দ্য ম্যানিপুলেটর-কানিজ পারিজাত

12 Apr 2023, 02:08 PM সাহিত্যভুবন শেয়ার:
দ্য ম্যানিপুলেটর-কানিজ পারিজাত


হালকা একটা ধাক্কা। ধাক্কার সাথে সাথেই বুকের নিচ থেকে নাভি বরাবর লম্বাভাবে পাক দেওয়া এক মোচড়। মোচড়টা অদ্ভুত এক শিরশিরে অনুভূতি হয়ে ছড়িয়ে পড়ে শরীরের মধ্যভাগে। ডাক্তার মারুফের মনে হয় তিনি যেন ফিরে গেছেন আগে, বহু আগে- বসে আছেন চলন্ত বাসের সামনের দিকের সিটে- গন্তব্য চিতাখোলা। বাস ছুটে চলেছে সরু পিচঢালা পথ বেয়ে- দুই পাশে সারি-সারি গাছপালা, ছোটো ছোটো ঘরবাড়ি, মাঠ, পুকুর সব সরে সরে যাচ্ছে- ছুটে চলা রাস্তায় একটু পরপর ছোটো বড়ো কালভার্ট আর ব্রিজ- ব্রিজে ওঠা আর নামার সময়ের ব্যবধান খুবই অল্প, ব্যাপারটা ঘটত বাস ব্রিজ থেকে নামার সময়- অদ্ভুত একটা অনুভূতি আসত- ঠিক নাভি বরাবর একটা খিচটান- তারপরই কেমন এক সুখ সুখ অনুভূতি। জীবনে বহুবার এমন সুখ সুখ অনুভূতির মুখোমুখি হয়েছেন ডাক্তার মারুফ। তবে আজ পরিস্থিতি ভিন্ন। তিনি আর চলন্ত বাসের সামনের সিটে বসা নেই। দাঁড়িয়ে আছেন কাচের দরজার সামনে, ছোট্ট প্যাসেজে। প্যাসেজের ঠিক শেষ মাথায় কাচ দিয়ে ঘেরা বেশ বড়সড়ো ঘর, জসিম ভাই দারুণ এক নাম দিয়েছে ঘরটার, ‘যন্তর মন্তর ঘর’- মাঝে মাঝেই ‘যন্তর মন্তর ঘরে’ রাউন্ডে ঢুকতে হয় ডাক্তার মারুফকে। আজও ঢুকতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ঢোকার মুখেই ঘটলো ঘটনাটা, চোখ গিয়ে পড়ল দূরে সারিবদ্ধ করে রাখা সোফার দিকে, তারপরেই একটা ধাক্কা, ধাক্কাটা বুকের নিচ থেকে নাভি বরাবর লম্বা একটা পাঁক দিয়ে মোচড় দিয়ে উঠতেই, ডাক্তার মারুফ অনুভব করলেন পুরনো সেই টান, খিচটান, তারপরই সেই সুখ সুখ অনুভূতি। 

সুখ সুখ অনুভূতির আবেশে বুঁদ হয়ে আছেন ডাক্তার মারুফ। ‘যন্তর মন্তর ঘরের’ কোনো কিছুতেই ঠিকমতো মন দিতে পারলেন না, বের হয়ে এসে দ্রুত পা বাড়ালেন লিফটের দিকে- গন্তব্য পাঁচ তলায় নিজের রুম। সুখ সুখ অনুভূতিটা এবার নাভি থেকে পাক দিয়ে উঠছে বুকের দিকে, কেমন এক ছন্দোময় গতিতে বিট করছে যেন ! লিফটে ঢুকেই অনুভূতিটা বদলে গেল ডাক্তার মারুফের। মুরগি বাজারে খাঁচায় ঠাসা মুরগিগুলোর মতোই একদল মানুষে ঠাসা লিফট- হুইল চেয়ারে বসা রোগী, উদ্বিগ্ন স্বজন, ব্রাদার, ক্লিনার, ফুড সার্ভিসের লোক- পাঁচমিশালি মাথাগুলো ডাক্তার মারুফের ঘাড়ে কাঁধে পিঠে গরম নিঃশ্বাস ফেলছে যেন ! মানুষের গা থেকে আসা উৎকট গন্ধ মাস্ক ভেদ করেও যেন ঢুকে যাচ্ছে ডাক্তার মারুফের নাকে, কোনোরকমে ভিড় ঠেলে লিফট থেকে বেরিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন তিনি। কয়েক পা এগিয়ে করিডোরের খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে মাস্ক নামিয়ে প্রাণভরে শ্বাস নিলেন আর তখনই অনুভব করলেন লিফটের পাঁচমিশালি জটলা আর মনুষ্য শরীরের যৌথসন্ধির গন্ধে উবে গেছে সেই অনুভূতি, সুখ সুখ অনুভূতি- কর্পূরের মতোই। হঠাৎ খেয়াল হলো, আরো একজন লিফটে চড়েই আসবে, মেজাজটা সত্যি বিগড়ে গেল তার। সব রাগ গিয়ে পড়ল জসিম ভাই-এর ওপর, নাহ ! এইবার জসিম ভাইকে ধরতেই হবে, এত ছ্যাঁচড়ামি ভালো নয়, এটলিস্ট নিজেদের জন্যে তো আলাদা একটা লিফটের ব্যবস্থা করবে !

লম্বা করিডোরের শেষ মাথায় ডাক্তার মারুফের রুম, রুমে ঢুকতে ঢুকতেই টেবিলে রাখা ফোনটা বেজে উঠল। ডক্টরস রুমের নাম্বার- নির্ঘাত ডাক্তার সুজনের ফোন ! গত তিন মাসে বেশিরভাগ ফোনই ছিল ডাক্তার সুজনের। জুনিয়র এই ছেলেটার স্বভাব ভানুর কৌতুকের সেই লোকটার মতো- ট্রেনে ভ্রমণের সময় বারবার নিষেধ সত্তে¡ও যে চেইন টেনে টেনে ট্রেন থামিয়ে দেয়, তারপর চেকার এসে ধরলেই বলে, ‘আমি, আমি টান দিয়া ফালাইছি’ !

চাপা বিরক্তি নিয়ে ফোন ধরেন ডা. মারুফ।

- হ্যাঁ বলো সুজন।

- স্যার, জসিম স্যার আপনাকে ফাইলটা রেডি করতে বলেছে।

- কোনটা ?

- স্যার, ওই যে গত মাসেরটা

- কোনটা ? যেইটার পার্টি গরম ?

- জ্বি স্যার।

- ফাইল তো রেডিই আছে-

স্বস্তির হাসি হাসে সুজন।

- এইজন্যেই তো জসিম স্যার আপনাকে এত পছন্দ করে, আপনি স্যার অতুলনীয় !

ছেলেটার আলগা তেলতেলে কথায় বিরক্ত ডা. মারুফ গম্ভীর কণ্ঠে বলেন,

- আর কিছু ?

- স্যার ডেট পড়েছে, ওরা ডেকেছে।

- কবে ?

