পর্ব-২
[পূর্ব প্রকাশিতের পর]
-আজ পর্যন্ত আমি যতগুলো কলমের কালি শেষ হওয়ার পর ফেলে দিয়েছি, যতগুলো চুলের ক্লিপ ব্যবহার করে ফেলে দিয়েছি, যত কসমেটিক্সের প্যাকেজিং ফেলে দিয়েছি, সে সব কিছু রয়ে গেছে।
আজকে পৃথিবীতে ৬.৩ বিলিয়ন মেট্রিক টন ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক জমা হয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগই সাগরে গিয়ে জমা হয়। করুণভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থান। মারা যাচ্ছে অসংখ্য সামুদ্রিক প্রাণী। আমরা কল্পনাও করতে পারছি না, ব্যাপারটা কত ভয়ানকভাবে বুমেরাং হয়ে আমাদের দিকে ফিরে আসবে।
-ম্যাডাম তো যেভাবে প্লাস্টিকের বোতল কেটে টব বানাচ্ছে, এই পদ্ধতিতে প্লাস্টিক থেকে পরিবেশ বাঁচানোর ব্যাপারটি সবাইকে বোঝাতে হবে।
-ঠিক বলেছ। পরিবেশের অনেকটা উপকার হবে সবাই যদি এই কাজ করে। শোন আম্মু, কী কী ক্ষতি হচ্ছে। প্রতিবছর আট মিলিয়ন টন করে প্লাস্টিক জমা হচ্ছে সমুদ্রে। এখানেই শেষ না। আমাদের ব্যবহারের পণ্য ছাড়াও অজস্র প্লাস্টিক আছে পরিবেশে যেগুলো খালি চোখে আমরা দেখি না। অত্যন্ত সূ² মাইক্রো প্লাস্টিক BPA ব্যবহার করা হয় প্লাস্টিকের বোতলকে স্বচ্ছ [transparent] করতে, DEHP প্লাস্টিকের বোতল কে নমনীয় [flexible] করতে। এছাড়াও হাজারো মাইক্রো প্লাস্টিক পাওয়া গেছে আমাদের খাবারে, কাপড় ধোয়া পানিতে, প্রসাধনীতে, সামুদ্রিক লবণে আর ঘর-বাড়ির ধুলো ময়লাতে। হ্যা, আমাদের শরীরে ঢুকতেও বাকি নেই। ৯০% মানুষের পেশাবে ইচঅ পাওয়া গেছে।
প্রতিবছর ৫১ ট্রিলিয়ন মাইক্রো প্লাস্টিক সমুদ্রে জমা হচ্ছে। প্ল্যাংক্টন খাওয়া প্রাণীরা এখন খাচ্ছে প্লাস্টিক। তাদের পরিপাক তন্ত্রের মাধ্যমে প্লাস্টিকের মাইক্রো ফাইবারগুলো আরো অনেক বেশি সূ² আকার নিয়ে পরিবেশে ফিরে আসছে। এই দূষণের প্রভাব তো কল্পনা করতেও ভয় লাগে।
-সত্যিই ভয়ের ব্যাপার। মানুষের কোনো চিন্তা নেই। আমরা খুব অসচেতন।
-এক্ষুনি সচেতন না হলে মিডাসের গল্পের মতো পৃথিবীটা হয়ত তেমন হয়ে যেতে পারে যেমন আমরা কোনোদিনও চাই না। এই সমস্যা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
সাইদার কথা শেষ হলে ড. জেসমিন বললেন, প্লাস্টিকের ব্যবহার কম করতে চলুন নিজে উদ্যোগ নিই এবং অন্যকে উৎসাহিত করি।
সাইদা বলল, আন্টি, পরিবেশকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছেন। এখন অনেকে সবুজ বনায়নে আগ্রহী। সবাই যদি আন্টির মতো প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করে তাহলে টাকাও বাঁচবে, পরিবেশও বাঁচবে।
গাছের ঝরাপাতার নূপুর বাজিয়ে শীত এলো। বসন্তের নতুন পাতা জাগিয়ে তার বিদায়। কী সুন্দর কুয়াশাভেজা শীতের ভোর। ভেজা দুর্বাঘাস। লাল সূর্য ওঠা মিষ্টি রোদ। প্রকৃতির এক ভিন্ন রূপ, যা সম্পূর্ণভাবে ধারণ করে শীতের সকালের গাম্ভীর্যময় এক মহিমা নিয়ে।
