বই নিয়ে কত কথা

07 Feb 2021, 02:38 PM অভোগ শেয়ার:
বই নিয়ে কত কথা

বাঙালি জাতির জীবনে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আসে অধিকার আদায়ের মূর্ত প্রতীক হয়ে। মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় বাংলার দামাল ছেলেদের আত্মদান ইতিহাসে বিরল। একুশের মহান ভাষা আন্দোলনই আমাদের স্বাধীনতার সূতিকাগার। তাই একুশ যেমন আমাদের আবেগে ভাসায় তেমনি অঅত্মপ্রত্যয়ী হতে শেখায়। একুশ এলে আমরা নত হই ভাষা শহিদদের স্মৃতির প্রতি, শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি তাঁদের আত্মত্যাগের কথা। শ্রদ্ধা নিবেদন করি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল ভাষাসংগ্রামীর প্রতি। একুশ এলে শুরু হয় বইমেলা। বাঙালির প্রাণের মেলা। এবছর বৈশ্বিক মহামারির কারণে হয়ত মেলা কিছুটা বিলম্বে শুরু হবে। তবু, আনন্দভুবনের পাঠকদের জন্য আমরা সাজিয়েছে বই নিয়ে কতকথা। লিখেছেন ফামেতা ইয়াসমিন...  


মানব সভ্যতার উন্মেষের সময় থেকে আজকের অবস্থানে এসে পৌঁছানোর যে সুদীর্ঘ যাত্রা- তার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বই। আরেকটু সহজ করে বলতে গেলে, এক প্রজন্মের অর্জিত জ্ঞানের উপর দাঁড়িয়ে পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ সেই জ্ঞানের ধারাটাকেই আরো সমৃদ্ধ করে তুলে দিয়েছেন তার পরবর্তী প্রজন্মের মানুষের কাছে। এই যে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিরাজমান জ্ঞানের পরিবহণ প্রক্রিয়ার সুফল আমরা আজকে ভোগ করতে পারছি- এটা বই ছাড়া কী করে সম্ভব হতো ? এটা কল্পনা করাই দুঃসাধ্য। আজ থেকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষদের মনে এমন একটা দুঃসাধ্য চিন্তা ভর করেছিল বলেই রক্ষা...! নইলে আজকের দিনে এসে মানুষের ইতিহাস হয়ত অন্যভাবেও লেখা হতে পারত। কিংবা যদি বই-ই না থাকত তাহলে লেখা হতো কোথায়, আর সেটা আমাদের হাতেই বা কীভাবে এসে পৌঁছাতো ? এমন সব আজগুবি ভাবনা না ভেবে, চলুন ঢুকে পড়া যাক মূল আলোচনায়...

খুব সহজ করে বললে, বই হচ্ছে একটি লিখিত দলিল। তাই বই নিয়ে ভাবার আগে, প্রাচীন মানুষকে কোনো চিহ্ন বা ছবি এঁকে মনের ভাব স্পষ্ট করার বিদ্যা আয়ত্ত করতে হয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, খ্রিষ্টপূর্ব ৩৪০০ থেকে ৩১০০ অব্দের মধ্যে সুমেরীয় সভ্যতায় প্রথম লেখার দক্ষতা বিকাশ লাভ করে। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ এ দক্ষতার সঙ্গে প্রাচীন গুহাচিত্রের সম্পর্ক খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। লিখতে শেখার সঙ্গে সঙ্গেই প্রয়োজনীয় হয়ে উঠল এমন একটি মাধ্যম, যেখানে লেখাটিকে সংরক্ষণ করে রাখা যায়। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে প্রাচীন সুমেরীয়দের তৈরি কাদামাটি দিয়ে নির্মিত এক রকমের ফলক পাওয়া যায়, যেগুলোকে বইয়ের পূর্বসূরি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এ-ধরনের ফলকগুলোকে কিউনিফর্ম ট্যাবলেট বলা হতো। পুরো মেসোপটেমিয়াজুড়ে এমন প্রায় ২০ হাজারের বেশি ট্যাবলেট পাওয়া গেছে, যেগুলোর অধিকাংশ নির্মিত হয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতকে।

খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের কাছাকাছি সময়েই প্রাচীন মিসরীয়রা উদ্ভাবন করে প্যাপিরাস গাছের বাকলে লেখার প্রযুক্তি। কলম হিসেবে তারা ব্যবহার করত সরু করে কাটা গাছের ডাল বা পাখির পালক। এ পদ্ধতিতে শুরুতে আলাদা আলাদা কয়েকটি প্যাপিরাস রোলে লিখে, তারপর সেটাকে জোড়া দিয়ে রোল করে পেঁচিয়ে রাখা হতো ; যা আধুনিক ইতিহাসবিদদের কাছে ‘ইজিপশিয়ান স্ক্রল’ নামে পরিচিত। একেকটি স্ক্রল আসলে একেকটি আলাদা বই, যেগুলো সাধারণত ১০-১৫ মিটার লম্বা হতো। তৃতীয় রামোসের আমলে লিখিত ৪০ মিটার লম্বা একটি স্ক্রল পাওয়া যায়। মিসরীয় সভ্যতার বিখ্যাত মেনুস্ক্রিপ্ট হায়রোগ্লিফিক-এর আবিষ্কারেরও পূর্বে এ-ধরনের লেখন পদ্ধতিটি হাইরেটিক নামে পরিচিতি লাভ করে। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় দশকে মধ্য ইউরোপে ‘পার্চমেন্ট’ নামে আরেক ধরনের লেখার উপকরণ জনপ্রিয়তা পায় ; যা তৈরি করা হতো বিভিন্ন গবাদিপশুর চামড়া থেকে। এছাড়াও এ-সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে বাঁশের কঞ্চিতে, হেম্প বা সিল্কের কাপড়ে এমনকি কাঠের ট্যাবলেটের ওপর মোম গলিয়ে তার ওপর দাগ কেটে লেখার কৌশল উদ্ভাবনের চেষ্টা করেছে অনেকেই।

বিশ্ব ইতিহাসে চৈনিক সভ্যতার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের মধ্যে গান পাউডার আর কাগজ অন্যতম। খ্রিষ্টাব্দের প্রথম শতকেই তারা কাগজের আবিষ্কারের মাধ্যমে আধুনিক মুদ্রণ শিল্পে একটি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিল। মূলত এরপর থেকেই লেখার উপকরণ হিসেবে বিচ্ছিন্ন প্রযুক্তিগুলোর ব্যবহার ধীরে ধীরে কমে যেতে শুরু করল। এর কয়েক শতক পর, ৬১৮ থেকে ৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই চীনে কাদামাটি বা কাঠের ব্লক ব্যবহার করে মুদ্রণের প্রচলন শুরু হয়ে যায়। এ পদ্ধতিতে প্রথম কাঠ বা কাদামাটি দিয়ে একটি ব্লক বানানো হতো, যেখানে যে লেখা বা ছবিটি মুদ্রণ করা হবে সেটি ফুটিয়ে তোলা হতো। এরপর সে ব্লকটিতে কালি লাগিয়ে সেটি দিয়ে কাগজের ওপর ছাপ দেওয়া হতো। এর ফলে কাগজ বা কাপড়ের ওপর ব্লকের ছাপ তৈরি হতো। এর প্রযুক্তির ফলে অনেক কম সময়েও পরিশ্রমে একই লেখার অনেকগুলো কপি ছাপানো সম্ভব হলো। চীনে ট্যাং শাসনামলে ৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বের প্রথম মুদ্রিত বই ‘ডায়মন্ড সূত্রা’ প্রকাশ হয়, যা পরবর্তীসময়ে মুদ্রণ শিল্পের আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে এক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। একইরকমের প্রযুক্তি ব্যবহার করে কোরিয়ায় ১৩৭৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশ হয় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বই ‘জিকজি’, যেখানে কাঠ কিংবা সিরামিক ব্লকের বদলে ব্রোঞ্জের ব্লক ব্যবহার করা হয়েছিল।