- পরশুদিন, সকাল দশটায়, আপনি থাকলে স্যার কোনো চিন্তা নেই, বোঝেন তো, আমি কিছুই তো বলতে পারব না, খুব টেনশনে আছি...

তাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ফোনটা কেটে দেয় ডাক্তার মারুফ। আগন্তুকের আসার সময় হয়ে গেছে। উত্তেজনায় ঢিপঢিপ করে ওঠে বুকটা- টেবিলে রাখা একটা ব্রাউন কালারের ছোট্ট মূর্তি- মানুষের অবয়ব। হাতটা বাড়িয়ে দেন ডা. মারুফ- তর্জনী দিয়ে অবয়বটার শরীরের মধ্যভাগ থেকে আঙুলটা লম্বভাবে টেনে আনেন ঠিক নাভির কাছে, চাপা উত্তেজনা বোধ করছেন ডাক্তার মারুফ, সুখ সুখ অনুভূতিটা ফিরে আসছে আবার- নাভি বরাবর !


একটি চারকোণা লম্বা টেবিলের এক প্রান্তে দুইজন সঙ্গীসহ বসে আছেন ডাক্তার মারুফ। বেশ নরম সকাল, সঙ্গী দুইজন উদ্বিগ্ন হলেও, ডাক্তার মারুফের মুড বেশ চনমনে। গত পরশু প্রথমে দেখলেন সোফায়, তারপরই সেই আগন্তুক এসেছিল রুমে। আহা ! যেন অনেক দিনের পুরনো সিন্দুক খুলে পুরনো কাপড়ের মিষ্টি সুবাস এসে লাগল নাকে ! সেই থেকে ফুরফুরে মেজাজে ডাক্তার মারুফ, বড্ড ফুরফুরে।

রুমটা বেশ বড়ো, হলরুমের মতো। খুব সম্ভবত সেমিনার কক্ষ। এ ধরনের কেইস নিয়ে এর আগেও বসতে হয়েছে, তবে এই রুমে এটাই প্রথম। প্রথম হলেও কোনো অস্বস্তি নেই ডাক্তার মারুফের মনে। এখানকার অলিগলি, ঘুপচি পথ, কানাগলি- সবই তার মুখস্থ আর আটকে গেলেও ভয় নেই, লুপহোলটা জানাই আছে !

উদ্বিগ্ন দুই সঙ্গীর একজন খুবই অস্থির- ডাক্তার ফারুকী। জিএম ফারুকী। নারীপ্রীতি থাকা, পোশাকে টিপটপ, স্বভাবে তঞ্চক, ঠান্ডা মাথার ষাটোর্ধ্ব প্রফেসর- আজ মাথাটা একটু বেশিই গরম- ইমেজের প্রশ্ন ! ইমেজ নিয়ে লোকটা এতই সচেতন, একটু পরপরই ফিসফিস করছেন ডাক্তার মারুফের কানে ! রুমটা এতই নীরব, ফিসফিস কথাও যেন শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। অবশ্য ডাক্তার মারুফের ফিসফিস করার প্রয়োজন নেই, জিএম ফারুকীর আছে। তিনি একটু পরপর টেবিলের নিচে ডা. মারুফের হাতে হাত রেখে বলছেন, ‘ইউ নো অ্যাবাউট মাই প্রেস্টিজ, প্লিজ সেইভ মি, বোঝোই তো, একটু এদিক-ওদিক হলেই আমার প্রেস্টিজ পাংচার হয়ে যাবে’ ! প্রেস্টিজ নিয়ে অতি সচেতন সতর্ক লোকটা এবার কেঁচেছেন ভালোই !

- ‘দেখো ভাই ,আমি কিন্তু কিছুই বলব না, বলব এখানে- এই ফাইলে সব লেখা আছে, আমি ডিপোজিট করে যাচ্ছি’।

হাসি পায় ডাক্তার মারুফের। বলবে কি করে ? ওনার তত্ত¡াবধানে থাকলেও, উনি তো আসলে দেখেনইনি। তাই কিছুই জানেন না। আর সংশ্লিষ্ট না হয়েও মাইনাস- প্লাসের কাজটা ডাক্তার মারুফকেই করতে হয় প্রতিবার। এবারও ফাইলটা তিনিই প্রস্তুত করে এনেছেন।

বেয়ারা এসে কফি দিয়ে যায় তিনজনের। একটু পরেই যেন পুলসিরাতে উঠবেন, পার হতে অসুবিধা যেন না হয়, তাই ডা. ফারুকী আরো একবার চাপা স্বরে ফিসফিস করে ওঠেন,

‘ওকে কিন্তু কিছুই বলতে দিও না, সব গুবলেট করে দেবে! ডুবিয়ে দেবে আমাকে’! তারপর দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে বলে ওঠেন, ‘স্ক্রাউন্ডেল একটা’- কথাটা ডাক্তার সুজনের উদ্দেশ্যে। একই গাড়িতে এসেছেন তিনজন, ডাক্তার ফারুকীর নতুন কেনা গাড়িতে। আসার পথে এই কেইসে তার টিমের ডাক্তার সুজনকে এভাবেই বহুবার ধমকে উঠেছেন ডাক্তার ফারুকী। সুজনও আসন্ন বিপদের গভীরতা আঁচ করতে পেরে মুখে কুলুপ এঁটে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। তার দিকে তাকিয়ে আবারো কৌতুকের হাসি পায় ডাক্তার মারুফের। ছেলেটা প্রাইভেট মেডিকেল পাস- সবকিছুতেই ভাব দেখায় সব জানে, সব পারে, কিন্তু আদতে সে কিছুই জানে না, কিছুই পারে না। শুধু পারে শিকারের শরীরে মুখ লাগিয়ে, রক্ত চুষে টুক করে খসে পড়তে- জোঁকের মতো। অবশ্য এদের মতো না জানা, অল্প জানাদের নিয়েই তো জসিম ভাইয়ের কারবার, জমজমাট কারবার- আর সেই কারবারের প্রধান ট্রাম্প কার্ড ডাক্তার মারুফ ! ওদের অজ্ঞতাই জসিম ভাইয়ের কাছে ডাক্তার মারুফের গ্রহণযোগ্যতা, ওদের দুর্বলতাই ডাক্তার মারুফের শক্তি !

রুমের দরজাটা খুলে গেল, দুজন নারী ঢুকলেন। দুজনেরই মুখ থমথমে, শক্ত, কঠিন- অভিযোগকারী- এই কেইসের অভিযোগকারী ও তার সঙ্গী। তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি হয় ডাক্তার মারুফের। মুখ থমথমে হলেও চোখে আগুন, শোকের আগুন। চোখ যত নরম আর ভিজে উঠবে, শোকের তীব্রতা তত কমে আসবে- সেই পার্টি তত তাড়াতাড়ি দুর্বল হবে- আবেগ মানুষকে পরাজিত করে দেয়। ভেতরে আগুন জিইয়ে রাখা পার্টিকে দুর্বল করা বেশ কঠিন- সুজন ঠিকই বলেছে, পার্টি আসলেই গরম !

