জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী তমা মির্জার ক্যারিয়ারের বয়েস ইতোমধ্যে ১৪ অতিক্রম করেছে। এই দীর্ঘ পথচলায় দর্শক বিভিন্ন রূপে দেখেছেন এই অভিনয়শিল্পীকে। যেকোনো চরিত্রে নিজেকে মানিয়ে নেন সাবলীলভাবে। গেল বছর ঈদুল আজহায় ‘সুড়ঙ্গ’ চলচ্চিত্রে ময়না চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও তার অভিনীত ‘সুড়ঙ্গ’ ছবিটি সাড়া ফেলেছে। আর সাড়া ফেলবেই-বা না কেন, প্রতিটি চরিত্রের জন্য তিনি প্রচুর পরিশ্রম করেন। ‘সুড়ঙ্গ’ ছবির ময়না চরিত্রের জন্যও তিনি নিজেকে তৈরি করেছেন লম্বা সময় নিয়ে। এবারও নতুন রূপে আসছেন তমা। নিজেকে তৈরিও করেছেন। শরীর থেকে ওজন ঝরিয়েছেন ৫ কেজি। বিস্তারিত লিখেছেন শেখ সেলিম...
বরাবরই চলচ্চিত্র অঙ্গনে নায়িকাদের একটা সংকট রয়েই যায়। এই সংকট উত্তরণের জন্য নতুন মুখের সন্ধানে একটি প্রতিযোগিতাও করে থাকে এফডিসি। দু’য়েকজন শিল্পী পেলেও কাক্সিক্ষত শিল্পী যেন কিছুতেই আসছে না। তাই তো ঘুরেফিরে একই মুখ দেখতে হয় দর্শকের। পূর্ণিমা, শাবনূর ও অপু বিশ্বাসের অধ্যায়ের পর, তেমন করে আর কাউকে জ্বলে উঠতে দেখা যায়নি। মাঝে পরিমনি আলোচনায় থাকলেও হলে দর্শক টানতে পারেননি, সেই দিক থেকে শবনম বুবলী ছিলেন এগিয়ে, বিশেষ করে শাকিব খানের সঙ্গে জুটি হওয়ার সুবাদে তিনি বেশ আলোচনায় ছিলেন, তবে শাকিব বিহীনও তিনি নিজের আসনকে বেশ পোক্ত করে রেখেছেন। এইদিকে শাবনূরের পর যাকে সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময় নায়িকা ধরা হতো তিনি হলেন তমা মির্জা। ইতোমধ্যে সাবলীল অভিনয়ের জন্য অর্জন করেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও। ইতোমধ্যে তমা মির্জার ক্যারিয়ার ১৪ বছর অতিক্রম করেছে। দিন দিন বেড়েই চলেছে তমা বন্দনা। প্রযোজক, পরিচালক, হল মালিকদেরও পছন্দের অভিনেত্রী এখন তমা মির্জা।
বিশেষ করে গেল বছর ঈদুল আজহায় ‘সুড়ঙ্গ’ চলচ্চিত্রে ময়না চরিত্রে অভিনয় করে সাড়া ফেলেন এই অভিনেত্রী। এরপর তাকে ঘিরে পরিচালক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের আগ্রহ বাড়ে।
ইতোমধ্যে দু’টি ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন তমা। নতুন চরিত্রে প্রবেশের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন অনেক আগে থেকেই। এর প্রথম ধাপ হিসেবে পাঁচ কেজি ওজন কমিয়েছেন তিনি। নিয়ম করে ব্যায়াম আর খাবারের রুটিনে পরিবর্তন করেছেন এতদিন। এবার শুটিংয়ের জন্য প্রস্তুত তিনি।
