খেয়া মাঝি -দিল আফরোজ রিমা

12 Apr 2023, 02:56 PM সাহিত্যভুবন শেয়ার:
খেয়া মাঝি -দিল আফরোজ রিমা


সারাদিন মাছের ঝাঁকা মাথায় নিয়ে বাড়ি-বাড়ি মাছ বিক্রি করে মাত্রই বাড়ি ফিরেছে ল²ী। এমন সময় কীসের যেন হট্টগোল শোনা যায়। জেলে পাড়ারই কয়েকজন কিশোর ল²ীর উঠানে এসে দাঁড়াল। একজনের কোলে একটি শিশু, ল²ী এগিয়ে যায়। দেখে শিশুটি তার নিজের তিন বছরের ছেলে। ল²ী জানতে চায়, কীরে গোবিন্দ, আমার রামের কী অইছে ?

গোবিন্দ ভয়ে ভয়ে বলে, চাচিগো, রামরে বুঝি আর বাঁচাইবার পারলাম না। আমি তো খেয়া পাড়ে ব্যস্ত আছিলাম। একবার পাড়ে নৌকা ভিড়ানোর সময় মনে অইল পানিতে কিছু একটা লাফালাফি করতাছে। বেশি পানি না। খেয়াল কইরা দেখলাম, ছোটো পোলাপাইনের মতো মনে অয়। আমি নৌকায় একজনেরে ডাইকা লই। তারপর নিজে পানিতে নাইমা বাচ্চাডারে তুলবার চ্যষ্টা করি। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দূরে ভাইসা গেছে। তহন আরো দুই তিনজনেরে ডাইকা লইলাম। অনেকক্ষণ ধইরা খুঁজাখুঁজি করি। হের পর হঠাৎ আমার পায়ের কাছে কিছু আন্দাজ করি। তুইলা দেখি ও আর কেও না, আমাগো রাম। ওর বুকের মধ্যে কান লাগাইয়া দেখলাম কোনো শব্দ নাই।


ল²ী ছেলেকে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে। শিশুটি সত্যিই বেঁচে নেই। প্রচুর পানি পেটে ঢুকেছে। অনেকক্ষণ পানিতে থাকায় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা গেছে। ল²ীর আর্তচিৎকার ছড়িয়ে পড়ে সারাপাড়ায়।

দিনের প্রায় শেষ। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। জেলেপাড়ায় বাড়িতে বাড়িতে আলতো আলোর প্রদীপ জ্বলছে। ভেসে আসছে তুলসী তলার শাঁখের ধ্বনি। এমন সময়ে ছোটো রামকে চিতায় নিয়ে যাওয়া হলো। খানিকটা দূরে গ্রামের মেঠো পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিল প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার ঘনশ্যাম। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখে তিনি ভাবেন, জেলেপাড়ায় বুঝি আবার কেউ মারা গেল। যাই, গিয়ে দেখি।

ঘনশ্যাম মাস্টার কিছুটা পথ হেঁটে ওখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, কে মারা গেলরে সোনাই ?

সোনাই চোখের জলে ভেসে জবাব দেয়, মাস্টার মশাই, আমার কপাল পুইরেছে। আমার ব্যাটা আইজ পানিতে ডুইবা মরল। তারেই জ্বালাইয়া দিলাম।

মাস্টার মশাই দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলেন, আফছোস করিস না সোনাই সবই তার ইচ্ছে। নদীর পাড়ের মানুষের কাছে নদী অনেক পরিচিত। ছোটো শিশু নদীর কুলে কাদা-মাটি মেখে খেলাধুলা করে বড়ো হয়। ছোটোবেলা থেকেই নদীর সাথে তাদের ভাব গড়ে ওঠে। শিশুরা সাঁতার কেটে নদীর এপার থেকে ওপারে যেতে পারে। তাই নদী নিয়ে কারো মনে কোনো ভয় নেই। তবে এই নদীর বুকে কত ছোটো শিশু, কত বৃদ্ধ নারী প্রাণ দিয়েছে, তার হিসেব কে রেখেছে। নদীর শান্ত অবস্থায় এইসব ঘটনা ঘটে থাকে। আর নদী যখন বর্ষার ডাকে ভয়ংকর আকার ধারণ করে, ভাসিয়ে নিয়ে যায় সব কিছু, সে কথা তো বলাই বাহুল্য। তাই আমরা নদী পাড়ের মানুষ হলেও বর্ষার মৌসুমে অন্তত শিশুদের একটু সাবধান রাখা দরকার।

