ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

14 Mar 2023, 01:55 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার


[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


কিন্ডার গার্ডেন থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণ আমরা এলোমেলো এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ালাম। পাতা ঝরার এ সময়ে ইউরোপের ওয়াকওয়েগুলো যেন রঙিন গালিচায় মোড়ানো থাকে, অদ্ভুত একটা ভালো লাগা কাজ করে। হাঁটতে হাঁটতেই আমরা পৌঁছে গেলাম একটি বড়োসড়ো লেকের পাড়। এখানে একটা বিষয় খুব কমন, ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশের শহুরে নদীগুলো প্রতিবেশ সরু, এপার-ওপার পায়ে হেঁটে যেতে সময় লাগে মিনিট কয়েক মাত্র, তবে অনেক লেক আছে যার এপার-ওপার খুব একটা দৃশ্যমান নয়। পায়ে চলার পথে সময় লাগে অনেক। এখানকার প্রতিটা নদীর উপরই একাধিক সেতু থাকে তার মধ্যে অন্তত একটি থাকবে পায়ে চলা পথিকের জন্য। আমরা সেতুর উপর হেঁটে পুরো সেতুটা প্রদক্ষিণ করে লেকের একপাশ থেকে অন্য পাশে চলে এলাম। এরপর প্রথমে বাস পরে মেট্রোতে চড়ে যে জায়গাটাতে পৌঁছুলাম তার নাম ল্যাঞ্জেলিনি প্রমোনাডে, এটি কোপেনহেগেনের কেন্দ্রে অবস্থিত। ল্যাঞ্জেলিনি মূলত একটি পার্ক এলাকা যেখানটার একপাশে বিশাল জলরাশি এবং এটাকেই কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিশাল পার্ক। এখানেই জলের কিনার ঘেঁষে একটি বড়োসড়ো পাথরের উপরে বসে আছে রূপকথার মৎস্যকুমারী। পাথরের উপরে ব্রোঞ্চের মৎস্যকন্যা যেন মাছ থেকে ধীরে ধীরে মানবী হয়ে উঠছে, মৎস্যমানবীর এ ব্রোঞ্চ মূর্তিটি লিটল মারমেইড নামেই বিশ্বজোড়া পরিচিত। এখানে অবশ্য লিটল মারমেইড ছাড়াও আরো বেশ কিছু স্কাল্পচার বা ভাস্কর্য রয়েছে, তার সব ক’টির নাম কিন্তু আমার মনে নেই। এই পার্ক এরিয়াটি এত বিশাল যে, কেউ বলে না দিলে এটা বোঝা কঠিন যে, পুরো এলাকটি আসলেই একটি নির্দিষ্ট পার্কের আওতাভুক্ত। 

