[পূর্ব প্রকাশিতের পর]
আমি বার্গেন থেকে প্যারিসে আসি ডিসেম্বরের ১০ তারিখ, এর আগে অক্টোবরে একবার প্যারিসে এসেছিলাম মাত্র দুই দিনের জন্য। তখন সময় যেন চোখের পলকেই ফুরিয়েছিল, কতকিছু দেখা হয়নি, কত জায়গায় যাওয়া হয়নি। আর সবচেয়ে বড়ো কথা আমার কাজিনের খুব আফসোস ছিল আমাকে ইউরোপের কিছুই ঘুরে দেখাতে পারলো না। তখনই তাকে আস্বস্ত করেছিলাম ডিসেম্বরে বেশ কিছুদিন সময় নিয়ে আসবো। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ আমার পরীক্ষা শেষ হয় সেই দিনই সন্ধ্যার ফ্লাইটে আমি প্যারিস চলে আসি। আমি প্যারিসে এসেছি তাও সপ্তাহখানেক হলো। এবার প্যারিসে আসার পেছনে বিশাল পরিকল্পনা ছিল কিন্তু আবহাওয়ার স্যাঁতস্যাঁতে ভাব আর আমার কাজিনের অনাকাক্সিক্ষত ব্যস্ততায় আমরা সময়ের থেকে পিছিয়ে ছিলাম। যদিও এর মধ্যে লু’ভর মিউজিয়াম আর ডিজনিল্যান্ডে যাওয়া হয়েছে কিন্তু প্যারিসের বাইরে এ পর্যন্ত পা দেওয়া সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে আমার যত না দুঃখ আমার ভাইয়ের [কাজিনের] দুঃখ তার চেয়ে বহুগুণ। এই দুঃখ সাথে নিয়েই সে যতটা সম্ভব তার কাজকর্মকে গুছিয়ে নিয়ে তিনদিনের এক ভ্রমণ পরিকল্পনা করে ফেলল। অবশ্য এ ক্ষেত্রে আমার পছন্দই প্রাধান্য পেল। এর আগে আমার ভাতিজা ইরফান বেলজিয়ামের উত্তর সাগরের তীর থেকে বেড়িয়ে এসে ফেসবুকে সেই উত্তর সাগরের ছবি পোস্ট করেছিল তখন থেকেই আমার মন জীবনানন্দের সেই উত্তর সাগর দেখার জন্য উদ্বেলিত ছিল। তাই সে মোতাবেক আমরা ভ্রমণ পরিকল্পনা সাজিয়ে নিলাম। প্রথমে বেলজিয়াম এরপর নেদারল্যান্ড। ইরফানও দেখেশুনে সাগরের কাছাকাছি একটি হলিডে হোমস ঠিক করে দিল আর নেদারল্যান্ডে আমারা ক্যাম্প স্টে করেছিলাম।
যাত্রার দিন আমি আমার ভাতিজারা আগ্রহের আতিশায্যে সকাল সকাল তৈরি হয়ে গেলাম, কিন্তু সেই ঘরের গৃহিণীর যেন আর সব গুছানো হয়ে ওঠে না। এ দিকে আমার কোথাও যাওয়ার ক্ষেত্রে তৈরি হওয়ার পর আর তর সয় না, ভাতিজারাও উসখুস করছে। অবশেষে বেলা সাড়ে বারোটায় ভাবি তৈরি হয়ে বের হলো। তখন আবার আরেক বিপত্তি, গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না। কেন নিচ্ছে না এটা বুঝতে বুঝতেই আমার কাজিনের গলদঘর্ম অবস্থা। এদিকে তো আমি আর ভাতিজাদ্বয় রীতিমতো অস্থির আর ত্যাক্ত হয়ে উঠেছি। অন্যদিকে এই শঙ্কাও কাজ করছে, আদৌ আমরা যাত্রা শুরু করতে পারব কি না। আর আমার কাজিন নেট ঘেটে ঘেটেও এর কুল পাচ্ছে না, ইউরোপে গাড়ির মেকানিক জোগাড় করা সে তো বড়োই ঝক্কির কাজ। তখনই ত্রাণকর্ত্রী হিসেবে এক স্বর্ণকেশীর আবির্ভাব ঘটে। এক ফরাসি ললনা যে কি না আমার কাজিনের প্রতিবেশী সে বাইরের কাজ সেরে বাড়ি ফিরে তার নিজের গাড়িটি পার্কিংয়ে রেখে আমার কাজিনের বেগতিক অবস্থা দেখে এগিয়ে এলো আর নিমিষেই বুঝে নিলো আসল সমস্য। সমস্যার সূত্রপাতে আসি, আগের দিন আমার ভাই তার পুত্রদ্বয়কে নিয়ে বাজারে গিয়ে অন্যান্য অনেক জিনিসের সাথে একটি মোবাইল চার্জার কিনে এনেছিল, যেটা দিয়ে গাড়ি থেকে মোবাইল চার্জ দেওয় যায়। আর