যৈবতী কন্যার মন নাটক থেকে সিনেমা

04 Jan 2021, 02:58 PM কাভার জুটি শেয়ার:
যৈবতী কন্যার মন নাটক থেকে সিনেমা

নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের অনবদ্য সৃষ্টি ‘যৈবতী কন্যার মন’। মঞ্চনাটক থেকে ধারাবাহিক নাটক হয়ে বড়োপর্দায় নিয়ে এসেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত নির্মাতা নারগিস আক্তার। ছবিতে প্রধান দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন নতুন মুখ ওপার বাংলার জনপ্রিয় সিরিয়াল ‘করুনাময়ী রানি রাসমণির’র রাজচন্দ্র অর্থাৎ গাজী আবদুন নূর ও সায়ন্তনী। গাজী আবদুন নূরকে সবাই ওপার বাংলার হিরো হিসেবে জানলেও মূলত তিনি বাংলাদেশের সন্তান। ছবিটি নিয়ে কথা হয় ছবির পরিচালক নারগিস আক্তার ও প্রধান দুই চরিত্র গাজী আবদুন নূর ও সায়ন্তনীর সঙ্গে। বিস্তারিত লিখেছেন শেখ সেলিম...


নারগিস আক্তারের ছবি মানেই ভিন্ন কিছু। গল্প ও নির্মাণশৈলীর কারণে সিনেমাবোদ্ধাদের কাছেও তিনি সমাদৃত। এরই ধারাবাহিকতায় এবার তিনি বড়োপর্দায় নিয়ে আসছেন নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের অনবদ্য সৃষ্টি ‘যৈবতী কন্যার মন’। এটি মঞ্চনাটকের পাশাপাশি টিভি নাটকেও দেখেছেন দর্শক। এবার আসছে বড়োপর্দায়। আর যিনি এটি বড়োপর্দায় নিয়ে আসছেন তিনি হলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত নির্মাতা নারগিস আক্তার। ছবিটি নির্মাণের আগে চিত্রনাট্য, অভিনয়শিল্পী, লোকেশন, কস্টিউম প্রভৃতি বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন নির্মাতা। ছবিটির চরিত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তিনি মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন।  ছবির প্রধান দুই চরিত্র আলাল ও কালিন্দি। এই দুটি চরিত্রে এমন দু’জন শিল্পীকে তিনি নির্বাচন করেছেন যাদের দেখলেই যেন দর্শক মনে করতে পারেন এরাই গল্পের কালিন্দি ও আলাল। আলাল চরিত্রে অভিনয় করেছেন ওপার বাংলার জনপ্রিয় সিরিয়াল ‘করুণাময়ী রানি রাসমনি’ সিরিয়ালের রাজচন্দ্র। রাজচন্দ্রের নাম গাজী আবদুন নূর। অন্যদিকে কালিন্দি চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন তিনি এর আগে অভিনয় করেননি। 

গাজী আবদুন নূরকে এপার বাংলা ও ওপার বাংলার সবাই রাজচন্দ্র হিসেবেই চেনেন। রাজচন্দ্র নামটি এসেছে জি বাংলায় প্রচারিত ‘করুণাময়ী রানি রাসমণি’ সিরিয়ালের দৌলতে। এই সিরিয়ালে নূর রাজচন্দ্রের চরিত্রে অভিনয় করে দুই বাংলায় ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। এপার বাংলায় প্রথম কাজ ‘যৈবতি কন্যার মন’ ছবিতে।

