ইউরোপের ১৫০ দিন-সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

09 Jan 2023, 02:29 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন-সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


মনে হতে পারে আমার বার্গেন সফরের পুরোটাই আমি শুধু ঘুরে বেড়িয়েছি, আসলে কিন্তু তা নয় ; আগেই বলেছি, আমার বার্গেন সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল পড়াশোনা করা। আমরা আমিসহ আরো এগারো জন মূলত ঢাকার নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিসি অ্যান্ড গর্ভনেন্স কোর্সের শিক্ষার্থী, যারা এক্সচেঞ্জ এডুকেশনের অংশ হিসেবে বার্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সেমিস্টারে অংশ নিতে বার্গেনে অবস্থান করছি। আমি আমার ইউরোপবাসকারীন যে-স্মৃতিগুলো পাঠকদের সাথে শেয়ার করেছি তা মূলত ইউরোপের বিভিন্ন দেশ বা স্থান ভ্রমণের তাই মনে হতেই পারে যে আমি হয়ত ভ্রমণের উদ্দেশ্যেই ইউরোপ এসেছি। আগাগোড়া মধ্যবিত্ত পরিবেশ থেকে একেবারে ইউরোপ ভ্রমণ বেশ সাহসের ব্যাপার বৈকি, আমি তখনো অতটা সাহস করে উঠতে পারিনি, সময়টা ২০১৮, এখন অবশ্য স্বপ্ন লালন করি বিশ্ব ঘুরে দেখার। যে কারণে এই ভূমিকার অবতারণা তা হচ্ছে আজ আর বেড়ানোর গল্প করবো না, আজ একটু পড়াশোনা আর বিদ্যাপীঠ নিয়ে কথা বলব।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস

বার্গেন ইউনিভার্সিটিতে আমাদের অরিয়েনটেশন হয়েছিল বিশাল একটা অডিটরিয়ামে, মনে হচ্ছিল এখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা যেন হাজারের সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। বার্গেন ছোট্ট একটা শহর আর এখানকার একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় বার্গেন বিশ্ববিদ্যালয় যা আবার সিটি ক্যাম্পাস নিয়ে চলছে ; সেখানে বহির্বিশ্ব থেকে আগত শিক্ষার্থীই যদি এতো হয় তবে তাদের নিজস্ব শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বা কত আর এত শিক্ষার্থীর সংস্থানই বা হয় কেমন করে। যাই হোক, ভাবনাকে সঙ্গী করেই অরিয়েনটেশন প্রোগ্রাম শেষ করলাম, তারপর যথারীতি ক্লাস রুটিন পাবলিস্ট হলো, না নোটিশ বোর্ডে না ; তবে, নোটিশ আকারেই এলো বার্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট অ্যাপে। এখানে ক্লাস, প্রেজেনটেশন আর গুটিকয় পরীক্ষা ছাড়া সবই অনলাইন নির্ভর।

