প্রাত্যহিক জীবনের ব্যস্ততা থেকে কিছুটা রিল্যাক্সের জন্য কোলাহলমুক্ত একটি পরিবেশ পছন্দ করেন না এমন মানুষ কমই রয়েছে। একটু মুক্ত বাতাসের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন অনেকেই। ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশের প্রকৃতি বর্ষাকালে যেন মনোরম, মনোমুগ্ধকর এবং আবেদনময়ী হয়ে ওঠে। জলজ সৌন্দর্য প্রেমীরা এই বর্ষাকালে যেখানে নিজেকে রাঙিয়ে নিতে পারেন, সেই সব সৌন্দর্যের লীলাভূমির তথ্য নিয়ে প্রতিবেদনটি লিখেছেন শেখ সেলিম...
এখন বর্ষাকাল। প্রকৃতি সেজেছে আপন রঙে। বর্ষার বৃষ্টিস্নাত সজীব প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগের জন্য এখনই উত্তম সময়। তাই যারা শহরের কোলাহল থেকে কিছুদিনের জন্য মুক্ত থাকতে চান তারা ঘুরে আসতে পারেন এই স্থানগুলো থেকে।
বিছানাকান্দি, সিলেট
সিলেটের বিছানাকান্দি এই বর্ষায় আপনাকে নিয়ে যাবে এক অন্যভুবনে। মেঘালয়ের সেভেন সিস্টার থেকে নেমে আসা ¯্রােত বিছানাকান্দিকে পাহাড়, জলপ্রপাত এবং নদীর মিলনে পরিণত করে। এই জায়গাটির বিশেষত্ব হলো এর মনোরম খাসিয়া পর্বতগুলো। সেগুলো এতই উঁচু যে, মাঝে মাঝে পাহাড়ের চূড়া ছুঁয়ে মেঘ দেখতে পাওয়া যায়। বর্ষায় পানির বিশাল স্রোত ঝরনা হয়ে হ্রদ তৈরি করে পিয়াইন নদীর সাথে সংযুক্ত হয় যার দৃশ্য সত্যিকার অর্থে নেশা ধরিয়ে দেয়।
বিছানাকান্দি ভ্রমণে প্রথমে সিলেটের আম্বরখানা থেকে হাদারপার যেতে হবে। এখানকার নৌকা-ঘাটের নৌকাগুলোই বিছানাকান্দি নিয়ে যায়। তবে জায়গাটি ষোল আনা উপভোগ করতে সবাই বিছানাকান্দি ও পান্থুমাইয়ের জন্য একত্রে নৌকা ভাড়া করে নেয়।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতটি বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। সাধারণত কক্সবাজার শীতকালে দর্শনার্থীদের সমাগম বেশি ঘটে। তবে, যারা কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বর্ষাকালীন রূপ দেখেননি, তারা ঝুঝতে পারবেন না, সাগরকন্যা বর্ষার রূপ কেমন। তাই যারা বর্ষাকালে সাগর কন্যার সৌন্দর্য দেখতে চান, তারা ভ্রমণের তালিকায় এই স্থানটি রাখতে পারেন। তাছাড়া এখন হোটেলগুলোতেও চলছে বিশেষ ছাড়। যাতায়াত ব্যবস্থাও অনেক সুন্দর। যারা বাসে ভ্রমণ করতে পারেন না, তারা ট্রেন যোগে যেতে পারবেন কক্সবাজারে।
এই সময়ে সমুদ্রের অবিরাম নীল জলরাশির সঙ্গে মেঘাচ্ছন্ন আকাশের এক অন্যরকম মিথস্ক্রিয়া দেখা যাবে, যার কোন কিছুর সঙ্গে তুলনা চলে না। আর অবিরাম বর্ষণ ভেজা হাওয়ার পূর্ণতা দিয়ে এক অদ্ভূত মুগ্ধতা সৃষ্টি করে। স্নান, সূর্যস্নান, সাঁতার কাটার মধ্যে একটি ভালো সময় অতিবাহিত করতে পারবেন।
ঢাকা থেকে সড়কপথে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে পৌঁছাতে সময় লাগে ৭ থেকে থেকে ৯ ঘণ্টা। অন্যদিকে, আকাশপথে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র পৌনে ১ ঘণ্টা।
রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট, সিলেট
সিলেট শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে রাতারগুলের এই ডুবে যাওয়া বনে রয়েছে প্রায় ৮০টির মতো প্রজাতির গাছপালা এবং প্রাণী। বর্ষাকালে ভারত থেকে অত্যধিক পানি নদী দিয়ে প্রবেশ করলে বনের সঙ্গে যুক্ত গোয়াইন নদী প্লাবিত হয়। আর তখনই বনটি তার স্বর্গীয় সৌন্দর্যে জীবন্ত হয়ে ওঠে।