গোবিন্দের মনটা ভালো নেই। সারাদিন খেয়া বেয়ে রাতে বাড়ি ফিরে কারো কান্নার শব্দ শুনতে পায়। শব্দটা তার খুবই পরিচিত। তাই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে, হায় ভগবান, আমার দিদির কপালে কি কোনোদিন সুখ অইব না। জীবনডা কি তার কাইন্দা কাটাইতে অইবো। সে কোনো কথা না বলে সরাসরি ঘরে গিয়ে মাকে বলে, মাগো, ভাত দে। ম্যালা ক্ষিদা পাইছে। সকালে পান্তা খাইয়া গেছি। সারাদিন খেয়া বাইছি। তারমধ্যে আবার রামডা মইরা গেল। ভালোই লাগে না, আর কিচ্ছু ভালো লাগে না মা।

মা কাবেরী বলে, তা তো বুঝলাম। তোর দিদি যে বিলাপ কইরা কানতাছে তোর তা চোকে পড়ে না ?

চোকে পড়ছে মা, বাড়ি ঢুকনের আগেই দিদির কান্দন আমার কানে আইছে। আর বুঝবারও পারছি দিদিরে জামাইবাবু আবার মাইর-ধইর করছে। আবার ট্যাকা-পয়সা চাইছে। আমি কি করুম মা। সারাদিন খেয়া বাই। যা পাই তোমার কাছে দেই। আমার ফাঁসি লইয়া মরতে অইবো।

অলইক্ষা কতা কস ক্যান্। ভাগ্যে যা আছে তা অইবো। তোর দিদি আর ওই বাড়ি যাইবো না। আর মাইরও খাইবো না। তোর জামাইবাবু আর নাই। মাছ ধরতে গিয়া সাপের কামড় খাইছে। ওঝা ডাকতে ডাকতে সারাগায়ে বিষ ছড়াইয়া গেছে। ওঝা অনেক চেষ্টা করছে তয় কোনো কাম অয় নাই।

গোবিন্দ আশ্চর্য হয়ে বলে, মা এইডা তুমি কী কও, জামাইবাবু নাই ? ও দিদি আমারে খবর দিবি না ? তুই কেমনে খবর দিবি ? আমরা বেজায় গরীব বুইলা তোর শ^উর-বাড়ির মানুষ আমাগরে মানুষ মনে করে না। আমার জামাইবাবু মইরা গেছে আর আমারে কোনো খবর দিওনের দরকার মনে করে নাই। দুঃখ করিস না দিদি, ভাগ্যে যা আছে তা তো অইবোই।

কাবেরী পিড়াটা এগিয়ে দেয়। একটি থালায় ছেলের জন্য কয়েকটি রুটি আর পাশে খানিকটা মরিচবাটা রেখে বলে, আয় বাবা রুটি কয়খান মুখে দে।

গোবিন্দ ভাবছে, বিধবা মা আর নিজের খাবার যোগাড় করতে পারে না সে। কোনোদিন দুই বেলা খাবার জোটে, কোনোদিন একবেলা খেয়ে খেয়া বাইতে হয়। খেয়াপাড় হয়ে লোকজন ঘাটে ঠিকমতো পয়সা জমা করে না। সেই বাকি পয়সার জন্য বাড়ি বাড়ি ঘুরতে হয়। এক টুকরো জমি ছিল তা বিক্রি করে তার দিদির বিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিয়ের পরেও কয়েকবার ধার-দেনা করে জামাইবাবুকে টাকা দিতে হয়েছে। সেই ঋণ বহু কষ্টে গোবিন্দ শোধ করেছে। এখন দিদি বাড়িতে চলে এলো। গোবিন্দ তিন জনের খাওয়া পরা কীভাবে চালাবে সে চিন্তায় অস্থির হয়ে ওঠে। কাবেরী আবার ছেলেকে খাবার খেতে তাড়া দেয়। কিন্তু গোবিন্দ জানায় তার আর ক্ষুদা নাই।