দরজা খুলে আরো দুইজন ঢুকলেন- তদন্তকারী কর্মকর্তা। স্বাগত কথার পর কমিটির প্রধান প্রথমে বলার সুযোগ দিলেন অভিযোগকারী নারীকে, কথা বলতে শুরু করেছে নারীটি- ভিকটিমের মা !

বেশ গুছিয়ে কথা বলছে নারীটি- ধীরস্থির শান্তভাবে। লক্ষণটা ভালো নয়। এইসব কেইসে সাধারণত ভিকটিমের স্বজন আবেগে ফেটে পড়ে, ভেঙে টুকরো টুকরো হয়, আবেগ তাদের লক্ষ্যভ্রষ্ট করে দেয়, টু দ্য পয়েন্টে কথা না বলে সরে আসে দূরে- বহু দূরে- তখনই তাদের ভুল হয়, পরাজিত হয় তারা। আসলে দুর্বল মানুষকে ভেঙে দেওয়া খুব সহজ। তবে এক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। অভিযোগকারী ননমেডিকেল পারসন হয়েও মেডিকেল টার্মগুলো বুঝেই কথা বলছে। তার মানে প্রস্তুত হয়েই এসেছে। কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে ডাক্তার মারুফের।

বক্তব্যের শেষ দিকে নারীটি-

- ‘আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে, উনি, ডাক্তার ফারুকী, অবহেলা করে আমার ছেলেকে ধাপে-ধাপে মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে গেছেন! আমার ১৩ বছরের তরতাজা ছেলে ডেঙ্গুজ্বরের ৪৮ ঘন্টা পূর্ণ হবার আগেই, সাবধানতার জন্যই ভর্তি করেছিলাম, বাসায় রাখলেও ফ্লুইড পেতো, কিছুই হতো না, উনি যে ভর্তি রোগীর প্রতি এতটা অমনোযোগী তা তো জানতাম না ! একজন প্রফেসর হয়েও উনি কি জানেন না, ডেঙ্গু রোগীর জীবন রক্ষাকারী একমাত্র উপাদান ফ্লুইড ! উনি মুখে সব তরল বন্ধ করে দিলেন ! আর ভেইনে ফ্লুয়িড দিলেন খুবই কম- ৫ ফিট ৭ ইঞ্চির বেশি লম্বা সবল ছেলে আমার- ২৪ ঘণ্টায় ভেইনে দিলেন মাত্র এক লিটার, মুখেও সব তরল বন্ধ ! দুই দিনে ৪৮ ঘণ্টায় কেবিনে মাত্র ২ লিটার দিয়ে ডিহাইড্রেটেড করে আমার ছেলেকে প্লাজমা লিকেজ করে কেবিনেই শকে নিয়ে গেছেন ! যখন বিপদ চিহ্নগুলো দেখা গেছে- রক্তের ঘনত্ব বেড়েছে, প্লাটিলেট অনেক নেমে গেছে, চামড়ার নিচে রক্তের বৃত্ত দেখা গেছে, মুখে, মাড়িতে রক্ত এসেছে, হার্টবিট বেড়ে ১৭২ হয়েছে, বারবার জানিয়েছি, না উনি আমলে নিয়েছেন, না ওনার টিম কোনো রেসপন্স করেছে, উনি তো আসেনইনি, সারাদিন চেম্বারে ব্যস্ত ছিলেন, আমার ছেলের রিপোর্ট পর্যন্ত দেখেননি, টিমের উপর ছেড়ে দিয়ে রেখেছেন, একের পর এক ভুল জমা করে, গোল্ডেন আওয়ার মিস করে আমার ছেলের মৃত্যু ঘটিয়েছেন ! ওনার দুই দিনের উন্নাসিকতা উনি ট্রান্সফার করেছেন আইসিইউ-তে, তারপর নিজের ইমেজ বাঁচাতে গা ঢাকা দিয়েছেন। এমনকি আইসিইউতে আমাকে সত্য না জানিয়ে বিভ্রান্ত করে রেখেছেন, উনি ইচ্ছে করেই কেবিনে ডেটরিয়েট করেছেন, যাতে আইসিইউ-তে নিয়ে বিল বাড়ানো যায়। ওনার ইলমোটিভের জন্যই আমার তরতাজা ছেলের এমন নির্মম মৃত্যু হয়েছে, আমি এই অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই!’

এক টানে কথাগুলো বলে লম্বা একটা শ্বাস নেয় নারীটি। চাপ চাপ অস্বস্তি হচ্ছে ডাক্তার মারুফের, ফারুকী ভাই বেশ ভালোই ফেঁসেছেন এইবার ! তবে মারুফ যা ভেবেছিল, ডাক্তার ফারুকী তার চেয়েও বেশি সেয়ানা। বক্তব্যের সময় ডাক্তার ফারুকী লম্বা এক স্পিচ দিলেন- অপ্রাসঙ্গিক তবে ইমোশনাল। টু দ্য পয়েন্টে আর যেতে হলো না তাকে, কমিটিকে দিকভ্রান্ত করে দিলেন। আর শেষে যে কথাটা বললেন, তার জন্য ডাক্তার মারুফ নিজেও প্রস্তুত ছিলেন না- তরতাজা সুস্থ ছেলেটাকে নন মেডিকেল পারসন টিমের কর্মকর্তাদের সামনে বিরল রোগী সাজিয়ে দিলেন !

নাহ্, এইজন্যই সবাই বলে ফারুকী ভাই চিকন বুদ্ধির লোক, অচিরেই রাজনীতিতে নাম লেখাতে যাচ্ছেন !

চিৎকার করে ওঠে অভিযোগকারী- ‘ইউ লায়ার, এত বড়ো বাটপারি ! আমার ছেলেকে অবহেলা করে মেরে ফেলে এখন মিথ্যা বলছেন !

আমার তরতাজা সুস্থ ছেলেকে বিরল সাজাতে চাইছেন! প্রমাণ করে দেবো, প্রতিটা ধাপে ধাপে নিজের ঝুড়িঝুড়ি মিথ্যা তখন গিলতে পারবেন তো ? ইউ কিলার’ !

দুপুর ছুঁই-ছুঁই। ফারুকী ভাইয়ের কালো রঙের গাড়িটি অপেক্ষাতেই ছিল। নতুন কিনেছেন গাড়িটি, দামি ব্রান্ডের এস ইউ ভি, সানরুফ মুনরুফ দুটোই আছে। ফিরছেন তিনজন- পেছনের সিটে ডাক্তার মারুফ আর ডাক্তার ফারুকী, সামনের সিটে ডাক্তার সুজন। তিনজনই চুপচাপ, গম্ভীর। কানে লেগে আছে অভিযোগ কারীর শেষ কথাগুলো, ‘আই হ্যাভ লস্ট মাই বেবি, আই হ্যাভ লস্ট মাই বেবি, আই হ্যাভ এভিডেন্স, আই উইল রান আফটার ইউ, আই উইল প্রæফ ইউর অফেন্স- ইউ কিলার’!!

