তারিনের নতুন অভিযাত্রা

04 Jan 2021, 03:10 PM কাভার স্টার শেয়ার:
তারিনের নতুন অভিযাত্রা

দর্শকের পছন্দের তালিকায় যেকজন অভিনয়শিল্পী রয়েছেন তাদের মধ্যে তারিন জাহান অন্যতম। তার সাবলীল অভিনয়শৈলী মুগ্ধ করেছে এদেশের অগণিত দর্শককে। টিভি নাটকে তার চাহিদা থাকা সত্তে¡ও তিনি নিয়মিত কাজ করছেন না। অথচ একটা সময় নাচ, গান, আবৃত্তি, অভিনয়, মডেলিং কিংবা উপস্থাপনা সবকিছুতেই সরব উপস্থিতি ছিল তার। কিন্তু কয়েক বছর ধরে বিশেষ দিবস ছাড়া খুব একটা দেখা যাচ্ছে না তাকে। তবে তারিন ভক্তদের জন্য সুখবর হচ্ছে তিনি কলকাতার একটি ছবিতে কাজ করছেন। তার বর্তমান কাজ ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে লিখেছেন শেখ সেলিম...


তারিন জাহান। যার নামেই লুকিয়ে রয়েছে লাস্যময়ী এক অভিনেত্রীর অবয়ব। রূপে, গুণে আর অভিনয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে মাতিয়ে রেখেছেন ভক্তদের। তারিনের অভিনয় মানেই দর্শকদের বাড়তি পাওনা। তার নিখুঁত অভিনয় দেখে মুগ্ধ হননি এমন দর্শক খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। তার দুর্দান্ত অভিনয়শৈলী, শৈল্পিক গুণ দিয়ে এখনো তিনি দর্শকের হৃদয়ে আসন করে রেখেছেন। তার সেই সিংহাসনে দর্শক তাকেই রানি বানিয়ে রেখেছেন। তবে দর্শকের মনে কষ্ট প্রিয় এই অভিনেত্রীকে এখন আর নিয়মিত দেখতে পাচ্ছেন না তারা। তারিনও দর্শকের কষ্ট উপলব্ধি করে বিশেষ দিবসগুলোতে অভিনয় করে থাকেন। কিন্তু এতেই দর্শকের মোটেও তৃষ্ণা মেটে না। দর্শক আরো উপস্থিতি চান প্রিয় অভিনেত্রীর। দর্শকের ভালোবাসায় সিক্ত তারিন এবার অভিনয় করতে যাচ্ছেন ওপার বাংলার একটি চলচ্চিত্রে। যদিও এর আগে তিনি দেশে আরো দুটি ছবিতে অভিনয় করে পুরস্কারও পেয়েছেন। কিন্তু এবারই প্রথম দেশের বাইরের কোনো ছবিতে অভিনয় করছেন তিনি। 

ছবিতে অভিনয়ের জন্যে বর্তমানে কলকাতাতেই অবস্থান করছেন তিনি। ২২ ফেব্রæয়ারি থেকে শুরু হয়েছে তার কলকাতা মিশন। ২৬ ফেব্রæয়ারি থেকে শুরু হয়েছে ছবির শুটিং। তারিন অভিনীত ছবিটির নাম ‘এটা আমাদের গল্প’। ছবিটি পরিচালনা করছেন কলকাতার মানসী সিনহা। তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রীও, গল্পও তার। এ ছবির মাধ্যমে পরিচালনায় নাম লেখালেন তিনি। টানা ১০ দিন কলকাতার বিভিন্ন লোকেশনে ছবিটির শুটিং হবে। ছবির গল্পে তারিনকে একজন বাংলাদেশি মেয়ে হিসেবে দেখা যাবে। তার চরিত্রের নাম সুদেষ্ণা। ছবিটি পারিবারিক গল্পের।  ছবিতে তারিন একজন বাংলাদেশের মেয়ে। তার বিয়ে হয় কলকাতায়। এরপর থেকে সেখানেই বসবাস।