‘যৈবতী কন্যার মন’ ছবিতে অভিনয় প্রসঙ্গে বলেন, ‘যৈবতী কন্যার মন’ একটি জনপ্রিয় নাটক, যেটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচিতে রয়েছে, নাটকটি মঞ্চে দেখেছি, কিন্তু পুরোটা দেখতে পারিনি। স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী যদি বলি, স্যার মঞ্চের নিয়ম অনুযায়ী দেখিয়েছেন। চলচ্চিত্রের লাইনআপ মেইনটেইন করেই ছবিটি নারগিস আক্তার পরিচালনা করেছেন। কলকাতায় আমি যখন আমার থিসিস পেপার তৈরি করি তখন দুই বাংলার নারী পুরুষদের নিয়ে কাজ করছিলাম, সে সময়ে মুঠোফোনে তার সঙ্গে কথা হয়, এরপর যখন তিনি কলকাতায় আসেন তখন তার সঙ্গে আমার আলাপ হয় ২০১৫ সালে। তার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তার মধ্যে মা-সুলভ আচরণ থাকায় তাকে ‘মা’ বলে ডাকি। কাজ করার সময় কখনোই কষ্ট হয়নি, কখনোই মনে হয়নি আমি একটা বাইরের টিমের সঙ্গে কাজ করছি। কারণ, একটা ফ্যামিলি এনভায়রনমেন্টের মধ্যে ছিলাম। নারগিস আক্তারের কাজ তো আমি আগেই দেখেছি। তাকে নিয়ে যখন গবেষণা করেছি, তখনই তার কাজ দেখেছি। যার ফলে তার সম্পর্কে একটা ধারণা আগেই হয়েছিল। কাজের প্রেক্ষাপট, ধরন, তিনি কীভাবে কাজ করেন গবেষণার ফলে জানতে পেরেছি। কাজ করতে গিয়ে আমার একটু সমস্যা হয়েছে, নির্মাতা আমাকে সেক্ষেত্রে ছাড় দিয়েছেন। কারণ আমি সাত দিনের একটি সিরিয়াল করতাম কলকাতায়। সে-কারণে ওখান থেকে আসতাম, আমাকে বারবার আসা যাওয়ার মধ্যে থাকতে হয়েছে। ছবিটি লেট হওয়ার কারণও আমি। 


ছবির সহশিল্পী সায়ন্তনী সম্পর্কে বলেন, সায়ন্তনী একদমই নতুন মুখ। এর আগে সে অভিনয় করেনি। সে যেটা করেছে, ভালো করেছে। গ্রæমিং করেছে। যেহেতু নারী কেন্দ্রিক গল্প, চরিত্রটা খুবই ভারি। সেটা নতুন একটা মেয়ের জন্য কষ্টকরই ছিল, কো-আর্টিস্ট হিসেবে বলবো, সে যথেষ্ট করেছে। ধৈর্য ধরে সে কাজটা করেছে। নারগিস আক্তার সম্পর্কে বলেন, পরিচালকের সম্পর্কে কথা বলার যোগ্যতা এখনো আমার হয়নি। তিনি জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন নির্মাতা। তার সঙ্গে শাবানা আজমী কাজ করেছেন। ভারতীয় অনেক শিল্পী তার সঙ্গে কাজ করেছেন। 

গাজী আবদুন নূর ২০১১ সালে থিয়েটার করতে শুরু করেন। গঙ্গা-যমুনা নাট্যোৎসবে একাধিকবার গিয়েছেন। সেখানে তার প্রথম মঞ্চনাটক ছিল রাজা প্রতাপাদিত্য। যেটি লিখেছিলেন আশীষ খন্দকার। সে নাটকটি করতে গিয়ে তার মনে হলো, থিয়েটারে ভালোভাবে কাজ করা উচিত।

নূরের দাদার বাড়ি বাগেরহাট জেলার মোল্লারহাট উপজেলায় আর নানার বাড়ি গোপালগঞ্জে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা করেছেন সেখানেই। কলকাতায় যান ২০১১ সালে। তিনি মঞ্চনাটকের সঙ্গে জড়িত হন বাংলাদেশেই। তিনি ‘বিবর্তন যশোর’র সদস্য। এই দলের হয়ে ২০১১ সালে কলকাতায় যান। অনীক থিয়েটার আয়োজিত গঙ্গা-যমুনা নাট্যোৎসবে ‘রাজা প্রতাপাদিত্য’ নাটক নিয়ে অংশ নেয় বিবর্তন যশোর। ওই সময় সেখানে নাটক নিয়ে পড়াশোনা করার ব্যাপারে আগ্রহ তৈরি হয় তার। যোগাযোগ করেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। নাটক নিয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়ে যান। পরের বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্রামা বিভাগে ভর্তি হন। সাফল্যের সঙ্গে স্নাতক শেষ করার পর স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ভারত সরকারের আইসিসিআর বৃত্তি পান। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেন।

