সন্ধ্যার নির্জনতায় বগালেকের জলের সাথে আলাপন : সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

03 Jun 2025, 01:46 PM ভ্রমন শেয়ার:
সন্ধ্যার নির্জনতায় বগালেকের জলের সাথে আলাপন : সৈয়দা তাসলিমা আক্তার


এক সময় হুমায়ূন আহমেদের খুব ভক্ত ছিলাম, তাঁর প্রায় বইতে দুটি শব্দ তিনি ব্যবহার করতেন ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’। বান্দরবানে আমি যখনই যাই তখনই আমার এ-শব্দ দুটি মনে পড়ে যায়- ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’। এই ভয়ঙ্কর সুন্দর জায়গাটির সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় প্রায় বছর পঁচিশেক আগে। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে ‘শিক্ষা-সফর’ এর অংশ হিসেবে তিন পার্বত্য এলাকায় ভ্রমণ, যার একটি ছিল বান্দরবান আর গন্তব্য ছিল চিম্বুক পর্যন্ত। চান্দের গাড়িও চেনা হয় তখনই। মেঘকে পাশ কাটিয়ে ভয় আর রোমাঞ্চে ভরপুর সেই অনুভূতি এখনও জীবন্ত। এখন বান্দরবানের সৌন্দর্য আরো বিস্তৃত, একসময় চিম্বুকই যেখানে পর্যটকদের last destination ছিল, সময়ের দুরন্ত গতি চিম্বুককে পাশ কাটিয়ে ছুটে গেছে নীলগিরি, নীলাচল অথবা আরও দূরে। নামের মতোই সুন্দর আর বেশ সাজানো গোছানো নীলগিরি বা নীলাচল যা সৌখিন ভ্রমণ-পিয়াসীদের কাছে খুব পছন্দের।

তবে, আমাদের এবারের ভ্রমণটা এই সাজানো গোছানো বান্দরবনকে ছাড়িয়ে আরো একটু এগিয়ে.. একটু বুনো আর অনেক বেশি প্রাকৃতিক কোনো জায়গাকে ঘিরে।

দিনটি ২৬-এ মার্চ ২০১৪, আমরা ফজরের নামাজ পড়ে শুধুমাত্র চা খেয়েই রওনা দিলাম বান্দরবানের উদ্দেশে। আমরা মানে আমরা তিন ভাই-বোন আর আমাদের ভাগিনা মোট চারজন। চারজন বললে বোধ হয় ভুল হবে। কেননা আমাদের ড্রাইভারও ছিল, মানে পাঁচজন। যেহেতু তখনো প্রকৃতিতে বসন্তকাল তাই গ্রীস্মের গরম থাবা আমাদের নাগালে পায়নি। আমারা বেশ ফুরফুরে ভোরের বাতাস গায়ে মেখে চলছিলাম। ভোর ভোর রওনা দেওয়ায় বেশ লাভও হলো। কুমিল্লা পর্যন্ত প্রায় নির্বিঘেœ চলে আসলাম। তখন ভোর চোখ মেলে সকালকে দেখছিল আর আমরাও চলতি পথে প্রকৃতির রং পরিবর্তনের সময়কে উপভোগ করছি। এদিকে বেলা বাড়ার সাথে সাথে পেটও জানান দিচ্ছে আজ দিনের এতটা সময় পর্যন্ত সে উপোস আছে। সুতরাং ভাববার আর সুযোগ নাই... আমরা যাত্রা বিরতি দিলাম নাশতা করবো বলে। হাইওয়ের এ-হোটেলগুলোর কোনো দিন-রাত্রি নেই- ২৪ ঘন্টাই ভীড় আর হুল্লোড়- আমরা খাবার অর্ডার করে বেশ তাড়া দেওয়ার পরও প্রায় মিনিট চল্লিশ লেগে গেল নাশতা সেরে নিতে। হোটেল থেকে বের হওয়ার পর কারো মধ্যেই আর কোনো ব্যস্ততার লক্ষণই নেই। কেউ কলা-চিপস্ কিনছে, কেউ পাশের হ্যান্ডিক্র্যাপ-এর দোকানে বাহারি পণ্য দরদাম করছে। সবার আচরণে মনে হচ্ছে গন্তব্য এই পর্যন্তই ছিল... শেষ পর্যন্ত ড্্রাইভারের ডাকে সকলের চৈতন্য হলো। আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম, আবার চলা শুরু। এরপর বিরতিহীন পথচলা, আমরা ঠিক করলাম একদম বান্দরবান পৌঁছেই দুপুরের খাবার খাবো। পথ কিন্তু এখন সকালের মতো ঝরঝরে নয় অর্থাৎ আমাদের থেমে থেমে এগুতে হচ্ছে, কারণ যানজট। অনেকটা কচ্ছপের মতো গতিতে আমরা বিকেল নাগাদ বান্দরবান পৌঁছি। যখন আমরা হোটেলে চেক-ইন করি তখন ঘড়িতে চারটা বেজে তিরিশ মিনিট। খিদেয় কারো মাথা ঠিক নেই কোনোরকমে ব্যাগ-পত্তর রুমে রেখে একটু ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এলাম খাবারের খোঁজে।