নিজ গÐির বাইরে কার না কাজ করতে মন চায়, সবার ইচ্ছে থাকলেও করা হয়ে ওঠে না। এজন্য প্রয়োজন অভিনয় দক্ষতা। তারিনের অভিনয়শৈলী তাকে নিয়ে গেছে নিজ দেশ থেকে অন্য দেশে। ছবিটিতে কাজ করা প্রসঙ্গে তারিন বলেন- ‘প্রথমে তারাই [কলকাতা] আমাকে তাদের প্রোডাকশনে কাজ করার প্রস্তাব দেন। অনেক আগে থেকেই ছবিটিতে কাজ নিয়ে কথা চলছিল। গল্প ও চরিত্র পছন্দ হওয়ায় রাজি হয়ে গেলাম। এর আগে একটি অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে নির্মাতার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়।’ ‘এটা আমাদের গল্প’ চলচ্চিত্রে তারিনের বিপরীতে অভিনয় করছেন দেবদূত ঘোষ। তিনি কলকাতার ছোটপর্দা ও বড়োপর্দার একজন সফল অভিনেতা। বছর দুয়েক আগে ভালোবাসাদিবসে বাংলাদেশের একটি নাটকে দেবদূত ঘোষের বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন তারিন। এবার দু’জনে চলচ্চিত্রে কাজ করছেন। 

ছবিটি প্রযোজনা করছেন ক্রিয়েটিভ ওয়ার্ল্ড এন্টারটেইনমেন্ট। ছবিতে তারিন ও দেবদূত ছাড়াও অভিনয় করছেন শাশ্বত চ্যাটার্জি, পূজা কর্মকার, কণিকা ব্যানার্জি, সঞ্জীব শর্মা, খরাজ মুখার্জি প্রমুখ। কলকাতার এ ছবিটি শুধু ওপার বাংলাতেই নয়, এপার বাংলাতেও দেখতে পাবেন দর্শক। এ নিয়ে তারিন জানান, ছবিটি কলকাতা ও বাংলাদেশে একসঙ্গে মুক্তির সম্ভাবনা রয়েছে। তারিন এর আগে বাংলাদেশের ‘পিরিত রতন পিরিত ধন’ ও ‘কাজলের দিনরাত্রি’ নামে দু’টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রে নিয়মিত না হলেও অভিনয় করেছেন অসংখ্য নাটক ও টেলিফিল্মে। 

তারিনের আজকের এই অবস্থানে আসার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। হুট করে তিনি নায়িকা বনে যাননি। এক এক করে সিঁড়ি ভেঙে পৌঁছেছেন তার গন্তেব্যে। সাংস্কৃতিক পরিমÐলেই তিনি বেড়ে উঠেছেন। ছেলেবেলা থেকেই তার ছোটপর্দায় বিচরণ। নাচ, গান আর অভিনয়ের সঙ্গেই তিনি বড়ো হয়েছেন। ১৯৭৬ সালের ২৬ জুলাই নোয়াখালী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন । ১৯৮৫ সালে জাতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিভা অন্বেষণ ‘নতুন কুঁড়ি’তে অভিনয়, নাচ এবং গল্প বলাতে প্রথম হন। তখন থেকেই তিনি শিশুশিল্পী হিসেবে ছোটপর্দায় কাজ শুরু করেন। তিনি ওস্তাদ হাসান ইকরাম উল্লাহর কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নেন।

শুরুটা নাচ দিয়ে হলেও অভিনেত্রী হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছেন তারিন। ‘এইসব দিনরাত্রি’ ধারাবাহিক নাটকের প্রধান ভূমিকায় প্রথম শিশু চরিত্রে অভিনয় করেন। তারপর তিনি ১৯৮৮ সালে শহীদুল্লা কায়সারের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ধারাবাহিক নাটক ‘সংসপ্তক’-এ শিশু চরিত্রে অভিনয় করেন। তিনি প্রথম প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন তৌকির আহমেদের সঙ্গে ‘কাঁঠাল বুড়ি’ নাটকে, যেটি ছিল বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট চ্যানেল এটিএন বাংলায় প্রচারিত প্রথম নাটক। তারিন দু’টি ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রে প্রিয়াংকা ত্রিবেদী এবং প্রিয়াংকা ব্যানার্জীর হয়ে কণ্ঠ দিয়েছিলেন। 

তারিন ২০১১ সালের ঈদ উল আজহায় ‘আকাশ দেব কাকে’ শিরোনামে প্রথম একক অ্যালবাম বের করেন। সেখানে ১০টি গান ছিল, যার মধ্যে ৪টি দ্বৈত গান ছিল। এই দ্বৈতগানগুলো তিনি কলকাতার রাঘব চ্যাটার্জী ও রূপঙ্কর বাগচী এবং বাংলাদেশের ইবরার টিপু ও তপন চৌধুরীর সঙ্গে গেয়েছিলেন। তিনি ‘স্বপ্নগুলো জোনাক পোকার মতো’ নাটকের শিরোনাম গান গেয়েছিলেন।

