জন্মের আগে ও পরে শিশুর যত্ন নেবেন যেভাবে

14 Aug 2022, 02:35 PM শিশুভুবন শেয়ার:
জন্মের আগে ও পরে শিশুর যত্ন নেবেন যেভাবে

অনেকেই মনে করেন, শিশুর জন্মের পরেই তার স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হয়। এধারণাটি ঠিক নয়। জন্মের আগে থেকেই শিশুর যত্ন নিতে শুরু করা উচিত।
জন্মের আগে শিশুর যত্ন নেবেন যেভাবে
ভাবছেন, জন্মের আগে কী ভাবে শিশুর যত্ন নেওয়া সম্ভব ? শিশু মায়ের গর্ভে থাকাকালীনই তার যত্ন নিতে শুরু করা দরকার। হবু মা-কে গর্ভাবস্থায় ১২ সপ্তাহের মাথায় ধনুষ্টঙ্কারের টিকা নিতে হবে। মা ও গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্য ঠিক আছে কি না তা বোঝার জন্য হবু মায়ের নিয়মিত ওজন মাপতে হবে।

১৪ সপ্তাহের পরে আরও একটি টিকা দিতে হবে। যে-সব পরিবারে জন্ডিস এবং বংশগত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস রয়েছে অর্থাৎ যে সব রোগব্যাধি গর্ভবতীকে প্রভাবিত করতে পারে, সেগুলো থেকে হবু মা ও শিশুকে দূরে রাখার যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। হেপাটাইটিস বি, আর এইচ নেগেটিভ থাকলে পরীক্ষা করিয়ে সেগুলোর প্রতিষেধক নিতে হবে। শিশুর স্বাস্থ্যের অবস্থা সম্বন্ধে জানতে যে-সব পরীক্ষা সহায়ক, মায়ের রক্তপরীক্ষার মাধ্যমে সেগুলোও করিয়ে নিতে হবে।

শুধু তাই নয়, গর্ভাবস্থায় মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যও যাতে ঠিকঠাক থাকে, সে দিকেও সমানভাবে নজর দিতে হবে। যেকোনো ধরনের মানসিক অশান্তি, দুশ্চিন্তা বা টেনশন শিশুর পক্ষে ক্ষতিকারক।

জন্মের পরপর শিশুকে যে টিকা দিতে হবে
জন্মের পরেই শিশুকে যক্ষ্মার টিকা দিতে হবে। গর্ভাবস্থায় ধনুষ্টঙ্কারের টিকা নেওয়া থাকলে এর পরেই হাম, হুপিং কাশির মতো রোগের প্রতিষেধক নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, পোলিও, ডিপথেরিয়া, পার টু সিস [হুপিং কাশি], টিটেনাস, হেপাটাইটিস বি এবং হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা [টাইপ-বি], এই সমস্ত রোগের টিকা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। শিশুবয়সের এই টিকাগুলো জীবনভর রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে।

ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শিশুকে শুধু মায়ের দুধ পান করান
মায়ের দুধ শিশুর কাছে অমৃতের সমান। এককথায় বললে শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ও প্রতিষেধক হিসেবে মাতৃদুগ্ধের কোনও বিকল্প নেই। মায়ের দুধ যেমন শিশুর খিদে মেটায়, পুষ্টি জোগায়, তেমনি অনেক রোগের প্রতিষেধক হিসেবেও কাজ করে। প্রসবের পরে মায়ের প্রথম গাঢ় হলুদ দুধ, যাকে ‘কোলোস্ট্রাম’ বলা হয়, এটি শিশুর জন্য অত্যন্ত জরুরি। এই দুধ যাতে প্রত্যেক সদ্যোজাত পায়, সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে।

আজকাল অনেক মা নানা কারণে সন্তানকে স্তন্যপান করাতে চান না। তারা বাজার থেকে গুঁড়ো দুধ কিনে শিশুকে পান করান। এ ক্ষেত্রে মায়ের কোনও শারীরিক সমস্যা থাকলে চিকিৎসককে দেখিয়ে নিয়মিত স্তন্যপান করাতে পারলে ভালো। স্তন্যপান করালে মায়ের সঙ্গে শিশুর শরীরের সংযোগ ঘটে, এটি খুবই জরুরি। বাইরের দুধ ব্যবহারে শিশু অনেক রোগের প্রতিষেধক থেকে বঞ্চিত হয়। একান্তই যদি বাইরের দুধ খাওয়াতেই হয়, সে ক্ষেত্রে দুধ খাওয়ানোর জন্য যে পাত্র ব্যবহার করা হয়, তা সম্পূর্ণভাবে জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে। দুধ খাওয়ানোর সময়ে সতর্কতা অবলম্বন না করলে শিশুর শরীরে নানা ধরনের রোগজীবাণু বাসা বাঁধতে পারে।

শিশুকে পানি পান করানো কতটা ঝুঁকির

অনেকে সদ্যজাত শিশুকে পানি পান করতে দেন। এটি একেবারেই উচিত না। শিশুর জন্মের পরে ছয় মাস শুধু মায়ের দুধই যথেষ্ট। কোনো কোনো বাবা-মায়ের এ বিষয়ে ভুল ধারণা থাকে। তারা মনে করেন যে, শিশুকে পানি না দিলে হজমে সমস্যা হবে। তারা জানেন না যে, মাতৃদুগ্ধের মধ্যে শতকরা ৮৮ ভাগ পানি রয়েছে। এই দুধ থেকেই শিশু প্রয়োজনীয় পানি পায়। তাই আলাদা করে পানি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং নির্দিষ্ট বয়সের আগে পানি পান করালে সমস্যা দেখা দিতে পারে।