নীরবতা ভেঙে ডাক্তার মারুফই প্রথম কথা বলে ওঠেন, ‘এত নিশ্চিত হয়ে এক লিটার বলছে কীভাবে ? ৫ ফিট ৭ ইঞ্চি উচ্চতার স্বাস্থ্যবান মানুষের জন্য এক লিটার তো অনেক কম, ভুলের মাত্রাটা তো একটু বেশিই হয়ে গেছে !’

ডাক্তার ফারুকী এবার সমর্পিত হন ডাক্তার মারুফ-এর কাছে, ‘দেখো, আমার একটা সেমিনার ছিল, চেম্বারে বেশ রোগীও ছিল, ওগুলো নিয়ে একটু ব্যস্ত ছিলাম- আর তাছাড়া আমি তো ওকে বলেই ছিলাম দেখতে, ওই স্ক্রাউন্ডেলটা ...’

ডাক্তার সুজন মুখ খুলে মিন-মিন করে বলে ওঠে

‘স্যার আপনি এত বিজি, কথা বলা যায় না, আর তাছাড়া আপনি আর জসিম স্যার তো বলেন, রোগী পেলেই একটু ইয়ে করে ... ইয়েতে যেন পাঠাই... তাই ..’

- শাট্আপ!

চিকন স্বর বদলে গেছে ডাক্তার ফারুকীর, সুজনকে ধমকানো শেষে গলাটা একটু নামিয়ে ডাক্তার মারুফের হাত ধরে বলেন, ‘তোমার তো এখানে লিঙ্ক আছে, কমিটিতেও চেনা আছে, আর তাছাড়া হ্যাপিএইডে’র সব ঝামেলা তুমিই তো সামলাও, সব পাজল তুমিই তো সলভ করো, আই নো ইউ আর দ্য বেস্ট ! দ্য গ্রেট ম্যানিপুলেটর !’

হ্যাঁ, ম্যানিপুলেটরই বটে, এই একটা গুণই ডাক্তার মারুফকে নিয়ে এসেছে এতদূর। তার ম্যানিপুলেশন প্রতিভার প্রথম হাতে খড়ি হয়েছিল ছেঁড়া নোট জোড়া দিয়ে। টুকরো টুকরো হওয়া পরিত্যক্ত ছেঁড়া নোট বললা ফলের আঠা দিয়ে জোড়া মেরে নিখুঁত বানিয়ে সেই টাকায় ছেলেবেলায় কটকটি কিনে নিজে খেয়ে, বন্ধুদেরও খাইয়েছিল মারুফ।

সেই শুরু। সেই গুণের আরো অভিনব শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে স্কুলে- কলেজে- কর্মস্থলে।

হ্যাপিএইড ডাক্তার মারুফের কর্মস্থল- জসিম ভাইয়ের হসপিটাল। পঞ্চাশোর্ধ ডাক্তার মারুফ এখানে যোগ দিয়েছেন প্রায় পাঁচ বছরের বেশি। এখানে আসার আগে আরো কয়েকটি ঘাটে তরী ভিড়িয়েছিলেন, তবে ঝলসে উঠতে পারেননি, তরীও ভরে ওঠেনি ফসলে। তবে জসিম ভাইয়ের এখানে এসে ঝলসে উঠেছেন, তরীও ভরে উঠেছে সোনার ফসলে। ডাক্তার মারুফ বুঝেছেন জসিম ভাইয়ের ভাষা, আর জসিম ভাই বুঝেছেন ডাক্তার মারুফের ভাষা। দিয়েছেন বড়ো পদ- হ্যাপিএইডের মেডিকেল ডিরেক্টর।

হঠাৎ ডাক্তার মারুফের চোখ পড়ে ডাক্তার ফারুকীর নতুন কেনা গাড়িটির দিকে, এই কেইসে ফ্যামিলিসহ ১৫ দিনের সুইজারল্যান্ড ট্রিপ আর শপিং খুবই কম হয়ে যায়, ফারুকী ভাইকে হাতটা আর একটু খুলতে হবে !

গাড়ির ছাদটা খুলে দিয়েছেন ডাক্তার ফারুকী। হাঁসফাঁস লাগছে মনে হয়। খোলা বাতাসের সাথে রোদের তাপ এসে লাগছে, খনখনে রোদের দুপুর- খুনে দুপুর !

এমনই এক খুনে দুপুরে খুন হয়েছিল মারুফ- এক উদ্ভিন্ন যৌবনার কাছে- শিলা- সেদিনের আগন্তুক !


শিলাদের বাড়িটা চিতাখোলা বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে কয়েক গজ পশ্চিমে। সবুজ গাছপালা দিয়ে ঘেরা শান বাঁধানো পুকুরঘাটওয়ালা বাড়িটা ‘মৃধা বাড়ি’ নামেই সবাই চিনত। অসংখ্য দুপুর কেটেছে মারুফের ‘মৃধা বাড়ির ঘাটে’।

শিলার ভাই আজাদ তার স্কুল-কলেজের বন্ধু। স্কুল থেকেই মারুফ বন্ধু মহলে বেশ জনপ্রিয়, তার ‘বিশেষ প্রতিভার জন্য’। অর্ধেকটা শিখে, বাকি অর্ধেকটা টুকে অল্প পরিশ্রমেই পাশ করে যেত মারুফ, ভালোভাবে। শুধু নিজেই টুকতো না, বন্ধুদেরও টোকার ব্যবস্থা করে দিত। আর তাই তো বন্ধু মহলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা তার। কখনো স্কেলে কখনও-বা ক্যালকুলেটরের কাভারের উল্টো পিঠে পেন্সিল দিয়ে ‘গণিত সূত্র’ লিখে, আবার কখনো বাথরুমের ভেন্টিলেটরের নিচে ইট চাপা দিয়ে বিজ্ঞান বা ইংরেজির নোট রেখে আসত মারুফ, নিজের জন্য- উত্তরসূরির জন্য।

এখনকার মতোই সাদামাটা চেহারা ছিল মারুফের। মুখে কখনোই ভাব ফুটে উঠত না- তাই তো শিক্ষক বা পরীক্ষকের সন্দেহের সীমারেখা অতিক্রম করে যেত অনায়াসে। অন্যরা পরীক্ষা চলাকালীন একাধিকবার বাথরুমে যাওয়ার সুযোগ না পেলেও, মারুফ পেত। আর তাই তো ফার্স্টবেঞ্চারদের অবিরাম খাটুনির ফল ৯৭ হলে মিডলবেঞ্চার মারুফেরও সবিরাম খাটুনির ফল হতো ৮২। তারপর বেশ জমিয়ে ফল লাভের ফল আস্বাদন করত বন্ধু মহলের জনপ্রিয় মারুফ।

জনপ্রিয়তার স্রোত বেয়েই বন্ধু আজাদের বাড়িতে প্রবেশ ঘটে মারুফের। আজাদের খালাতো ভাই কাউসার, দুইবার ম্যাট্রিক ফেল। মারুফের উপর দায়িত্ব পড়ে, এইবার, ৩য় বার তাকে পাস করানোর।