বনের পুরোটাই পানির নিচে তলিয়ে যায় এবং গাছের ছাউনি ছাতার মতো বনকে ঢেকে দেয়। নৌকায় করে নদী পেরোনোর সময় পাখির কিচিরমিচির ও পাতায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার মৃদু শব্দের প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়।
সিলেট শহরের খাদিম চা বাগান ও খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে অল্প সময়ে শ্রীঙ্গি ব্রিজ অথবা জাফলংগামী যেকোনো গাড়িতে করে সারিঘাট হয়ে গোয়াইনঘাট বাজার।
রাতারগুলের জলাবন ঘোরার জন্য শ্রীঙ্গি ব্রিজ বা গোয়াইনঘাট বাজার থেকে ডিঙ্গি নৌকা ভাড়া পাওয়া যায়। বাস ও ট্রেন দুই মাধ্যমে যেতে পারেন এখানে। তবে প্রথমে শহরে নেমে, সিএনজি, ছোটো বাস কিংবা অন্যকোনো মাধ্যমে সেখানে যেতে পারবেন। তবে সন্ধ্যার আগেই আবার আপনাকে ফিরতে হবে শহরে।
সুন্দরবন, খুলনা
বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন এবং ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হওয়ায় প্রতিটি প্রকৃতিপ্রেমী সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই অপার প্রাচুর্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চান। সবুজের সতেজতায় ভিজিয়ে রাখা ছাড়াও সুন্দরবন ছোটো ছোটো দ্বীপে পরিপূর্ণ। সারাদিন বিশেষ করে, সূর্যাস্তের সময়ে এসব দ্বীপের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। সুন্দরবনে ভ্রমণের ক্ষেত্রে ঘন বনের মধ্য দিয়ে হাঁটার ক্ষেত্রে হীরণ পয়েন্ট বা নীলকোমল সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থান।
একটু সময়সাপেক্ষ হলেও সুন্দরবন পৌছানোর জন্য স্টিমার হয়ে প্রথমে খুলনা যাত্রাটি গ্রামবাংলার মনোরম প্যানোরামার অনুভূতি দেবে। খুলনা থেকে সুন্দরবনে যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম নৌ পরিবহণ। এক্ষেত্রে বন পরিদর্শন করার জন্য একটি ব্যক্তিগত মোটর লঞ্চ বা স্পিডবোট ভাড়া করা যেতে পারে।
জাফলং, সিলেট
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এ অঞ্চলের ওপারে আছে ভারতের ডাউকি। ডাউকি নদী পাহাড় থেকে জাফলং হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। জাফলংয়ের বাংলাদেশ সীমান্তে দাঁড়িয়ে ভারতের সুউচ্চ পর্বতশ্রেণি দেখা যায়। এসব পাহাড় থেকে নেমে আসা জলপ্রপাত এক মনোরম দৃশ্য সৃষ্টি করে।
এছাড়া, ভারতের ডাউকি বন্দরের ঝুলন্ত সেতুও পর্যটকদের কাছে প্রধান আকর্ষণ। বর্ষার সময় ভারতীয় সীমান্তে ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে সর্পিলাকার ডাউকি নদী যেন তার প্রাণশক্তি ফিরে পায়। ডাওকি নদীর পানির স্বচ্ছতাও জাফলংয়ের অন্যতম আকর্ষণ।
ঢাকা থেকে সিলেট পৌঁছার পর শহর থেকে বাসে বা সিএনজি অটোরিকশায় দুই ঘণ্টার মধ্যেই জাফলং যাওয়া যায়।
শ্রীমঙ্গল চা-বাগান, মৌলভীবাজার
বিপুল সংখ্যক চা বাগান এবং সাত রঙা চায়ের উৎপত্তির কারণে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলাটিকে বলা হয় বাংলাদেশের চায়ের রাজধানী। শ্রীমঙ্গলের প্রবেশপথেই সাতগাঁও চা-বাগানের সহায়তায় মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসনের তৈরি চা-কন্যা ভাস্কর্য স্বাগত জানাবে।
চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের [বিটিআরআই] ভেতরে দক্ষিণ দিকে পড়বে ফিনলের চা-বাগান। ভানুগাছের পথ ধরে সামনে এগোলেই দেখা যাবে জেরিন টি-এস্টেট। তারপর লাউয়াছড়ার কিছু আগেই জঙ্গলঘেরা পথে হাঁটলে নূরজাহান টি-এস্টেটের দেখা পাওয়া যাবে।