জন্মের পরই বহু শিশুই কম ওজন এবং জন্ডিসের মতো অসুখে ভোগে। তা ছাড়া, শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এমনিতেই কম। তাই ঠিকমতো যত্ন না নিলে নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শ্বাসজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ঠান্ডা লেগে সর্দি-কাশির সমস্যা হতেই পারে। ঠান্ডা লাগা না কমলে নিউমোনিয়াও হতে পারে। শিশুদের বারবার মুখে হাত দেওয়া, কোনো জিনিস বা খেলনা মুখে দেওয়ার প্রবণতা থাকে। এ সবের মাধ্যমে রোগজীবাণু প্রবেশের সম্ভাবনা থেকে পেটের রোগও দেখা দিতে পারে। এ সব ক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অবহেলা করলে রোগ জটিল আকার ধারণ করতে পারে।

শিশুর কোনো শারীরিক সমস্যা আছে কি ?

শিশুর কোনো শারীরিক সমস্যা থাকলে, তার প্রাথমিক লক্ষণ হল স্তন্যপানে অনীহা। স্বাভাবিকভাবে স্তন্যপান করলে বুঝতে হবে শিশু সুস্থ ও স্বাভাবিক রয়েছে। কিন্তু স্তন্যপান করতে না চাইলে বা ঘ্যান ঘ্যান করলে বুঝতে হবে কোনও সমস্যা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। শ্বাস-প্রশ্বাস জোরে হলেও বুঝতে হবে শিশু কোনো শারীরিক সমস্যায় ভুগছে।

যে-সকল শিশুর স্বাস্থ্য সামগ্রিক ভাবে খারাপ, তাঁদের ডায়েরিয়া সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেক বেশি। বিশেষ করে যাদের ওজন স্বভাবিকের তুলনায় কম, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে বড়ো হয়, মায়ের স্বাস্থ্য ভালো নয়, তাদেরই সমস্যা বেশি দেখা দেয়। ডায়েরিয়া হলে অনবরত মলত্যাগের কারণে শরীরে জলের অভাব হলেই শিশু ক্রমশ নেতিয়ে পড়ে। তাই ডায়েরিয়া শুরু হলেই বারেবারে মুখে খাওয়ার স্যালাইন খাওয়ানো বাধ্যতামূলক। দুগ্ধপোষ্য হলে অবশ্যই মায়ের দুধই দেওয়া উচিত।

রোটা ভাইরাসের কারণে ডায়েরিয়া হলে তা প্রাণঘাতীও হতে পারে। তাই রোটাভাইরাসের টিকা দিয়ে নিলে ভালো হয়। এই টিকা নেওয়া থাকলে রোটা ভাইরাসজনিত ডায়েরিয়ার কারণে হওয়া ৮০ শতাংশ মৃত্যু রোধ করা সম্ভব।


শিশুর বংশগত রোগালাই

মা-বাবা অথবা পরিবারের কারও শ্বাসজনিত সমস্যা থাকলে শিশুও এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। কেননা, শ্বাসপীড়া একধরনের বংশগত রোগ। মা, বাবা বা পরিবারে এ-ধরনের অসুস্থতা থাকলে শিশুরও ওই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। যেকোনো বংশগত রোগের ক্ষেত্রে এটা সত্য।


নিয়মিত গোসল করাতে হবে

শিশুকে নিয়মিত গোসল করানো দরকার। ত্বক পরিষ্কার রাখতে সাবান, শ্যাম্পু ব্যবহার করা যায়। তবে, সরিষার তেল ব্যবহারে অ্যালার্জির ঝুঁকি বেশি থাকে। পাশাপাশি, শিশুর ঘুম পর্যাপ্ত হচ্ছে কি না, সে বিষয়েও নজর রাখা জরুরি। কারণ, শিশুর ঠিকমতো শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত ঘুম দরকার।


শিশুর স্বাস্থ্যের সঙ্গে প্রসূতি মায়ের যত্ন অঙ্গাঙ্গিভাবে জাড়িত

শিশুর যত্ন নিতে গিয়ে অনেক সময়েই আমরা মায়ের স্বাস্থ্য সম্পর্কে উদাসীন হয়ে যাই। অথচ শিশু মায়ের থেকেই তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায়। তাই শিশুর স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য মায়ের ঠিকমতো পুষ্টি যাতে হয়, তা দেখতে হবে। সময়মতো পুষ্টিকর খাওয়াদাওয়া, ঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, রোগ হলে সত্বর তার চিকিৎসা করানোÑ সব বিষয় মেনে চলতেই হবে।


শিশুর হাতে মোবাইল ফোন দেবেন না

অনেক সময়েই দেখা যায়, খেলনার পাশাপাশি আজকাল বাবা-মায়েরা শিশুর হাতে মোবাইল ফোনও ধরিয়ে দেন। এমন করা একেবারেই উচিত নয়। মোবাইল ফোন কখনো খেলনার বিকল্প হতে পারে না। মোবাইল ফোন থেকে নির্গত বিকিরণ শিশুর পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। অনেক সময়ে শিশুরা মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে জিভও ছোঁয়ায়। এর থেকে নানা ধরনের ক্ষতিকর জীবাণু শিশুর শরীরে প্রবেশ করতে পারে।