আমার ভাতিজা সকাল সকাল তৈরি হয়ে কোনো কাজ না থাকায় সদ্য কেনা চার্জারের কার্যকারিতা পরখ করতে গাড়িতে বসে তার ট্যাবটি চার্জ দিয়েছিল তখন গাড়িতে স্টার্ট দেওয়া না থাকায় চার্জার গাড়ির ব্যাটারির সব চার্জ শুষে নিয়েছিল যে কারণে গাড়ির এই দুর্গতি। যাক, যেহেতু সমস্যার মূলে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে সেহেতু সমাধানও সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রেও সেই স্বর্ণকেশীই ভরসা, সে তার গাড়ির ব্যাটারি থেকে আমাদের গাড়ির ব্যাটারি চার্জের ব্যবস্থা করে দিল। আধঘণ্টার মতো চার্জ নিয়ে অবশেষে আমরা যাত্রা শুরু করলাম, ততক্ষণে বেলা তিনটে।
যাক, তবু তো শুরু করা গেল, যা একদম শুরু না হওয়ার চেয়ে তো ভালো। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছিল হয়ত আর যাওয়াই হবে না। ইউরোপে হাইওয়ে রাইড খুবই চমৎকার, দুই পাশের প্রকৃতি আর জনজীবনের চিত্র যেন পটে আঁকা ছবি। এই দেখতে দেখতে পথ চলতে বেশ লাগে। সাধারণত ইউরোপের হাইওয়েগুলোতে তেমন কোনো জ্যাম থাকে না। চারপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা ইতোমধ্যে ফ্রান্স ছাড়িয়ে এসেছি। শুরু করেছিলাম বেলা তিনটে নাগাদ, তাই এখন সুর্যের আলো না থাকাই স্বাভাবিক। তবে, আকাশ পরিষ্কার থাকায় সূর্য ডোবার পরেও আলোর রেশ মিলিয়ে যায়নি। এখানে রাস্তার আলোগুলোও বেশ চমৎকার। আমরা একটি হাইওয়ে কফিশপে ক্ষণিকের বিরতি নিলাম। ইচ্ছে কিছু খাওয়া-দাওয়া সেই সাথে ফ্রেশ হওয়াটাও জরুরি ছিল। এটি একটি ছোটো-খাটো ক্যাফে, খুব বেশি লোকজনের ভিড় নেই। মূলত দূর যাত্রার যাত্রীরাই এখনে বিরতি নেয়। আমরা কোণার দিকে একটি খালি টেবিলে নিজেদের বসার জায়গা করে নিলাম, সবাই ফ্রেশ হয়ে তারপর সাথে থাকা খাবার খেয়ে নিলাম। শপ থেকে কফি নিয়ে কফি খেতে খেতে কিছু সময় ক্যাফের বাইরে হাঁটাহাঁটি করে আবার রওনা হলাম। আমরা যখন বেলজিয়ামে পৌঁছি তখন রীতিমতো রাত। আমারা আমাদের ভাড়া করা হলিডে হোমসে পৌঁছানোর আগেই তার কেয়ার-টেকারকে ফোন করি, তিনি তার বাসা থেকে এসে আমাদের চাবি দিয়ে ঘরদোর বুঝিয়ে দিয়ে যায়। ঘরে ঢুকতেই মন ভালো হয়ে যায়। বিশাল বাড়ি, ডুপ্লেক্স। নীচ তলায় ড্রয়িং, ডাইনিং, কিচেন আর বাথরুম। দোতলায় শোবার ঘর। ইউরোপে একটা বিষয় আমাকে খুব অবাক করেছিল যে এখানে বাড়ি যত বড়োই হোক না কেন বাথরুম একটাই হবে। আগে জানতাম এটাচড বাথরুমের ধারণা এসছে ইউরোপীয়ানদের কাছ থেকে এখন দেখি ব্যাপারটা অন্যরকম। সারাদিনের যাত্রার সমাপ্তিতে আমরা ততক্ষণে ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্থ। চলতি পথে যতটা বুঝেছি যে আমরা মোটামুটি শহর ছাড়িয়ে এসেছি। ইউরোপের যেকোনো বড়ো শহরে হালাল খাবারের সন্ধান পাওয়া গেলেও ছোটো ছোটো শহর বা শহরতলীতে তা পাওয়া খুবই দুরূহ। নেটে সার্চ দিয়ে মাইল তিনেকের মধ্যে একটি অ্যারাবিয়ান খাবারের দোকানের সন্ধান পাওয়া গেল, যেহেতু বাচ্চারা জার্নিতে তখন বেশ ক্লান্ত আর ভাবিও বাইরে যেতে চাচ্ছেন না তাই আমার কজিন