কলেজ পড়ুয়া মারুফ যখন মৃধা বাড়ির ঘাটে আজাদের খালাতো ভাইয়ের জন্য ‘হরলাল রায়ে’র রচনা বই ফালিফালি করে কাটছিল, ঠিক তখনই ছুটে আসে শিলা- আজাদের ছোটো বোন। মারুফের থেকে বছর পাঁচেক ছোটো, স্কুল পড়ুয়া মেয়েটা বেয়ে ওঠা লতার মতোই বেড়ে উঠেছে তর-তর। কী যেন আছে তার সৌন্দর্যে- খুব ফর্সা নয়, আবার শ্যামাও নয়, কেমন যেন বরুণ ফুলের মতই অদ্ভুত এক আভা-মাখা সৌন্দর্য- আঠার মতোই চোখটা লেগে যায় সেই উদ্ভিন্ন যৌবনার দিকে ! মারুফেরও চোখটা লেগে গেল শিলার দিকে।

মারুফ তখন উঠেপড়ে লেগে যায়- শিলার খালাতো ভাইকে পাস করাতেই হবে- প্রতিদিন যায়- মৃধা বাড়ির ঘাটে।

বই দাগায়- বই কাটে- ফালি-ফালি করে বই কাটে- মৃধা বাড়ির ঘাটে।

শিলাও ছুটে আসে বারবার- সাজি হাতে- মুড়ি হাতে- ফালি-ফালি করে কাটা নারকেল হাতে ।

কাউসার পাস করতে পারে না, তবে মারুফের জায়গাটা পোক্ত হয়ে যায় মৃধা বাড়ির ঘাটে। এমনই এক পোক্তদিনে দুপুরবেলা ছুটে আসে শিলা, পরনে শাড়ি- গোলাপি জর্জেট শাড়ি- বিকেলে স্কুলে নাচ করবে সে। সে চায় ফুল, চুলে লাগানোর ফুল- চালতা গাছের সাদা-সাদা ফুল। গাছে উঠে পড়ে মারুফ। ডাল ধরে ঝাঁকি দেয়- ফুল পড়ে- কুড়ায় শিলা। আঁচলে তুলে, হাত তুলে আবারো দেখায় নিশানা, ঠিক তখনই ঘটে ঘটনাটা। মারুফ দেখে- শিলার আঁচল গেছে সরে- ভেসে উঠেছে নাভি- পদ্ম ফুলের মতোই প্যাঁচানো- পদ্মনাভি !

সেদিকে তাকিয়ে কেমন একটা নাড়া খায় মারুফ, শরীরের মধ্যভাগে টান অনুভব করে, মোচড় দেওয়া টান- নাভির কাছে অদ্ভুত এক শিহরণ ! সেদিন সেই খনখনে রোদের দুপুরে শিলা ছোটে নাচের অনুষ্ঠানে- ‘উহুম না উহুম না, চতুর্দোলায় চড়ে

দেখো ওই বধূ যায়,

স্বপ্ন সুখে তার চোখ দুটো যায় উছালায়’- এই গানের সাথে নাচতে।

আর মারুফ ছোটে, স্বপ্ন চোখে, ভাবালু মুখে- বাজারের কোণায় বটগাছটার নিচে বসা দাড়িওয়ালা লোকটার কাছে। চড়া মূল্যে কিনে নেয় সে পাটাতনের নিচে লুকানো বই- ‘সেলিনার গোপন কথা’, ‘গোপনীয় অপ্রকাশ্য’, ‘যৌবন তরঙ্গ’- ছবি দেওয়া দেওয়া, গোপন-গোপন কথা লেখা- গোপনীয় সব বই।

সেই খনখনে রোদের খুনে দুপুরেই খুন হয়েছিল মারুফ- শিলার কাছে- পদ্মনাভির কাছে !

- রোগী কি আপনার বেয়াই লাগে নাকি ?

- ইউ ডেভিল, হাউ ডেয়ার ইউ আটার দিস টাইপ অব ওয়ার্ডস ! আই এম আ ডক্টর হু ইজ কমিটেড টু হিজ পেসেন্ট’স, আমার প্রায় সুস্থ হওয়া রোগীকে মেরে ফেলে এখন ফাউল কথা বলা হচ্ছে !

উচ্চতর্কের এক ঝড়ের মধ্যেই জসিম ভাইয়ের রুমে ঢোকে ডাক্তার মারুফ। এক পাশে খোলা ছাদসহ এই রুম হ্যাপিএইডের সাত তলায়। জসিম ভাই এখানেই অফিস করেন- হাওয়া খান- মাঝে মধ্যে ভিন্ন হাওয়াও খান !

তর্কটা হচ্ছে ডাক্তার তৌফিক জামান ও ডাক্তার ওদুদের মধ্যে। ডাক্তার তৌফিক নীতিবান- রোগীদের প্রতি নিবেদিত প্রাণ- সিনিয়র প্রফেসর ! দুই দিনের জরুরি কাজে বাইরে যেতে হওয়ায় ডাক্তার ওদুদকে কেবিনে থাকা তার রোগীর দায়িত্ব দিয়ে যান। ফিরে এসে দেখেন ‘যন্তর মন্তর ঘরে’ তার রোগী- মারা গেছে !

ঘাড়মোটা ডাক্তার ওদুদ বেশি কিছু বলছেন না- মাঝেমধ্যে দুই একটা বাক্য ব্যবহার করছেন আর তাতে জিহŸা নিঃসৃত জিংক মিশিয়ে দিচ্ছেন, উদ্দেশ্য- ডাক্তার তৌফিককে বিরক্ত ও ক্লান্ত করে থামিয়ে দেওয়া। তবে বরাবরের মতোই তেজী ডাক্তার তৌফিক, দমার পাত্র একেবারেই নন- উচ্চস্বরে ধমকে যাচ্ছেন ডাক্তার ওদুদকে, বাকিদেরকেও।

সৎ মানুষের বুকে ও গলায় জোর থাকে বেশি, সব সময়ই।

এমনিতেও ডাক্তার তৌফিকের সামনে সবাই চুপ করেই থাকে। হ্যাপিএইডের সবচেয়ে প্রাচীন, সৎ, নিষ্ঠাবান, রোগীদের কাছে খুবই জনপ্রিয় প্রফেসর ডাক্তার তৌফিক। দিন রাতের হিসাব মাপেন না। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রোগীর হাত ধরে থাকেন।

- ‘আমার রোগী কি আইসিইউ-তে পাঠানোর মতো ছিল ? ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতি- এটা কি আইসিইউ পর্যন্ত টেনে নেবার মতো ইস্যু ছিল ? আনসার মি !’