এভাবেই কেটে গেল পরের কয়েকটা বছর। ১৪৫৫ সালে জোহানেস গুটেনবার্গ নামে একজন জার্মান স্বর্ণকারের হাত ধরে চীনা মুদ্রণ প্রযুক্তি একটা নতুন মাত্রা পেল। এ বছরই ল্যাটিন ভাষায় ‘গুটেনবার্গ বাইবেল’ নামে একটি বই ছাপানো হলো, যেটিকে আধুনিক মুদ্রণ যন্ত্র ব্যবহার করে প্রকাশিত প্রথম বইয়ের মর্যাদায় ভূষিত করা হলো। ব্যস, এভাবেই সারাবিশ্বে ধীরে ধীরে শুরু হয়ে গেল বাণিজ্যিকভাবে বই উৎপাদনের প্রক্রিয়া। এর পরের ইতিহাসটুকু তো আর নতুন করে বলার কিছু নেই। সেদিনের সেই ছাপার অক্ষরের প্রথম বই থেকে আজকের ই-বুক, কেবলমাত্র প্রযুক্তির উৎকর্ষের প্রমাণ।

পৃথিবীতে প্রতিবছর গড়ে প্রায় সাড়ে নয় লাখ বই ছাপানো হয়। এছাড়া পিডিএফ বা ই-বুক তো রয়েছেই। কিন্তু আজকের অবস্থানের পেছনে এই দীর্ঘ সাধনার ইতিহাস অনেকটাই বিস্মৃত হয়ে গেলেও, সেটা আধুনিক প্রকাশনা শিল্পের মধ্যদিয়ে ঠিকই টিকে আছে এবং এটা যে সভ্যতার শেষ দিন পর্যন্ত থাকবে সে ভবিষ্যদ্বাণী করাই যায়।

বই প্রকাশ করলেই হয় না- বইয়ের ভালো-মন্দ রয়েছে। তাই পাঠকের কাছে বই নিয়ে হাজির হয় প্রকাশক। পাঠকের হাতে বই পৌছে দেওয়ার একটি অন্যতম মাধ্যম হলো বইমেলা। পৃথিবীর কয়েকটি বড়ো ও গুরুত্বপূর্ণ বইমেলা নিয়ে রইল কিছু কথা...


অমর একুশের গ্রন্থমেলা 

বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে আয়োজিত ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ সাধারণ্যে ‘একুশের বইমেলা’ নামেই বেশি পরিচিত। এই মেলা বাঙালির প্রাণের মেলা, লেখকের মেলা, প্রকাশকের মেলা, পাঠকের মেলা। এই মেলাকে কেন্দ্র করেই প্রকাশ হয় বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ সৃজনশীল বই।

১৯৮৩ সালে মনজুরে মওলা যখন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, তখন তিনি বাংলা একাডেমিতে জাঁকজমকের সঙ্গে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র আয়োজন সম্পন্ন করেন। কিন্তু স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষাভবনের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে ট্রাক তুলে দিলে দু’জন ছাত্র নিহত হয়। ওই মর্মান্তিক ঘটনার পর সে বছর আর বইমেলা শেষ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র সূচনা হয়। এরপর প্রতিবছর বইমেলা বিশাল থেকে বিশালতর আকার ধারণ করে।

২০১৪ সাল থেকে এই বইমেলা বর্ধমান হাউজ থেকে স¤প্রসারিত হয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিস্তৃত হয়।