এরই মধ্যে ব্যায়ামের কয়েকটা ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন তমা মির্জা। এই প্রসঙ্গে তমা বলেন, ‘নতুন ছবির শুটিং শুরু হবে। তাই গত কয়েক মাস ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছি, নিয়মিত ব্যায়াম করছি, খাদ্যাভাসেও পরিবর্তন এনেছি। আর তাতে কাজও হয়েছে। খুব শিগ্গিরই শুটিং শুরু হবে বলে জানান তিনি। তবে কি সিনেমায় কাজ করছেন, সহ-অভিনেতা কে ? কিছুই এখন বলতে চাইছেন না তিনি। বললেন, চমক দেওয়ার জন্যই এই গোপনীয়তা। সেসব তথ্য জানতে আর অল্প কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
এছাড়াও তমা মির্জা অভিনয় করেছেন ভারতীয় গায়ক ও চলচ্চিত্রকার অঞ্জন দত্তের পরিচালনায় ওটিটি প্লাটফর্মের জন্য ‘দুই বন্ধু’ নামে একটি মিউজিক্যাল ওয়েব সিরিজ। পরিচালনার পাশাপাশি সিরিজটিতে অভিনয়ও করছেন অঞ্জন দত্ত। সিনেমায় তমা মির্জা ছাড়া আরো থাকছেন দুই বাংলার অভিনয়শিল্পী।
অঞ্জনের সঙ্গে কাজের অনুভূতি জানতে চাইলে তমা মির্জা বলেন, ‘অঞ্জন দত্তের পরিচালনায় কাজ করছি এটা ভেবে অনেক ভালো লাগছে। দারুণ একটি গল্পে নির্মাণ হচ্ছে সিরিজটিতে। শিগ্গিরই দেখা যাবে। মিউজিক্যাল এই ওয়েব সিরিজে বড়ো চমক হিসেবে থাকছে অঞ্জন দত্তের গাওয়া নতুন ছয়টি গান।’
‘সুড়ঙ্গ’ ছবি মুক্তির পর আরো বেশি কাজের প্রতি যতœবান হয়েছেন তমা। তারই প্রমাণ ‘সুড়ঙ্গ’ মুক্তির পর বেশকিছু সিনেমা, ওয়েব সিরিজ ও ওয়েব ফিল্মের প্রস্তাব পান তিনি। সেখান থেকে বেছে কয়েকটিতে কাজ করছেন। তার মতে, ‘সুড়ঙ্গ’ দর্শকের অনেক বছর মনে রাখার মতো একটি ছবি। তাই আমিও খুব একটা চাপে ছিলাম না এই ভেবে যে, দ্রুত একই বছরে আরেকটা কাজ নিয়ে দর্শকের সামনে আসতেই হবে।”
বর্তমানে তমা মির্জা শাহনেওয়াজ কাকলীর পরিচালনায় ‘ফ্রম বাংলাদেশ’ ছবির শুটিং সম্পন্ন করেছেন। এছাড়া শাহরিয়ার নাজিম জয়ের পরিচালনায় ‘পাপকাহিনী’ ও আরিফুজ্জামান আরিফের পরিচালনায় ‘কাঠগড়ায় শরৎচন্দ্র’ ছবি দু’টির শুটিংয়ের কাজ প্রায় শেষের দিকে।
তমা মির্জার জন্ম বাগেরহাটের কচুয়ায়, সেখানেই তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে। সেখান থেকে মাধ্যমিক পাশ করেছেন। পরবর্তীসময়ে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজে এবং বর্তমানে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করছেন।
ছেলেবেলার স্মৃতিচারণ করে তমা মির্জা বলেন, ছোটবেলায় আমার ছবি আঁকার শখ ছিল। প্রচুর ছবি আঁকতাম। আব্বু সরকারি চাকরি করতেন। আমাদের বাসা থেকে আব্বুর অফিসে যেতে ২ মিনিট সময় লাগত। আমি ছবি এঁকেই দৌড়ে আব্বুর কাছে চলে যেতাম। সব ব্যস্ততা ফেলে আব্বু আমার আঁকা ছবি দেখতেন। আব্বু হাত খরচ দিতেন দুই টাকা। সেই টাকা দিয়ে মোয়া খেতাম, বিস্কুট খেতাম। আবার কোনোদিন বন্ধুদের খাওয়াতাম। ছেলেবেলায় ভ্যানে করে স্কুলে যেতাম। আগে টং দোকানে পায়ে পা রেখে চা পান করতাম, এখন সেটা করতে পারি না।