বিকেলটা আমরা বান্দরবান শহরের আনাচে-কানাচে ঘোরাঘুরি করে কাটালাম। এখানে বলে রাখি, এ-ভ্রমণযাত্রা আমার জন্য অনেকটা রথ দেখা কলা বেচার মতো ছিল। আসলে বান্দরবান বেতারে আমার একটা দাপ্তরিক কাজ থাকায় তার সাথে সময় মিলিয়েই এই ট্যুর প্লান করা, তাই অফিস সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ বেতার বান্দরবান যাওয়ার একটা তাড়াও ছিল। যদিও সময়ের কিছুটা হেরফের হয়েছে। তবে, উদ্দেশ্য সিদ্ধি হয়েছে এই রক্ষে। বেতারের কাজ শেষ করে আমরা পরদিন বগালেক যাওয়ার ব্যবস্থাটাও পাকা করে রখলাম অর্থাৎ গাড়ি ঠিক করে নিলাম। ও আচ্ছা বান্দরবান যাচ্ছি এটা শুরুতেই জানিয়ে ছিলাম কিন্তু সুনির্দিষ্ট গন্তব্যের কথা বলিনি তো ? এখন বলা হয়ে গেল। আমাদের এবারের ভ্রমণ বগালেককে কেন্দ্র করে। বগালেক নিয়ে প্রচলিত মিথটি খুব মজার, জানা আছে নিশ্চয়ই। কেমন যেন একটু রহস্যময়। তবে মিথ তো মিথই, কিন্তু সত্য এই যে এটি আসলেই একটি বিধাতার একটি বিস্ময়কর সৃষ্টি।