ডাক্তার ওদুদ চুপ। চুপ হয়ে আছেন ডাক্তার ফারুকী, ডাক্তার জিয়া, ডাক্তার নিপা, ডাক্তার ইসরাত, ডাক্তার সুজন, ডাক্তার সোহাগ, ডাক্তার এশা।

সবাই চুপ থাকায় আরও যেন মেজাজ চড়ে যায় ডাক্তার তৌফিকের। প্রাইভেট মেডিকেল থেকে আসা কিছুই না জানা ডাক্তার নামধারী এই ডামিগুলো যদি আইসিইউ পর্যন্ত নিয়েও যায়, হোয়াট বলস ইউ ওয়্যার প্লেয়িং দেন ? ইউ আর এ ডক্টর, হ্যাভ ইউ ফরগটেন দ্য ওথস ?

উচ্চ তর্কালাপের মধ্যে মাঝেমধ্যেই নিজের কান মিউট করে নিচ্ছেন ডাক্তার মারুফ, ভাবলেশহীন মুখে। ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে আছেন জসিম ভাইও। সকলের সাথে খিস্তি মুখে কথা বললেও কেন যেন ডাক্তার তৌফিককে দেখলেই জোঁকের মুখে নুন পড়ার মতোই চুপসে যান জসিম ভাই। সততার সামনে শঠতা দাঁড়াতে পারে না, হয়ত তাই।

বাতাসটা গুমোট হয়েছে দেখে ডাক্তার তৌফিককে শান্ত করতেই ডাক্তার ফারুকী চিকন গলায় বলে ওঠেন- ‘আপনি কিন্তু আমাদের কথা ভাবছেন না, উই অল আর বিলংস টু সেইম কমিউনিটি। যদি কোনো ভুল হয়েই যায় সেটা গোপন রাখতে হবে, কমিউনিটির বাইরে জানতে দেওয়াটা ঠিক হবে না।’

ভুরু উঁচু করে তাচ্ছিল্যের চোখে ডাক্তার ফারুকীর দিকে তাকান ডাক্তার তৌফিক-

‘হু ইজ টেলিং মি দিস ? আপনি ? গত ডিসেম্বরে ১৩ বছরের বাচ্চাটাকে ফ্লুইড না দিয়ে কেবিনেই শকে পাঠিয়ে দিয়ে গা ঢাকা দিয়েছিলেন, বাচ্চাটার নির্মম মৃত্যুর পর এতটুকুও অনুতপ্ত না হয়ে নিজের ইমেজ বাঁচাতে পয়সা ঢেলে যাচ্ছেন কলমের পেছনে, নয় কমিটির পেছনে ! শেইম অন ইউ, ম্যান ! শেইম !

- ‘ইউ আর অ্যাটাকিং মি পারসোনালি। দিস ইজ নট ফেয়ার’।

গলাটা মোটা করে বলে ডাক্তার ফারুকী।

চটে ওঠেন ডাক্তার তৌফিক,

- ‘অফকোর্স ! আই হ্যাভ দ্য রাইট, নিজেদের চিকিৎসায় তো সবসময় বিদেশেই ছোটেন, আর দেশের মানুষের ভরসা নিয়ে ছিনিমিনি খেলেন ! ইউ অল আর ট্রেইটরস’।

কানটা আবারও মিউট করে নিয়েছেন ডাক্তার মারুফ, অপ্রয়োজনীয় কথা দিয়ে কান ভরা ঠিক হবে না। রুমের কাচের দরজাটার বাইরে খোলা ছাদে সাজানো গাছগুলোর দিকে মন দিলেন।

উঠে দাঁড়িয়েছেন ডাক্তার তৌফিক, ‘জসিম ভাইয়ের উদ্দেশ্যে কড়া কথা বলছেন,

- ‘আপনি ব্যবসা করবেন ভালো কথা, তাই বলে এইভাবে মানুষ মেরে মেরে ? শুধু মুনাফার কথা চিন্তা করে করে দক্ষ ডাক্তার, নিউট্রিশনিস্ট, স্টাফ, নার্স সব ছাঁটাই করে দিয়েছেন, তার বদলে অল্প বেতনে পাওয়া যায় এমন সব ডামি ডাক্তার দিয়ে হসপিটাল ভরেছেন। সেবার মান এখন এতটাই নিচে নামিয়েছেন যে, হ্যাপিএইড এখন একটা মৃত্যুফাঁদ। আমি আর এই মৃত্যুফাঁদের সহযাত্রী হতে চাই না।’

কাচের দরজাটা ঠেলে বেরিয়েই যাচ্ছিলেন, হঠাৎ জ্বলন্ত চোখে তাকালেন ডাক্তার মারুফের দিকে, ‘আর আপনি, কাজটা খুবই জঘন্য করেছেন, আমার রোগীর রিপোর্ট, ফাইল সব বদলে দিয়েছেন ! এর জবাব আপনি পাবেন’।

তিনি বেরিয়ে যেতেই উপস্থিত সুধী একটা গুঞ্জন তুলল, তবে সেই গুঞ্জন থামিয়ে দিয়ে জসিম ভাই শুধু ডাক্তার মারুফকেই থাকতে বললেন। সবাই চলে গেলে ডাক্তার মারুফকে আস্তে আস্তে বললেন,

- ত্যাড়া টাইপ লোক ,বাইরে লিক আউট করে যদি, ব্যাপারটা খারাপ হবে, একটু দেখো’।

খোলা দরজা দিয়ে খোলা হাওয়া ঢুকছে, ফুরফুরে হাওয়ায় ফুরফুরে মারুফ শান্ত কণ্ঠে ধীরে-ধীরে বলেন,

‘কিছুই হবে না, সবই সরিয়ে ফেলেছি, ফাইল আমি নিজে সাজিয়েছি’।

জসিম ভাই আবারো চিন্তিত কণ্ঠে বলেন, ‘এখানে নাকি চেম্বার আর করবে না, উনার তো অনেক রোগী, টেস্ট কমে যাবে, ক্ষতি হবে তো’!

- ‘কিছুই ক্ষতি হবে না, একজন একা ব্যক্তি কখনোই প্রতিষ্ঠানকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না। রোগীরা বাইরে ওনাকে দেখালেও টেস্ট করতে এখানেই আসবে।’

ধীরে ধীরে বলেন ডাক্তার মারুফ।

প্রসন্ন হাসি ফোটে জসিম ভাইয়ের মুখে। ডাক্তার মারুফ এখানে যোগ দিয়ে বেশ কিছু বুদ্ধি দেন, তিনবেড বনাম তিনজন নার্স না করে তিনবেড বনাম একজন নার্স- ইনপুট কম দিয়ে আউটপুট বেশি পাওয়া- এমনই বেশ কিছু থিওরি দেন। তাতেই ধুমধুমার মুনাফা বেড়েছে জসিম ভাইয়ের, ডাক্তার মারুফেরও বেড়েছে পদ, বেড়েছে কদর।

কদর তার মৃধা বাড়িতেও ছিল, শিলার জন্য পড়া গুছিয়ে, নোট নিয়ে ছুটতো মারুফ। কেউ কিছু বুঝতো না। ভাবলেশহীন মারুফকে নিয়ে কেউ কিছু ভাবেওনি- না ‘মৃধাবাড়ি’র লোকজন, না শিলা ! শিলার পড়া গুছিয়ে দেয় মারুফ- গোছায় নিজেকেও! অল্প সময়ে মনে রাখার জন্য বানায় অভিনব সব ছড়া-