তমা মির্জা খুব সাধারণ জীবনযাপন করেছেন। এই সাধারণ জীবনকে অসাধারণ করে দিয়েছেন তার বাবা-মা। পড়াশোনার পাশাপাশি নাচ শেখানোসহ বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করতেন বাবা-মা। তাদের সহযোগিতার কারণেই তিনি শোবিজে কাজ করতে পারছেন বলে জানান।
তিনি আরো বলেন, পরিশ্রম করে আজকে এই অবস্থানে এসেছি। পরিশ্রম করার কারণে বিনয়ী হতে পেরেছি। এক লাফে এতদূর আসিনি। এখন অনেকের মধ্যে বিনয় জিনিসটা নেই। এখন অনেকে তাড়াহুড়ো করেন। এসেছি, আমাকে স্টার হতে হবে। স্টার কে সেটাই আমরা বুঝি না, সুপারস্টার তো অনেক বড়ো কথা। সুপারস্টার অনেক বড়ো তকমা।
হঠাৎ করেই কাজের প্যাটার্ন বদলে ফেলেছেন তমা মির্জা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বলেন, আমার ট্রান্সফরমেশনের গল্পটা এখনো বলা হয়নি। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ার পর বুঝলাম, ভালো কাজের মূল্যায়ন হয়। ভালো কাজ, মন্দ কাজ বুঝতে পেরেছি। সে অনুযায়ী কাজ বাছাই করতে পারছি। এজন্য এখন নেগেটিভ মন্তব্য কম পাই। শুরুর দিকে প্রচুর নেগেটিভ কথা শুনতে হয়েছে।
‘দ্য ডার্ক সাইট অব ঢাকা’ ওয়েব ফিল্মে অভিনয় করে বেশ প্রশংসা কুড়ান তমা মির্জা। দর্শক তার অভিনয় নিয়ে কথা বলেছেন। ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলেননি। তমার উপলব্ধি, দর্শক কাজ দেখতে চান।
নায়িকাদের গসিপ প্রসঙ্গেও বলেন, অনেক সময় দেখি আপনারা জাজমেন্টাল হয়ে যান। দয়া করে এটা করবেন না। কারো একজনের লাইফের নেগেটিভ কোনো জিনিস প্রকাশ্যে এলেই গণহারে আপনারা সবাইকে একরকম মনে করেন। আসলে সবাই একরকম নয়। কেউ অল্পতে খুশি, আর কেউ অনেক পেয়েও খুশি নয়। নেট দুনিয়ায় অ্যাবিউজ না করে সমর্থন করেন। ভালো না লাগলে এড়িয়ে যান। হ
একনজরে তমা মির্জা
তমা মির্জার বড়োপর্দায় অভিষেক হয় শাহিন সুমনের ‘মনে বড়ো কষ্ট’ ছবির মাধ্যমে। প্রথম ছবিতে পার্শ্ব নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। ভালো অভিনয়ের কারণে আরো কয়েকটি ছবিতে পার্শ্ব নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এরপর অনন্ত হীরার ‘ও আমার দেশের মাটি’ ছবিতে একক নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। একের পর এক ভালোমানের চলচ্চিত্রে অভিনয় করে নিজের অবস্থান শক্ত করেছেন। শুধু তাই নয়, অভিনয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘নদীজন’ ছবিতে অভিনয় করে অর্জন করেছেন ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
প্রথম দিকে অভিনীত ছবিগুলো খুব একটা সফলতার মুখ না দেখলেও ধীরে ধীরে তমা মির্জা নিজের অবস্থান শক্ত করে নিয়েছেন। এই অঙ্গনে কাজ করা প্রসঙ্গে তমা বলেন, শুরুতে চাইতাম নায়িকা হব, নাচ গান করব, এখন বুঝলাম নায়িকা নয়, আমাকে অভিনয়শিল্পী হতে হবে। এই ইচ্ছে নিয়েই এখন পথ চলছি।