বারান্দায় গোলাপের পাপড়ির গায়ের রুপোলি কুয়াশা মনে করিয়ে দিল শাকিলার গ্রামে থাকা শীতের সকালের কথা। ছেলেবেলার সেই গ্রামীণ জীবনের গৃহত্যাগী পাখিদের নিস্তেজ ডাকাডাকি আর কৃষাণের ব্যস্ত আনাগোনায় শুরু হতো শীতের সকাল। পাড়ার রহিম চাচার কাঁধে মিষ্টি খেজুর রসের হাড়ি সেই সকালকে করে তুলতো আরো মোহনীয়।
উত্তর দিকের হিম শীতল রাতের দীর্ঘশ্বাস শিরশির করে বয়ে যেত গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে। কেঁপে উঠত শীতল পত্রপল্লব। আহা সেই টুপটাপ শিশিরের শব্দ আর রুপোর দানার মতো শিশির কণা মন মাঝারে ছবি হয়ে আছে। সিক্ত মেঠোপথ, কুয়াশাভেজা ঘাস আজও পিছু ডাকে। হলদে সর্ষে ক্ষেত আর ভেজা মটর লতা ছেলেবেলায়ই তাকে কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত করেছিল। সেদিনের সেই খেজুর গাছের রসের হাঁড়ি আর বাতাসে ভেসে আসা সেই মিষ্টি গন্ধের আজ বড়ো অভাব। পাতা ঝরার সেই দিন, সেই কচি সবুজ চারার দোলন, পুবাকাশে কুয়াশার চাদর চিরে লাল সূর্যের মিষ্টি আভা। আহা কতই না শোভাময় ছিল সেই ক্ষণ, সেই ফেলে আসা শীতের ভোর।
এসব ভাবনার মধ্যেই মুঠোফোনটা বেজে উঠল। ফোনটি রিসিভ করতে হলো শাকিলার। ড. জেসমিন ম্যাডামের কণ্ঠ- দুঃখিত আপা এত ভোরে ফোন করলাম।
শাকিলা শান্ত কণ্ঠে বলল- না ম্যাডাম, কোনো সমস্যা নেই। আপনি ভালো আছেন ?
- জি¦ ভালো আছি, আপনি কী করছেন ?
- বারান্দায় বসে ফেলে আসা শীতভোরের স্মৃতিরোমন্থন করছিলাম।
- আপনাকে আজ আমার ছাদে লাল সূর্য ওঠা, আমার কুয়াশাভেজা ফুল আর সবজি গাছ দেখতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আপনার ভালো লাগবে। আমি ছাদে যাচ্ছি, আপনি আসুন। একটু হলেও উপভোগ করতে পারবেন।
- আমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম ম্যাডাম। এক্ষুণি আসছি।
শাকিলার ঘরে আজ কেউ নেই। গায়ে চাদরটা জড়িয়ে, দরজায় তালা লাগাল শাকিলা। এক শুভ্র সুন্দরের প্রত্যাশায় পা বাড়াল।
ম্যাডাম ছাদে অপেক্ষা করছেন। শাকিলা গিয়ে দেখল কুয়াশাঘেরা আবছা আঁধারি ভেদ করে লাল মিষ্টি সূর্য উঁকি দিয়েছে নীরব আকাশে। বড়ো বড়ো দালানগুলো মনে হচ্ছে শীতে জড়সড়। হঠাৎ তার মনে হলো পায়ের উপর কিছু পড়ল। চেয়ে দেখল কমলা বৃন্তের সাদা দুটো শিউলি ফুল। ম্যাডামের ছাদ বাগানের বাহারি ফুল আর সবুজ সবজি গাছের পাতার গায়ে রুপোলি কুয়াশা তাকে নিয়ে গেল এক মোহনীয় কল্পজগতে। সে অন্যমনস্ক হয়ে শহরের মধ্যেও প্রকৃতির এক অপূর্ব নীরবতা আর শুভ্রতায় মুগ্ধ হলো। ধীরে ধীরে লাল সূর্যের মিষ্টি রোদে ভরে গেল পুরো বাগান। সবুজ পাতার গায়ের কুয়াশাগুলো ঝলমল করে উঠল।