শ্রীমঙ্গল থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে কমলগঞ্জ যাওয়ার পথে পড়বে লাউয়াছড়ার মনোরম উদ্যান। কমলগঞ্জ থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরত্বে পাহাড়ঘেরা চা-বাগানের মধ্যে চোখে পড়বে সুবিশাল মাধবপুর লেক। মাধবপুর লেক থেকে ধলাই সীমান্ত পর্যন্ত চলে যাওয়া পথের দুপাশে শুধুই চা-বাগান।
সিলেটের বিমান বন্দর, রেলওয়ে বা বাস স্টেশন থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করে অনায়াসেই শ্রীমঙ্গল যাওয়া যাবে। গাড়ি রিজার্ভ করে চা-বাগানগুলো ঘুরে দেখা যেতে পারে।
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, পটুয়াখালি
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এই ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতটি পর্যটকদের কাছে সমুদ্রকন্যা নামে পরিচিত। এটি বাংলাদেশের একমাত্র সমুদ্র সৈকত যেখানে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত উভয়ই দেখা যায়।
এখানকার পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণগুলো হচ্ছে ৩৬-ফুট লম্বা সোনার বৌদ্ধ মূর্তি, শুটকি পল্লি, ফাতরার চর, লাল কাঁকড়ার দ্বীপ এবং মনোমুগ্ধকর মায়ামী গঙ্গামতির চর। এছাড়া যে কুয়ার নামে এই শহরের নামকরণ সেই ঐতিহাসিক কুয়া দেখতেও ভ্রমণপিপাসুরা ভিড় জমায়।
পূর্বে ঢাকা থেকে কুয়াকাটা যেতে প্রায় ১২ থেকে ১৩ ঘণ্টা লাগলেও, পদ্মা সেতু হওয়ার পর এই সময়টা কমে নেমে এসেছে প্রায় ৫ ঘণ্টায়। তাই এখন কুয়াকাটাকে আরো অভিজাত করে সাজানো হচ্ছে পর্যটকদের জন্য।
ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর, সিলেট
ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর সিলেটের উত্তর থেকে ৩৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে, এটি সিলেটের বৃহত্তম পাথর উত্তোলন স্থান। এই দর্শনীয় স্থানটির প্রধান আকর্ষণ হলো মেঘালয়ের মেঘ, পাহাড়ি ঝরনা, এবং ধোলাইয়ের বালুকাময় উপকূল।
বর্ষার পাহাড়ি ঢলের সাথে নেমে আসা সাদা পাথরগুলো ধলাই নদের বুকে মিশে ভোলাগঞ্জের সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে ভোলাগঞ্জ যাওয়ার সড়কের অবস্থা খুব একটা আরামদায়ক নয়। সিলেট সদরের যেকোনো স্থান থেকে বাস, সিএনজি, লেগুনা বা প্রাইভেট কারে করে পৌঁছা যায় প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বের ভোলাগঞ্জে।
নীলাচল, বান্দরবান
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সুদূর সমুদ্রের স্পর্শ থেকে শুরু করে গাছপালা ও পাখির কিচিরমিচিরে পরিপূর্ণ এই প্রকল্পটি ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে উদ্বোধন করা হয়েছিল। এই পর্যটন কেন্দ্রটি এত উচ্চতায় অবস্থিত যে, এর সৌন্দর্য আকাশের বিশালতাকেও হার মানায়।
নীলাচলে পর্যটকদের সুবিধার্থে ছোটো-বড়ো অনেক রেস্ট হাউজ রয়েছে। আর শিশুদের খেলার জন্যও রয়েছে আকর্ষণীয় ব্যবস্থা। নামের সঙ্গে মিল রেখে প্রতিটি বিশ্রামাগারের রংও করা হয়েছে নীল। বর্ষায় ভেজা প্রকৃতির মায়া বিমোহিত করবে বৃষ্টিভেজা সকালে। দূরের তাজা বন, আকাশে কালো মেঘ এবং দূর সৈকতের গর্জন সবকিছু মিলে প্রকৃতির এক অপূর্ব দৃশ্য তৈরি করে।
ঢাকা থেকে বাসে সরাসরি বান্দরবান যাওয়া যায় ১০ থেকে ১১ ঘণ্টার মধ্যে। এরপর বান্দরবান থেকে নীলাচল যেতে সিএনজি ভাড়া নিতে হয় অথবা কোনো গ্রুপের সাথে উঠে পড়তে হয় চান্দের গাড়ি বা জিপে।