বারান্দায় খেজুর পাতার মাদুর বিছিয়ে নেয় গোবিন্দ। ঘরে ভাঙা সিন্দুকটার ওপর থেকে একটা আধাময়লা কাঁথা আর তেল চিটচিটে একটি বালিশ তুলে নেয় সে। খেজুর পাতার মাদুরের ওপর কাঁথাটা বিছিয়ে শুয়ে পড়ে।

সকালবেলা খেয়া পারাপারের সময় আনন্দ মিস্ত্রিকে খাটে শুইয়ে খেয়া পার করা হয়। তাই গোবিন্দ জিজ্ঞেস করে, আনন্দ দাদার পা খান বুঝি আর ভালা অইল না।

আনন্দ মিস্ত্রির ছোট ভাই কানাই ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলে, নারে গোবিন্দ, কী একখান পেরেক পায়ে ফুটল, সেই থিকা বেদনা। পা ফুইলা গেল। অহন তো অর্ধেক পা পইচাই গেছে। ফটিক ডাক্তার ম্যালা অষুধ খাওয়াইল, কোনো কাম অইলো না। পায়ের কষ্টে দাদা এমন কান্দাকাটি করে। হের চিল্লানিতে কারো ঘুমাইবার সাধ্য থাকে না। দেখি সদরের হাসপাতালে নিয়া। ভাইরে, জমি জিরাত যেটুক আছিল দাদার পায়ের পিছনে সব গেল।

নৌকার মধ্যে ঘনশ্যাম মাস্টারও ছিলেন। তিনি আফসোস করে বললেন, আহারে ছেলেটা শুধু মিস্ত্রির কাজ করত তাই নয়। ছেলেটা গতর খাটাইয়া মানুষের উপকার করত। বল তো, আমি গরীব মানুষ তাই ট্যাহা পয়সা দিয়া কারো সাহায্য করতে পারুম না। তয় আমি খাটবার পারি। যার যা কাজের দরকার আমারে খালি কইলেই অইব। আমি কইরা দিমু। কোনো ট্যাহা চাই না।

হায় ভগবান জানি না তুমি কেন এমন কর। এত সুন্দর নদী আর তার চারিপাশ। নদীর স্বচ্ছ টলমল পানি। দূরে দূরে ঝাঁক বেঁধে হাঁসেরা ভাসে। নদীর পাড়ে কলমি আর হেলেঞ্চা সবুজ ডগা বাড়িয়ে মনোরম করেছে নদীর শোভা। আকাশে উড়ে বলাকার ঝাঁক। নেচে গেয়ে খেলা করে খঞ্জনা। নদী পারের মানুষগুলোর কেন এত দূর্দশা। হাতে গোনা কয়েকটা পরিবার আছে যারা স্বচ্ছল। তারা তো আবার এই নিম্নজাতের মানুষদের মানুষ বলেই মনে করে না। বেশির ভাগ মানুষই খুব কষ্টে দিন কাটায়। অভাব অনটন দুঃখ দুর্দশা নিয়েই এদের জীবন। কেউ শাপলা তুলে লবণ মরিচ দিয়ে রেঁধে দু’মুঠো ভাত মুখে দেয়। কেউ দু’বেলা, কেউ একবেলা খেয়ে দিন কাটায়। কেউ মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে। কেউ কুমারের কাজ করে।

নদীর পাড়ের মানুষগুলো সাধারনত নি¤œবিত্ত। এদের বুঝি দেখার কেউ নেই। এই অসহায় মানুষগুলোর ওপর নদীও খেপে ওঠে। ভাসিয়ে নিয়ে যায় এদের কুঁড়েঘরখানি। তার সাথে হারিয়ে যায় এক চিলতে জমিও। এদের নয়নের মনি ছোটো ছোটো শিশুরাও। যাদের মুখে অসহায় বাবা-মা কোনো দিন দু’মুঠো মাছ ভাত তুলে দিতে পারেনি। পারেনি গায়ে পরার জন্য একটি খুব সাধারণ জামা কিনে দিতে। খালি গায়ে, খালি পায়ে যাদের দিন কাটে। সেই শিশুদের তলিয়ে যেতে হয় নদীর ভয়াল করাল গ্রাসে। হায় প্রভু, এরাও যে মানুষ, এদের দয়া কর।

রাত অনেক হয়েছে। লোক চলাচলও বন্ধ হয়েছে। তাই গোবিন্দ এবার বাড়িতে যায়। বাড়ির বাইরে তার দিদি সুবালা মাটিতে বসে আছে। গোবিন্দ বলে, দিদি তুই এত রাইতে আমার জন্যে বাইরে বইয়া থাকিছ না তো। আমার তো রাইত অইবই। পত্যেক দিনই রাইত অইব।

সুবালার চোখে পানি। কপালে চিন্তার রেখা। সে কেঁদে বলে, ভাইরে, মা বাজারে গেছে আর তো ফিরা আইলো না।

মায়ের বাজারে যাওনের দরকার অইল ক্যান ?

