রেয়াজ কেবল গানের জন্যই নয়, শুদ্ধতার জন্যও দরকার -ইয়াসমীন ফায়রুজ বাঁধন

07 Feb 2021, 02:32 PM সারেগারে শেয়ার:
রেয়াজ কেবল গানের জন্যই নয়, শুদ্ধতার জন্যও দরকার -ইয়াসমীন ফায়রুজ বাঁধন

পুরো নাম ইয়াসমীন ফায়রুজ বাঁধন। যদিও তিনি এ নামে মোটেই পরিচিত নন, তবে বাঁধন নামে গানের ভুবনে ঠিকই আলাদা স্বতন্ত্র অবস্থানে নিজেকে নিয়ে গেছেন। নামটির সঙ্গে একধরনের নস্টালজিক ব্যাপারও কাজ করে, শ্রোতারা সেভাবেই তাকে মনে রেখেছেন। পেছনে পারিবারিক আবহের তকমা থাকার পরও অনেকটা এড়িয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। যদিও চাইলেও মহীরুহদের এড়ানো যায় না, সে-কথা স্বীকারও করে বলেছেন, মাঝে মাঝে খুব গর্বও হয় আমি সাবিনা ইয়াসমীনের মেয়ে ‘বাঁধন’। এমন বরেণ্য শিল্পীর গুণী সন্তান হওয়ার পরও তার পা কিন্তু মাটিতেই। ব্যক্তি চরিত্রে একজন গুণী, মেধাবী, মানবিক চরিত্রের অধিকারী। চাকরির পাশাপাশি সংগীত তার প্রথম পছন্দ। চলতি লেখায় আহমেদ তেপান্তরকে দেওয়া বাঁধনের সাক্ষাৎকারে তুলে ধরা হলো তার অন্দরের একান্ত কিছু আন্তরিক আলাপচারিতা আনন্দভুবনের পাঠকদের জন্য...


আনন্দভুবন : করোনার সময়টাতে কী করছেন, কীভাবে নিজেকে সতর্ক রাখছেন ? 

বাঁধন : অতিমারির এই সময়টার চাপ সারাবিশ্বেই চলছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। অতিমারির সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলতে হচ্ছে আমাদের। ব্যাপারটা অনেকটা এমন মৃত্যু আমার দুয়ারে। হয় মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করব নয়ত তাকে এড়াতে জীবনপণ যুদ্ধ করব। আমরা সেই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। দীর্ঘদিন অফিসে যাইনি। যেহেতু ব্যাংকে চাকরি করছি, তাই পরে অফিসে যেতে হলো। যেতাম তবে সেটা সাবধানতা অবলম্বন করে। যেটা এখনো করি। জীবন বাঁচাতে জীবনের জন্য কর্মটাও জরুরি, এটাকে তো এড়ানো যায় না।

আনন্দভুবন : জীবন ব্যবস্থায় এর প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন ?

বাঁধন : অবশ্যই। মহামারির আগে আমাদের জীবন ব্যবস্থা যেমন ছিল এখন কিন্তু সেভাবে যাচ্ছে না। একধরনের শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। বলতে পারেন সকাল থেকে রাত অব্দি প্রতিটি কাজের মাঝেই শৃঙ্খলাবোধ কাজ করছে।

আনন্দভুবন : শুনেছি আপনার দৈনন্দিন রুটিনে প্রাধান্য পায় রেওয়াজ ?

বাঁধন : [হাসতে হাসতে] দেখুন, গানের পূর্বশর্ত হচ্ছে নিয়মিত রেওয়াজ। আর এটা মা-খালাদের থেকেই শেখা। অর্থাৎ পরম্পরা। তাদের দেখেছি রেওয়াজে তারা কখনোই ফাঁকি দিতেন না। নিয়ম করে রেওয়াজ করতেন, ছেলেবেলা থেকেই এসব দেখে দেখে অভ্যস্ত, তাই ব্যতিক্রম হওয়া বা রেয়াজে ফাঁকির চিন্তা মাথায় আসেনি। তাছাড়া একটা বয়সে এসে এতটুকু বুঝতে পেরেছি- রেওয়াজ কেবল গানের জন্যই নয়, শুদ্ধতার জন্যও দরকার। সংগীত হচ্ছে আত্মার খোরাক সেই খোরাক তখনই মধুমিশ্রিত হবে যখন রেয়াজে মগ্ন হতে পারবেন। আমি সে চেষ্টাই করি কেবল। এখান থেকে অর্জিত শুদ্ধতা মানে আত্মার শুদ্ধতা। শুদ্ধতা থাকলে সুরের সঙ্গে কণ্ঠের ডেলিভারি ঐকতান হয়।

আনন্দভুবন : গানের বাইরে কি পছন্দ আপনার ?

বাঁধন : গানের বাইরে আমি খুবই আড্ডাবাজ। ঘুরতে খুব পছন্দ করি। যেখানেই হোক-না-কেন ঘোরাঘুরি আমি খুব এনজয় করি। সময় পেলেই দলবেঁধে ঢাকার বাইরে সিলেট, খুলনা, কক্সবাজার চলে যাই। এছাড়া গাছপালাঘেরা যেকোনো প্রাকৃতিক পরিবেশ আমার খুব প্রিয়। সে-সব স্থানে যাই, খুব ছবি তুলি। ছবি তোলাটা আমার নেশার মতো। আমার ফেসবুক ওয়ালে গিয়ে এটা আপনারাও দেখতে পারেন। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে আম্মাকে নিয়ে ভারতের জয়পুর, ব্যাঙ্গালুরু হয়ে কলকাতায় যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু অতিমারির কারণে সবই স্থগিত। এ-বছর অবস্থা স্বাভাবিক এবং সুস্থ থাকলে প্ল্যান অনুযায়ী বেরিয়ে পড়ব। যেহেতু ভারতে পড়াশোনা করেছি সে-কারণে সেখানে আমার কিছু সহপাঠী রয়েছে ইচ্ছে আছে তাদের সঙ্গেও আলাপের। আসলে একা একা ঘুরতে ভালো লাগে না। সঙ্গে কেউ থাকলে এখান থেকে অর্জিত ট্রাভেলের অভিজ্ঞতাটাও হয়ে যায়। ইচ্ছে আছে ট্রাভেলের ওপর একটা বই করার, যদিও সেটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।  


আনন্দভুবন : শিল্পী পরিবারের সন্তান। পিছুটানও নেই তারপরও কাজ করছেন ব্যাংকে, ম্যানেজ করছেন কীভাবে ?

বাঁধন : দেখুন আমার দাদা কুমিল্লা শহরের নামকরা একজন ব্যারিস্টার। সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের গভীর যোগাযোগ ছিল। অপরদিকে নানা খুলনার সে-সময়ের নামডাকওয়ালা উকিল। তার ঘরে পাঁচ কন্যা। প্রত্যেকেই কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা। প্রত্যেকেই আবার গানের জগতে দেশবরেণ্য। তাদের কারো কারো সন্তান গানের ভুবনে যুক্ত কিংবা শিল্পের অন্য মাধ্যমে। তবে জীবন-জীবিকার তাগিদে প্রায় প্রত্যেকেই কিছু না কিছু করছেন। করতে হয় বলেই করছেন। তাছাড়া এখনকার সময়টা ভিন্ন, কিছুটা অস্থির সময় বলেই হয়তো ভিন্ন। আম্মাদের সময় প্রচুর কাজ, দম ফেলার সময় তাদের ছিল না। অগ্রযাত্রায় বিশুদ্ধতা বজায় রেখে কাজ হতো। শ্রোতা-দর্শকও বাহবা দিতেন। ফলে আম্মা-খালাদের দেখেছি সংগীতের পেছনে তাদের একনিষ্ঠ ধ্যান। যে-কারণে নানুর তত্ত্বাবধানেই আমি বেড়ে উঠেছি। আর এখন আমাদের কর্মহীন পরিবেশটাই জীবনকে চাবুক মেরে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। বাধ্য হয়ে কেবল শিল্পের পেছনে অর্ধেক সময় বাকিটুকু জীবিকার পেছনে ছোটা বাস্তবতা। গত একদশক ধরে জীবিকার পেছনে ছোটা বাস্তবতার ভয়ঙ্কর রূপ দেখতে পাচ্ছি তথাকথিত ইউটিউব, ফেসবুক ইত্যাদিতে ভিউ লাইকের প্রতিযোগিতায়। এখন কেউ কাউকে গান শোনানোর আমন্ত্রণ নয় বরং দেখানোর আমন্ত্রণ জানান। ফলে একধরনের অস্থিরতা লেখক, সুরকার, শিল্পী সবার মাঝে। ফলে গান আর আজকাল হৃদয় ছুঁয়ে যায় না। অথচ এখনো মাঝে মাঝে কিছু গান শুনি যা হৃদয় ছুঁয়ে যায় কিন্তু তথাকথিত ভিউয়ের দৌড়ে পিছিয়ে পড়ায় গণমাধ্যমে এ নিয়ে আর আলোচনা শোনা যায় না। ফলে প্রচার না থাকায় অনেক শ্রোতা বিশুদ্ধ গান থেকে বঞ্চিত থাকছে। আমাদের এ অবস্থা থেকে বের হতে হবে। নয়ত সংগীতকে পুরোপুরি পেশা হিসেবে এখনকার প্রজন্ম নিতে পারবেন না।

আনন্দভুবন : এতে করে সংগীতের প্রতি একনিষ্ঠতা কমছে কি না ?

বাঁধন : কমছে বৈকি, এ মুহূর্তে এ অবস্থা থেকে বের হওয়ার উপায়ও দেখি না।

আনন্দভুবন : কখনও কি মনে হয় মা-খালাদের ছায়ায় ঢাকা পড়েছে আপনার সংগীত প্রতিভা ?

