যক্ষা কেবল ফুসফুসের রোগ নয় : ডা. মুসাররাত সুলতানা [সুমী]

30 Dec 2020, 01:59 PM স্বাস্থ্যভুবন শেয়ার:
যক্ষা কেবল ফুসফুসের রোগ নয় : ডা. মুসাররাত সুলতানা [সুমী]


যক্ষা একটি সংক্রামক ব্যাধি। যা প্রধানত ফুসফুসকে আক্রান্ত করে থাকে। যা²া বলতে সাধারণভাবে আমরা ফুসফুসের যক্ষাকেই বুঝি। তবে ফুসফুস ছাড়াও শরীরের বিভিন্ন স্থানে যক্ষা হতে পারে। যেমন : লসিকাগ্রন্থি, হাড় ও গিট, অন্ত্র, হৃদপিণ্ডের আবরণ ও মস্তিষ্কের আবরণ ইত্যাদি। অতীতে মানুষের যক্ষা ধরা পড়লে হতাশ হয়ে জীবন যাপন করত। কারণ, তখন যা²ার কোনো ওষুধ ছিল না। ফলে মানুষ খুবই ভয় পেত। এখন আর সেই দিন নেই, নিয়মিত যক্ষার ওষুধ সেবন করলে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হওয়া যায়। ২৪ মার্চ বিশ্ব যক্ষাদিবস। জেনে নিন যক্ষা রোগের আদ্যপান্ত...


যক্ষা শুধু ফুসফুসে হয় না

যক্ষার জীবাণু যে কেবল ফুসফুসকে আক্রান্ত করে তা নয়, এটি মস্তিষ্ক থেকে শুরু করে ত্বক, অন্ত্র, লিভার, কিডনি, হাড়সহ দেহের যেকোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গে সংক্রমণ হতে পারে। ফুসফুসে যক্ষা হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি হওয়ায় সবার ধারণা যে, যক্ষা মানেই ফুসফুসের রোগ। কিন্তু আসলে তা না। মানবদেহের এমন কোনো অর্গান [অঙ্গ] নাই, যেখানে যক্ষা হতে পারে না। যক্ষা হচ্ছে একটি বায়ুুবাহিত ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রামক ব্যাধি যেটা মাইকোব্যাক্টেরিয়াম টিউবারকুলোসিস জীবাণুর সংক্রমণে হয়ে থাকে। আর এই জীবাণুর সংক্রমণ যেকোনো অঙ্গেই হতে পারে।


কারা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন ?

দেশের মোট জনসংখ্যার একটি অংশ জন্মগতভাবেই যক্ষা রোগের জীবাণু বহন করে। তবে শরীরে জীবাণু থাকা মানেই এই নয় যে, ব্যক্তি রোগে আক্রান্ত। তবে জীবাণুর ধারক নিজে আক্রান্ত না হলেও তার মাধ্যমে অন্যের শরীরে যক্ষা ছড়াতে পারে। আর সেটা যেকোনো অঙ্গেই হতে পারে। এই জীবাণু থেকে তাদেরই রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল। এছাড়া ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের এই জীবাণুতে সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। এছাড়া পরিবেশ দূষণ, দারিদ্র্য, মাদকের আসক্তি, অপুষ্টি, যক্ষার হার বাড়ার অন্যতম কারণ।


করণীয় কী ?

উপরের লক্ষণগুলো দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগীকে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। যদি শরীরের কোনো অংশ ফুলে ওঠে আর কয়েক দিনেও ফোলা না কমে, এছাড়া ফুসফুসে যক্ষার লক্ষণগুলোর মধ্যে হাঁচি-কাশিসহ বাকি লক্ষণগুলোর কোনো একটি যদি দেখা দেয়, তাহলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। ডাক্তারি পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে যে, ব্যক্তি যক্ষায় আক্রান্ত কি না। সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিলে যক্ষা পুরোপুরি সেরে যায়। তাই দেরি না করে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। যক্ষা দীর্ঘমেয়াদি রোগ হওয়ায় এর জন্য দীর্ঘমেয়াদি ওষুধ সেবন করতে হয়। যেটা ছয় থেকে নয় মাস পর্যন্ত হয়ে থাকে। রোগীদের ধৈর্যের সাথে ওষুধ খেয়ে যেতে হয়। দৈর্য হারালে চলবে না। অনেক সময় দুই থেকে তিন মাস ওষুধ খাওয়ার পর রোগী খুব ভালো অনুভব করে। তার রোগের সব লক্ষণ চলে যায়। এমন অবস্থায় অনেকেই সেরে উঠেছে ভেবে ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দেয়। এরকম ক্ষেত্রে রোগীর আবারও যক্ষায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং আগে যে ওষুধ খেয়েছে তা কোনো কাজে লাগে না। পুনরায় শুরু থেকে ওষুধ খেতে হয়। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না নিলে এই জীবাণু শরীরের অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে গিয়ে রোগীর মৃত্যু হতে পারে এবং চিকিৎসা না নেওয়ার কারণে তার মাধ্যমে আরও অনেকের মধ্যে জীবাণুটি ছড়িয়ে পড়তে পারে।


শরীরের অন্য অংশের যক্ষা কতটা ছোঁয়াচে ?