‘মুক্তির নানী তিতা’- মুক্তমধ্য অমরাবিন্যাসে- ‘নুনেশাক আর তুঁতে’

এমনই সব ছড়া বানিয়ে মনে রাখে জীববিজ্ঞান আর রসায়নের শত শত তথ্য, চান্স পায় মেডিকেলে- নিজেকে তৈরি করবে সে শিলার জন্য, ওই পদ্মনাভির জন্য।

শহরের হোস্টেল থেকে চিতাখোলার দিকে বাসে করে যাবার পথে প্রায়ই শিহরিত হতো মারুফ, স্বপ্ন দেখত, বিড়বিড় করত,

‘আমারে টেনে নাও তোমার কাছে ,

আদিম সরোবরে ভেসে থাকা ফুলের কাছে

তোমার পদ্মনাভীর কাছে’।

হাতে থাকা ফোনটা বেজে ওঠে, শিলা, শিলার ফোন ! কেঁপে ওঠেন ডাক্তার মারুফ,

- ‘আজ বিকেলে দেখা করতে পারবা মারুফ ভাই ? গুলশানে ?’


খুব কাছে বসে আছে শিলা। ডাক্তার মারুফের খুব কাছে। গুলশানের ‘সিক্রেট জোন’ রেস্টুরেন্টে। স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশিই নীরব এই রেস্টুরেন্ট- ডাক্তার মারুফের পছন্দ। গুলশানেই একটি ব্যাংকে চাকরি করে মধ্য চল্লিশ পার হওয়া শিলা। কয়েক ঘাটের জল খাওয়া, দুই তিন হাত ঘুরে আসা শিলা এখন থাকে রামপুরায়, মেয়েকে নিয়ে, একা। শিলার ১৪ বছরের মেয়ে সারা- ‘বাবু’ যার ডাক নাম, একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। লেমন কালার শিফন জর্জেট শাড়ি পরেছে শিলা, আলো আঁধারিতে অদ্ভুত এক আভা ছড়াচ্ছে সে- আগের মতোই। শাড়ির স্বচ্ছতা ভেদ করে, উঁকি দিচ্ছে শিলার মসৃণ মেদহীন উজ্জ্বল আভামাখা পেট- ওখানেই, ওখানেই সেই নাভি- পদ্মনাভি- এখনো ছোঁয়া হয়নি- তবে কাছেই আছে- খুব কাছে !

আর এইটুকু কাছে আনতেই মারুফকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে, কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। সেদিন হসপিটালে দেখা হওয়ার পর থেকে নিয়মিত শিলার খোঁজ রেখেছে মারুফ। খুঁজে-খুঁজে বের করেছে শিলার ঘাটতি- শিলার সমস্যা- শিলার প্রয়োজন- তারপর মুশকিল আসানের সর্বমুখী বিদ্যা নিয়ে নিজেই হাজির হয়েছে শিলার সামনে- হাতেমতাই হয়ে। শিলার আস্থা পেয়েছে আবারো- বহুদিন পর।

এতদিন ক্রমাগত আবাদ করে গেছে ডাক্তার মারুফ, এখন ফলতে শুরু করেছে ফসল। অচিরেই ঘরে তুলতে পারবে সে। তবে এই ফসল ঘরে তোলায় নিজের ঘর বা শিলার ঘরে কোনো সমস্যাই হবে না। ডাক্তার মারুফের নিজের ঘর বলতে দুটি বড়ো সন্তান আর আটপৌরে একটি স্ত্রী। দুই দুইবার ঘর ভেঙেছে শিলার, দ্বিতীয় ঘরের সম্পদ একমাত্র মেয়ে ‘বাবু’, নতুন করে আর নিজের মন ভাঙতে চায় না শিলা। আসলে বয়স বাড়লে পুরুষ ছোটে বাইরে- আর নারী ফেরে ঘরে, পুরুষ হয় বেয়ারা, বেপরোয়া- নারী হয়ে ওঠে ধীরস্থির- শান্ত, পুরুষ খোঁজে যৌবন, নব যৌবন- নারী খোঁজে কাঁধ- ভরসার কাঁধ। একটু একটু করে তেমনই শিলার ভরসার কাঁধ হয়ে উঠছে ডাক্তার মারুফ।

হাতের ফোনটা বেজে ওঠে, ডাক্তার ফারুকীর ফোন। বিরক্তমুখে ফোনটা হাতে টেবিল থেকে সরে আসে ডাক্তার মারুফ, ‘এই মারুফ একটা ঝামেলা হয়ে গেছে রে ভাই, পার্টির কাছে তো ফ্লুইডের হিসেব আগে থেকেই আছে, মেডিসিনের বিলে- তোমরা তো ভেইনে অনেক বেশি দেখাইছ, ওআরএস দেখাইছ, ওআরএস তো বিলে নাই রে ভাই, এখন কী হবে রে ভাই, কোনোভাবেই তো দুই লিটারের বেশি দেখানো যাচ্ছে না, গড়বড় হয়ে যাচ্ছে।’ মেজাজটা খিঁচিয়ে ওঠে ডাক্তার মারুফের ।

- আচ্ছা, ফারুকী ভাই তখন নিজের পেসেন্টকে নিজে না দেখে ফেলে রাখছিলেন কেন ? এখন এইভাবে ঝামেলা করতেছেন কেন’!

- ‘এইটা তুমি কী বললা ভাই, তুমি তো জানোই, জসিম ভাই সব সময় কেমন একটা প্রেশারে রাখে, রোগী বেশি আইসিইউতে না পাঠালে চেম্বার উঠায় দেওয়ার হুমকি দেয় ! জানোই তো এখানে আমার একটা পসার হয়ে গেছে, ভুল কেমনে হইছে তুমি তো জানোই, আর তাছাড়া তুমি তো আছোই, তোমার তো কত লিংক, কমিটিকে দেরি করাও, দেরি করিয়ে ফাইলটা হিম ঘরে পাঠিয়ে দাও প্লিজ, আমি তোমাকে খুব ভরসা করি’ ....

