বসন্তউৎসবের গল্প

30 Nov 2020, 01:23 PM অভোগ শেয়ার:
বসন্তউৎসবের গল্প

বাংলার রূপময় নিসর্গ ছুঁয়েছে বসন্ত। চারিদিকে ফুলের শোভা। অশান্ত বাতাস। এমনও দিনে মন যেন পাগলপারা। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : ‘আহা আজি এ বসন্তে / এত ফুল ফোটে / এত বাঁশি বাজে এত পাখি গায়।

শীতের জীর্ণতা সরিয়ে এসেছে ঋতুরাজ। জীবন রাঙিয়ে দেওয়ার দিন। বসন্ত ধরা দেয় নানাভাবে। বসন্তের আগমনে কোকিলের কুহুতানে মুখরিত হয়ে ওঠে বাংলার শ্যামল সবুজ প্রান্তর। আর শুকনো পাতারা ঝরে গিয়ে জন্ম নেয় কচি নতুন পাতা। সেই পত্রপল্লবে, ঘাসে ঘাসে, নদীর কিনারে, কুঞ্জ-বীথিকা আর ওই পাহাড়ে অরণ্যে বসন্ত দেয় নবযৌবনের ডাক।

বসন্তের রং ‘বাসন্তি’কে সঙ্গে নিয়েই শুরু হয় পয়লা ফাল্গুন। গাঁদা ফুলের রঙেই সাজে তরুণীরা। পরে বাসন্তি রঙের শাড়ি। খোঁপায় গুঁজে ফুল, মাথায় টায়রা আর হাতে পরে কাচের চুড়ি। বাংলার তরুণরাও পিছিয়ে থাকে না। তারাও বাসন্তি রঙের পাঞ্জাবি বা ফতুয়া পরে নামে পথে। বসন্ত মানেই ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা।’ তাই তরুণ-তরুণীদের পাশাপাশি সব বয়সী মানুষ ঘরের বাইরে আসেন। আর রাজধানীর বুকে বাসন্তি সাজে তারা ঘুরে বেড়ান শাহবাগ, চারুকলা আর টিএসসিতে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা পরিণত হয় বাসন্তি রঙের বাগানে। রমনা পার্ক, জাতীয় সংসদ, চন্দ্রিমা উদ্যান, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বলধা গার্ডেন, চারুকলার পেছনের সবুজ প্রাঙ্গণে ঘুরতে বেরোয় রাজধানীবাসী। পয়লা ফাল্গুনে ঘরকুনো মানুষটিও হয়তো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। পলাশ-শিমুলের রঙে রাঙিয়ে নেন মন। হয়ত বসন্তের বিকেলটা বা সন্ধ্যাটা প্রিয় মানুষটির সঙ্গে কাটিয়ে হবেন পরমসুখী।

বসন্ত কেবল আনন্দ-উচ্ছ্বাসেের রং ছড়ায় না, আমাদের ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শহিদদের রক্তরঙিন স্মৃতির কথাও মনে করিয়ে দেয়। ১৯৫২ সালের আটই ফাল্গ–ন বা একুশের পলাশরাঙা দিনের সঙ্গে তারুণ্যের সাহসী উচ্ছাস আর বাঁধভাঙা আবেগের জোয়ারও যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। তাই বসন্তের বন্দনা আছে কবিতা, গান, নাচ আর চিত্রকলায়। বসন্তের প্রথম দিনটি বাঙালি পালন করে ‘পহেলা ফাল্গুন-বসন্ত উৎসব’ হিসেবে। এ উৎসব এখন সব বাঙালির উৎসব। এ উৎসবটির একটি ইতিহাস আছে। মোগল সম্রাট আকবর প্রথম বাংলা নববর্ষ গণনা শুরু করেন ১৫৮৫ সালে। নতুন বছরকে কেন্দ্র করে ১৪টি উৎসবের প্রবর্তন করেন তিনি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বসন্ত উৎসব। তখন অবশ্য ঋতুর নাম ও উৎসবের ধরনটা এখনকার মতো ছিল না। তাই বসন্ত উৎসব শুধু একটা উৎসব নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলার গৌরবময় ঐতিহ্য।

ফাল্গুনের হাত ধরেই বসন্তের আগমন। পয়লা ফাল্গুন বা পয়লা ফাল্গুন বাংলা পঞ্জিকার একাদশতম মাস ফাল্গুনের প্রথম দিন ও বসন্তের প্রথম দিন। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৩ ফেব্রুয়ারি পয়লা ফাল্গুন বা বসন্ত উৎসব পালিত হয়। বসন্তকে বরণ করে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশ্যাসহ অন্যান্য রাজ্যে দিনটি বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগতে পারে এই বসন্ত উৎসব কীভাবে এলো ?

