ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

14 May 2023, 01:13 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


আসা যাওয়াসহ চারদিনের এই ডেনমার্ক সফরে ইতোমধ্যে দুইদিন পার করে ফেলেছি, আজ তৃতীয় দিনে যথারীতি আমি আর বাবু সকাল সকালই বেরিয়ে পড়লাম, খাবার-দাবার সঙ্গে করে নিতে ভুললাম না, অন্যেরা যে যার কাজে চলে গেছে। আজ অবশ্য বাবু তার গাড়ি নিয়েছে যেন ইচ্ছেমতো যে কোনো দিকে যাওয়া যায়। শুরুটা হলো পুরোনো ফোর্ট থেকে, এ শহরের যত্রতত্রই যেমন সমুদ্রের দেখা মেলে তেমনি ফোর্টের সংখ্যাও নেহায়েত কম না। তবে, সমুদ্র যেন শহরটাকে আগলে বসে আছে। কেননা, সেদিন সারাদিনের মধ্যে যতগুলো স্পট ঘুরে বেড়ালাম যেন ঘুরেফিরে সমুদ্রকেই দেখলাম। বলছিলাম দুর্গের কথা, জায়গাটি ডেনমার্কের হেলসিঙ্গার শহরের একদম উত্তর-পূর্ব পাশে জিল্যান্তের oresund প্রণালি যাকে ইংরেজিতে সাউন্ড প্রণালি বলে, এর এক সংর্কীণ কোণে অবস্থিত, যার কারণে দূর্গটি তিনদিক থেকে সমুদ্রবেষ্টিত। দুর্গটির নাম ক্রনবোর্গ দুর্গ। ১৪০০ শতকের শুরুর দিকে ডেনিশ রাজা এরিক বাল্টিক সাগরের প্রবেশমুখ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে এ দুর্গটি নির্মাণ করেন। সাগরপাড়ে ছোট্ট একটা জেটি ঘেঁষে বিশাল এলাকাজুড়ে এটি এখনো অম্লান, না এর কৌশলগত অবস্থানের কারণে নয় বরং দুর্গের সাথে সম্পর্কিত কিছু বাস্তব চরিত্রের করুণ পরিণতি এ দুর্গকে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের মর্যাদা দিয়েছে যা এখন সাহিত্যপ্রেমী সাধারণ মানুষের আগ্রহের কেন্দ্র। খুলেই বলি, কথিত আছে, ডেনিশ রাজা এরিক-এর পুত্র হ্যামলেট পড়াশোনার জন্য জার্মানিতে ছিলেন, সেখানেই তিনি জানতে পারেন তার পিতা রাজা এরিক মারা গেছেন। তিনি ফিরে আসেন নিজ দেশে, পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে তিনি আবিস্কার করেন যে, তার পিতা প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার এবং তার মা রানি গার্ট্রড এবং চাচা ক্লাডিয়াস যৌথভাবে এই ষড়যন্ত্রের রূপকার এবং একসময় তার মা এবং চাচা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আর এই কাহিনিকে উপজীব্য করেই উইলিয়াম শেক্সপিয়র নির্মাণ করেন তার কালজয়ী ‘হ্যামলেট’ নাটকটি।

