সংগীতাঙ্গনের দীর্ঘদিনের পথচলায় লোকজ ঘরানার গান যার কণ্ঠে বেশি শোভা পায় এবং বিশেষভাবে লালনগীতি যার কণ্ঠে বেশি পূর্ণতা পায়, বেশি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে তিনি লালনকন্যা বিউটি। পুরো নাম নাসরিন আক্তার বিউটি। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে ক্লোজআপ ওয়ান প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অধিকারী বিউটিকে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল লালনকন্যা উপাধি দিয়েছেন। তারপর থেকেই দেশের অগণিত ভক্ত-শ্রোতাদের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন লালনকন্যা হিসেবে। আনন্দভুবনের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বিউটি নানান বিষয়ে কথা বলেছেন। সেইসব কথার চুম্বক অংশ তুলে ধরেছেন শহিদুল ইসলাম এমেল...
বিউটি বর্তমানে সংগীতাঙ্গনের নানা মাধ্যমে ব্যস্ত সময় পার করছেন। সম্প্রতি নতুন পাঁচটি মৌলিক গানের কাজ শেষ করেছেন। সেগুলোর মিউজিক ভিডিওর কাজ শুরু হচ্ছে। ওপেন স্টেজ শো এখন কম হচ্ছে, তাই টেলিভিশন এবং অডিও রেকর্ডিংগুলো করছেন। বিভিন্ন টেলিভিশনের লাইভ শো করছেন নিয়মিত। স্টেজ প্রোগ্রাম থাকুক বা না থাকুক দিনশেষে অডিও, টিভি এবং নিজের ঘর সবমিলিয়ে গানের মধ্যেই আছেন তিনি। পাশাপাশি দুই ছেলে রায়াত আর রাহিলকে সময় দিচ্ছেন।
বিউটির পাঁচটি সলো এবং একটি ডুয়েট অ্যালবাম বেরিয়েছে। বেশকিছু সিনেমায় প্লেব্যাক করেছেন। বিউটি ফোক গানের শিল্পী, তাছাড়া ফোক রিলেটেড ছবি খুবই কম নির্মিত হয়। ফোক রিলেটেড ছবি বেশি হলে হয়ত আরো বেশি ছবিতে প্লেব্যাক করার সুযোগ পেতেন।
ফোক গানের প্রতি আগ্রহী হলেন কেন জানতে চাইলে বিউটি বলেন, “ফোক গান তো হচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ জুড়েই তো আছে আমাদের দেশীয় ঐতিহ্য ফোক গান। মানে মাটির গান। ফোক গান কেন করি যদি বলেনÑ তাহলে তো আমি বলব, ফোক গান আমার রক্তে মিশে আছে। কেননা, লালন সাঁইজির এলাকার কাছাকাছি আমার জন্ম, সেটার একটা প্রভাব আমার ভেতর ছিলই। আমি ছেলেবেলা থেকেই চেষ্টা করতাম সব ধরনের গান গাইতে। আমি ক্লোজআপ ওয়ান প্রতিযোগিতায় আসার আগে স্টেজ প্রোগ্রাম করতাম। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতাম তখন সবাই আমার গাওয়া ফোক গানই বেশি পছন্দ করতেন। তারপর ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে যখন ক্লোজআপ ওয়ান প্রতিযোগিতায় এলাম তখন শ্রদ্ধেয় আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল স্যার আমাকে ভালোবেসে ‘লালনকন্যা’ উপাধি দিলেন এবং উনি বললেন, লালন সাঁইয়ের গান তুমি ছাড়বে না। তারপর জনগণও আমাকে স্বীকৃতি দেয় যে, ফোক গানের জন্য আমি কিছুটা হলেও যোগ্য। আর যে যেটা ভালো পারে তার সেটা নিয়েই এগিয়ে যাওয়া উচিত। একসঙ্গে সব বিষয় নিয়ে যদি চেষ্টা করা হয় তাহলে কোনোটাই ভালো হবে না। যেমন, এখন আমি চাইলেই আধুনিক গান ভালো গাইতে পারব না। আমাকে শ্রোতারা যে গানের জন্য ভালোবাসেন, আমার কাছে শ্রোতারা যে গান শুনতে চান সেই গানই আমাকে করতে হবে। এভাবেই ফোক গানে আসা এবং ফোক গান করা।”
বিউটির ‘লালনকন্যা’ হওয়ার পেছনে তার বাবার অবদান সবচেয়ে বেশি। তার বাবা একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন। তাই বেড়েও উঠেছেন একটা সাংস্কৃতিক পরিম-লে। ছেলেবেলা থেকেই দেখেছেন বাবা ওস্তাদ রেখে বাড়িতে গান শিখেছেন এবং গানটা ছিল ওনার মনের খোরাক। তার বাবা কখনো স্টেজ প্রোগ্রামে গান গাননি। ছেলেবেলা থেকেই বাসায় সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র দেখে বিউটি অভ্যস্ত এবং সন্ধ্যা হলেই তার বাবা হারমোনিয়াম, তবলা, একতারা, দোতারা এগুলো নিয়ে গান গাইতে বসতেন। এগুলো শুনতে শুনতে বাবার হাত ধরেই বিউটির গান শেখা। তারপর বাবা দেখলেন তার মেয়ে যখন একটু ভালো গান করতে পারে তখন স্থানীয় একজন ওস্তাদের গান শেখার একাডেমিতে তাকে ভর্তি করিয়ে দেন। তারপর থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি পরিবারের সবার অনুপ্রেরণায় বিউটির গানের যাত্রা শুরু।
