাজধানীর খ্যাতি অর্জন করে। আর সে-সূত্রে আধুনিক গোলাপের জন্মও হয় ফ্রান্সেই, ১৮৬৭ সালে। সঙ্গত কারণে ফুলের নামও রাখা হয় ‘লা ফ্রঁস’। গোলাপের ইতিহাসে ব্যক্তিবিশেষের অবদানের বিচারে গোলাপের এই নিষ্ঠাবতী প্রেমিকা এককথায় অনন্যা। গোলাপ যদি হয় ফুলের রানি, জোসেফিন তবে গোলাপের রানি। 

ইয়োরোপ ছেড়ে এবার দৃষ্টি ফেরানো যাক ভারতবর্ষের দিকে। ভারতবর্ষে গোলাপ আনেন প্রথম মোঘলসম্রাট জহিরুদ্দিন মোহাম্মদ বাবর (১৪৮৩-১৫৩০), ইরাকের বসরা থেকে। গোলাপের জন্য আলাদা বাগান করার ধারণাও তারই প্রবর্তনা। তবে ধারণাটি ব্যাপকভাবে বাস্তবায়িত হয় চতুর্থ মোঘলসম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে (১৬০৫-২৭), গোলাপপ্রেমী সম্রাজ্ঞী মেহেরুন্নিসা নূরজাহানের উৎসাহে। তার উদ্যোগে ও প্রেরণায় গোলাপচর্চা ছড়িয়ে পড়ে আমির-ওমরাহ ও অন্যান্য রাজন্যবর্গের মধ্যে। স্থাপিত হয় শালিমার, নিশাতবাগ প্রভৃতি গোলাপবাগান- দিল্লি-আগ্রা-লাহোর প্রভৃতি গোলাপানুকূল অঞ্চলে।

বঙ্গদেশে গোলাপ আসে ব্রিটিশযুগে, উপনেবেশকদের হাত ধরে। উপনেবেশক জাতিটি ছিল গোলাপপাগল। কোটের বাটনহোলে গোলাপ পরতেন, ভেতরে পিন মেরে লাগিয়ে রাখতেন বাটনহোল-জলাধারও। আড়ালে থাকা জলভরা নলটি গোলাপের বৃন্তটিকে জলে ডুবিয়ে রেখে ফুলটির সজীবতার আয়ু বাড়াত। 

আধুনিক গোলাপ ব্যাপকভাবে বাংলাদেশে আসে স্বাধীনতার পর। আজকাল বাংলাদেশের ফুলের বাজারে সারাবছরই গোলাপ পাওয়া যায়। প্রেমিক-প্রেমিকার প্রেম নিবেদন তো বটেই বিয়ে-শাদিসহ যাবতীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয় গোলাপ, বিশেষত ভালোবাসার লালগোলাপ।