আমাদের ক্লাস সপ্তাহে তিন দিন, বেশ মজা তাই না ? রুটিন পেয়ে তো আমরা মহাখুশি, বাকি দিনগুলোতে বার্গেন ঘুরেফিরে দেখতে পারব। আরও মজার বিষয় হচ্ছে ক্লাস উপস্থিতি এখানে কোনো গুরুত্বর্পূণ বিষয় না ইচ্ছে হলে ক্লাস করো না হলে ক’রো না- পুরোপুরি স্বাধীন। না, আমরা কিন্তু স্বাধীনতার অসৎ ব্যবহার করিনি, প্রায় নিয়ম মেনে ক্লাসে আমাদের উপস্থিতি নিয়মিত ছিল। ক্লাস করতে এসে একটা বিষয় আমার কাছে খুবই অদ্ভুদ লেগেছে যে ক্লাসে স্থানীয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা একদমই না থাকার মতো। এখানে ক্লাস সাইজ নির্ভর করে যথারীতি সাবজেক্ট অনুযায়ী, সিলেক্টটেড সাবজেক্টে শিক্ষার্থী বড়োজোর বিশ/পঁচিশজন আর বাধ্যতামূলক সাবজেক্টে সংখ্যাটা দাঁড়ায় চল্লিশ/ পঁয়তাল্লিশ জনে। এর মধ্যে খুঁজে পেতে এক-দু’জন হয়ত নরওজিয়ান শিক্ষার্থী পাওয়া যেতে পারে। আসলে বার্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ কোর্সই এক্সচেঞ্জ এডুকেশনের আওতাভুক্ত। যে কারণে এখানে তাবৎ দুনিয়ার সকল দেশের মানুষের এক মহামিলন মেলা থাকে বছরজুড়ে। এক্সচেঞ্জ এডুকেশনের আওতাভুক্ত গ্রাজুয়েট এবং পোস্ট গ্রাজুয়েট কোর্সগুলোর স্থিতি পাঁচ মাস থেকে শুরু করে কয়েক বছর অব্দি হয়ে থাকে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে সেমিস্টার অনুযায়ী স্থিতি নির্ধারণ করা হয় কেউ হয়ত এক সেমিস্টারের জন্য নির্বাচিত কোনো কোর্সে হয়ত একাধিক সেমিস্টার এক্সচেঞ্জ এডুকেশনের আওতাভুক্ত থাকে। আমরা বার্গেনে এসেছি আগস্ট মাসে এখন অক্টোবরের শেষ অ্যাসাইমেন্টের প্রথম কিস্তি জমা দেওয়া শেষ প্রেজেন্টেশনও কমপ্লিট, দ্বিতীয় কিস্তির আংশিক সমাপ্ত, কিছু কাজ এখনো বাকি, শেষ হতে হতে নভেম্বরের মাঝামাঝি পার হয়ে যাবে। এর মধ্যে অবশ্য পরীক্ষার সিডিউলও অ্যাপে দিয়ে দেওয়া হয়েছে, বলা বাহুল্য বার্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিস্টারের পুরো প্লানিং সেমিস্টারের শুরুতেই দিয়ে দেওয়া হয়, অ্যাপে পরীক্ষার সম্ভাব্য সময়ও থাকে পরবর্তীসময়ে তা শুধু নিশ্চিত করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে লেখক

যেহেতু পরীক্ষা আসন্ন প্রায় একই সাথে অ্যাসাইনমেন্টও কিছু বাকি রয়ে গেছে, তাই বাধ্য হয়ে পড়াশোনার প্রতি মনোযোগী হতেই হলো। আগেই বলেছি, পরীক্ষা বা অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করা নিয়ে আমি খুব একটা উদ্বিগ্ন নই। তবে, অ্যাসাইনমেন্ট উপস্থাপন আমাকে খুবই নার্ভাস করে তোলে। কিন্তু কিছু করার নেই এটা কোর্সের অত্যাবশ্যকীয় অংশ কোনোভাবেই এড়ানো সম্ভব নয়। এর মধ্যে আমরা শিক্ষার্থীরা যারা নর্থসাউথ ইউনির্ভসিটি থেকে বার্গেন ইউনির্ভাসিটিতে একটি সেমিস্টার করছিলাম তারা সবাই মিলে বার্গেনে আমাদের কোর্সের সাথে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি ছোটোখাটো গেটটুগেদারের আয়োজন করব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। গেটটুগেদার অনুষ্ঠানটি কেমন হবে কী করা হবে, খাবারের মেন্যু কী হবে, কে কোন আইটেম রান্না করবে এ সকল বিষয়ে বিস্তারিত আলাপের জন্য ফ্যান্টপ স্টুডেন্ট ক্লাবে একটি নাতিদীর্ঘ সভাও হয়ে গেল। আমাদের কোর্স টিচার ইশতিয়াক জামিল স্যারের সাথে কথা বলে সময়ও নেওয়া হলো। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সম্ভবত দিনটি নভেম্বরের চার তারিখ ছিল, আমরা গেটটুগেদার করব বলে ঠিক হলো। হাতে যেহেতু সময় বেশি নেই তাই বাজার-ঘাট করাও শুরু। এখানে বলে রাখা ভালো বার্গেনে গরুর মাংস বা খাসির মাংস পেতে হলে বেশ ঝক্কি পোহাতে হয় আর যেহেতু গরুর মাংস খাওয়ার ব্যাপারে অনেকেরই বিধি-নিষেধ আছে তাই যেটা এখানে সহজলভ্য ভেরার মাংস তাই কেনা হলো, এছাড়া সবজি বা মুরগির মাংস এখানে খুব একটা দুঃ®প্রাপ্য না হওয়ায় তা সহজেই কেনা গেল। আমরা সবই একটু আগেভাগে কিনে নিয়েছি, কেননা এখানে সপ্তাহের বিশেষ বিশেষ দিন বিশেষ বিশেষ দোকান খোলা বা বন্ধ থাকার বিষয় রয়েছে তাই কোনোরকম অনিশ্চয়তায় না থেকে আগেভাগেই প্রস্তুত থাকা আর কি। এছাড়া একেকজন একেক আইটেম রান্না করবে তাই যে যার পছন্দ মতো সময়ে নিজেদের কাজ গুছিয়ে রাখছে। একটা পিকনিক পিকনিক আবহ, অবশ্য আমাদের মূল রাঁধুনী কিন্তু নাসরিন আর ফারজানা, রান্নার ব্যাপারে আমাকে কেউই ভরসা করতে পারেনি বিধায় আমি হেলপার হিসেবে থেকে গেলাম।

