আনন্দহীন শিক্ষা শিশুর বিকাশে বড়ো বাধা -ইকবাল খোরশেদ

19 Sep 2022, 12:30 PM শিশুভুবন শেয়ার:
আনন্দহীন শিক্ষা শিশুর বিকাশে বড়ো বাধা  -ইকবাল খোরশেদ

‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।’ কবির এই বাক্য বলে দেয়, শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। অর্থাৎ আজ যে শিশু, কয়েক বছর অন্তে সে-ই জাতির কর্ণধার। রাষ্ট্র ও সরকারের নানা গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে সে নেতৃত্ব দেবে। তাই শিশুর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য তাদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। আর শিশুকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার প্রধান দায়িত্ব বিদ্যালয়ের।

পরিবার বা বাড়ির বাইরে শিশুর অন্যতম সামাজিক প্রতিষ্ঠান হলো বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ে বিভিন্ন পরিবার থেকে শিশুরা আসে। প্রত্যেক শিশুর মন-মানসিকতা, আচার-আচরণ, খ্যাদ্যাভ্যাস, আদব-কায়দা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। একজন শিশুর কাছ থেকে অন্য জন শেখে, এটাই স্বাভাবিক। শিশুর সামগ্রিক বিকাশে বিদ্যালয়ের ভ‚মিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ছোটো বড়ো, নানা শ্রেণির পরিবার থেকে এলেও শিশুরা বৃহত্তর সমাজেরই অংশ। সেই সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য শিশুর সামাজিক বিকাশ জরুরি। আর এই কাজে বিদ্যালয়ই প্রধান ভ‚মিকা রাখে। শিক্ষার নানারকম উদ্দেশ্যের মধ্যে শিশুকে সমাজের সাথে সম্পৃক্ত করা, সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করার সক্ষমতা অর্জন করানো অন্যতম। কেননা, শিশু সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে না পারলে সে অসামাজিক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারে। এতে শিশুর বিকাশ ও ভবিষ্যৎ যেমন নষ্ট হয়ে যেতে পারে, তেমনি সমাজে চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাস, অত্যাচার, অনিয়ম বেড়ে যেতে পারে। তাই শিশুর যথাযথ বিকাশে এবং সুষ্ঠ‚ সমাজ বিনির্মাণে সমাজিক শিক্ষা অত্যন্ত জরুরি। আর শিশুর সামাজিক শিক্ষার দায়িত্ব বিদ্যালয়ের ওপরই বর্তায়। পাঠ্য বইয়ের শিক্ষা দানের পাশাপাশি শিশুকে প্রকৃত শিক্ষিত করে তোলা বিদ্যালয়ের কাজ। শিশু শিক্ষিত হয়ে উঠলে সমাজের ভেতরে বিদ্যমান কুসংস্কার, অন্ধ বিশ^াস, ধর্মীয় গোঁড়ামি, মানসিক সংকীর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা, ধনী-দরিদ্র ভেদাভেদ ইত্যাদি নির্মূল করা সম্ভব। একজন শিশু সামাজিকভাবে বিকশিত হলে সে সমাজের দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে, তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সবসময় সচেষ্ট ও সক্রিয় থাকবে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুকে প্রকৃত শিক্ষিত করে তোলা সম্ভব কি না, তা ভেবে দেখবার অবকাশ রয়েছে। কেননা, শিশুকে শেখাতে হবে আনন্দের সঙ্গে। শিক্ষার মধ্যে আনন্দ না থাকলে তা ভারি বোঝার মতো মনে হবে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আনন্দহীন শিক্ষা, শিক্ষা নয়, যে শিক্ষায় আনন্দ নেই, সে শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষা হতে পারে না।’

‘শিশুর মনের আনন্দই তার দেহমনের শক্তির মূল উৎস।’ আনন্দ ও শিশুবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারলে শিশুকে প্রকৃত শিক্ষিত করে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। শাসন, নিয়ন্ত্রণ, আনন্দহীন পরিবেশ শিশুর শিক্ষাজীবনকে চরম অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়। শিশুশিক্ষার উপযুক্ত মাধ্যম হলো আনন্দদায়ক শিক্ষা। শিশুরা সব সময় আনন্দঘন পরিবেশে থাকতে পছন্দ করে। শিশুশিক্ষা ও আনন্দ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। প্রতিজন শিশুর ভেতরেই কোনো-না-কোনা প্রতিভা সুপ্ত থাকে, উপযুক্ত পরিবেশ পেলে সে তার বিকাশ ঘটাতে পারে। আর তার জন্য চাই আনন্দঘন পরিবেশ। শিশুরা শিখবে আনন্দের সাথে খেলাধুলার মাধ্যমে, নিজেদের ইচ্ছেমতো, মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ইচ্ছেগুলোর ফানুস উড়িয়ে। মানুষ যা কিছু শেখে তার অনেক কিছুই সে প্রকৃতি থেকে পায়। তাই শিশুশিক্ষায় প্রকৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে পারে। শিশুদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হলে তাদের প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিয়ে যেতে হবে।