আমরা এরপর জলের ধার দিয়ে হেঁটে অনেকটা খোলা চত্বর পেরিয়ে একটা ঢিবির মতো জায়গায় পৌঁছালাম। সেখানে গাছের লতা-পাতায় ঘেরা চার দেয়ালের স্থাপনা যার উপরটা খোলা, ভেতরে চারটি প্রকষ্ঠ, মূলত ছবি তোলার জন্যই এই নান্দানিক স্থাপনা, বেশ চমৎকার এক আয়োজন। এখন অবশ্য আমাদের দেশেও এ ধরনের স্থাপনা হরহামেশাই চোখে পড়ে। তবে, প্রথম দেখায় এটি এত ভালো লাগল, আমি অনেকটা মুগ্ধতা নিয়ে এখানে বেশকিছুক্ষণ সময় কাটালাম। এর পাশ দিয়ে চলে গেছে শহরের ব্যস্ততম সড়ক, আমরা উপর থেকে রেলিং ঘেঁষে দাড়িয়ে শহরের খানিকটা সৌর্ন্দযও উপভোগ করে নিলাম। এরপর আবার হেঁটে চলা, বলছিলাম লিটল মারমেইড ছাড়াও এখানে আরো কিছু ভাস্কর্য রয়েছে, গেফিয়ান ঝরনা, এমনি একটি ডেনিশ ভাষায় একে Gefionspringvandet বলে। মূলত ঝরনা হলেও এটি বেশ কয়েকটি ভাস্কর্যের সমন্বয়ে একটি স্বতন্ত্র স্থাপনা। এখানে একদল বলশালী গোরু একটি লাঙল টানছে যা আবার নর্স দেবী গেফজন নিজ হাতে নিয়ন্ত্রণ করছে। নর্স উত্তর জার্মানির পৌরাণিক দেবীদের কল্পরূপ। দেবী গেফজন মূলত শস্য আর ঐশর্যের দেবী। Gefionspringvandet -এরও একটি কিংবদন্তি রয়েছে যে, এই ঝরনার জলে কয়েন ফেললে মনোবাসনা পূর্ণ হয়। তাই ঝরনার স্বচ্ছ জলের তলায় অজ্র রুপালি কয়েন সূর্যের আলোতে ঝকমকিয়ে উঠছে। প্রচলিত আছে দেবী গেফজন নিঃস্বরূপে সুইডেনে যান এবং সেখানে তিনি অনেকটা রহস্যময়ী নারী হিসেবে আবির্ভূত হন। সুইডেনের রাজা এই রহস্যময়ী নারী দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে তাকে তার ভূমির কিছু অংশ দিতে চান, ততটাই যতটা জমিতে গেফজন একরাত একদিনে লাঙল চালাতে পারবে। তবে অবাক করা বিষয় ছিল গেফজন রাতারাতি সুইডেনের রাজভ‚মির অনেকটা অংশ সাথে করে উধাও হয়ে যায়, পরদিন রাজা তার জমিসহ গেফজনকে আর খুঁজে পায়নি। গেফজনের নিয়ে আসা জমিই এখন ডেনমার্কের জিল্যান্ড। যাক রূপকথার গল্প অনেক হলো, এবার বর্তমানে ফিরি, ঝরনাসহ এই পুরো স্ট্রাকচারটি দর্শণার্থীদের কাছে নিঃসন্দেহে অনেক প্রিয়। যারাই এ পার্কে বেড়াতে আসেন এখানে ছবি তুলতে ভোলেন না। আমিও ব্যতিক্রম নই ; তবে, বেশ কিছুক্ষণ ধরেই খেয়াল করছিলাম ধবধবে সাদা স্যুট পরিহিতা এক গ্রিক প্রৌঢ়া সেলফি স্টিকের সাহায্য নিয়ে ঝরনার সাথে নিজের ছবি তোলার চেষ্টা করছিলেন। সম্ভবত, ছবি তার মনঃপূত হচ্ছিল না। বন্ধু বাবু আমাকে ভদ্র মহিলার ছবি তুলে দিতে বলল, আমি একটু দ্বিধায় ছিলাম উনি আবার কী মনে করেন। কিন্তু যখন আমি তার ছবি তুলে দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করালাম তখন তার আনন্দ সত্যিই উপভোগ্য ছিল। তিনি বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে, বিভিন্ন ভঙ্গিমায় পোঁজ দিলেন আমিও আনন্দ নিয়ে একাকী বেড়াতে আসা গ্রিক এই নারীর ক্ষণিক আনন্দের সঙ্গী হলাম। এখানে আমিও কিছু ছবি তুলে নিলাম- এ ক্ষেত্রে আমার ফটোগ্রাফার ছিল বাবু, এরপর পথচলা, অনেকটা পথ পেরিয়ে গেলাম। আগেই বলেছি, এখানটাতে অনেক ভাস্কর্য রযেছে, না আমি সবকটির নাম বা ইতিহাস মনে করতে পারছি না, তবে এখন যে ভাস্কর্যটির কাছে আছি এটি মূলত বর্ণবাদ আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদী ভাস্কর্য। মূর্তিটি মেরি থমাসের, যিনি ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে ডেনিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে এক জলন্ত অগ্নিস্ফুলিং হয়ে এসেছিলেন। রানি মেরি থমাস ফায়ারবান নামে এক শ্রমিক বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিলেন, ধারণা করা হয়, এটি ডেনিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো শ্রমিক বিদ্রোহ। এটি ডেনমার্কে স্থাপিত প্রথম একটি কিষ্ণাঙ্গ মহিলার সর্বজনীন স্মৃতিস্তম্ভ। বিশাল আকৃতির এ স্তম্ভের সামনে কালো পাথরে খোদাই করে লিখা রয়েছে ‘‘I am queen Mary’। 

চলতে চলতে খিদে পেয়ে গেল, আমরা একটা যুতসই জায়গা খুঁজছিলাম বসার জন্য। এটা ঠিক, বসার জন্য এখানে ভালো এবং সুন্দর জায়গার কিন্তু অভাব নেই তারপরও কেন যুতসই জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছি এটা একটা প্রশ্ন বটে, বলছি সুর্য এখন ঠিক মাথার উপর না হলেও প্রায় কাছাকাছি, তেজটাও বেশি। নভেম্বরের এই সময়ে এসেও কিছুটা চনমনে গরম লাগছে, গাছের ছায়ায় বসা যায়, সেটা আবার কেমন যেন স্যাঁতসেঁতে মনে হয়, আমরা আসলে বেশ আলো আছে সাথে বাতাসের অবাধ আনাগোনা, এমন একটা জায়গা খুঁছিলাম। শেষে পেয়েও গেলাম, জলের উপরে কাঠের পাটাতন, তার উপর আবার সারিবাঁধা কাঠের বেঞ্চ। তার একটিতে বসে সাথে আনা খাবার আর পানি খেয়ে কিছুটা সময় জিরিয়ে নিলাম। এখান থেকে কোপেনহেগেনের এক ভিন্ন চিত্র দেখা মেলে। মনে হয় যেন শহরের ঠিক মাঝখানে এক টুকরো সমুদ্র। এটা সম্ভবত খাড়ি, যেখানে বেশ কিছু সমুদ্রগামী জাহাজকে জিরোতে দেখা যায়। নভেম্বরের মাঝামাঝি এই সময়ে ইউরোপে রোদের দেখা পাওয়া সত্যিই বিরল, আমি নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান যে রৌদ্রোজ্জ্বল সময়টাকে পেয়েছি, জেটির কাছাকাছি বসে সাগরের নোনাজল আর নোনাবাতাসের এক আরামদায়ক শান্ত মায়াবী পরিবেশে সময় দ্রুত চলে যায়। এদিকে দুপুর হতে চলল, আগেই বলেছি, ছ থেকে সাড়ে ছ’ঘণ্টার দিনের দুপুর হতে না হতেই সন্ধে নামে বিকেলের দেখা মেলে না। তাই আমরা আবার পথে নামবো বলে উঠে পড়লাম। ফেরার পথে দেখি ছোট্ট একটা ক্যারাভ্যান তার আশেপাশে বেশ কিছু টেবিল-চেয়ার পাতা, প্রতিটি টেবিলে আবার একটি করে হারিকেন রাখা। বিষয়টি বেশ কৌত‚হলোদ্দীপক, দূর থেকে ভেবেছিলাম বুঝি ডামি হারিকেন কাছে গিয়ে দেখলাম না একদম ট্রেডিশনাল, আমাদের চিরাচরিত তেল সলতের হারিকেন। ইউরোপের এই অত্যাধুনিক সময়ে এই হারিকেন প্রদর্শনীর কারণ খোঁজার সময় হাতে না থাকায় অনুমতি নিয়ে কিছু ছবি তুলে ফিরতে হলো। এখানে আরেকটি মজার বিষয় ছিল পোট্রেট কর্নার, যেখানে হবু কনেরা নিজেদের ছবি তোলে বিভিন্ন রঙের ছোঁয়ায় সেজে ওঠা দেয়াল ঘেঁষে বিয়ের কনেরা নানান ভঙ্গিমায় নিজেদের ছবি তুলতে আসে, সাথে নিয়ে আসে প্রফেশনাল ক্যামেরাম্যান। দেয়ালটির বিশেষত্ব কী তা ঠাহর করতে না পারলেও দেয়াল ঘেঁষে তোলা ছবি যে নিঃসন্দেহে সুন্দর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেমন করে বুঝলাম ? কারণ, আমি নিজের গুটিকয়েক ছবি তুলেছিলাম যে, যদিও আমার সাথে প্রফেশনাল ক্যামেরাম্যান ছিল না।  [চলবে]