ড. জেসমিন ম্যাডামের ছাদ ভর্তি গাছ। নানা রঙের গাঁদা আর চন্দ্রমল্লিকা ঝলমল করছে। নানা রঙের নয়নতারা, স্টেপেলিয়া, গ্রাউন্ড অর্কিড, পিটুনিয়া, সেলভিয়া, নানা রঙের সন্ধ্যামালতি, রোজ ক্যাকটাস, কাঠগোলাপ, বিভিন্ন রঙের রুয়েলিয়া, অপরাজিতা, সাদা ও নীল মর্নিং গ্লোরি, নানা রঙের হলুদ, সাদা, লাল গোলাপি কাটামুকুটের কী অপরূপ শোভা।
সিনড্রেলা, অরেঞ্জ মার্মালেড, হলুদ ক্যালাঞ্চু, লাল ক্যালাঞ্চু, নানা রঙের দোপাটি, গোল্ডেন বুশ, পয়েনসেটিয়া, রজনীগন্ধা, কয়েকরকম লিলি, ইনকা গাঁদা, চায়না গাঁদা, ব্লুডেউজ, মাদার অব থাওজেন্ড ড্যান্সিং, লেডি অর্কিড, গোলাপ স্টারফুল ইত্যাদি আরো অনেক ফুল রয়েছে।
রয়েছে শীতকালীন সব ধরনের শাক-সবজির গাছ। পঁচিশ রকমের টমেটো গাছের সজীবতায় প্রাণ জুড়িয়ে যায়। টমেটো গাছই সবচেয়ে বেশি এবং সুন্দর। ম্যাডাম এসব সম্পূর্ণ অর্গানিক উপায়ে চাষ করেন। শাকিলা জানতে চাইল চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে। ম্যাডাম শাকিলাকে প্রথম থেকে ধারাবাহিকভাবে বলতে শুরু করলেন-
আমি প্রথমে মাটি প্রস্তুত করি। ২০% সম্পূর্ণ নতুন মাটি হালকা শুকিয়ে ঝুরঝুরে করে তাতে ৪০% শুকনো গোবর আর ৪০% কোকোডাস্ট মিশিয়ে মাটি প্রস্তুত করি। কোনো প্রকার রাসায়নিক সার বা কীটনাশক কখনো দিই না।
বীজ প্রস্তুতি
বীজগুলোকে আলাদা আলাদা নাম লিখে ২ ঘণ্টা রোদে রাখি। তারপর একগ্লাস পানিতে ১ চা-চামচ হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড মিশিয়ে তাতে বীজগুলো ভিজিয়ে রাখি ৭-৮ ঘণ্টা। তারপর সে বীজগুলো ছেকে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে কিছু ছাই মিশিয়ে ঝুরঝুরে করে নিই।
স্থান নির্বাচন
ছিদ্রযুক্ত ফলের ঝুড়ি, ওয়ানটাইম বক্স, সিডলিং ট্রে বা ওয়ানটাইম গ্লাসে বীজগুলোর নাম লিখে পূর্বে প্রস্তুতকৃত কিছু মাটি নিয়ে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড মিশানো পানি স্প্রে করি, ছাই মেশানো বীজগুলো বিছিয়ে দিয়ে আবার সেই পানি স্প্রে করি। তারপর আরো এক স্তর মাটি দিয়ে বীজগুলোকে ঢেকে দিয়ে পানি দিয়ে ছায়াযুক্ত স্থানে রাখি। মাঝে মাঝে হালকা পানি দিই প্রয়োজন বুঝে আর চারা উঠতে শুরু করলে রোদে রাখি। তবে পাখির হাত থেকে রক্ষার জন্য ঢেকে রাখতে হয়।
শাকিলা আবার পশ্ন করল- ম্যাডাম হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড কোথায় পাব ?
ম্যাডাম বললেন- হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ফার্মেসিতে ৩০ টাকা মূল্যে পাবেন। এটি ব্যবহারে বীজ শোধিত হবে, বীজ হবে রোগমুক্ত।
চারা বড়ো হলে নির্ধারিত টবে পূর্বে প্রস্তুতকৃত সারযুক্ত মাটিতে লাগিয়ে দিই। তবে লাউ, সীম এসব বড়ো সাইজের বীজগুলো আমি টিস্যুতেও জার্মিনেট করি। আর লাল শাক বা একেবারে ছোটো সাইজের বীজ না ভিজিয়ে সরাসরি মাটিতে ছিটিয়ে দিয়ে উপরে কিছু মাটি ছড়িয়ে দিই। [চলবে]
মডেল : মাহমুদা আখতার