পরদিন বেশ সকাল সকাল আমরা আমাদের যা কিছু সম্বল সব গুছিয়ে নিয়ে রুমার উদ্দেশে রওনা হলাম। পথে কোথাও সুবিধাজনক স্থানে নাশতা করে নেব এ-চিন্তা থেকেই নাশতা না করেই পথে নামলাম। আধ ঘণ্টা পথচলার পর পেট যেন আর মানতে চাইল না, তাই বাধ্য হয়ে থামতে হলো। পাহাড়ি পথের বাঁকে ছোট্ট একটি দোকান, জিজ্ঞেস করে জানা গেল এখানে সকালের নাশতা পাওয়া যায়। তন্দুরি রুটি আর ডিম ভাজা, সাথে চাও আছে। আয়োজনটা ভালোই মনে হলো, আমরা বসে পড়লাম। দোকানের ভেতরে জায়গার স্বল্পতা থাকায় বাইরে বেঞ্চ পেতে বসার ব্যবস্থা। মনোরম এক পাহাড়ের বাঁকে খোলা আকাশের নিচে বসে ডিম ভাজা আর তন্দুরি রুটি খাচ্ছি। বেশ রোমাঞ্চকর, খাবারের স্বাদও মন্দ নয়। পেটপুজো সেরে আবার নতুন উদ্যোমে পথচলা। এখন টানা অনেকটা পথ যেতে হবে। তাই আমরা বেশ আয়েশ করে গুছিয়ে বসলাম। আমাদের গাড়ি পাহাড়ঘেঁষে কখনো মেঘ ছুঁয়ে কখনো বা মেঘ উড়িয়ে ছুটে চলছে। আমরা ঘন সবুজের মাঝে সিঁথির মতো পথ পেরিয়ে চলছি। ঘন সবুজের মাঝে সরু পাহাড়ি পথ, কোথাও কোথাও পথের দু’ধারেই খাদ, কোথাও একধারে পাহাড়ের দেয়াল। খাদগুলো গাঢ় সবুজ জঙ্গলে ঘেরা। হঠাৎ হঠাৎ এই সবুজের ভেতর থেকে সাদা পেঁজা তুলো মেঘ আকাশ পানে ছুট দিচ্ছে, কখনো এক পাহাড় থেকে দৌড়ে অন্য পাহাড়ে গিয়ে দল পাকাচ্ছে, যেন পাহাড়ের সাথে মেঘেদের দৌড় ছুটের পাল্লা চলছে। অনেকক্ষণ থেকেই রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের সঙ্গী হয়ে ছিল তবে ‘দূর কোথাও দূরে’ গানটি যখন বেজে উঠল তখন পথ আর প্রকৃতির সৌন্দর্য যেন বহুগুণ বেড়ে গেল। ওয়াই জংশনে এসে পথ দু’ভাগ হয়ে গেল একটি নীলগিরি হয়ে থানচির পথ ধরল অন্যটি রুমার। আমরা রুমার পথ ধরলাম। ওয়াই জংশনের কিছুটা আগে আমাদের মিলন ছড়ি চেকপোস্টে নামতে হয়েছিল নিজেদের পরিচয় জানাতে। আর সেই সুযোগে মেঘের সাথে একপ্রস্থ মোলাকাত হয়ে গেল। অনেকক্ষণ থেকেই গাড়িতে বসে মেঘের আনাগোনা দেখছিলাম, ছুঁতে পারছিলাম না, এবার স্বাদ মিটল। আমরা ইচ্ছে করেই এখানে কিছুটা সময় কাটালাম। প্রায় মিনিট পনের পর আবার যাত্রা- এবার আর কোথাও না থেমে সোজা রুমা। রুমার পথটা অতটা মসৃণ নয়। বেশ উঁচু-নিচু আর খানা-খন্দে ভরা। এছাড়া পাহাড়ের নিজস্ব বাঁক তো আছেই। মুড়ির মতো ঝাঁকি খেতে খেতে আমরা বেলা সাড়ে নটা নাগাদ রুমা বাজারে পৌছুলাম।

আমাদের ড্রাইভারের কাছ থেকে আগেই জেনেছিলাম রুমায় এসে আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে একজন গাইড ঠিক করা। তাই আমরা এসেই গাইডের খোঁজে লেগে গেলাম। এটা যে এতটা ঝক্কির কাজ, আগে জানা ছিল না। প্রথমে এজেন্টের সাথে যোগাযোগ করতে হয় তারপর এজেন্ট সিরিয়ালি গাইড সরবারহ করে। যেহেতু এ-সময়টাতে বেশ কিছু পর্যটকের দল বগালেক যাওয়ার উদ্দেশে রুমায় হাজির তাই সিরিয়ালটাও বেশ লম্বা। এখানেই কি শেষ নয় এরপর আবার বিজিবি ক্যাম্পে নিজেদের জীবনবৃত্তান্ত দাখিল করার সিরিয়াল, যদিও মজা করে বললাম- তবে, এটা খুব জরুরি। পর্যটকেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই এটা আবশ্যক, তবে ক্যাম্পটি বেশ উঁচুতে হওয়ায় এবং সিঁড়ির ধাপগুলো খাড়া হওয়ায় মাঝ বয়সীদের জন্যই এটা বেশ কষ্টকর- যারা কিছুটা পৌঢ় তাদের বিষয়টা নিশ্চয়ই সহজে আন্দাজ করা যায়। যাহোক, গাইড ঠিক হলো, ক্যাম্পে বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করা হলো। তবে, এবার বিপত্তি গাড়ি নিয়ে। যে-গাড়িটি নিয়ে আমরা বান্দরবান থেকে এসেছি পথের দুরাবস্থা দেখে সে আর বগালেক যেতে চাইল না। অবশ্য আমাদের নবনিযুক্ত গাইড রিংকু আমাদের আশ্বস্ত করে গাড়ি যোগাড়ের চেষ্টায় নেমে পড়ল এবং সফলও হলো। তবে, সব মিলিয়ে প্রায় ঘন্টাদেড়েক সময় আমাদের এখানে খরচ করতে হলো।