ফোক গানের বর্তমান অবস্থার কথা জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি মনে করি, বর্তমানে ফোক গানের অবস্থা সবচেয়ে ভালো। অন্য ধারার সংগীতের চেয়ে ফোক ধারা অনেক এগিয়ে আছে আমার মনে হয়। যেটা অনেক আগে ছিল না। তখন গতানুগতিক আমাদের সিনিয়র শিল্পীরা ধারণ করতেন একটা বিষয়কে নিয়ে কিন্তু এখন ফোক গান তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সাড়া ফেলেছে। এখন সর্বজনীন স্বীকৃত হচ্ছে আমাদের ফোক গান। আমাদের পাশের দেশ ভারতেও যেসব প্রতিযোগিতা হয় সেখানেও কিন্তু বেশিরভাগ শিল্পীই ফোক গান গেয়ে থাকেন। ২০০৫-এ আমি যখন ক্লোজআপ ওয়ানে তখনো কিন্তু ‘সারেগামাপাতে’ও ফোক গান রিলেটেড প্রতিযোগী খুব একটা দেখিনি। কিন্তু এখন দেখেন ‘সারেগামাপা’র বিগত কয়েকটি সিজনে অনেক প্রতিযোগীই কিন্তু শুধু ফোক গান নিয়েই এসেছে। অনেকেই আমাদের বাংলাদেশের ফোক গান নিয়ে এসেছে। ফোক গান গেয়ে চ্যাম্পিয়নও হয়েছে। এটা আমাদের জন্য তো একটা গর্বের বিষয়। এখান থেকেই তো বোঝা যায়, আমাদের ফোক গান দেশের গ-ি পেরিয়ে দেশের বাইরে কতটা প্রভাব ফেলেছে।’
লালন সাঁইজির ১০০টি গানের প্রজেক্টের অগ্রগতি কতদূর ? “ওটা অলরেডি চলছে। সুমন কল্যাণদা করছেন। দেশের পরিস্থিতির কারণে কিছুদিন কাজ বন্ধ ছিল। এখন নতুন দশটি গানের কাজ চলছে। শেষ হওয়ার পর মিউজিক ভিডিওর কাজ দ্রুত শেষ করব। তারপর সংবাদ সম্মেলন করে একটা একটা করে আমার ইউটিউব চ্যানেলে রিলিজ করব।”
সংগীতজীবনে অনেক বিশেষ স্মৃতি রয়েছে বিউটির। ‘ক্লোজআপ ওয়ান-২০০৫’ ছিল বাংলাদেশের প্রথম রিয়েলিটি শো। সেই সময়ে ‘ক্লোজআপ ওয়ান’ দেশে এবং দেশের বাইরে খুব সাড়া ফেলেছিল। প্রতিযোগিতা শেষে বিউটি যখন প্রথম আমেরিকা ভ্রমণে যান, ওই প্রতিযোগিতায় নোলক প্রথম ছিল তাই নোলককে নিয়ে সবার একটু বেশি কৌতূহল থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ওখানে গিয়ে বিউটির প্রতি মানুষের এত ভালোবাসা, এত উৎকণ্ঠা, এত এত শুভকামনা, দোয়া- আসলে ওখানে না গেলে তিনি বুঝতেই পারতেন না। ওই প্রতিযোগিতায় নোলক ক্লোজআপ ওয়ান, রাজিব ২য়, এবং বিউটি ৩য় হন। কিন্তু বিউটিকে যে মানুষ এত ভালোবাসে ওখানে না গেলে বুঝতে পারতেন না। গান শেষ করে স্টেজ থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে ভিড় ঠেলে হুড়োহুড়ি করে মানুষ তার কাছে চলে আসে বিউটিকে একনজর দেখার জন্য। অনেকে আবার গিফট নিয়েও আসে। মানুষের জমায়েতের কারণে বিউটিকে সঙ্গে সঙ্গে ওখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। বিউটি মনে করেন তার প্রতি মানুষের এই ভালোবাসা পাথেয় হয়ে থাকবে তার সংগীতজীবনে। বিউটি দর্শকদের এই ভালোবাসা নিয়েই এগিয়ে যেতে চান।
সংগীত নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী ? এমন প্রশ্নের জবাবই বলেন, ‘আসলে পরিকল্পনা ওইভাবে করা যায় না। ধরুন, এখন যে পরিকল্পনার কথা ভাবছি, দেখা যাচ্ছে দু’বছর পরে সেটা অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। আসলে সংগীত নিয়েই আমার সব পরিকল্পনা। সংগীতকে আরো বেশি সমৃদ্ধ করার প্রচেষ্টা থাকবে এবং লালন সাঁইয়ের গান আমি যেন আরো বেশি সমৃদ্ধ করতে পারি।’
বিউটি সংগীতের ওপর মাস্টার্স করেছেন ইউডা থেকে। তার প্রিয় শিল্পীর তালিকায় আছেন অনেকেই। তিনি যেহেতু লালনের গান করেন তাই ফরিদা পারভীনকে অনুসরণ করেন। ওনাকে বিউটির আইডল মনে করেন। তাছাড়া শফি ম-ল আছেন তার ধারার। অন্যদের মধ্যে আছেন রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন, সামিনা চৌধুরী, কনকচাঁপা, এন্ড্রুকিশোর, সুবির নন্দী ও সৈয়দ আব্দুল হাদি।