বঙ্গবন্ধুর ‘জুলিও কুরি শান্তি পদক’ প্রাপ্তির সুবর্ণজয়ন্তী আজ -ইকবাল খোরশেদ

23 May 2023, 01:24 PM নিবন্ধ শেয়ার:
বঙ্গবন্ধুর ‘জুলিও কুরি শান্তি পদক’ প্রাপ্তির সুবর্ণজয়ন্তী আজ -ইকবাল খোরশেদ

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘জুলিও কুরি শান্তি পদক’ প্রাপ্তির ৫০তম বার্ষিক আজ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক-পর্যায়ে বিভিন্ন অবদানের জন্য ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৩-এ মে বঙ্গবন্ধুকে ‘বিশ্বশান্তি পরিষদ’ ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করে। এই পদক লাভ বাঙালি জাতির জন্য এক অনন্যসাধারণ প্রাপ্তি ছিল। 

নিপীড়িত, নিষ্পেষিত, শোষিত, বঞ্চিত বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলার মানুষ নয় মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর জাতির স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ পরিহার করে বন্ধুত্বের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করে বিশ্ববাসীর সুনাম অর্জন করেন। আর বিশ্ব মানবতায় অবদান রাখার কারণে ‘বিশ্ব শান্তি পরিষদ’ বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ পদকে ভূষিত করে।  


বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখন বিশ্ব পরিস্থিতি, শান্তি, প্রগতি, গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর এবং গণতন্ত্র ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অনুকূলে অভূতপূর্ব পরিবর্তন এসেছিল। সে-সময় উপমহাদেশে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের ভেতর সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক স্থাপন ও উপমহাদেশে শান্তির সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের কালপর্বে “ভারত-সোভিয়েত শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা-চুক্তি ১৯৭১” এবং “বাংলাদেশ-ভারত শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা-চুক্তি ১৯৭২”, বাংলাদেশের মৈত্রী-সম্পর্কে এই উপমহাদেশে উত্তেজনা প্রশমন ও শান্তি স্থাপনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল।


পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল নীতির বিপরীতে বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক জোট নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ এবং শান্তি ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান গ্রহণের নীতির ফলে বাংলাদেশ বিশ্বসভায় একটি ন্যায়ভিত্তিক দেশের মর্যাদা লাভ করে। সবার প্রতি বন্ধুত্বের ভিত্তিতে বৈদেশিক নীতি ঘোষণা করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, “পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তি যে অর্থ ব্যয় করে মানুষ মারার অস্ত্র তৈরি করছে, সেই অর্থ গরিব দেশগুলোকে সাহায্য দিলে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে।”


এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই অক্টোবর চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে ‘বিশ্ব শান্তি পরিষদ’র প্রেসিডেন্সিয়াল কমিটির সভায় বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলন এবং বিশ্ব শান্তির সপক্ষে বঙ্গবন্ধুর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘জুলিও কুরি শান্তি পদক’ প্রদানের জন্য শান্তি পরিষদের মহাসচিব রমেশ চন্দ্র প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। বিশে^র ১৪০টি দেশের শান্তি পরিষদের দুইশ’ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জুলিও কুরি শান্তি পদক’ প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই পদক প্রাপ্তির ফলে ‘বিশ্ববন্ধু’র স্বীকৃতি পান বঙ্গবন্ধু।  


১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী মেরি কুরি ও পিয়ের কুরি দম্পতিকে সম্মান জানানোর জন্য এই পদকের সূচনা হয়। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় ম্যারি কুরি ও পিয়েরে কুরি দম্পতির সংগ্রামী অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে ‘বিশ্বশান্তি পরিষদ’ এই পদক চালু করে। বঙ্গবন্ধুর আগে যাঁরা ‘জুলিও কুরি শান্তি পদকে’ সম্মানিত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন নেলসন ম্যান্ডেলা, ইন্দিরা গান্ধী, ফিদেল কাস্ত্রো, হো চি মিন, ইয়াসির আরাফাত, সালভেদর আলেন্দে, মাদার তেরেসা, পাবলো নেরুদা, জওহরলাল নেহরু, মার্টিন লুথার কিং, নিওনিদ ব্রেজনেভ প্রমুখ। 



“সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয় এবং সকল বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান”- এই ছিল বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র। ‘বিশ্বশান্তি পরিষদ’র শান্তি পদক জাতির পিতার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ। এটি ছিল বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় তার অবদানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। আর এই পদক ছিল বাংলাদেশের জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মান।


বঙ্গবন্ধু-কে ‘জুলিও কুরি শান্তি পদক’ প্রদান করা হবে, ‘বিশ^শান্তি পরিষদ’র এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২০-এ নভেম্বর ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সংবর্ধনা জানায়। সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ প্রদান করেছিলেন সে-ভাষণে তিনি প্রথমেই বলেছিলেন, “এ সম্মান কোনো ব্যক্তি বিশেষের জন্য নয়। এ সম্মান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারী শহিদদের, স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানীদের। ‘জুলিও কুরি শান্তি পদক’ সমগ্র বাঙালি জাতির।” এ থেকে বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধু তাঁর দেশের সাধারণ মানুষকে কতটা ভালোবাসতেন। সেদিন বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণ শেষ করেন এই বলে যে, “দুনিয়ার কারো সঙ্গেই আমার দুশমনতা নাই। সকলের সঙ্গে বন্ধু হয়ে বাস করতে চাই। ...

জয় বাংলা। 

বিশ্বশান্তি জিন্দাবাদ।”


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন করেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংঘাতময় পরিস্থিতি উত্তরণে তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন।


‘বিশ্ব শান্তি পরিষদ’ কর্তৃক ‘জুলিও কুরি শান্তি পদকে’ ভূষিত স্বাধীনতার প্রাণপুরুষ ও বাংলাদেশের মহান স্থপতি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখন আমাদের মাঝে নেই। সাম্রাজ্যবাদের নীলনকশা অনুযায়ী এক ঘৃণ্য ঘাতকচক্র ১৯৭৫ খ্রিষ্টব্দের ১৫ই আগস্ট রাতের অন্ধকারে বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যসহ হত্যা করে।


বঙ্গবন্ধু সশরীরে উপস্থিত না থাকলেও তাঁর মহান আদর্শ, উদ্দেশ্য এবং নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ আছে। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে আছেন, চিরকাল বেঁচে থাকবেন। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে তার সুযোগ্য উত্তরসূরির হাত ধরে।