শুরুতে তিনি ক্যামেরার পেছনে কাজ করেন। অরোরা ফিল্মস, চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠান, ১১১ বছরের পুরোনো। এখানে নির্বাহী প্রযোজক হিসেবে কাজ করেন। এখানে যে চেয়ারে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন থেকে শুরু করে বড়ো বড়ো নির্মাতারা বসেছেন, সেই চেয়ারে নূর বসেছেন। এটা সত্যিই প্রশংসনীয়।  

তবে খুব বেশিদিন ক্যামেরার পেছনে কাজ করতে হয়নি নূরকে। কারণ, একসময় তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত নেন, পেছনে নয়, ক্যামেরার সামনে কাজ করবেন। কিন্তু কলকাতার টিভি ও চলচ্চিত্রে এখন কঠিন প্রতিযোগিতা। এর মাঝে কীভাবে নিজের জন্য এতটুকু জায়গা করে নেবেন গাজী আবদুন নূর ! জানালেন, শুরুতে তার ইচ্ছে ছিল বড়োপর্দায় কাজ করবেন। কিন্তু প্রস্তাব পেলেন ছোটোপর্দার। কালারস বাংলার ‘রেশম ঝাঁপি’ আর জি বাংলার ‘বাক্স বদল’ সিরিয়ালের মূল চরিত্র। কিন্তু তিনি রাজি হননি। বললেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে, দুটোই গতানুগতিক গল্প।’

এরপর ‘করুণাময়ী রানি রাসমণি’ সিরিয়ালে রাজচন্দ্র দাশের চরিত্রে অডিশন দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ পান। কিন্তু সে কী, এই চরিত্রে অডিশন দিতে এসেছে ২০০ জন! এখানে গাজী আবদুন নূরের সিরিয়াল ১১৭। কীভাবে সম্ভব ? বললেন, ‘এতদিন ড্রামা নিয়ে পড়েছি, তাই কিছুটা আত্মবিশ্বাস ছিল। শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছি।’

রানি রাসমণির যে গল্প ‘করুণাময়ী রানি রাসমণি’ সিরিয়ালে তুলে ধরা হয়েছে, তা ২০০ বছর আগের। সিরিয়ালেও রয়েছে সেই সময়ের আবহ। চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে কিছু নাটকীয়তা যুক্ত করা হলেও মূল গল্প থেকে সরে যায়নি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এই সিরিয়ালে কাজ করতে এসে গাজী আবদুন নূর বাস্তব জীবনেও নিজেকে ‘জমিদার রাজচন্দ্র দাশ’ ভাবতে শুরু করেছেন। জানালেন, এই সিরিয়ালের কাজ শুরু করার আগে পাঁচ বছর সেই কাহিনি নিয়ে গবেষণা হয়েছে। গবেষণা থেকে রাজচন্দ্র দাশের চেহারার ব্যাপারে যতটা ধারণা পাওয়া গেছে, সেভাবেই নিজেকে সাজিয়েছেন। 

২০০ বছর আগে কলকাতার বাবুরা যেভাবে কথা বলতেন, গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে তার কিছু রূপ। গাজী আবদুন নূর বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের ছেলে। আমাদের উচ্চারণ আলাদা। এই সিরিয়ালে কাজ করতে এসে আমি সেই বাবুদের কথা বলার ধরন আর চলাফেরা রপ্ত করেছি।’ গাজী আবদুন নূরের মনে অভিনয়ের পোকাটা নাকি ঢুকিয়েছিলেন ছোটোপর্দার নির্মাতা ফেরদৌস হাসান রানা। তখন গাজী আবদুন নূর যশোর থেকে ঢাকায় আসছিলেন বেড়াতে, বোনের বাসায়। বললেন, ‘আমি ক্লাস নাইনে পড়ছি। গাড়িতে পরিচয় হয় এই নির্মাতার সঙ্গে। তিনি আমাকে অভিনয়ে যোগ দেওয়ার জন্য বলেছিলেন। তার সেই কথা আমি ভুলিনি।’