রুমা বাজারেই শুনেছিলাম পথের বর্ণনা, এখন দেখছি আর হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। এতক্ষণ তো বলছিলাম মুড়ির মতো ঝাঁকি খাচ্ছি, এখন মনে হচ্ছে পুরোপুরি আলুভর্তা হয়ে যাচ্ছি। কোথাও কোথাও মনে হচ্ছে গাড়ি চালানোর দরকার নেই গাড়ি আপনাতেই টগবগ টগবগ করে চলবে। আর যেটা চলছে সেটা গাড়ি না ঘোড়া বোঝা দায়। একইসাথে ধুলায় ধুসরিত পথের ধুলায় আমাদের সবার চেহারা কেমন আদ্ভুতুড়ে হয়ে উঠছে। যতই সামনে যাচ্ছি পথ ততই বন্ধুর হচ্ছে, অবশ্য তাতে আমাদের সামনে যাওয়ার আগ্রহে কোনো ঘাটতি পড়ছে না, ঘাটতি পড়ছে না আনন্দেও। এরই মধ্যে আমরা বেশ কিছু পাহাড়ি জনপথ ছাড়িয়ে এসেছি। একেকটা জনপদের একেকটা নাম। পথ চলতি দেখা মিলল অনেক পাহাড়ির, পিঠে বাঁশের ঝুড়ি বেঁধে চলছে হাটের পথে আথবা হাট ফেরতা বাড়ির পথে, এটি পাহাড়ের চিরচেনা ছবি। প্রায় ঘন্টাদেড়েক চলার পর আমরা একটা সমতল খোলা জায়গায় পৌঁছলাম। এটিও একটি পাহড়ি জনপদ, জানলাম এর নাম ‘কমলা বাজার’। অধিকাংশ পর্যটক এ-পর্যন্ত গাড়িতে এসে তারপর ট্রেকিং করে বগালেকে যায়। আমরা অবশ্য পাহাড় ট্রেকিংয়ের সাহস করতে পারিনি। তাই জিপে করেই রওনা দিলাম। পরে দেখা গেল গাড়িতে যাওয়াটাই শুধু সাহসের কাজ নয়, দুঃসাহসিক কাজ হয়ে গেল। এর আগে বা পরে বহুবার পাহাড়ে বহু জায়গায় গিয়েছি কিন্তু এমন ভয়ানক পথ আর দেখিনি। মনে হলো, পথটি হঠাৎই স্লিপারের মতো ঢালু হয়ে গেল, দু’পাশে খাদ, কোনোরকমে গাড়ির চাকা খাদের ধার ছুঁয়ে চলতে পারে। সামনের দিকে তাকানোর সাহস হচ্ছিল না। ড্রাইভারের এলেম আছে বলতে হবে। সে বেশ সফলভাবেই ‘পুলসিরাত’ পাড়ি দিল। ‘পুলসিরাত’ই বলতে হবে। কারণ চাকা একটু হড়কালেই শেষ। তবে, এটাই শেষ নয় সামনে যে বিপদ ওঁৎপেতে ছিল তা কে জানত, চলতে চলতে আমাদের বহনকারী গাড়ির স্ট্রাট এক সময় বন্ধ হয়ে গেল, ঢালু পাহাড়ি রাস্তায় তখন সেটা ঠিক সরিসৃপের মতো আটকে আছে, গাইড আমাদের তাড়া দিল জলদি গাড়ি থেকে নেমে যেন একপাশে সরে যাই। গাড়ির পেছন থাকা যাবে না। কারণ, ইঞ্জিন বন্ধ থাকায় গাড়িটি পেছনে পিছলে যেতে পারে। আমাদের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে গাইড আর ড্রাইভারের যৌথ কসরতে মিনিট পনের পর আবার গাড়ি চলতে শুরু করল, এবার সত্যিই অতি উৎসাহে খানিক ভাটা পড়ল, তবে তা ক্ষণিকের জন্য। যা হোক, শেষ পর্যন্ত আমরা বেশ সাহসের সাথেই ঝুঁকিপূর্ণ পথ অতিক্রম করে বগালেকে পৌঁছে গেলাম। এখানে এসে আবার বিজিবি ক্যাম্পে নাম ঠিকানা এন্ট্রি করার পালা। পথে অবশ্য আরো বেশ ক’জায়গায় নিজেদের পরিচয় জানান দিতে হয়েছে। বিজিবি ক্যাম্পে নাম এন্ট্রি করার সময়ই চোখে পড়ল বগালেক। একটু দূর থেকে পুরো লেকটাই দেখা যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল একটি বিশাল কাজল কালো চোখ সবুজ পাপড়িতে ঘেরা, স্বচ্ছ টলটলে কিন্তু গভীর মায়াবী।