যত যক্ষা রয়েছে তার মধ্যে ৮০ ভাগই ফুসফুসে হয়ে থাকে এবং এটি সবচেয়ে গুরুতর ও ভীষণ ছোঁয়াচে। ফুসফুসের যক্ষা আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে সুস্থ মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে যেতে পারে। মূলত হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এমনকি কথা বলা থেকেও যক্ষার জীবাণু দ্রুত একজনের কাছ থেকে আরেকজনের ভেতর ছড়িয়ে পড়তে পারে। তবে শরীরের অন্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গের যক্ষা এতটা ছোঁয়াচে নয়। তাই সেগুলো ফুসফুসের য²ার মতো অতটা ঝুঁকিপূর্ণও নয়। শুধু আক্রান্ত ব্যক্তি যদি তার আক্রান্ত স্থান সুস্থ ব্যক্তির শরীরের কেটে যাওয়া বা ক্ষত হয়ে যাওয়া কোনো অংশ স্পর্শ করে, তাহলে এই রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি থাকে। তবে যক্ষার চিকিৎসা শুরুর একমাসের মধ্যে এই জীবাণু ছড়ানোর প্রকোপ কমে যায়।


যক্ষা রোগের পরীক্ষা

যক্ষা নির্ণয়ের জন্য সাধারণত এমটি টেস্ট, স্পুটাম টেস্ট, স্মিয়ার টেস্ট, এক্স-রে, সিটি স্ক্যান, কালচার টেস্ট, এফএনএসি এবং বর্তমান যুগের সবচেয়ে আধুনিক জিন এক্সপার্ট পরীক্ষা করানো হয়ে থাকে। রোগের ধরন বুঝে নমুনা হিসেবে রোগীর কফ, লালা, হাড়, বা গ্রাণ্ডের তরল সংগ্রহ করা হয়। 


শরীরের অন্য কোন অঙ্গে যক্ষা

রোগের লক্ষণ কী ?

ফুসফুসে যক্ষার জীবাণু সংক্রমিত হলে টানা কয়েক সপ্তাহ কাশি, কফের সাথে রক্ত যাওয়ার মতো সাধারণ কিছু লক্ষণের কথা কম-বেশি প্রায় সবারই জানা। তবে শরীরের অন্য কোনো অংশে যক্ষার জীবাণু সংক্রমতি হলে জানা যাবে কীভাবে ? তারও কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ রয়েছে :

* শরীরের যে অংশে যক্ষার জীবাণু সংক্রমিত হবে সেই অংশটি ফুলে উঠবে। যেমন গলার গ্যান্ড আক্রান্ত হলে গলা ফুলবে, মেরুদণ্ড আক্রান্ত হলে পুরো মেরুদণ্ড ফুলে উঠবে।

* ফোলা অংশটি খুব শক্ত বা একদম পানি পানি হবে না। সেমি সলিড হবে। ফোলার আকার বেশি হলে ব্যথাও হতে পারে।

* লিভারে যক্ষা হলে পেটে পানি চলে আসে, তাই পেটও অস্বাভাবিক ফুলে যায়।

* মস্তিষ্কে সংক্রমিত হলে সেখানেও পানির মাত্রা বেড়ে যায়। অর্থাৎ মানুষের মস্তিষ্ক যে ইডিমা বা পানির মধ্যে থাকে, সেটার পরিমাণ বেড়ে যায়।

* এছাড়া চামড়ায় বা অন্য যেখানেই হোক না কেন সেই অংশটি ফুলে ওঠে।

* এছাড়া ক্ষুধামন্দা, হঠাৎ শরীরের ওজন কমে যাওয়া, জ্বরজ্বর অনুভব হওয়া, অনেক ঘাম হওয়া ইত্যাদি যক্ষার কিছু সাধারণ লক্ষণ।


যক্ষা ছড়ানো প্রতিরোধের উপায়

যক্ষার জীবাণু ছড়ানো প্রতিরোধে কিছু বিষয়ে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন :

* হাঁচি-কাশির সময় মুখে রুমাল ব্যবহার করা, না হলে অন্তত হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বা সবার থেকে দূরে গিয়ে কাশি দেওয়া

* যেখানে সেখানে থুথুু-কফ না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে ভালোভাবে জায়গাটি পরিষ্কার করা বা মাটি চাপা দেওয়া

* কারো মুখের সামনে গিয়ে কথা না বলা অথবা যক্ষা জীবাণুমুক্ত রোগীর সঙ্গে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলা

* যক্ষা রোগীর আক্রান্ত স্থান, সুস্থ ব্যক্তির ক্ষত স্থানের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখা

* পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হবে

* রোগী জীবাণুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রেডিওথেরাপি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল