নিকট অতীতেও ‘ইয়োগা’ বা ‘যোগ’ শব্দটি আমাদের সমাজজীবনে বিশেষ ধর্মীয় আচার ও একধরনের বিভ্রান্তিকর অর্থ বহন করত ! যেমন যোগীরা সংসার বিচ্ছিন্ন, আধ্যাত্মিক, পাহাড় অরণ্যে স্বল্পবস্ত্রে ঘুরে বেড়ায়... এইসব ! ইয়োগা আসলে কী ? কী এর রহস্য ? এর উৎসই বা কোথায় ? যোগব্যায়াম কয়েক সহস্র বছর আগে ভারতবর্ষে উদ্ভাবিত শাস্ত্রীয়-পদ্ধতি। সুস্থ শরীর ও সুস্থ মন গঠনের জন্য এটি একটি অনন্য জ্ঞান। বর্তমানে সারাবিশ্বে ইয়োগা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। জাতিসঙ্ঘ সৌরবর্ষের দীর্ঘতম দিন ২১ জুন বিশ্ব যোগদিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে।
প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বের সিন্ধু সভ্যতার প্রত্ম নিদর্শন থেকে ইয়োগা মুদ্রা ও আসনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এছাড়া সুপ্রাচীন গ্রন্থ বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ ও পুরাণে যোগ সম্পর্কিত আচার অনুষ্ঠানের উল্লেখ রয়েছে। তবে, খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়কালের আর্য ঋষি পতঞ্জলিকে আধুনিক যোগশাস্ত্রের জনক বলে ধরা হয়। পতঞ্জলি একটি আদর্শ ও নৈতিক জীবন-যাপনচর্চার মাধ্যমে কীভাবে আত্মউন্নয়ন ঘটানো যায় তার একটি গাইডলাইন বা নীতিমালা ১৯৫টি যোগ সূত্র’র মাধ্যমে প্রকাশ করেন। এই সূত্রগুলোই বিভিন্ন আঙ্গিকে যোগসাধনা বা ইয়োগার মৌলিক উৎস হিসেবে বর্তমানে স্বীকৃত।
ধ্যান, আসন, মুদ্রা ও প্রাণায়ামের সমন্বয়ে ইয়োগা বা যোগ সাধনার পরিপূর্ণ প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ সুপ্ত অসীম শক্তিকে জাগ্রত করা সম্ভব।
২.
‘যোগ’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ভাষার ‘যুজ’ ধাতু থেকে। এর বুৎপত্তিগত অর্থ হলো যুক্ত করা, বন্ধন করা, মিলিত করা ইত্যাদি। পরমাত্মার [universal soul] সাথে জীবাত্মার [individual soul] সংযোগ স্থাপন করে যোগ।
ওজন কমানো, শক্তিশালী নমনীয় শরীর, উজ্জ্বল ত্বক, শান্ত মন, ভালো স্বাস্থ্য ইত্যাদি যা কিছু আমরা পেতে চাই সব কিছুর চাবি আছে যোগাসন, মুদ্রা, ধ্যান ও প্রাণায়ামের নিয়মিত অনুশীলন অভ্যাসে। এতে অনেক রকম শারীরিক সমস্যা যথা- উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, করোনারি আর্টারি ব্লক ইত্যাদি রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব এবং শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিকভাবে সুস্থ জীবন কাটানো সম্ভব। যোগ হলো এক জীবন দর্শন, যোগ হলো আত্মানুশাসন, যোগ হলো এক জীবন-পদ্ধতি। যোগ শুধু বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতিই নয়, বরং যোগের প্রয়োগ ব্যাধিকে নির্মূল করে। এটি এক বিধাতা প্রদত্ত শুধু শরীরেরই নয়, পুরো মানসিক রোগেরও চিকিৎসাশাস্ত্র। যোগ অ্যালোপ্যাথির মতো কোনো লাক্ষণিক চিকিৎসা নয়, বরং রোগের মূল কারণ নির্মূল করে আমাদের ভেতর থেকে সুস্থ করে তোলার এক উপায়। ইয়োগা বা যোগ ব্যায়াম ।
৩ .