অভিনয়ের ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো বেশি প্রাধান্য দেন ? নূর বলেন- কলকাতায় কাজ করতে গিয়ে আমার একটা ক্ষুধা তৈরি হয়েছে, যেটা আমার আগে ছিল না, সেটা হচ্ছে আমার নির্মাতা যদি আমার কাজ দেখে ভালো না বোধ করেন তাহলে দর্শকরাও ভালো বোধ করবেন না, সেজন্য সবসময় আমি নিজেকে প্রশ্ন করি, আমি কি ঠিক শটটা দিলাম, তারপর নির্মাতাকে জিজ্ঞেস করি। কাজটা আনন্দ নিয়ে করা উচিত, নিজে উপভোগ করা উচিত সেক্ষেত্রে কাজের মান অনেক ভালো হয়। কাজের ফিডব্যাক যখন ভালো হয়, তখন কাজের প্রতি দায়িত্ব বাড়ে, শ্রদ্ধা বাড়ে। কলকাতার অনেক কিছুই আমি মিস করি। বাংলাদেশে যদি আমাকে অবস্থান করতে হয় অবশ্যই আবার থিয়েটার দিয়ে শুরু করতে চাই। মার্চের শেষে আমার প্রথম ছবি মুক্তি পাবে, আমি আরেকটি ছবিতে কাজ করেছি, শাহনাজ কাকলীর ‘ফর্ম বাংলাদেশ’, মুক্তিযুদ্ধের ছবি। 

ছবিটা সবধরনের দর্শকের কাছেই ভালো লাগবে। ‘যৈবতী কন্যার মন’ নাটকটি মঞ্চে আমাদের বোঝার ক্ষেত্রে যতটা দুর্লভ হয়ে ওঠে, চলচ্চিত্রে যেভাবে করা হয়েছে, সেটা বোঝার জন্য সহজলভ্য হবে, সেদিক দিয়ে একটা সফলতা অবশ্যই আসবে। সবাইকে কাজটি দেখার জন্য অনুরোধ করবো। নারগিস আক্তারের ছবির আলাদা একটা মানদÐ থাকে। সাহিত্যের উপর কাজ আমাদের দেশে কম হয়। বিগ বাজেটের একটি কাজ এটি। তারপরও অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজটি করতে হয়েছে। দেশের চলচ্চিত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সবাইকে হলে এসে সিনেমা দেখা উচিত, শুধু আমার ছবি নয়, সবার ছবি দেখুন হলে এসে। আমাদের উচিত দর্শকদের ভিন্ন স্বাদ দেওয়া। স্বাদ বদলানোর চেষ্টা যেমন শিল্পীদের করতে হয়, নির্মাতা, প্রযোজকদেরও করতে হয়। স্বাদ বদলানোর চেষ্টা করতে হবে, দ্বিতীয়ত সবার ছবি দেখা উচিত।

এখন ইন্টারনেটের যুগ, আমরা ঘরে বসে মোবাইলে সব দেশের ছবি দেখতে পাচ্ছি। কাজেই আমাদের সবার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এগিয়ে যেতে হবে। 