মায় কয়ডা মাছ ধরছে তাই লইয়া...

তাই ব্যাচার জন্যে মাইরে তুই বাজারে পাঠাইলি। মাইরে আমি বাজারে যাইতে দেই না। তার শরীলডা খুব খারাপ। দিদি আইজ মার যদি কিছু অয় ? মার গায়ে জ্বর থাকে। মার একখান বড়োসড়ো অসুখ অইছে, আমি বুঝবার পারছি। কিন্তু ট্যাহা নাই তাই ডাক্তার দেখাইবার পারি নাই। মাগো, মা-। মা তুমি কই গ্যালা মা...।

গোবিন্দ ও সুবালা বাজারের মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে মাকে খুঁজতে থাকে। তারপর বাজারের পাশে একটি ঢালো জায়গায় গোবিন্দের মায়ের মৃত দেহ পাওয়া যায়।

পনের দিন পরের কথা। একদিন নদীর দিকে যাচ্ছিল গোবিন্দ। রাস্তায় কৃষ্ণকলি তাকে ডেকে দাঁড় করালো। বলল, গোবিন্দদা, আমি জানি তোমার মনের অবস্থা ভালো নাই। তয় আমিও বেজায় বিপদে আছি। তোমার লগে আমার কথা আছে।


গোবিন্দ গম্ভীর কণ্ঠে বলে- ক, কী কবি।

- বাবায় আমার বিয়ার জন্যে পাত্র খুঁজতাছে।

- তা আমি কী করুম, পাত্র খুঁজতাছে ভালা কতা। বিয়া কইরা শ্বউর ঘরে সুখে সংসার করবি।

- গোবিন্দদা, তুমি আমারে অমন কইরা কইতে পারলা ? আমি যে তোমারে ছাড়া অন্য কোনো মাইনষের সাথে সংসার করবার পারুম না। আমি তোমারে ছাড়া বাঁচুম না।

- কৃষ্ণকলি মন খারাপ করিছ না। আমার ভাগ্যে বিয়া, সংসার ওসব কিছুই নাইরে। দুঃখ করিছ না। খুরু মশাই তোর বালর জন্যই চিন্তা করতাছে। তুই আমারে ভুইলা যারে কৃষ্ণকলি। আমার মত কুলাঙ্গাররে আর ভালোবাসিস না কলি, ভুইলা যা, আমারে ভুইলা যা।

কাঁধের গামছা দিয়ে চোখ মুছে দ্রæত পায়ে হেঁটে যায় গোবিন্দ। কৃষ্ণকলি মাটিতে বসে পড়ে। বিলাপ করে কাঁদে। ওরাও যে মানুষ ওদেরও মন আছে। তাই ওরাও ভালোবাসে প্রিয়জনের সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে।

কেটে যায় বেশ কিছু বছর। বদলে যায় অনেক কিছু। গোবিন্দর দিদি সুবালার যক্ষা হয়। কিছুদিন রোগে ভুগে তারপর একদিন মারা যায়। তার কিছুদিন পর গোবিন্দ অনেক রাতে খেয়া পাড় করতে গিয়ে ভয় পায়। সে দেখতে পায় তার নৌকায় একজন মানুষ উঠেছে, কিন্তু তার পা দেখা যাচ্ছে না। সে খুব ভয় পেয়ে যায়। এটা গোবিন্দর চোখের ভুল কি না কেউ তা জানে না। তবে সে ভয় পেয়েছিল। দৌড়ে বাড়িতে যায়। কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়ে। গায়ে ভীষণ জ্বর ওঠে। সাত দিন জ্বরে ভোগে। তারপর গ্রামের একজন তার খোঁজ নিতে গিয়ে দেখে সে মরে পড়ে আছে। হ

লেখক : গল্পকার

অলঙ্করণ : মনিরুজ্জামান পলাশ