আমরা যখন বগালেকে পৌঁছাই বেলা তখন দুপুর ছুঁই-ছুঁই। কড়কড়ে রোদে আমরা বগালেক পাড়ায় ঢুকি। বম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত পাড়াটি বেশ জমজমাট। মনে হলো ছোটোখাটো একটি আদি শহর। এখানে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা বলতে একতলা-দোতলা বিভিন্ন ধরনের কাঠের মাচাং। পাড়াটিতে ঢুকেই যে মাচাংটি আমাদের নজর কেড়েছে খোঁজ নিয়ে জানা গেল এটি জেলা পরিষদের এবং তখনো পর্যন্ত ফাঁকা ছিল। আমরা সাত-পাঁচ কিছু না ভেবে তৎক্ষণাৎ এখানেই থাকব বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। এ মাচাংয়ের বিশেষত্ব হচ্ছে, সামনে পেছনে ঝোলানো ব্যালকনি এবং পেছনের ব্যালকনিটা একদম লেকের ধারঘেঁষে। যিনি এই মাচাংয়ের দায়িত্বে ছিলেন তিনিই আমাদের খাবার-দাবারের দায়িত্ব নিলেন। সূর্য তখন ঠিক মাথার উপর আর্থাৎ লাঞ্চ টাইম হতে আরো সময় বাকি তাই আমাদের গাইড পরামর্শ দিলো আমরা চাইলে এ-সময়টায় কেওক্রাডং ঘুরে আসতে পারি। আইডিয়াটা মন্দ ছিল না। তাই আমরাও রাজি। আমাদের অস্থায়ী আবাসের সাময়িক দখলদারিত্ব বুঝে নিয়ে মালামাল যা কিছু গাড়িতে ছিল তা কোনোরকমে ঘরে রেখে আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম। বগালেক পাড়ার ভেতর দিয়েই কেওক্রাডং যাওয়ার রাস্তা। হেঁটে যেতে প্রায় ঘণ্টা তিনেক লাগলেও গাড়িতে আমরা মিনিট ৪০-৪৫-এর মধ্যে কেওক্রাডং পৌঁছে যাই।

এখানে মেঘ অনেক কাছ থেকে দেখা যায়। মেঘে আর রোদের অদ্ভুত লুকোচুরি খেলা চলে এখানে। আর মাঝে মাঝেই দমকা বাতাস তাদের খেলায় ব্যাঘাত ঘটায়। কেওক্রাডং-এ আসার পর থেকে আমার মাথায় ছোটো বেলায় সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে পড়া ‘বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কেওক্রাডং (যদিও এখন বিজয় তার জায়গা নিয়েছে)’ এই কথাটি আকারণে ঘুরপাক খাচ্ছে। আর আমি এখন তার চূড়ায়। একটু নস্টালজিক অনুভূতি। জানি না অন্যদের মনের ভাবনা কি ছিল ? কেওক্রাডংয়ের চূড়াটি বেশ প্রশস্ত, এখানে একটা হেলিপ্যাডও আছে। আছে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য একটা রাউন্ডশেপের শেড, প্রচন্ড রোদের তাপে চোখ খোলা রাখা দায়। এই শেডে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে কিছুটা নিচে নেমে আসতেই বেশ কিছু খাবারের হোটেল ও দোকানের সন্ধান পেলাম। না আহামরি কিছু না, এ-বিজন পাহাড়ে আশা করাও ঠিক না। হোটেলগুলো তখন পর্যটকদের আপ্যায়নে ব্যস্ত। এদিকে ঘড়িতে সময় তখন প্রায় আড়াইটে, খাবারের ঘ্রাণে আমাদের পেটের ক্ষুধা আর মনের রসনাবিলাসের ইচ্ছেটা এত প্রবল হয়ে ওঠে যে, বাগালেক পর্যন্ত যেতে তর সইলো না। তো কি আর করা, আমরাও তাই একটি হোটেলে বসে পড়লাম আপ্যায়িত হতে।