সবাই রাজচন্দ্র হিসেবে চেনে, নূরকেÑ এই প্রসঙ্গে জানতে চাই। নূর বলেন, আমার কাছে ভালো লাগার বিষয় যেমন আছে, আবার মন খারাপ করার বিষয়ও আছে। আমাকে সবাই মনে করেন আমি কলকাতার, এটার কারণ হচ্ছে আমি কলকাতার বড়ো একটি সিরিয়ালে কাজ করেছি। আমরা সবাই কমবেশি কলকাতার সিরিয়ালগুলো দেখছি, এখন বড়ো প্রশ্ন আমাদের সিরিয়াল ও ছবিগুলো কেন দেখছি না। এটার দায়িত্ব সবার, মেকআপম্যান থেকে শুরু করে, সেট ডিজাইনার, নির্মাতা, গল্পকার, শিল্পী অন্যান্য কলাকুশলির। এজন্য সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব বাড়াতে হবে। করুণাময়ী রানী রাসমণিতে বাবু রাজচন্দ্র দাসের চরিত্রটি করতে আমাকে অনেক স্ট্রাগল করতে হয়েছে। আরো দুজন হিরো কনর্ফাম ছিল, তাদের বাদ দিয়ে আমাকে নির্বাচন করে, এটার জন্য অবশ্যই জি বাংলার কয়েকজনের নাম বলতে হয়Ñ শিল্পী দি, নবনীতা, অভিজিৎ দা প্রমুখ তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। গল্পতে আমার চরিত্র ছিল মাত্র ছয় মাসের, কিন্তু পরবর্তীসময়ে রাজচন্দ্রের চরিত্র বেড়ে যায়। যে সিলিয়ালটা টিআরপিতে টানা তিন বছর এক নম্বরে ছিল। 

অন্যদিকে সায়ন্তনী কলকাতার মেয়ে। কখনো ভাবেননি অভিনয় করবেন। আর দশজন সাধারণ মেয়ের মতো কাটছিল তার প্রাত্যহিক জীবন। সেই জীবনে হঠাৎ আলোকরশ্মী দেখা দিল, আর এই আলোকরশ্মী হলো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত নির্মাতা নারগিস আক্তার, তিনি তার ‘যৈবতী কন্যার মন’ ছবির জন্য সায়ন্তনীর মতোই একজন খুঁজছিলেন।

দীর্ঘদিন খোঁজার পর তার সন্ধান মিলল কলকাতার একটি কলেজে। যেখানে সায়ন্তনী একটি নৃত্য পরিবেশন করছিলেন। নারগিস আক্তারের চোখ আটকে যায় সায়ন্তনীকে দেখে। যাকে দীর্ঘদিন যাবৎ খুঁজছিলেন আজ যেন তিনি নিজে এসেই ধরা দিলেন। প্রথম দেখায় নারগিস আক্তার আবিষ্কার করলেন সেলিম আল দীনের ‘যৈবতী কন্যার মন’-এর কালিন্দিকে। এরপর সায়ন্তনী ও তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে ঢাকায় নিয়ে এসে গ্রæমিং করান সায়ন্তনীকে। শুরু হয় শুটিং। জীবনে প্রথম অভিনয় দুরু-দুরু বুকে শুরু করলেন, আগে গ্রæমিং করায় অভিনয়ের খুঁটিনাটি রপ্ত করেছিলেন কিছুটা। তার মধ্যে নির্মাতা নারগিস আক্তার, যিনি নতুনদের নিয়েই কাজ করতে বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তিনি শক্ত হাতে গড়েন সায়ন্তনীকে। তাই তার অভিনয় দেখে কেউ হয়ত বলতে পারবে না সায়ন্তনীর এটি প্রথম কাজ।

ছবিটিতে কাজ করা প্রসঙ্গে কালিন্দি অর্থাৎ সায়ন্তনী দত্ত বলেন, সত্যি কথা বলতে কলেজ থেকে তুলে এনে দিদি আমাকে অভিনয় করালেন। যখন আমি চরিত্রের গল্প শুনি, তখন চরিত্রের প্রেমে পড়ে যাই। চরিত্রের সঙ্গে কীভাবে যেন নিজেকে রিলেট করতে পারি। খুব ভালো লেগেছে কাজটি করে। আর বাংলাদেশে এসে কখনোই আমার মনে হয়নি অন্য জায়গায় এসে কাজ করছি। সবাই খুব আপন করে নিয়েছেন। সবাইকে বলবো, আমার জন্য দোয়া করবেন। আর ছবিটি সপরিবারে সিনেমা হলে এসে দেখবেন। ছবিটি দেখে সবার মন্তব্য আশা করছি। আমার জীবনে প্রথম কাজ, কঠিন একটি চরিত্র। আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। সিনেমার পরিচালক নারগিস আক্তার [দিদি], আমাকে সব কিছু সহজ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এত বড়ো ক্যানভাসে কাজ করাটা ভাগ্যের ব্যাপার। আমি কৃতজ্ঞ দিদির কাছে, এ-রকম একটি গল্পে আমাকে সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। আমি কখনো অভিনয় করিনি, তবে এর আগে মডেলিং করেছি। আমি তাকে [নারগিস আক্তার] দিদি বলে ডাকি। কাজ করতে এসে তার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি ; প্রতিনিয়ত শিখছি।