১৯৮৪ সালের আগেও এই বইমেলার কিছু ধারাবাহিকতা রয়েছে, ১৯৬৫ সালে জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের তখনকার পরিচালক, কথাসাহিত্যিক সরদার জয়েনউদ্দীন তখনকার পাবলিক লাইব্রেরিতে [এখন ঢাকা বিশ্বদ্যালয় লাইব্রেরি] শিশু গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন, যাকে ঢাকার প্রথম বইমেলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তারপর ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জে একটি গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হয়।

আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ উপলক্ষে ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে প্রথম একটি আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলারও আয়োজন করা হয়। শামসুজ্জামান খান তার প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘ওই বছর বাংলা একাডেমির দেয়ালের বাইরে স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সের রুহুল আমিন নিজামী তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশনীর কিছু বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেন। তার দেখাদেখি মুক্তধারা প্রকাশনীর চিত্তরঞ্জন সাহা এবং বর্ণমিছিলের তাজুল ইসলামও ওভাবেই তাদের বই নিয়ে বসে যান। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে একটি বিশাল জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর উদ্বোধন করেন।

বইমেলা শুধু বইমেলা নয়, ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত বাংলা একাডেমির মূল মঞ্চে আয়োজন করা হয় ভাষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতিভিত্তিক আলোচনা সভা এবং অনুষ্ঠান। তাতে বিদেশি লেখকেরাও অংশ নেন। এছাড়া এই মেলা চলাকালে দেশের খ্যাতিমান লেখকদের মধ্য থেকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করা হয়।


কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা

১৯৭৬ সালে কলকাতা পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড নামের একটি সংস্থার আয়োজনে এই বইমেলার প্রথম আয়োজন হয়েছিল। বই কেনার আগ্রহের কথা বিবেচনা করে বইপ্রেমীদের জন্যই শুরু হয়েছিল এই মেলা। সাধারণত জানুয়ারি মাসের শেষ বুধবার কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা। আগে অবশ্য ওই সংস্থা ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আয়োজনে ১৯৯২-এর আগ পর্যন্ত পৃথক পৃথক বইমেলা হতো। পরে দুই মেলাকে এক করে একটি মেলার আয়োজন করা হয়।


ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা

বাণিজ্যিক দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো বইমেলা হলো ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা। আর দর্শনার্থীর আগমনের দিক থেকে ইউরোপে এর অবস্থান দ্বিতীয়। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে প্রতিবছর অক্টোবরে এই মেলার আয়োজন করা হয়।

মূলত সারাবিশ্ব থেকে এই মেলায় মানুষ আসে আন্তর্জাতিক প্রকাশনা স্বত্ব ও লাইসেন্সিং ফি নিয়ে দর কষাকষি করতে। ১০০টির বেশি দেশ থেকে অন্তত ৭০০০ সংস্থা অংশ নেয় এই মেলায়। প্রকাশনা সংক্রান্ত চুক্তিবাণিজ্যের জন্য এই বইমেলাকে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইমেলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলার ইতিহাস বেশ পুরনো, প্রায় ৫০০ বছরেরও বেশি। ফ্রাঙ্কফুর্টের কাছেই মেইনজে যখন জোহানেস গুটেনবার্র্গ ছাপাখানার প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি সাধন করেন, তখন স্থানীয় বই বিক্রেতাদের আয়োজনে প্রথমবারের মতো বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। ছাপানো বইয়ের যুগ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত শুধু পাণ্ডুলিপি বিক্রি হতো মেলায়। ১৭ শতকের শেষ পর্যন্ত এটি ছিল ইউরোপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইমেলা। 

১৯৫০ সাল থেকে প্রতি বছর এই বইমেলা চলাকালীন ‘পিস প্রাইজ অব দ্য জার্মান বুক ট্রেড’ পুরস্কার প্রদান করা হয়। এই মেলায় সবচেয়ে অদ্ভুত নামের বইটিকেও পুরস্কার দেওয়া হয়।