যদিও স্ট্রাকচার আমাকে তেমন টানে না, তবুও পুরোনো রাজপ্রাসাদ বা দুর্গগুলো অন্যরকম একটা ভাবনার খোরাক দেয়। আমি যখন এই প্রাসাদের অলিগলি ঘুরে দেখছিলাম তখন খুব মনে হচ্ছিল সেই সময়কার মানুষদের কথা, কেমন ছিলেন তারা, তাদের জীবনপ্রণালি। একই সাথে এটাও মনে হচ্ছিল যে, আমাদের জীবনের স্থিতি কত কম। ১৪০০ শতকের মানুষ নির্মিত স্থাপনা এখনো সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, অথচ যাদের দ্বারা এবং যাদের প্রয়োজনে এ কর্মযজ্ঞ তারা আজ কোথায় বিলীন। তবে ক্রনবোর্গ দুর্গটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আমাকে যতটা না আকৃষ্ট করেছে তার থেকে এর অবস্থান এবং আর্কিটেকচার আমাকে অনেক বেশি মুগ্ধ করেছে। একদম সমুদ্রঘেঁেষ দাঁড়িয়ে থাকা এ দুর্গের পাতালপথ সমুদ্রে গিয়ে মিশেছে, দুর্গটি তিনদিক থেকে বাল্টিক সাগর দ্বারা বেষ্টিত থাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিতে শুধুমাত্র এর সিংহদ্বারের দিকটিতে গভীর পরিখা খনন করা হয়েছে, যা এখনো টলটলে জলে পরিপূর্ণ। কালের পরিক্রমায় কি না জানি না এর সীমানা প্রাচীর কিন্তু সমুদ্রের ধার দিয়ে খুব একটা উঁচু নয়। আমরা সহজেই এই প্রাচীর ডিঙিয়ে সমুদ্রের কাছে চলে যেতে পারলাম। সমুদ্র এখানে বেশ গভীর, তাই বালিয়াড়ি পার হয়ে জলে পা ডোবানোর সুযোগ নেই বড়ো-বড়ো পাথর আর কংক্রিটের বোল্ডার দিয়ে সমুদ্রতীর বেঁধে দেওয়া। বলা হয়নি আজ আবহাওয়া খুবই চমৎকার। সকাল থেকেই সূর্যের আলোয় এমনিতেই প্রকৃতি ঝলমল করছিল আর এখন সময় যখন মধ্যাহ্নের দিকে পা বাড়াচ্ছে তখন সমুদ্রের ছোটো ছোটো ঢেউয়ের ওপর আছড়ে পড়া সূর্যের আলোয় চারিদিক যেন রুপার আলোর ঝলকানিতে ঝকমকিয়ে উঠছে। মাথার উপর সূর্যের তেজ তবু সমুদ্রের তীরে বসে থাকতেই যেন ভালো লাগছে, সমুদ্র থেকে ভেসে আসা পাগলা বাতাস যেন সবকিছু ছাপিয়ে মনকে আবার নিয়ে যাচ্ছে সুদূর কোন অতীতে ; যখন এই দুর্গ জনকোলাহলে সরব ছিল, হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া। রাজদরবার পারিষদের গুরুগম্ভীর আলোচনায় মশগুল ছিল, ছিল অন্দরমহলে দাসদাসীদের কলরব, সখী সহচরে রানি ব্যস্ত ছিল নিজের মতো করে। কোনো একসময় এই প্রাসাদ-দুর্গের চিত্র এমনই ছিল। জীবনানন্দের ভাষায় আবার সেই একই কথা বলেতে হয় “এইসব ছিল সেই জগতে একদিন। অনেক কমলা রঙের রোদ ছিল, অনেক কাকাতুয়া পায়রা ছিল, মেহগনি ছায়ঘন পল্লব ছিল অনেক ; অনেক কমলা রঙের রোদ ছিল।” আর আজ সময়ের পরিক্রমায় সেই সমুদ্রপাড়ের কাহিনি ‘খিলান আর গম্বুজের বেদনাময় রেখা’ হয়েই আছে।

সময় দুপরে এসে দাঁড়ালে আমরা আমাদের সাথে করে আনা খাবার খেয়ে নিলাম, আমরা এখন আর সমুদ্র পাড়ে নেই, প্রাসাদের সিংহদ্বার পার হয়ে খোলা চত্বরে রোদ পোহাতে পোহাতে আমাদের মধ্যাহ্নভোজ সেরে নিলাম। আমরা অবশ্য আমাদের খাবার সমুদ্রপাখিদের সঙ্গে ভাগ করে নিলাম। পুরো ইউরোপজুড়ে এ এক চমৎকার দৃশ্য- পাখিরা যেন এখানে ভয়হীন, সমগ্র জনপদ তাদের অভয় আশ্রম। এর মধ্যে আকাশ একটু মেঘলা হলে আমরাও এখানকার পাট গুটিয়ে উঠে পড়লাম, আমাদের এখনকার গন্তব্য ডেনমার্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা আমালিয়েনবর্গ প্রাসাদ যা ডেনমার্কের রাজ পরিবারের সরকারি বাসভবন। রানি মার্গারেট (২) শীতকালে এবং শরৎকালে এ প্রাসাদে বসবাস করে থাকেন। বিশাল এলাকাজুড়ে তৈরি এই প্রাসাদের অনেকটাই জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। প্রাসাদ পরিভ্রমণ শেষে কিছুটা সময় আমরা অনেকটা উদ্দেশ্যহীনভাবেই শহরের এদিক-সেদিক ঘুরে দেখলাম। ঘুরেফিরে বাল্টিকের দেখা মিলল বার কয়েক। সমুদ্র যেন সুযোগ পেলে ফাঁক-ফোঁকর গলে শহরে ঢুকে পড়েছে। বেলভ্যু শহরের উত্তর উপকন্ঠে অবস্থিত একটি সৈকত, স্থানীয় ভাষায় একে বেলভিউ সৈকত বলে। এর মূল আকর্ষণ দীর্ঘ বালিয়াড়ি, বিস্তৃর্ণ লন আর লাইফগার্ড টাওয়ার। আমরা যখন বেলভ্যুতে তখন আকাশ বেশ মেঘলা আর প্রচণ্ড বাতাস বইছিল, সম্ভবত সেকারণেই বালিয়াড়ি প্রায় জনশূন্য ছিল, দু’-একজন আতি সাহসী পর্যটককে সমুদ্রে সাঁতার কাটতে দেখা গেছে। বেলভ্যু সৈকত অবশ্য আমাকে অতটা আকর্ষণ করতে পারেনি তবে লাইফগার্ড টাওয়ারটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এর যে বেজ বা পাটাতন তা চলে গেছে সমুদ্রের অনেকটা ভেতরে, এখানে দাঁড়িয়ে বাতাসের প্রচণ্ডতা উপভোগ করা যায় ষোলআনা। সত্যি বাতাসের এই প্রচণ্ডতা আমার কাছে বেশ উপভোগ্য ছিল, যদিও শীতের কনকনে অনুভূতিও এর সাথে যুক্ত ছিল।