ছেলেবেলা থেকে স্বপ্ন দেখতাম আইনজীবী হবো। সংস্কৃতির সঙ্গে আমার সখ্য ছেলেবেলা থেকে। সায়ন্তনীর বয়েস যখন তিন বছর তখন থেকে তিনি আবৃত্তি ও নাচের সঙ্গে জড়িত। তার ঠাকুর মা ভালো আবৃত্তি করতেন, দাদু উত্তম কুমারের সঙ্গে কাজ করেছেন। সেখান থেকে বলা যেতে পারে সাংস্কৃতিক পরিমÐলেই বেড়ে উঠেছেন সায়ন্তনী। ছবিতে সায়ন্তনীর চরিত্র সম্পর্কে বলেন, আমার চরিত্রটি একজন দেবদ্রোহী নারীর চরিত্র। কঠিন একটি চরিত্র। মেয়েটির চোখে সবসময় একটা কঠিন ভাব থাকে। তার শরীরের রংটা কালো বলে সব জায়গা থেকে সে রিজেক্টেড।

নিয়মিত অভিনয় প্রসঙ্গে বলেন, এই ছবিতে কাজ করার পর বাংলাদেশ ও ভারত থেকে আমার কাছে কিছু ছবির অফার আসছে, কিন্তু আমি চাইছি, দর্শক আমাকে আগে কালিন্দিরূপে দেখুক। গান বাজনার ছবি তো দর্শক দেখেনই, কিন্তু ‘যৈবতী কন্যার মন’ একটা কনটেন্ট বেজ গল্প, এই ধরনের গল্প নিয়ে খুব একটা ছবি হয় না। এই ধরনের গল্পে কাজ করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। নিয়মিত কাজ করার ইচ্ছে আছে, কিন্তু ভালো গল্প হলে অবশ্যই করা হবে। বাংলাদেশ আর কলকাতা তো আলাদা নয়, আমরা বাঙালি। ভাষা এক। 

ভবিষৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বলেন, আমি এখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। পড়াশোনা চালিয়ে যাব। বাবা-মা বলেছেন, পড়াশোনা ঠিক রেখে বাকি সব করো। পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করে যাব। মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করতে চাই। আমি প্রথম সুযোগটাই পেয়েছি বড়োমাপের একজন নির্মাতার কাছ থেকে। দিদি যখন প্রথম আমাকে বললেন, ‘তুমি এই কাজটি করবা।’ আমি তখনই অবাক হই। কারণ, আমি অভিনয় জানতাম না। দিদি আমাকে গ্রæমিং করিয়ে করিয়ে এখানে নিয়ে এসেছেন। নূর প্রসঙ্গে বলেন, তার সঙ্গে কাজ করে আমার দারুণ ভালো লেগেছে। যেহেতু সে একজন থিয়েটারকর্মী, প্রতি মুহূর্তে তার কাছ থেকে শিখেছি। তার যে অভিজ্ঞতা আছে সেখান থেকে কিছু নেওয়া। প্রচÐ কো-অপারেটিভ। এটা নূরের ও আমার প্রথম সিনেমা। আপনারা ছবিটি দেখলেই আমাদের সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। হলে এসে সিনেমা দেখুন। প্রতিনিয়ত আমাকে গাইড করেছে। আমরা খুব ভালো বন্ধু।


ছবি ও অন্যান্য প্রসঙ্গে কথা বলেন নির্মাতা নারগিস আক্তার...