গুয়াডালাজারা আন্তর্জাতিক বইমেলা

গুয়াডালাজারা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে ১৯৮৭ সালে শুরু হয় এই বইমেলা। মেক্সিকোর জালসিকোতে এটি আরম্ভ হয় প্রতিবছর নভেম্বরের শেষ শনিবার এবং চলে একটানা ৯ দিন। স্প্যানিশ ভাষাভাষীদের জন্য সবচেয়ে প্রখ্যাত এই বইমেলা।

এই বইমেলাটি এর স্প্যানিশ নামের আদ্যাক্ষরগুলোর সমন্বয়ে পরিচিত ‘এফআইএল’ নামেও। ৪০ হাজার বর্গমাইল জায়গা নিয়ে হয় এই মেলা, প্রায় দুই হাজার প্রকাশনা সংস্থা অংশ নেয় এই মেলায়। প্রায় ৭ লক্ষ মানুষের সমাগম হয় এই মেলায়।


লন্ডন বুক ফেয়ার

ইউরোপের বইপ্রেমীদের অন্যতম বৃহৎ মিলনমেলা ঘটে লন্ডন বুক ফেয়ারে। ইউরোপিয়ান প্রকাশক, বিক্রেতা, এজেন্টদের তীর্থস্থান হিসেবে খ্যাত এই লন্ডন বুক ফেয়ার। লিওনেল লেভেনযাল নামক একজন প্রকাশকের উদ্যোগে ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে এক হোটেলের বেজমেন্টে এই বইমেলার গোড়াপত্তন হয়। প্রকাশকদের বইগুলো লাইব্রেরির মালিকদের কাছে সহজে প্রদর্শনের উদ্দেশ্যেই মূলত এই বইমেলার আয়োজন হয়েছিল। প্রথমবারের আয়োজন বেশ সফল হওয়ায় পরের বছর নভেম্বরে আবারো প্রদর্শনীর আয়োজন হয়। এভাবেই প্রতিবছর এ মেলার ব্যাপ্তি বাড়তে থাকে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত এ মেলা চলত লিম্পিয়া এক্সিবিশন সেন্টারে। এই বইমেলায় প্রায় ১০০ দেশ থেকে প্রকাশক, বিক্রেতা, এজেন্ট, লাইব্রেরিয়ান ও সাপ্লায়ার অংশগ্রহণ করেন। টেলিভিশন, সিনেমা ও অডিও রেকর্ডের প্রতিষ্ঠানের নিকট বইয়ের স্বত্ব বিক্রিসহ প্রকাশনা শিল্পের যাবতীয় বাণিজ্যিক কাজ সম্পাদিত হয় এই মেলায়।


বুয়েন্স আয়ার্স আন্তর্জাতিক বইমেলা

পৃথিবীর বৃহত্তম বইমেলার একটি বুয়েন্স আয়ার্স আন্তর্জাতিক বইমেলা। আর্জেন্টাইন সোসাইটি অব রাইটার্স-এর প্রতিষ্ঠিত ফান্দাসিও এল লিব্রো নামক একটি অলাভজনক সংস্থা এই বইমেলার আয়োজন করে থাকে। লেখক, প্রকাশক, সম্পাদক, অনুবাদক, বিক্রেতা এবং প্রকাশনার সাথে জড়িতদের অংশগ্রহণে কনফারেন্স ও সভা উন্মুক্ত থাকে সবার জন্য।

১৯৭১ সাল থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে বুয়েন্স আয়ার্স-এ ৩৫টির মতো বাইমেলার আয়োজন করা হয়েছিল। ১৯৭৪ সালে আর্জেন্টাইন সোসাইটি অব রাইটার্স আর্জেন্টিনার সম্পাদনা সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে বইমেলা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭৫ সালের মার্চে প্রথমবারের মতো বুয়েন্স আয়ার্স আন্তর্জাতিক বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। সাড়ে সাত হাজার বর্গমিটার জায়গা নিয়ে প্রথমবারের মতো এই আন্তর্জাতিক মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়। ৫০ জন লেখক এবং ৭টি দেশ এই মেলায় অংশ নেয়। প্রথম বইমেলায় প্রায় দেড় লাখ মানুষ সমবেত হয়েছিল। বর্তমানে এই মেলায় প্রায় ৫০টি দেশ অংশ নেয়। দর্শনার্থী হয় ১২ লাখের বেশি। প্রায় ৪৫ হাজার বর্গমিটার এলাকা নিয়ে হয় এই মেলা।