চলতি পথে এক সময় আমরা শহরের মধ্যে কোনো এক রিজার্ভ ফরেস্ট বা বোটনিক্যালে ঢুকে পড়লাম। সেখানে ঝরাপাতার গালিচায় কিছুটা সময় হেঁটে বেড়ালাম, যেমন ছেলেবেলায় হাঁটতাম, পায়ের চাপে শুকনো পাতা পিষ্ট হয়ে একটা ঝমঝম-মচমচ শব্দ হয়, বেশ লাগে। ইউরোপের এই সময়টায় সারা ইউরোপের পথেঘাটে নানান রঙের পাতা ঝরে থাকে দূর থেকে মনে হয় যেন রঙিন গালিচা, আর সেটা যদি হয় কোনো পার্ক বা উদ্যান তাহলে তো কথাই নেই, যেমন এখানে, যতদূর চোখ যায় যেন বিস্তীর্ণ এক গালিচা। বিশাল বিশাল গাছের সমারোহে সেখানে সূর্যের আলো ঢুকাতে পথ পায় না তাই ছায়াছায়া একটা ঠান্ডা অনুভূতি, এমনিতেই নভেম্বরের পড়ন্ত বেলা শীত কেমন তা আর বলে বোঝানোর দরকার নেই। তবে, সূর্য তখনও পাটে যায়নি। গাছের শাখায় কমলা-হলুদ পাতার ছটা যেন একটা হালকা সোনালি আলোর আভা দিচ্ছে তাই বনের ভেতরটা একটা মায়াবী আলোয় পরিপূর্ণ। সুন্দরের সাথে সময় সবসময়ই দ্রæত যায়। ঘড়ির কাঁটা বলছে সময় মাত্র বেলা আড়াইটা কিন্তু প্রকৃতি বলছে দিন ফুরোলো বলে।

সূর্য ডোবার আগেই আমরা মালমো ব্রিজ দেখবো বলে আবারো বাল্টিক তীরে যাত্রা করলাম। আগেই বলেছি, সমুদ্র এখানে এমনভাবে ছড়ানো যে থেকে থেকে মনে হয় যেন একই পথে ঘোরপাক খাচ্ছি, আদতে কিন্তু তা নয়। যাই হোক ডেনমার্কের যে স্থান থেকে মালমো ব্রিজ সবচেয়ে দৃশ্যমান সে জায়গাটির নাম হলো আমাগার স্ট্রান্ডপার্ক। এটি কোপেনহেগেনের সমুদ্রতীরবর্তী একটি পাবলিক পার্ক যেখানে রয়েছে কৃত্রিম দ্বীপ আর মেরিনা সৈকত। এটি মূলত ভ্রমণ পিপাসু মানুষের অবসর আর বিনোদনের কথা চিন্তা করে তৈরি যেখানে ছোটোখাটো পিকনিক স্পট, কায়াক ক্লাব, ক্যাফে, রয়েছে ঘাস কার্পেটে ঢাকা উন্মুক্ত চত্বর যেখানে গ্রীষ্মকালে কনসার্ট এর আয়োজন হয়ে থাকে। তবে আমাগার স্ট্রান্ডপার্কের এতসব আয়োজন কিন্তু আমাদের আগ্রহের কেন্দ্র নয়, আমরা মূলত মালমো ব্রিজ দেখবো বলেই এখানে এসেছি।  [চলবে]