তার উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হলো- ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘সংসপ্তক’, ‘ফুলের বাগানে সাপ’, ‘কথা ছিল অন্যরকম’, ‘ইউ টার্ন’, ‘মায়া’, ‘হারানো আকাশ’, ‘রাজকন্যা’, ‘সবুজ ভেলভেট’, ‘অনুচ্ছেদ ৭১’, ‘অগ্নিবলাকা’ ইত্যাদি। এছাড়া তারিন বেশ কিছু টেলিফিল্মে অভিনয় করেছেন এবং কিছু টেলিভিশন প্রোগ্রামে উপস্থাপনা করেছেন।

‘পিরীত রতন পিরীত ধন’ এবং ‘কাজলের দিনরাত্রি’ সিনেমা দু’টিতে অভিনয় করেন। ‘কাজলের দিনরাত্রি’ ২০১৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়।

তারিন ‘মেরিল-প্রথম আলো সমালোচক পুরস্কার’ পেয়েছেন। টেলিছবির নাম ‘সবুজ ভেলভেট’। এর আগে তিনি মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার পেয়েছেন আরো দু’বার ২০০৬ সালে ‘কথা ছিল অন্যরকম’ টেলিছবি আর ২০০৭ সালে তার একক অভিনীত নাটক ‘মায়া’র জন্য। দুটি পুরস্কারই তিনি পেয়েছিলেন পাঠকদের ভোটে।

তিনি আগের মতো নাটকে নিয়মিত না হলেও অভিনয় থেকে দূরে নন। ভালো কাজ পেলে অভিনয় করেন, নয়তো বসে থাকেন তবুও মানহীন কাজের সঙ্গে আপস করেন না তিনি। এখনো ভালো স্ক্রিপ্ট হাতে পেলে প্রমাণ করে ছাড়েন তিনি সত্যিই একজন ভালো অভিনেত্রী। তারিন বলেন, ‘সংখ্যা বাড়ানোর জন্য অভিনয় করতে চাই না। দর্শক দিনশেষে একটি ভালো কাজের কথাই মনে রাখেন। যে কারণে বছরজুড়ে কাজ না করলেও ভালো গল্পের নাটক কিংবা টেলিছবিতে বেছে বেছে অভিনয় করছি। আরো কয়েকটি নাটকের প্রস্তাব এসেছে। কলকাতা থেকে ফিরে এসে যদি স্ক্রিপ্ট পছন্দ হয় তাহলে অভিনয় করব।’

বর্তমান সময়ের নাটকের পরিবেশ আগের মতো নেই বলে মন্তব্য করেন এই অভিনেত্রী। তিনি বলেন, ‘এখন মিডিয়ার কাঠামো পরিবর্তন হয়েছে। অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের মতো কিংবা সিনিয়র শিল্পীদের নিয়ে কাজ করা বোধহয় কমে গেছে। প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের যথাযথ সম্মান এখন আর দেওয়া হয় না। রেসপেক্টের জায়গায় ঘাটতি আছে। আমরা যদি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিকে তাকাই তা হলে দেখব, সেখানে গুণী শিল্পীদের যথেষ্ট সম্মান করা হয়। সেখানে একজন শিল্পীর বিষয়টি মাথায় রেখে ডিরেক্টর স্ক্রিপ্টের চিন্তা করেন। শুধু ভারত নয়, অন্যান্য দেশেও একই রকম। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এখন মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। এ কারণেই মিডিয়ায় ধস নেমেছে। সিন্ডিকেট থেকে মিডিয়া মুক্ত না হলে এর অবস্থা আরো ভয়াবহ হবে।’ 

টিভি নাটক নিয়ে অনেক অভিযোগ শোনা যায়। দর্শক আগের মতো টিভি দেখে আনন্দ পান না। কিন্তু দর্শক এখনো বিনোদন খোঁজেন টিভি পর্দায়। তারিন বলেন, ‘দর্শক ভালো নাটক দেখতে চান। তারা মঞ্চ, টিভি নাটক, টিভি অনুষ্ঠান এবং হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে চান। এক সময় তাই হত। সিনেমা হলে দর্শক যেত, মঞ্চে নাটক দেখত, পরিবারের সবাই মিলে টিভি নাটক দেখত কিন্তু এখন তা আর নেই।’