বসন্ত উৎসবকে দোলযাত্রাও বলা হয়। দোলযাত্রা মূলত একটি হিন্দু বৈষ্ণব উৎসব বলেই বিবেচিত। ইংরেজরা প্রথম দিকে এই উৎসবকে রোমান উৎসব ‘ল্যুপেরক্যালিয়া’ হিসেবেই মনে করেছিল। অনেকে আবার একে গ্রিকদের উৎসব ‘ব্যাকানালিয়া’-এর সঙ্গেও তুলনা করত।

বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’ যা রচিত হয়েছিল তৃতীয়-চতুর্থ শতকে, তাতে এই উৎসবের উল্লেখ আছে। ‘কামসূত্রে’ দোলায় বসে আমোদ-প্রমোদের কথা আমরা জানতে পারি।

সপ্তম শতকে রচিত শ্রীকৃষ্ণের ‘রত্মাবলী’ এবং অষ্টম শতকের ‘মালতী-মাধব’ নাটকেও এর বর্ণনা পাওয়া যায়। জীমূতবাহনের ‘কালবিবেক’ ও ষোড়শ শতকের ‘রঘুনন্দন’ গ্রন্থেও এই উৎসবের অস্তিত্ব রয়েছে।

মূলত পুরীতে দোলোৎসব ফাল্গুন মাসে প্রবর্তনের যে রেওয়াজ হয়, সেখান থেকেই বাংলায় চলে আসে এই সমারোহ। দোলযাত্রা বা হোলি উৎসব সংক্রান্ত পৌরাণিক উপাখ্যান ও লোককথাগুলো মূলত দুই প্রকার : প্রথমটি দোলযাত্রার পূর্বদিন পালিত বহ্ন্যুৎসব হোলিকাদহন বা মেড়াপোড়া সংক্রান্ত এবং দ্বিতীয়টি রাধা ও কৃষ্ণের দোললীলা বা ফাগুখেলা কেন্দ্রিক কাহিনি।

বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী, ফাল্গুনী পূর্ণিমা বা দোলপূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবির ও গুলাল নিয়ে রাধিকা ও অন্যান্য গোপীগণের সঙ্গে রং খেলায় মেতেছিলেন। সেই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি হয়। দোলযাত্রার দিন সকালে তাই রাধা ও কৃষ্ণের মূর্তি আবির ও গুলালে স্নাত করে দোলনায় চড়িয়ে কীর্তনগান সহকারে শোভাযাত্রা বের করা হয়। এরপর ভক্তরা আবির ও গুলাল নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে রং খেলেন। দোল উৎসবের অনুষঙ্গে ফাল্গুনী পূর্ণিমাকে দোলপূর্ণিমা বলা হয়। আবার এই পূর্ণিমা তিথিতেই চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম বলে একে গৌরপূর্ণিমা নামেও অভিহিত করা হয়।

দোল বা হোলি ধর্মীয় অনুষঙ্গের আড়ালে থাকা এক সামাজিক অনুষ্ঠানও বটে, যার সর্বজনীন আবেদন আছে। দোলযাত্রা উৎসবের একটি ধর্মনিরপেক্ষ দিকও রয়েছে। এখন আর শুধুমাত্র সনাতন ধর্মালম্বীদের মধ্যে হোলি খেলা নয়, বরং সব ধর্মের নারী পুরুষের মধ্যেই রং খেলার প্রবণতা দেখা যায়।

মধ্যযুগে সম্রাট আকবর বাংলা বর্ষপঞ্জি হিসেবে আকবরি সন বা ফসলি সনের প্রবর্তন করেন। সেসময় ১৪টি উৎসব পালনেরও রীতি প্রবর্তিত হয়। এর অন্যতম ছিল বসন্ত উৎসব। সেসময় বাংলার সকল স¤প্রদায়ের মানুষই বসন্ত বরণে বিভিন্ন লোকজ উৎসব ও মেলায় অংশ নিতেন। পয়লা ফাল্গুনে বসন্ত উদ্যাপনের রীতিও ঐতিহ্যবাহী।

শান্তিনিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতের মাধ্যমে বসন্তোৎসব পালনের রীতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কাল থেকেই চলে আসছে। এখনো সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। আরেকটি সূত্র থেকে জানা যায়, ১৯০৭ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটো ছেলে শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুরু করেছিলেন ঋতুরঙ্গ উৎসব। সেদিন শান্তিনিকেতনের প্রাণকুঠির সামনে শুরু হয় এ উৎসব। এখন অবশ্য সেদিনের প্রাণকুঠি শমীন্দ্র পাঠাগার হিসেবে পরিচিত। সেই ঋতুরঙ্গ উৎসবই আজকের বসন্ত উৎসব।

এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বসন্তোৎসব।

লেখা : শ্যামল কায়া