কায়রো আন্তর্জাতিক বইমেলা

আরব বিশ্বের প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম বইমেলা হলো কায়রো আন্তর্জাতিক বইমেলা। মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই এই মেলার আয়োজন করে ‘জেনারেল ইজিপশিয়ান বুক অরগানাইজেশন’। আরবীয় প্রকাশনার জগতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন হিসেবে বিবেচনা করা হয় এই বইমেলাটিকে।

১৯৬৯ সালে শুরু হয় কায়রো বইমেলা। মিশরের সরকারি প্রকাশক ও বিক্রেতাদের সংস্থা জেনারেল ইজিপশিয়ান বুক অরগানাইজেশন এই মেলার আয়োজন করে। কায়রো শহর প্রতিষ্ঠার ১০০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এই মেলার আয়োজন করা হয়। প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের মিলনমেলায় মুখরিত হয় এই মেলা। পৃথিবীতে আরবি ভাষায় রচিত বইগুলোর গড়ে পাঁচটির মধ্যে তিনটিই প্রকাশ করে কায়রোভিত্তিক প্রকাশনা সংস্থাগুলো। তাই আরব বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় বইমেলা এটি। প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে চলে এই মেলা। প্রতিবছর জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে মিশরের কায়রোতে অনুষ্ঠিত হয় কায়রোর বইমেলা।


মস্কো আন্তর্জাতিক বইমেলা

প্রতিবছর ৩ থেকে ৭ তারিখের মধ্যে মস্কো এক্সিবিশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয় মস্কো ইন্টারন্যাশনাল বুক ফেয়ার বা মস্কো আন্তর্জাতিক বইমেলা। এই বইমেলার প্রধান আকর্ষণ থাকে নানা ধরনের ওয়ার্কশপ, গোলটেবিল বৈঠক, লেখকদের আবৃত্তি। অতিথিদের অটোগ্রাফ সংগ্রহের আলাদা ব্যবস্থা থাকে এবং লেখকদের সঙ্গে সরাসরি আলাপচারিতার সুযোগও থাকে। এখানে। ১৯৭৭ সালে ১ সেপ্টেম্বর প্রথম শুরু হয় এই বইমেলা। রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশগুলোর নামকরা প্রকাশনী সংস্থা এখানে অংশগ্রহণ করে। এই মেলায় শিশুদের জন্য ‘লেটস রিডস’ নামে একটি কর্নার করা হয়।


বলগ্না চিলড্রেন বুক ফেয়ার

এটি মূলত শিশুদের জন্য বইমেলা। ১৯৬৩ সাল থেকে মার্চ এবং এপ্রিলের চার দিন এই মেলা ইতালির বলগ্নায় অনুষ্ঠিত হয়। ১৫০০ প্রকাশক এই মেলায় অংশগ্রহণ করে থাকে। শিশুসাহিত্য, শিশুচলচ্চিত্র এবং অ্যানিমেশন নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের জন্য এই বইমেলা এক তীর্থস্থান বলা যেতে পারে। প্রতিবছর ৭০ থেকে ৮০টি দেশের প্রতিনিধিরা এই মেলায় অংশ নিয়ে থাকে। এই মেলা চলাকালীন কিছু প্রধান অ্যাওয়ার্ড ঘোষণা করা হয়। সেগুলোর মধ্যে বিয়ানুয়াল হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন অ্যাওয়ার্ডস এবং দ্য লিন্ড গ্রিন মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড অন্যতম।