যোগ ব্যায়াম কেবল বাহ্যিক পেশিবহুল শরীরের কথা বলে না, এতে অভ্যন্তরীণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গের স্বাস্থ্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জিমে গিয়ে যন্ত্রপাতি দিয়ে অনুশীলন করে সিক্স প্যাক বানালেন কিন্তু যদি লিভার ঠিকভাবে কাজ না করে তাহলে পেশিবহুল শরীর দিয়ে কী করবেন ? শরীর নমনীয় হওয়াটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নমনীয় শরীরে চলনে-বলনে আরাম পাওয়া যায়। একটু ভাবুন, দেহের অভ্যন্তরীণ বেশিরভাগ অঙ্গ প্রত্যঙ্গের অবস্থান বুক এবং পেটের অংশে। এগুলো কিন্তু শক্ত করে কোনো নাট-বল্টু দিয়ে জোড়া লাগানো নয় ! এরা শিথিল একটি জালে জড়িয়ে ঝুলছে। আপনি যদি পদ্মাসন, সিদ্ধাসন, গো-মুখাসন বা ভদ্রাসনে বসেন তবে আপনার মেরুদণ্ড সোজা হয়ে থাকবে। আর মেরুদণ্ড সোজা করে বসলে আমাদের অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলো সম্ভাব্য সর্বোচ্চ স্বাচ্ছন্দ্যে থাকে। অথচ আমাদের চলমান কর্ম সংস্কৃতিতে স্বাচ্ছন্দ্য মানে পেছনে হেলান দিয়ে বসা বা সামনের দিকে ঝুঁকে বসা ! এই অবস্থায় আমাদের মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে যায়, যেটা শরীরের অভ্যন্তরীণ স্বাস্থ্যের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
মেরুদণ্ড [Vertebral Column] আমাদের দেহে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে আছে। এরই স্থিতিস্থাপকতা ও সবলতার উপর দেহের যৌবনশক্তি ও কর্মক্ষমতা নির্ভর করে।
ধ্যানাসন, পদ্মাসন, সিদ্ধাসন, গো-মুখাসন ইত্যাদি আসনগুলো মেরুদণ্ড সবল ও নমনীয় রাখতে সাহায্য করে। এইসব আসনকালে দেহে পেশির ক্রিয়া হয় না বললেও চলে। ফলে দেহে অতি সামান্য কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস উৎপন্ন হয়। হৃদপিণ্ড ও ফুসফুসের কাজ মন্থর হয়, ফলে তারাও কিছুটা বিশ্রাম পায়। মস্তিষ্ক ও দেহ ভারমুক্ত হয় ও বিশ্রাম পায়। মানসিক বিশ্রামে ও চিত্তশুদ্ধিতে আসনগুলো অদ্বিতীয়। তাছাড়া এই সব আসনে পেটের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর রক্ত চলাচল করে। ফলে হজমশক্তি বৃদ্ধি পায়।
৪.
শারীরিকভাবে সুস্থ মানেই কিন্তু পুরোপুরি ফিট থাকা নয়। তখনই পুরোপুরি ফিট যখন মানসিক, আধ্যাত্মিক, শারীরিক ও সামাজিকভাবেই আপনি সুস্থ থাকবেন। আপনার আবেগ থাকবে আপনার নিয়ন্ত্রণে। কথায় বলে, রোগের অনুপস্থিতি কিন্তু স্বাস্থ্য নয়, স্বাস্থ্য হলো জীবনের বহুমুখী বহিঃপ্রকাশ। আপনি কতটা আনন্দ এবং উৎসাহের সঙ্গে জীবন উপভোগ করতে পারছেন সেটাই কিন্তু আপনার স্বাস্থ্যের প্রমাণ। যোগাসন আপনাকে দেয় পরিপূর্ণ স্বাস্থ্য। আপনাকে সর্বদা ফিট রাখে শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক সব ভাবেই। জীবনীশক্তির উচ্চতর সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে চাইলে নিজের অভ্যন্তরীণ শক্তি ব্যবহারের প্রকৌশল জানতে হবে। ইয়োগা আর এর আসন, মুদ্রা, ধ্যান আর প্রাণায়াম জীবনের চূড়ান্ত প্রকাশের জন্য একেকটি সরঞ্জাম মাত্র।
৫.
সকালে ভাবুন, দুপুরে ক্রিয়া, সন্ধ্যায় পড়ুন আর রাতে ঘুমান। একটু প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে দেখুন, পর্যবেক্ষণ করুন। দেখবেন কী নিয়ন্ত্রিত ছন্দে প্রহরে প্রহরে বদলে যাচ্ছে রং রূপ শব্দ বর্ণ গন্ধ। নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করুন, দেখবেন এটারও একটা নিজস্ব প্যাটার্ন রয়েছে। একবার ছন্দটা ধরে নিতে পারলেই জীবনের গতিপথের চালক হয়ে উঠবেন। একটাই জীবন- খুঁজুন জীবনানন্দ।
লিঙ্গ মুদ্রা : ওজন কমাতে সাহায্য করে, শরীর উষ্ণ রাখে, যৌন শক্তি বৃদ্ধি করে, কফ কাশি ও শীতকালীন অসুস্থতায় কার্যকর।
কুণ্ডলিনী মুদ্রা : রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে, শরীরের অবাঞ্ছিত ফাঙ্গাস ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ রোধ করে।
পদ্ম-মুদ্রা ও শঙ্খ-মুদ্রা
উপকারিতা : পদ্ম-মুদ্রা গ্যাস্ট্রিক, আলসার, জ্বর, স্ট্রেস রিলিফে কার্যকর। ত্বকে উজ্জ্বলতা আনে ও ভক্তিভাব জাগ্রত করে।
শঙ্খ মুদ্রা : অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিস, কফ, স্বরভঙ্গ, ফুসফুস ও শ্বাসনালীর সংক্রমণ প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর।
ডিটক্সিফিকেশন মুদ্রা : শরীরের ভেতর থেকে বিষাক্ত পদার্থ নিষ্কাশন করে। মানসিক চাপ কমায়। নেতিবাচক স্মৃতি ভুলিয়ে দেয়। ভয় জড়তা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। ইতিবাচক মানসিকতা তৈরি করে।
প্রাণায়াম - নাড়িশুদ্ধী
প্রক্রিয়া : ধ্যানাসনে বসে ডান হাতের তর্জনি ও মধ্য আঙুল ভাঁজ করে ফেলুন। বাঁ-হাতের করতল উল্টে কোলের উপর রাখুন। এবার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে নাকের ডান পাশের ফুটো বন্ধ করুন। বা নাসারন্ধ্র দিয়ে শ্বাস নিই এবং ছাড়ি। এবার অনামিকা দিয়ে বা নাসারন্ধ্র বন্ধ করে ডান পাশেরটা খুলে শ্বাস গ্রহণ করি এবং ছাড়ি। এভাবে তিন থেকে চার মিনিট অনুশীলন করি।
উপকারিতা : রক্তে অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়ে, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ায়, ফুসফুসের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে, রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে।
পদ্ধতি : বাঁ-হাঁটুর ওপরে ডান হাঁটু রেখে বসুন যেন বাঁ-পায়ের গোড়ালি ডান নিতম্বের এবং ডান পায়ের গোড়ালি বাঁ নিতম্বের সংলগ্ন থাকে। ডান হাত মাথার ওপরে তুলে কনুইয়ের কাছ থেকে ভেঙে পিঠে নামান। বাঁ হাত কনুইয়ের কাছে ভেঙে পিছনে নিন। দু’ হাতের আঙুলগুলো বাঁকিয়ে হুকের মতো আঁকড়ে ধরুন। মেরুদণ্ড সোজা থাকবে। স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাসে মনে মনে দশ থেকে ক্রমশ বাড়িয়ে তিরিশ গুনুন। এবার হাত পা বদল করে বিপরীতভাবে অভ্যাস করুন। তারপর শবাসনে বিশ্রাম নিন। এভাবে তিনবার। মনে রাখবেন, যে-পা হাঁটুর ওপরে থাকবে সে হাতই ওপরে তুলতে হবে।