তবে, খুব শিগ্গিরই এই আনন্দ আয়োজনের তোড়জোড়ে বাধা পড়ল আমাদের আয়োজনের প্রধান অতিথি ইশতিয়াক জামিল স্যার এবং ম্যাডাম [ইশতিয়াক জামিল স্যারের স্ত্রী], হঠাৎই একটি পারিবারিক কারণে পূর্ব নির্ধারিত ওই দিনে তাঁরা আসতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন, অগত্যা অনুষ্ঠানের আয়োজন আপাতত বন্ধ রাখা হলো, পরবর্তীসময়ে স্যারের সাথে কথা বলে আবার দিনক্ষণ নেওয়া হবে। এর মধ্যে সময় গড়াচ্ছে আমি এবং আমরা এখন খানিকটা বেশি সময়ই পড়াশোনায় মনোযোগ দিচ্ছি, যারা বেশ সিরিয়াস তারা সকাল থেকে সন্ধ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতেই সময় কাটাচ্ছে আবার রাতেও ফ্যান্টপ ক্লাবের স্টাডি রুমে গ্রুপ ডিসকাশন করছে। গ্রুপ ডিসকাশন বা লাইব্রেরিতে পড়াশোনা আমার সাথে কখনোই যায় না। আমি সব সময় একা একা নিজের পছন্দ মতো সময় ও স্থানে নিভৃতে পড়ালেখা করতে পছন্দ করি। একান্তই কিছু না বুঝতে পারলে তখন করো সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি। এ ক্ষেত্রে ফারজানার সাথেই আমার কিছুটা ডিসকাশন চলে। যাই হোক এর মধ্যে অ্যাসাইনমেন্ট এর কাজ কিছুটা গুছিয়ে এনেছি, অর্থাৎ ফাস্ট ড্রাফ্ট জমা দেওয়া শেষ-এখন কোর্স টিচারের কমেন্ট এর জন্য অপেক্ষা, যার প্রেক্ষিতে অ্যাসাইনমেন্ট ফাইনাল করার কাজ চলবে। হাতে তখন কিছুটা অবসর রয়েছে, তাই মনটাও উসখুস করছে কোথাও একটু ঢুঁ মেরে আসার।

বিরান স্টেশনে অপেক্ষারত লেখক

আমি বার্গেনে আসার কিছু দিনের মধ্যেই অনেক দিনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন বন্ধু বাবু আমার ম্যাসেঞ্জারে হঠাৎই নক করলো, দেখা করতে চায় সে হতে পারে আমি ডেনর্মাকে তার বাসায় অথবা সে অসলোতে আসছে একটা অনুষ্ঠানে অংশ নিতে, যদি আমার পক্ষে সম্ভব হয় অসলোতে যাওয়ার। যেহেতু সে খুব কম সময়ের জন্য অসলোতে আসছে তাই তার পক্ষে সময় করে বার্গেনে আসা সম্ভব হচ্ছে না আর সে সময় আমার পুরোদস্তু ক্লাস আর অ্যাসাইনমেন্ট-এর প্রেসার ছিল বলে অসলোতে গিয়ে তার সাথে আমার দেখা করা সম্ভব হয়নি। বাবু ডেনর্মাকে আছে আমি জানি, কিন্তু তার ম্যাসেজ পেয়ে আমার প্রথমেই মনে হলো আমি যে নরওয়ে এসেছি এটাতো আমি তাকে জানাইনি সে জানলো কি করে, পরে অবশ্য বুঝলাম আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের যে ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ আছে তানিয়া (আমার বন্ধু) সেখানে পোস্ট দিয়েছিল। তবে হঠাৎ তার সাথে এই যোগাযোগটা আমার খুব ভালো লাগলো। প্রবাস জীবনে পুরোনো বন্ধুর সাথে হঠাৎ যোগাযোগ নিঃসন্দেহে বেশ আনন্দের। আমিও তার সাথে দেখা করার জন্য বেশ উদগ্রীব ছিলাম।  [চলবে]