আনন্দভুবন :  ‘যৈবতী কন্যার মন’ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের কারণ জানতে চাইÑ

নারগিস আক্তার : সেলিম আল দীনের কথ্যনাট্য ‘যৈবতী কন্যার মন’, ঢাকা থিয়েটারের প্রযোজনা। শ্রদ্ধেয় নাসিরউদ্দিন ইউসুফের নির্দেশনায় এই নাটকটি আমি বহুবার মঞ্চে দেখেছি। যতবার দেখেছি ততবার আমার মন টেনে নিয়ে গেছে। নাটকে দুই প্রজন্মের দুই নারীর ভেতর একই সত্তা, একই আকাক্সক্ষা, একই মনোভাব, একই দৃঢ়তা ; সামাজিকতা ও ধর্মীয় চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত তারা নিজেদের মতো বাঁচতে পারেনি। এই বিষয়টি আমাকে আবেগতাড়িত করেছে। নাটকটি দেখতে থিয়েটারে দর্শকও আসছেন, সেই চিন্তা থেকে ভাবলাম, এই নাটকটি যদি চলচ্চিত্র ক্যানভাসে নিয়ে আসি, তাহলে ছবিটি অনেক দর্শক দেখবেন। পাশাপাশি আরেকটা কারণ ছিল, এটা জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ে নাট্যতত্ত¡ বিভাগে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত। নাটকটি পড়ানোর পাশাপাশি প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস হয়। আমার মনে হয়েছে যদি এটা সিনেমা আকারে নিয়ে আসা হয়, যারা গল্প থেকে দূরে রয়েছেন, যুগের বিবর্তনে যখন মানুষ গল্প দেখতে চাইবে না, তখন হয়ত বা এই সিনেমাটিই একটি কারিকুলাম হয়ে যাবে, যেকোনো ক্লাশে ছবিটি দেখানোর পরে ছাত্রছাত্রীরা খুব সহজে গল্পটি বুঝতে পারবে। আর্কাইভ ভ্যালুটা চিন্তা করেই এই ছবিটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিই।

অনেকটা হঠাৎ করেই অনুদানের ছবিতে এই স্ক্রিপ্টটা জমা দিই, অনেকে আমাকে বলেছিলেন অনুদানের এই টাকায় ছবিটি করা সম্ভব নয়। কিন্তু আমার ভেতরে চ্যালেঞ্জ ঢুকে গিয়েছিল কাজটি করার, তাই করা। চিত্রনাট্যের সময় দেখেছি এর ব্যাপকতা বেড়ে যাচ্ছে। কারণ, গল্পটির প্রেক্ষাপট একশো বছর আগের। একশো বছর আগের প্রেক্ষাপট, লোকেশন, কস্টিউম, অর্নামেন্টস, গান প্রভৃতি চিন্তা করেই আমাকে ডেভেলপ করতে হয়েছে। গল্পটি দুই ভাগে বিভক্ত একটি পার্ট শেষ করেছি, আরেকটি পার্ট ভবিষ্যতে হয়ত করবো। যে অংশটা করেছি, সেটা একশো বছরের আগের কাহিনি। সেখানে এমন একটি চেহারা প্রয়োজন ছিল, যেটা সেলিম স্যার গল্পে বলে গেছেন। যার উপর বেজ করে গল্পটাÑ তার নাম কালিন্দি। 