একাই গেল খাবার পার্সেল করে নিয়ে আসবে বলে। গেল তো গেল আর ফেরার নাম নেই, প্রায় ঘণ্টার বেশি সময় হয়ে গেল। এদিকে ফোনের নেটওয়ার্কও খুব খারাপ, তাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না, আমরা কিছুটা টেনশনেই পড়ে গেলাম, আবার না পথ গুলিয়ে ফেলেছে। আশঙ্কা সত্যি ছিল আসলে সে পথ ভুলে বেশ কিছু সময় ভুল পথে চলে পরে পথচারীদের সহায়তায় দিক চিনে ফিরতে পেরেছে। নেটওয়ার্কের বাজে অবস্থাই এর জন্য দায়ী। এরপর আমরা রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে কিছুটা সময় গল্প-গুজবে কাটিয়ে ঘুমুতে গেলাম।
এমনিতে আমি ঘুম কাতুরে মানুষ কিন্তু কোথাও বেড়াতে গেলে আমি বেশ সকাল বেলার পাখি হয়ে উঠি। এখানেও ব্যতিক্রম কিছু ঘটলো না। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে গেলাম, অবশ্য আমার ভাতিজাদ্বয়ও আমার সাথে তৈরি। এরপর আমরা পুরো বাড়িটার ভেতর-বাহির ঘুরে-ফিরে ছবি তুলে টুকটাক সকালের নাশতা সেরে বেরিয়ে পড়লাম। কোথায় যাচ্ছি ? সে বড়োই হৃদয় বিদারক ব্যাপার, বেলজিয়ামের ব্রুগস [ইৎঁমবং] শহরে এসেছিলাম মূলত উত্তর সাগর দেখবো বলে, এটি উত্তর সাগর উপকূলবর্তী একটি শহর, আখেরে সেখানে একটি রাত্রি যাপন করে আবার পথে নামলাম। আসলে আমাদের পরিকল্পনা মাফিক প্যারিস থেকে সকাল আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে রওনা হয়ে বেলা এগারোটা সাড়ে এগারোটার মধ্যে বেলজিয়ামে ব্রুগস্-এ পৌঁছানোর কথা। কিন্তু বিধি বাম আটটা-–সাড়ে আটটা তো দূর আমরা দিনের প্রায় পুরোটা সময় পার করে বিকেল তিনটে নাগাদ রওনা দিতে পেরেছিলাম, কেন?-সে কথা তো আগেই বলেছি। তাই গন্তব্যে পৌঁছে রাত্রি-যাপন করা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার ছিল না। আমাদের পরের গন্তব্য নেদারল্যান্ড, পেছনে আমার উত্তর সাগর অধরা আর অদেখা হয়েই রইল। সকাল সকাল রওনা হয়েছিলাম যেন অন্তত নেদারল্যান্ডে সকাল সকাল পৌঁছুতে পারি। ইৎঁমবং থেকে নেদারল্যান্ডের দূরত্ব গাড়িতে প্রায় তিনঘণ্টার পথ, যেহেতু আমরা সকাল সাড়ে সাতটার দিকে রওনা দিয়েছি সেহেতু বড়জোর বেলা এগারোটার মধ্যে আমরা নেদারল্যান্ড পৌঁছে যাব। হিসেব মতো এর বেশি সময় লাগার কথা না। কিন্তু এ যাত্রায় ভাগ্য যেন আমাদের প্রতি প্রসন্ন হবে না বলেই পণ করেছে, ‘অভাগা যে দিকে তাকায় সাগর শুকিয়ে যায়’, আমাদের অবস্থা এখন সেই রকম।
বেলজিয়াম থেকে নেদারল্যান্ড ঢোকার মুখে একই জায়গায় আমরা প্রায় তিন ঘন্টা আটকে ছিলাম, না ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত জাটিলতা না ¯্রফে জ্যাম, কী অবাক লাগছে, লাগারই কথা কেননা ইউরোপে জ্যাম তাও এতো লম্বা সময় ? এটা কোনো বিশেষ পরিস্থিতি না, এখানে নাকি এরকম চিত্র প্রায়শই দেখা যায়। আসলে ইউরোপ তো পৃথিবীরই একটি অংশ, স্বর্গ তো নয়। যদিও দূর থেকে সবই সুন্দর আর মসৃণ মনে হয়, কাছে গেলেই ফাঁক-ফোঁকর বা ক্ষুতগুলো চোখে পড়ে। তিন ঘণ্টার পথ আর তিন ঘণ্টা জ্যামে কাটিয়ে সন্ধ্যার মুখোমুখি আমরা নেদারল্যান্ডে পৌঁছি। [চলবে]