নীল পাহাড়ি তিন বোনের গল্প : ফারহানা খানম

03 Jun 2025, 01:48 PM ভ্রমন শেয়ার:
নীল পাহাড়ি তিন বোনের গল্প : ফারহানা খানম


অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসে রাজ্যে অবস্থিত একটি বিশেষ ভূ-প্রাকৃতিক এলাকা। এলাকাটি তার নীল কুয়াশা আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। যাকে আমরা বাংলায় বলতে পারি নীল পাহাড় বা নীল পর্বতমালা। নামটি শুনে প্রথমে আমার মনে খটকা লাগে, পাহাড় কখনো নীল হয় ? এ-প্রশ্ন আমাকে আরো আগ্রহী করে তোলে জায়গাটি পরিদর্শনের জন্য। সেখানে পৌঁছানোর পর আমার প্রশ্নের উত্তর পেলাম কেন এর নাম ‘ব্লু মাউন্টেন’।

‘নীল পবর্তমালা’ আমাকে এতটা মুগ্ধ করবে আগে ভাবতে পারিনি। ক্রোনেস্ট থেকে ট্রেনে আমরা কাটুম্বা’র উদ্দেশে রওনা হই সকাল সাতটায়। Blue Mountain spot-এর অবস্থান কাটুম্বা রেলস্টেশন থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে। এই স্থান থেকে দর্শনার্থীরা এর অপার সৌন্দর্য অবলোকন করার সুযোগ পায়। ট্রেনটি কাটুম্বা রেলস্টেশনের কাছাকাছি পৌঁছাতে আমরা দূরে ব্লু মাউন্টেনের অবারিত প্রান্ত দেখতে পেলাম। ট্রেনটি কাটুম্বায় পৌঁছানোমাত্রই আমাদের মতো ট্রেন থেকে নেমে পড়ল আরো অনেক দর্শনার্থী। ঠান্ডা হিমেল হাওয়া প্রবাহিত করে কাটুম্বা যেন আমাদের অভ্যর্থনা জানাল। আমরা বেশ বুঝতে পারছিলাম, অন্য জায়গার আবহাওয়ার চাইতে এখানকার আবহাওয়া বেশ ভিন্ন। আমরাও নিজেদের শীতের গরম কাপড়ে আবৃত করে পথ চলতে শুরু করলাম।

দূরত্ব স্টেশন থেকে দেড় কিলোমিটার। বাসে চেপে অথবা পায়ে হেঁটে যেতে হয়। আমরা হাঁটাপথ বেছে নিলাম। উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ, পিচঢালা রাস্তা, রাস্তার দু’ধারে দোকানপাট। সরিবাঁধা নানারকম পুরনো পণ্যসামগ্রী বিক্রির দোকান, খাবারের দোকান, কফির দোকান দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে চলেছি। হঠাৎ একটি চকলেটের দোকান দেখতে পেলাম, দোকানটি থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না- তাও আবার সম্পূর্ণ হাতে তৈরি চকলেট বিক্রি করছে দোকানি। দল বেঁধে সবাই দোকানে ঢুকে পড়লাম। নানারকমের ক্যান্ডি থেকে কিছু ক্যান্ডি পরখ করে দেখলাম। কোনটা রেখে কোনটা খাব তা নির্ণয় করাই ছিল মুশকিল- চকলেটগুলো স্বাদে ছিল অসাধারণ আর সৌন্দর্য ছিল চোখ ধাঁধানো। রাস্তার দু’ধারে বাড়ি আর বাড়ির সীমানা প্রাচীরের স্থান দখল করে আছে নানা বর্ণের ফুলের গাছ। সারি-সারি ফুলের সৌন্দর্য থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। প্রতিটি বাড়িরই সামনের সীমানা নির্ধারক একেকটি বাগান এত সুন্দরভাবে বিন্যস্ত, সাজানো গোছানো আর পরিচ্ছন্ন বলার মতো না। এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ পথ ফুরিয়ে এলো। এতক্ষণ যে দৃশ্য দেখছিলাম, তার সাথে সামনের দৃশ্যপটের যেন কোনো মিলই নেই।

দিগন্তজুড়ে ছড়িয়ে আছে এক রহস্যময় নীলাভ আভা। সামনে যতদূর দৃষ্টি যায় সবুজের ঢেউ যেন মিলিয়ে যাচ্ছে আকাশের নীলের সাথে। পাহাড়গুলো একটার পেছনে আরেকটা ঠিক যেন কুয়াশার চাদরে ঢাকা কোনো রাজ্য। বাতাসে ভেসে আসছে ইউক্যালিপটাস গাছের সুঘ্রাণ। ওই গাছের পাতার তেল সূর্যের আলো ছুলে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে একধরনের কুয়াশা। সেটা এই পাহাড়কে দেয় এক বিশেষ নীল রং- আর এই কারণেই এই পাহাড়ের নাম ‘ব্লু মাউন্টেন’।

