এসো হে বৈশাখ এসো এসো

11 Apr 2023, 03:38 PM মুক্তগদ্য শেয়ার:
এসো হে বৈশাখ এসো এসো

“পয়লা বৈশাখ মানে বাঙালির বাসভূমে ফেরা

বুকে হাত রেখে নিজেকে আপন করে চেনা।


পয়লা বৈশাখ মানে হালখাতা, মিষ্টিমুখ

আবার নতুন করে সবকিছু শুরু।”

বাঙালি সংস্কৃৃতির গভীরে প্রোথিত এক সর্বজনীন প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখ। সামাজিক ও লোক-উৎসবের এই দিনটি বর্তমানে একটি সাংস্কৃতিক দিবসে রূপ নিয়েছে। নববর্ষ বাঙালির মননের প্রতীক, বাঙালির চৈতন্যলোকে অনিন্দ্য সত্তার বাতিঘর।

বাংলা নববর্ষ অতীতে ছিল কৃষি আর কৃষকের উৎসব। প্রকৃতি ও তার সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা মানুষের জীবনাচরণ-কে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল নববর্ষ উৎসব- নতুন বছরের মঙ্গল কামনায় কৃষাণবধূরা পালন করতেন এ-লোকাচার। চৈত্র-সংক্রান্তির রাতে একটা মাটির হাঁড়িতে ভেজাতেন আতপ চাল। তাতে রাখতেন কচি পাতা-সহ একটা আমের ডাল। নববর্ষের প্রভাতে বাড়ির সবাইকে ডেকে তুলে খেতে দিতেন সে চাল- আমানি বলত তাকে আর সে-কারণে সুদূর অতীতে এ-উৎসবের নাম ছিল আমানি উৎসব। এমন লোকায়ত এবং জনমানুষসম্পৃক্ত মঙ্গল কামনার আনন্দ-উৎসব খুব কম আছে বলেই বাংলা নতুন বছর বাঙালির শেকড়ের সন্ধানের উৎসব। পুরাতনকে বিদায় দিয়ে নতুনকে আলিঙ্গনের অনন্য উদাহরণ হিসেবে দিনটি আসে, আনন্দে মাতিয়ে আগামীর দিনগুলোর জীবনসংগ্রামে সাহস জোগায়।

কৃষকের বাড়ির আঙিনা ছেড়ে গ্রামের সীমানা পেরিয়ে নববর্ষ উৎসব সর্বজনীন উৎসব হিসেবে কালক্রমে ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে দিনে দিনে বদলে গেছে নববর্ষ উদ্যাপনের প্রকার-প্রকৃতি। গ্রামে গ্রামে বাউলের একতারার সুর যেমন নতুন বছরকে আবাহন করে তেমনি রাজধানীতে রমনার উদ্যানে নতুন বছরের নতুন সূর্যোদয়ের সময় রবীন্দ্রনাথের গান- ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো,’ জানিয়ে দেয় কালের পরিক্রমায় বাঙালিজীবনে এসেছে আরেকটি বছর।

পয়লা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামল থেকে। সম্রাট আকবরই প্রথম বঙ্গাব্দ প্রবর্তন করেন। শুরুর দিকে পয়লা বৈশাখের আনুষ্ঠানিকতা কৃষক, জমিদার ও ভূ-স্বামীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। অবশ্য এ উপলক্ষে পুণ্যাহ, হালখাতা, মেলা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হতো। ধীরে ধীরে তা ব্যাপকতা পায়, নানা উৎসব-অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে পয়লা বৈশাখ হয়ে ওঠে সর্বজনীন– শুভবোধ আর কল্যাণ চেতনার প্রতীক। বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনার একটি উপাদান হিসেবে বাংলা নববর্ষ পালিত হয়। বাঙালির ঘরে ঘরে এ দিন উৎসবের ছোঁয়া লাগে। পরস্পরের মঙ্গল কামনা এ দিনের সামাজিকতার অঙ্গ।

নববর্ষের অন্যতম আকর্ষণ বৈশাখিমেলা। মেলার আমেজে নববর্ষ উৎসব-মুখর হয়ে ওঠে। বৈশাখিমেলা দেশের নানা অঞ্চলে বসে। কোথাও তিনদিন কোথাও পাঁচদিন আবার কোথাও-বা সাতদিন ধরে চলে বৈশাখিমেলা। লোকজ এ-সব মেলায় জাতি-ধর্ম-বর্ণ-বয়সভেদে সবধরনের লোকের সমাগম হয়। বৈশাখিমেলায় স্থানীয় কৃষিজাতপণ্য, কারুপণ্য, কুটিরশিল্পজাত সামগ্রী, সবধরনের হস্তশিল্প ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী, শিশুদের খেলনা, আসবাপত্র বেচা-কেনা চলে। বিভিন্ন লোকজ খাদ্যদ্রব্য যেমন : চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা নানা প্রকার মিষ্টান্ন-সহবিচিত্র দ্রব্য-সামগ্রীর সমারোহ থাকে। মেলায় বিনোদনেরও ব্যবস্থা থাকে। পুতুলনাচ ; নাগরদোলা ; সার্কাস ; বায়োস্কোপ ; যাত্রাপালা, লোকসংগীত, জারি, সারি, গম্ভীরা, বাউলগান, নাটক ; চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়।

ঢাকায় সেই ১৩৭৩ বঙ্গাব্দ থেকে ছায়ানট রমনার বটমূলে গান গেয়ে ও কবিতা আবৃত্তি করে নতুন বছরকে বরণ করে।

বর্ষবরণ উদযাপনের ইতিহাস কয়েকশ বছরের পুরনো হলেও মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রথম শুরু হয়েছিল ১৩৯১ বঙ্গাবব্দের পহেলা বৈশাখে যশোরে। তখন দেশে ছিল সামরিক শাসন। উদ্দেশ্য ছিল দেশের লোকজ সংস্কৃতি উপস্থাপনের মাধ্যমে সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা।

এর চার বছর পর ১৩৯৫ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখে ঢাকার চারুকলা থেকেও শুরু হয় এই মঙ্গল শোভাযাত্রা। শুরুতে এর নাম ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ ছিল। তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থাকে মাথায় রেখেই এমন নামকরণ করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এটি ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ হিসেবেই পরিচিত হয়। কারক্রমে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ জাতিসঙ্ঘের সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান লাভ করে।

সর্বোপরী, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও আঞ্চলিকতার ক্ষুদ্র সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে শুভ ও মঙ্গল কামনার মধ্য দিয়ে মানব স্বীকৃতিই পয়লা বৈশাখের মূল কথা। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে বাঙালির নববর্ষ ভিন্নমাত্রা লাভ করেছে। বিশ্বের অনেক দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ এই উৎসব সম্পর্কে জানে এবং আগ্রহভরে অংশ নেয়। এর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও অসাপ্রদায়িক চেতনা মানুষকে আকৃষ্ট করে। বাঙালির প্রাণের এই উৎসব মূলত বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার প্রতীকী উপস্থাপনা। 

লেখা : ইকবাল খোরশেদ