কালিন্দি কালো মেয়ে। তার ডাগর ডাগর চোখ, তার ভেতরে দেবীর ভাব, সে দেবদ্রোহী নারী। কালিন্দি কালো বলে তার বিয়ে হয় না, বাড়িতে মেয়ের বয়েস বেড়ে যাচ্ছে এটা নিয়ে তার পরিবার চিন্তিত। স্যারের বলে যাওয়া সেই কালিন্দিকে উপস্থাপন করতে গিয়ে আমার আর এক যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আমাদের এখানে যারা কাজ করেন তাদের ভেঙে কালিন্দি বানাবো, সেরকম কাউকে খুজে পাই না। কারো চোখ মিলে না, কারো বয়েস মিলে না, আমার ইমোশনও কালো মেয়ের উপর। গল্পের কালিন্দিকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এর মধ্যে আমি কলকাতায় গিয়েছিলাম, আমার এক বান্ধবী কলকাতার একটি কলেজের অনুষ্ঠানে নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে দেখলাম একটি মেয়ে নাচ করছে, মেয়েটার সবকিছু আমি অনুসরণ করলাম, আমি কালিন্দির জন্য যে মেয়েটিকে খুঁজছিলাম, বোধ হয় পেয়ে গেলাম। আমি গ্রিনরুমে গিয়ে মেয়েটিকে বললাম, তুমি কি অভিনয় করবে, মেয়েটা আমার কথা শুনে অবাক! সে কখনোই অভিনয় করেনি, এরপর মেয়েটির পরিবারের সঙ্গে কথা বললাম। তারা শুনে খুশি হলেন, তাদের মেয়ে অভিনয় করবে। 

কলকাতায় এগারোজন মেয়ে অডিশন দেয়, তার মধ্যে তাকেই আমি নির্বাচন করলাম। প্রথমদিন সে আমাকে বলছিল আমি কি পারবো ? কখনো অভিনয় করিনি, কিছুক্ষণ পরই দৃঢ়তা নিয়ে বলল, হ্যাঁ, আমি পারবো। কনফিডেন্ট লেভেল যদি থাকে, তাকে গড়ে নেওয়া ব্যাপার হবে না। তাকে ঢাকায় নিয়ে এসে গ্রæমিং করালাম। আমি কখনোই স্টার কাস্টিংয়ে নির্ভর নই, নতুনদের নিয়েই কাজ করতে আমার ভালো লাগে। অনেকে হয়ত বলবেন বাংলাদেশে কী মেয়ে ছিল না, সত্যিই পাইনি, যখন ছবিটি দর্শক দেখবেন তখন বলে উঠবেন এই মেয়েটিই তো কালিন্দি।

এখানে যদি আমাদের দেশের পূর্ণিমা কিংবা মিমকে নেওয়া হতো তাহলে বলতো, জোর করে কালিন্দি বানিয়েছে। প্রথম কাজ হিসেবে সে যতটুকুই করছে, বেশ ভালো করেছে। আমি সার্থক আমার কল্পনায় যে কালিন্দি ঘুরে বেড়াচ্ছিল আমি সেই কালিন্দিকেই পেয়েছি।

অন্যদিকে গল্পের আলাল চরিত্রে যে কাজ করেছেন তিনি হলেন গাজী আবদুন নূর, তাকে পর্দায় দেখলেই মনে হবে এই হচ্ছে গল্পের আলাল। 

সীমিত বাজেটের ছবি, ছবির কাজ শেষ করতে অনেক কষ্ট হয়েছে। আমি হাল ছাড়িনি। কারণ, এটা আমার জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল। অনেকে তো বলেই দিয়েছিলেন, এই ছবি কখনো শেষ করতে পারবো না। গত দুই তিন বছর যাবৎ সমালোচকদের অনেক কথাই শুনেছি, আমি কর্ণপাত করিনি, শুধু কাজটি নিয়েই ছিলাম। ছবিটি দেরি করে জমা দেওয়ায় আইনগত সমস্যা হয়েছিল, কিন্তু যেদিন আমার ছবিটি মন্ত্রণালয়ে প্রিভিউ হয়েছে, সকলেই ছবিটি দেখে খুশি হয়েছে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি মানুষের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তারা সবাই আমাকে সহযোগিতা করেছেন।

এপ্রিলের শুরুতে ছবিটি মুক্তি দেওয়ার ইচ্ছে আছে। বাণিজ্যিকভাবে ছবিটি মুক্তি দেওয়া হবে। যতগুলো সিনেমা হল পাবো সেগুলোতেই প্রদর্শনের ইচ্ছে রয়েছে। এখানে মুক্তির একমাস পর, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও ইউএসএ রিলিজ দেওয়া হবে। এরপরে ইউরোপে। ছবিটি পুরো পৃথিবীতে নিয়ে যেতে চাই।