উপকারিতা : স্নায়ুশূল বা নিউরলোজিয়া, অনিদ্রা, স্বপ্নদোষ বা নাইটপলিউশন, অসাড়ে মূত্রত্যাগ, একশিরা, অণ্ডকোষ প্রদাহ ও বৃদ্ধি ও ফ্রোজেন শোল্ডার উপকারী।
প্রথমে সুখাসনে বসুন। এবার পা দু’টি খুলে এগিয়ে দিন। পায়ের পাতা দু’টি পরস্পর সংলগ্ন অর্থাৎ ডান পায়ের পাতা বাঁ পায়ের পাতার সঙ্গে লেগে থাকবে এবং হাঁটু দু’টি মাটিতে পাতা থাকবে। এখন দু’হাতের সাহায্যে গোড়ালি দু’টি ভেতর দিকে টানুন যেন জননেন্দ্রিয় স্পর্শ করে। ডান হাতের চেটো দিয়ে ডান হাঁটু এবং বাঁ-হাতের চেটো দিয়ে বাঁ-হাঁটু মাটিতে চেপে ধরুন। দু-কনুই সোজা থাকবে। যতটা সম্ভব মেরুদণ্ড সোজা থাকবে। স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাসে মনে মনে দশ থেকে ক্রমশ বাড়িয়ে তিরিশ গোনার পর শবাসন। এ রূপ তিনবার।
উপকারিতা : কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত অংশ শক্তিশালী করে। জননাঙ্গের সক্ষমতা বাড়ায়। পেটের মেদ কমাতে কার্যকর। নারীদের মাসিকের সময় তলপেটে ব্যথা বেদনা হ্রাসে এটি অত্যন্ত কার্যকর।
গুপ্ত পদ্মাসন
প্রক্রিয়া : ইয়োগা ম্যাটে বসে দুই পা সামনে মেলে ধরুন। এরপর বাঁ-পা ডান ঊরুর উপর ও ডান পা বাঁ উরুর উপর আড়াআড়ি করে পদ্মাসনে বসুন। এরপর দুই হাত মুঠো করে হাঁটুর সামনে মেঝেতে চাপ দিয়ে বুক ও পেটের উপর উপুড় হয়ে চিবুক মেঝেতে লাগিয়ে কিছুক্ষণ থাকুন।
উপকারিতা : মেরুদণ্ডের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে, ব্যাক পেইন ও জয়েন্ট পেইন রিলিফ করে।
পাকস্থলির সব ধরনের অসুস্থতার জন্য উপকারী। কাঁধে ব্যথা, পিঠে ব্যথা, বুকে ব্যথা, গাঁটে ব্যথা, স্নায়বিক সমস্যা দূর করে।
শবাসন
পদ্ধতি
১. দুই হাত শরীরের দুই পাশে মেলে রেখে সটান চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ুন। এই সময় হাতের তালু থাকবে উপরের দিকে এবং একটু বাইরের দিকে হেলানো থাকবে।
২. পা দুটোর মাঝে কিছুটা ফাঁক রাখুন। এই সময় পায়ের পাতা বাইরের দিকে একটু হেলে থাকবে।
৩. সমস্ত শরীর শয়ন তলের উপর ছেড়ে দিন।
৪. খুব ধীরে ধীরে শ্বাস-প্রশ্বাস চালাতে থাকুন। এবার মন সমস্ত চিন্তা মুক্ত করুন এবং শরীর শিথিল করে দিন।
উপকারিতা
১. উচ্চ-রক্তচাপের রোগীরা এই আসনটি থেকে বিশেষ উপকৃত হবেন।
২. দীর্ঘক্ষণ শারীরিক বা মানসিক পরিশ্রমের পর শরীর অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়লে এই আসন দ্বারা শারীরিক ও মানসিক শক্তি পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়।
৩. স্নায়ুবিক দুর্বলতা, অনিদ্রা, অবসাদ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য এই আসন অত্যন্ত ফলপ্রসূ।
লেখক : যোগ-প্রশিক্ষক, আবৃত্তিশিল্পী
মডেল : কাজী মাহতাব সুমন, আনিকা তাসনিম, সালমান ইউসুফ