সামনে যেতেই চোখে পড়ল রেলিংয়ের ধারঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু লোকের ওপর। কী ব্যাপার, তা কাছাকাছি যেতেই বুঝতে পারলাম। চোখ ফেরাতে পারছিলাম না নিজেও। স্বপ্ন মনে হচ্ছিল। সামনে এক বিশাল প্রাকৃতিক দৃশ্য, মাঝে কাছ থেকে দেখা যায় পাহাড়। যা তিন ভাগে বিভক্ত। দূরের নীলচে কুয়াশায় মোড়ানো পাহাড় আর নিচে ইউক্যালিপটাসের সবুজ বন। তিনটি শিলা নীরবে দাঁড়িয়ে। যেন কিছু বলতে চায়, বোঝাতে চায়। এই সৌন্দর্য বর্ণনা করে বোঝানোর নয়, শুধু তাকিয়ে দেখে অনুভব করার। তাই তাকিয়ে রইলাম অপলক।

কিছুটা এগিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই যেন অন্য এক জগতে প্রবেশ করলাম। চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তিনটি শিলা আরো পষ্ট, আরো কাছ থেকে দেখলাম। ঋতুবৈচিত্র্য আর দিবারাত্রি আলোর খেলায় ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে পাহাড়ি এলাকাটি। দৃষ্টিনন্দন একেক সময়ের একেকটি রূপ, মনকে প্রভাবিত করে। একবেলার রূপের সাথে অন্য বেলার রূপের কোনো মিল নেই। ভোরের আলো ফোটার পর থেকে নির্জন রাত কোনো সময়ই যেন ব্লু মাউন্টেন নীরব থাকে না। দিন-রাত্রিতে তার কাব্য রচনা অব্যাহত থাকে। এখানে দর্শনার্থীরা তাই যে-সময়ই আসুক না কেন, তারা রূপে মুগ্ধ না হয়ে পারে না। যতভাবে বলি, যাই বলি না কেন, খালি চোখে যা দেখেছি তার কিছুই বোঝানো সম্ভব নয়, ক্যামেরাবন্দি ছবিতে বা বর্ণনায়।

এখানে এলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি একটি পৌরাণিক গল্পের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ মিলবে। যা প্রচলিত সামনের তিনটি শিলাকে ঘিরে। অস্ট্রেলিয়ার পৌরাণিক গল্পে এই তিনটি শিলা ‘থ্রি সিস্টার্স’ নামে পরিচিত। তিন বোনের প্রেমের শেষ পরিণতির সাক্ষী হয়ে রয়েছে ‘থ্রি সিস্টার্স’। তাদের প্রেমের করুণ পরিণতি আজও সারাবিশে^র মানুষের হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করে তোলে। আজও তাদের সৌন্দর্যে হয় মুগ্ধ। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ভ্রমণকারীরা ‘থ্রি সিস্টার্স’ দেখে যেতে ভুল করেন না। তাই আজও তিন বোনের প্রেমকাহিনি একইভাবে ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে চলেছে।

মিহনি, উইমলা, গুনেডু নামে তিনবোন বাস করত জেমসন ভ্যালির উপত্যকায়। অতুলনীয় সৌন্দর্যের অধিকারী তিনবোন প্রেমে পড়ে প্রতিবেশী উপজাতি পরিবারের তিন ভাইয়ের। নীল পর্বতমালার অধিকারী তিন ভাইয়ের নাম আজও অজানা। কিন্তু তিন বোনের সংস্কৃতির রীতিনীতিতে নিজ উপজাতির বাইরে এ-ধরনের সম্পর্ক ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। প্রেমের ইতিহাসে প্রেম কখনোই কোনো বাধা মানেনি। তাই জোর করে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তাদের প্রেমিকেরা। এই ঘটনায় এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাধে দুই গোত্রের মধ্যে। হুমকিতে পড়ে বোনেদের জীবন। জাদুবিদ্যায় পারদর্শী এক জাদুবিদ তাদের সুরক্ষার দায়িত্ব নেন। উপত্যকার চূড়ায় তিনি তাদের নিয়ে যান। জাদু শক্তিকে তাদের পাথরের রূপ দেন। এতে তাদের জীবন শঙ্কামুক্ত হয়। যুদ্ধ শেষে তাদের আবার মানুষ রূপে ফিরিয়ে আনবেন এমনই তিনি ভেবে রেখেছিলেন। কিন্তু তাদের ভাগ্যে ছিল অন্যকিছু। দুই গোত্রের মধ্যে সংঘাত চলাকালে তিনি আহত হয়ে মারা যান। শুধুমাত্র তিনিই জানতেন এই মন্ত্রটি। মন্ত্রটি উল্টে তিনি তাদের সৌন্দর্য ফিরিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তা আর হলো না। আর এ-কারণেই তাদের আর কোনোদিন মানুষরূপে ফেরা হয়নি।

তাদের প্রেমকাহিনি তাদের করেছে অমর। চিরন্তন প্রেমের স্মৃতিচিহ্ন শিলার দিকে তাকিয়ে আমি অনুভব করলাম তাদের বেদনা। ভালোবাসার জন্য তাদের ত্যাগ আর সংগ্রামের কাহিনি আজও এখানে আসা মানুষকে ভাবায়। প্রকৃতি আর ইতিহাস কতটা গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে মানুষকে তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ ‘থ্রি সিস্টার্স’।

এখানে এসে আমার মনে হয়েছে, আমার আর প্রকৃতির মাঝে আর কোনো সীমারেখা নেই। একটা শান্তি একটা প্রশান্তি বুকের গভীরে অনুভব করছিলাম। এখানে প্রকৃতি তার ভাষা বোঝায় নিঃশব্দে কিন্তু তা বেজে চলে হৃদয়জুড়ে।