আমরা যখন বগালেকে ফিরে এলাম তখন সবে বিকেল তার পসরা সাজাচ্ছে। ফেরার পথে খুব ক্লান্ত লাগছিল, মনে হচ্ছিল ঘরে ফিরে একটু বিশ্রাম নিতেই হবে। কিন্তু ফেরার পর লেকের দিকে তাকিয়ে সমস্ত ক্লান্তি যেন কোথায় পালিয়ে গেল। বিকেলের সোনা রোদ যেন লেকের জলে ¯œান করতে নেমেছে, সোনালি রোদের পরশে ঝলমল করছে লেকের জল। মনে হচ্ছে রূপকথার রাজ্যের সোনার কাঠির ছোঁয়ায় লেকের সমস্ত জল যেন সোনা হয়ে গেল। অবাক করা সৌন্দর্যে মুগ্ধ আমরা ভাষাহীন। এরই মাঝে বিকেল সন্ধের কাছে সময়ের ভার দিয়ে ঘরে ফিরল। সন্ধেটা আর একটু জাঁকিয়ে বসতেই আমরা তৈরি বগালেকের জলে জলকেলির জন্য। এ সময়টা বেছে নেওয়ার একটি কারণ ছিল বৈকি, একটু নির্জনতা আর নির্জনে জলের সাথে আলাপনের সুযোগ। সন্ধে আর রাতের সন্ধিক্ষণে জলের সাথে আলাপন সেরে আমরা নীড়ে ফিরলাম। এরপর রাত্রি। তরুণী রাত্রিতে বগালেক পাড়া কোলাহলে মুখরিত। গানে আড্ডায় জমজমাট পুরো পাড়া। রাতজুড়ে এতটুকুর জন্য নির্জতা আসেনি বগালেক পাড়ায়। তবে নির্জন ভোরের দেখা মিলেছিল। আমরা বেশ ভোরেই বিছানা ছাড়ি, মনের মধ্যে একটা তাড়া ছিল, বগালেক আর সমস্ত পাড়াটা একটু ভালো করে ঘুরে দেখা। সূর্য তখনো কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে আছে। ভোরের কোমল আলোয় ¯িœগ্ধ বগালেক আর চারধার...। আমরা পারঘেঁষে জেগে থাকা পাথরের চাঁইয়ের উপর বসে লেকের জলে পা ডুবিয়ে রাখি। নিজেদের মধ্যে গল্প করতে করতে একসময় তন্ময় হয়ে সূর্যের গা থেকে কুয়াশার চাদর সরে যেতে দেখি। দেখি সূর্যের প্রথম আলোকচ্ছটায় ঝলমলিয়ে ওঠা লেকের জল।

বেলা বাড়তে থাকে আবার ব্যস্ত হতে শুরু করে জনপদ। আমরাও ব্যস্ত হই নিজেদের গোছগাছে, ফিরতে হবে...।

[বি. দ্র. সময়টা এখানে উল্লেখ করা হলো, এখন অবশ্য বগালেক যাওয়া পথ অনেক মসৃণ, ২০১৯ সালে আমি আবার গিয়েছি ; তখন অবশ্য বগালেকের বম পাড়ার সেই জমজমাট অবস্থা ছিল না। জেনেছিলাম, সবকিছু নতুন করে সাজানো গোছানোর কাজ চলছে।]