বাঁধন : মনে হয় না। প্রতিভা অনুযায়ী যার যেখানে থাকার কথা প্রত্যেকেই সেখানে আছে। আমিও তাই। তাই মনে হয় না ঢাকা পড়েছি। তবে আমি গর্ব অনুভব করি দেশবরেণ্য এমন একজন মায়ের গর্ভে জন্মেছি বলে। তিনি কেবল একজন সংগীতশিল্পী নন, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একজন মানুষও বটে। এ-কারণেও তাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করি। সবার কাছে গর্ব করে বলতেও ভালো লাগে, তবে তাই বলে সেটা অহংকারের পর্যায় যেন না পড়ে সেদিকে আমার চেয়ে আম্মার বেশি খেয়াল। এজন্য তিনি আমাকে বারবার সতর্কও করেন।

আনন্দভুবন : গানের জগতে প্রতিষ্ঠা পেতে মায়ের সহযোগিতা কতটুকু পেয়েছেন

বাঁধন : পাইনি এ কথা বললে অন্যায় হবে। তবে আম্মা কখনো কাউকে আমার নাম রেফার করেননি। ওই কাজটা তিনি কারও বেলায় করেন না। যেহেতু সবাই জানেন আমি সাবিনা ইয়াসমীনের মেয়ে, তার সঙ্গে আমার বেশকিছু গানও প্রকাশ হয়েছে, সে সুবাধে সবার সঙ্গে আমি একরকম যোগাযোগ করে কাজ করছি। তবে আমিও চেষ্টা করি আম্মার ব্যাপারটার আড়ালে রাখতে। কখনো কখনো বিব্রত হই। তবে সত্যি হচ্ছে সবাই স্নেহও করেন।

আনন্দভুবন : দীর্ঘদিন পর আপনাকে গানে ব্যস্ত হতে দেখা যাচ্ছে-

বাঁধন : বাসায় বসে বসে কেবল রেয়াজ ছাড়া গতবছরে অতিমারির কারণে কোনো কাজই করিনি। বেঁচে থাকার লড়াইটা তো আমাদের সবাইকেই করতে হচ্ছে। তাছাড়া দেশবাসীকে সুস্থজীবন ধারায় ফেরাতে সরকারের নির্দেশনা মানাও জরুরি ছিল, সব মিলিয়ে গত বছর কোনো আয়োজনেই গান করতে পারিনি। এরমধ্যে অনেকেই যোগাযোগ করছেন তার মধ্য থেকে বিটিভি’র নিয়মিত আয়োজেনের জন্য একটি গানে কণ্ঠ দিলাম।

‘না চাইলে মন রঙিন হয় না, অনেক পেয়েও কিছু মন সুখী হয় না...’ শীর্ষক গানটির কথা লিখেছেন মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ আর সুর করেছেন লোকমান হাকিম। এছাড়া নতুন বছরে বেশকিছু গানের প্রস্তাব ইতোমধ্যে পেয়েছি এরমধ্যে জি-সিরিজ এবং এইচ এম ভয়েসের সঙ্গে কথা চলছে। এছাড়া আরো কিছু পরিকল্পনা নিয়েছি, তবে সব কিছুই অপেক্ষা করছে অতিমারির ওপর।

আনন্দভুবন : মা সাবিনা ইয়াসমীনের গান কেমন লাগে ?

বাঁধন : অসম্ভব ভালো। তার কণ্ঠে মেলোডি রোমান্টিক গানগুলো যে-কারোরই ভালো লাগবে নিশ্চয়ই, মা বলেই যে তার ভক্ত ব্যাপারটা তা নয়, একজন শ্রোতা হিসেবেও তার ভক্ত। এছাড়া রুনা লায়লা আন্টির চটুল গানগুলো মন দোলা দেয়। ওদিকে শাহনাজ রহমতুল্লাহ আন্টির উর্দু ও বাংলা দেশাত্মবোধক গান শুনে কেমন যেন হারিয়ে যাই। এছাড়াও মিতালী মুখার্জির গানগুলোও মাঝে মাঝে শুনি। 

আনন্দভুবন : তরুণদের কার গান ভালো লাগে ?

বাঁধন : অনেকেরই এখন ভালো লাগে, তবে এরমধ্যে মোমিন বিশ্বাাসের গায়কিতে ভারিক্কি রয়েছে। প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর রাখতে পারবেন। এছাড়া, স্বীকৃতি, লাবণী ওরা দু’বোন কিন্তু বেশ ভালো গায়। বিশেষ করে স্বীকৃতির প্লেব্যাক কিন্তু বেশ ভালো।

আনন্দভুবন : এর বাইরে আর কি করছেন ?

বাঁধন : আমি প্রচুর পড়ি। এরপর নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসা করবেন কী ধরনের বই পছন্দ সেটাও জানিয়ে দিচ্ছি আমার পছন্দ অ্যাডভেঞ্চার, থ্রিলার-নির্ভর বই। সেবা প্রকাশনীর বই বোধ হয় কোনোটাই বাদ যায়নি। সময় পেলেই পড়ি। এছাড়া বাসায় বসে নিয়ম করে ক্র্যাফট বানাই। প্রিয়জনদের সেগুলো উপহার দিই। আম্মার বাসায় অধিকাংশ ক্র্যাফট যা দেখবেন, সবই আমার করা।