বিদ্যালয় শিশুদের প্রাণ। তাদের মেধা ও মননশীলতা বিকাশের মুক্তাঙ্গন, অবাধ জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান। শিক্ষক হলেন এ জ্ঞানচর্চা কেন্দ্রের প্রধান। শিশুর সামগ্রিক বিকাশে শিক্ষকের ভ‚মিকা সবচেয়ে বেশি। ভয়-ভীতি, সংশয়, দ্বিধা শিশুর জ্ঞানচর্চায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এবং তাদের মনে একঘেয়েমির জন্ম দিতে পারে। তাই শিশুর জানার পথে যাতে একঘেয়েমি না আসে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শিক্ষার কৌশলে নতুনত্ব আনতে হবে। পাঠ্যবই মুখস্থ না করিয়ে গল্প বলার ছলে, খেলাধুলা, ছবি আঁকার মাধ্যমে শেখাতে হবে। শিক্ষককে শিশুদের প্রভু না হয়ে তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতে হবে। শিশুরা যেন নির্ভয়ে প্রশ্ন করতে পারে, সহজে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে, শিক্ষককে সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। শিশুমনের নানা কৌত‚হলী জিজ্ঞাসার জবাব শিক্ষক-কে দিতে হবে।

আমাদের দেশে নানামুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে। শিশুশিক্ষার জন্য সরকার পরিচালিত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, এবতাদিয়া ও কওমি মাদ্রাসা, কিন্ডারগার্টেন, এনজিও পরিচালিত বিদ্যালয়, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল প্রভৃতি। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এসব হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোথাও আনন্দঘন শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ নেই। আবার নানামুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু থাকায় জীবনের শুরুতেই শিশুরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। শিকার হচ্ছে প্রতারণার। তাদের প্রকৃত মেধা ও প্রতিভার বিকাশ ঘটছে না। বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দালানকোঠার ভেতরে প্রতিষ্ঠিত। প্রকৃতির সঙ্গে কোনো যোগ নেই। খেলাধুলার মাঠ নেই। ফলে ইট-কাঠের ইমারতের ভেতরে বড়ো শহরাঞ্চলে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে এসি রুমে বসে শিশুরা বই মুখস্থ করছে। যারা সরকারি বিদ্যালয়ে পড়ছে, তারা এসি রুমে না বসলেও কাজ কিন্তু একই করছেÑ মুখস্থ করছে বই। ‘গ্রন্থগত বিদ্যা আর পরহস্তে ধন, নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়োজন।’ চির সত্য এই বাক্যটির ভাবসম্প্রসারণ লিখতে দেওয়া হয় বিদ্যালয়ের পরীক্ষায়। পরিহাসের বিষয়, গ্রন্থগত বিদ্যা অর্জন করে তার বিরুদ্ধেই লিখতে হয় কোমলমতি শিশুদের। ‘হায় সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ।’

তার মানে এই নয় যে, শিশু বই পড়বে না। শিশু শ্রেণিকক্ষে অবশ্যই বই পড়বে। বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান শিখবে। কিন্তু সেই শেখাটা হতে হবে আনন্দের। শিশুকে নদীর কাছে, বৃক্ষের কাছে, পাখির কাছে নিয়ে যেতে হবে। দিগন্তবিস্তৃত সবুজ প্রান্তর, ধানক্ষেত, হলুদ শর্ষেফুলের মাঠ শিশু মনে যে আনন্দ দেবে বই পড়ে ধান গাছ বা শর্ষে গাছ চিনতে গেলে কি শিশু সেই আনন্দ পাবে ? না কি ধানগাছ, বটগাছ, শর্ষে ফুল ঠিকভাবে চিনতে পারবে ?

প্রত্যেক শিশুর ভেতরেই কোনো-না-কোনো প্রতিভা লুকিয়ে থাকে। শিক্ষক ও বিদ্যালয়ের দায়িত্ব হলো শিশুর প্রতিভা বিকাশে সহযোগিতা করা। এর জন্য প্রয়োজন নিযমিত গান, নাচ, আবৃত্তি, গল্প বলা, বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা, বই পাঠ। বিদ্যালয়ে নিযমিত এসবের আয়োজন করতে হবে। শিক্ষকের দায়িত্ব হলো শিশুদের এইসব আয়োজনে অংশ নিতে সহায়তা করা। শহরের ব্যবসায়কেন্দ্রিক বিদ্যালয়গুলোতে খেলার মাঠ নেই। ফলে শিশুরা বেড়ে উঠছে দুর্বল স্বাস্থ্য নিয়ে। বিদ্যালয়ে যদি খেলার মাঠ না থাকে, তাহলে বিদ্যালয়ের কাছাকাছি পাড়া-মহল্লায় যেখানে মাঠ আছে, সেখানে শিশুরা যেন খেলাধুলা করতে পারে, বিদ্যালয়ের উচিত সেই ব্যবস্থা করে দেওয়া।

শিশুরা সব সময় গন্তিবব্ধ জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। তারা বাধার প্রাচীর ডিঙিয়ে সামনে এগুতে চায়। তারা চায় নদীর প্রবহমানতার মতো বাধাহীন উন্মুক্ত জীবন। ধরাবাঁধা নিয়মের নিগড়ে তারা আটকে থাকতে চায় না। শিশুদের এইসব মুক্তচিন্তার দরজা-জানালাগুলো খুলে দিয়ে তাদের ঠিক পথে পরিচালিত করা শিক্ষক ও বিদ্যালয়ের দায়িত্ব।