তার কথা শেষ হবার আগেই ফোনটা কেটে দেয় ডাক্তার মারুফ। কোনো ঝামেলা এখন নিতে চায় না সে, শিলা আর তার মাঝে আর কোনো বাধা নয়।

শিলা এখনো সেই আগের মতোই সুন্দরী, মধ্য চল্লিশ পার হয়েও শরীরে জমেনি মেদ। সেদিনের উপচে পড়া উদ্ভিন্ন যৌবনা আজ যেন জলসাঘরের নৃত্যরতা মধ্য তিরিশের বাইজি- সৌন্দর্য ধারালো ও মজবুত।

শিলার সাথে সম্পর্ক আরো মজবুত করতেই নিজের হোস্টেল থেকে কলেজে পড়া শিলার জন্য ছন্দের পড়া সাজিয়ে শিলার হোস্টেল গেইটে গিয়েছিল মারুফ। দেখে গেটের বাইরে, দূরে পায়ে পা মিলিয়ে ছন্দে ছন্দে হাঁটছে শিলা, শাড়ি পরা শিলা, সহপাঠী শরীফের সাথে। শরীফের সাথেই দেখা যেত শিলাকে কখনো পুনম জর্জেট কখনো বা ক্লিওপেট্রা জর্জেটে- শহরের বিবির পুকুর পাড়, সেঞ্চুরির সামনে, সিএনবি রোডে। মারুফও দেখত, দূর থেকে- তারপর নিজের হোস্টেলে ফিরে তোশকের নিচ থেকে বের করতে স্মৃতিমাখা পুরনো বই ‘ফিরে এসো নিলি’!

শরীফের সাথেই পরিবারের অমতে পালিয়ে ছিল শিলা, সংসার টেকেনি তার, পরিবার থেকে দেওয়া বিত্তশালী বয়সী লোকটার সাথেও সংসারটা টেকেনি। এখন শিলা একা, সম্পূর্ণ একা- শিলাকে একা ভাবতেই অদ্ভুত এক শিহরণে কেঁপে ওঠে মারুফ। বুকের ভেতর কেমন এক সুখ-সুখ অনুভূতি হয়।

বেয়ারা এসে টেবিলে দুটো সি ফুডের প্লাটার রেখে যায়- খুব যতœ করে শিলার প্লেটে খাবার তুলে দেয় ডা. মারুফ। শিলা আনমনে বলে যায় নিজের কথা, বাবুর কথা, মারুফ শোনে, খুব মন দিয়ে শোনে, মাথা নিচু করে শোনে। প্রতিটি মানুষই জীবনে কারো-না-কারো সামনে নত হয়- সত্যিকারভাবে।

- জানো মারুফ ভাই, বাবুকে একটু না দেখলেই অস্থির লাগে, দিনশেষে বাবুই আমার সব । তারপরও ও যখন ঘুমায় কেমন একটা শূন্য শূন্য লাগে, নিজেকে কেমন একা মনে হয়, এত ছুটলাম তবু জীবনে একটা বিশ্বস্ত কাঁধ পেলাম না’।

খুব কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে মারুফ। আর একটু, আর একটু এগোলেই কাক্সিক্ষত গন্তব্য, আর একটু গেলেই হিমালয়ের চুড়ো, কাঁপা গলায় ঘন কণ্ঠে ধীরে ধীরে বলে ওঠেন ডাক্তার মারুফ- আমি তো আছি।


এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করেছে ডাক্তার মারুফের প্লেন। চারদিন পর। বিদেশে থাকা ডাক্তার এহসানের আমন্ত্রণে একটা প্রেজেন্টেশন নিয়ে দুবাই গিয়েছিলেন। জায়গাটা শহর থেকে বেশ দূরে। সব সুবিধা পেলেও একটা অসুবিধা ছিল- ফোনের নেটওয়ার্ক কাজ করে না ! ‘বটিম’ নামে একটা অ্যাপস আছে তাই দিয়ে দেশে কথা বলতে হয়, শিলার ‘বটিম’ না থাকায় যোগাযোগ করা যায়নি ! চারদিন যেন ৪০০ বছর।

দেশে নেমেই ডাক্তার মারুফ ফোন অন করেন। অনেক মেসেজ জমা হয়ে আছে। আসছে একটার পর একটা।

# বাবুর জ্বর, গলা ব্যথা, তোমার হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি, পরিচিত কাউকে বলে দাও।

# ওরা বলছে টনসিলের অবস্থা ভালো নয়, ওটিতে নিয়ে এখনই কেটে ফেলে দিতে হবে, তোমার ফোনে ঢুকছে না, টেনশন হচ্ছে !

# ওরা বলছে বাবুর অবস্থা ভালো না, আইসিউতে নেবে, ওদের আচরণ কেমন যেন অদ্ভুত, তোমার ফোন বন্ধ, প্লিজ ফোন ধরো, ভয় লাগছে আমার, খুব ভয় লাগছে...

আর পড়তে পারেন না ডাক্তার মারুফ। পাগলের মতো গাড়ি নিয়ে ছুটতে থাকেন হ্যাপিএইডের দিকে।

শহরটা যেন থেমে আছে, ভয়াবহ জ্যাম। গাড়ি থেকে আগেই নেমে দৌড়াতে শুরু করেছেন ডাক্তার মারুফ। ক্রমাগত ফোন দিয়ে যাচ্ছেন শিলাকে, শিলার ফোন বন্ধ। পাওয়া যাচ্ছে না ডাক্তার সুজনকেও।

হ্যাপিএইডের দিকে পাগলের মতো দৌড়াচ্ছেন ডাক্তার মারুফ, পৌঁছাতে হবে দ্রুত- বাবুকে বের করতে হবে ‘যন্তর মন্তর ঘর’ থেকে। দ্রুত পৌঁছাতে হবে নিরাপদ কোনো জায়গায়, ভালো কোনো হসপিটালে। 

বেশ চড়া রোদের দুপুর, খুনে দুপুর, জ্যাম ঠেলে, ভিড় ঠেলে ছুটছেন ডাক্তার মারুফ পাগলের মতো- উ™£ান্তের মতো হ্যাপিএইডের দিকে!

* * *

খুব জোরে একটা ধাক্কা খেলেন ডাক্তার মারুফ। ‘যন্তর মন্তর ঘর’র সামনে অনেক মানুষের জটলা। একটা গগনবিদারী আর্তনাদ ভেসে আসছে জটলার ভেতর থেকে। শব্দের উৎসের খোঁজ করতেই দৃশ্যটায় চোখ আটকে গেল ডাক্তার মারুফের। দূরে সাজানো সোফায় কয়েকজন ধরে রাখার চেষ্টা করছে শিলাকে, এলোমেলো- অবিন্যস্ত- উ™£ান্ত শিলা। ক্রুদ্ধ বাঘিনীর মতোই চিৎকার করছে সে, ‘মেরে ফেলেছে, আমার বাচ্চাকে ওরা মেরে ফেলেছে, আই হ্যাভ লস্ট মাই বেবি, আই হ্যাভ লস্ট মাই বেবি, ছাড়বো না, ওদের কাউকে ছাড়বো না আমি, আই উইল টেইক অ্যাকশন।’

ভিড়ের মধ্য থেকে হঠাৎ ছুটে আসে ডাক্তার সুজন, ডাক্তার মারুফের কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, ‘স্যার এই পার্টি তো আরো বেশি গরম, জসিম স্যার আপনাকে এটার ফাইল এখনই গোছাতে বলেছেন !’

হতভম্ব, স্থবির, বিমূঢ় ডাক্তার মারুফ হঠাৎ করেই খুব জোরে একটা টান অনুভব করলেন- খিচটান-

নাভিতে নয়- বুকে !

অলঙ্করণ : মনিরুজ্জামান পলাশ