ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

14 Aug 2022, 02:03 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]

আমরা যখন প্রাগে পৌঁছলাম তখন দিনের শেষ, সন্ধের শুরু। প্রাগ এয়ারপোর্টটিও নেহায়েত ছোটো নয়। তবে, তেমন কোনো ঝামেলা ছাড়াই নির্বিঘ্নে এযারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আমরা সরাসরি টেক্সি স্ট্যান্ডে চলে যাই; আসলে জুরিখে আমাদের হোটেল থেকে এয়ারপোর্ট পৌঁছুতে যে ধকল গেল তারপর আমাদের আর খুব কম এনার্জিই অবশিষ্ট ছিল পাবলিক ট্রান্সপোর্ট খুঁজে নিয়ে হোটেলে যাওয়ার। তারচেয়ে এই ভালো গুগল থেকে ঠিকানাটা ডাউনলোড করে টেক্সি ড্রাইভারকে তা বুঝিয়ে দিয়ে নিশ্চিত হয়ে যাওয়া। আমরা যখন হোটেলে পৌঁছাই তখন রীতিমতো রাত, সূর্যের আলোর আর ছিটেফোটাও অবশিষ্ট নেই। এরই মাঝে বশির হোটেল মালকিনের সাথে ফোনে কথা বলে মূল দরজার পাসওয়ার্ড জেনে নিয়ে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট অ্যাপার্টমেন্টের চাবির হদিসও নিল। অ্যাপার্টমেন্টটি বেশ বড়ো, তিনটে রুম, ডাইনিং আর কিচেন তো রয়েছেই আর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার দুটি বাথরুম রয়েছে। কি শুনে খুব অদ্ভুদ লাগছে না, কেননা আমাদের দেশে এটাই খুব স্বাভাবিক ঘটনা কিন্তু ইউরোপে একটি অ্যাপার্টমেন্টে একাধিক অপ্রত্যাশিত এবং আশ্চর্যজনক। অ্যাপার্টমেন্ট যত বড়ই হোক না কেন, বাথরুমের ব্যাপারে তাদের কৃচ্ছ্র দেখার মতো। যাই হোক, এটা আমাদের জন্য খুব স্বস্তির ব্যাপার ছিল। ও হ্যা প্রাগের এই অ্যাপার্টমেন্টেটা কিন্তু এয়ার বিএনবির এনলিস্টেট হলিডে হাউজ, এ বিষয়টি নিয়ে আগেও একটু বলেছি। তবে, যে বিষয়টি আবারও বলতে ইচ্ছে করছে তা হলো, আমরা যখন প্রাথমিকভাবে আমাদের ভ্রমণ ডেস্টিনেশন ঠিক করে সেখানে হোটেল বা হলিডে হোমস বুক করছিলাম তখন প্রাগে আমরা বুকিং ডটকম থেকে একটি বোটহাউজ বুক করেছিলাম। মূলত নতুন কিছু ভেবেই করা তবে ভেনিসের ক্যাম্পহাউজ আমাদের এতটাই হতাশ করল যে, আমরা ভেনিসে ক্যাম্পে চেকইন করেই প্রাগের বোটহাউজ ক্যানসেল করে এয়ার বিএনবি থেকে এই হলিডে হোমসটি বুক করি, নিঃসন্দেহে এটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এই প্রথম আমরা ইউরোপের কোনো শহরে এসে এত চমৎকার আয়োজন পেলাম। সবাই বেশ খোশ মেজাজে নিজেদের ঠাঁই বুঝে নিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম, তারপর যে বিষয়টি জরুরি হয়ে দেখা দিল তা হলো খাবার। বলাবাহুল্য দুপুরে আমাদের খাওয়াটা জুৎসই হয়নি, কেন হয়নি যারা আগের পর্বটি পড়েছেন তারা তো জানেনইÑ সেই দুঃখের গল্প আর না বলি, আমরা বরং এখন কী খাওয়া যায়, কোথায় খাওয়া যায় তার সন্ধান করি।

গোটা ইউরোপজুড়েই এ বেশ পুরনো সমস্যা, হালাল খাবার। আমরা গুগলে সার্চ দিয়ে কাছাকাছি একটি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট পেলাম, ‘দিল্লির দরবার’ না ‘রেড ফোর্ট’ এরকম কোনো নাম হবে, মনে করতে পারছি না। যাই হোক, ভাত পাওয়া যাবে এ ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম। গুগল মামার দেখানো পথ অনুসরণ করে রেস্টুরেন্টটি খুঁজে পেতে খুব বেগ পেতে হলো না। বেশ ট্র্যাডিশনাল ইন্ডিয়ান ধাঁচে সাজানো রেস্টেুরেন্টটিতে লাল রঙের আধিক্য চোখে পড়ার মতো। একজন বাঙালি ওয়েটারও পাওয়া গেল, ম্যানু চার্ট দেখে কিছুটা হতাশ হতে হলো, না ভাত মিলবে না তবে হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি পাওয়া যাবে, চিকেন, মাটন, ভেজিটেবল এবং চিংড়ি। ওয়েটারের সাথে কথা বলে বুঝলাম চিকেন আর মাটন হালাল বিবেচনায় না খাওয়াই উত্তম তাই আমার জন্য চিংড়ি বিরিয়ানি অর্ডার করলাম। আবিশা চিকেন, বশির মাটন আর সুস্মা যথারীতি ভেজিটেবল ; ও এটা বলা হয়েছে কি না মনে করতে পারছি না, সুস্মা কিন্তু পুরোদস্তর ভেজিটেরিয়ান। এদের পরিবেশনের ধরন বেশ মজার- সাবটাই হাঁড়িতে করে পরিবেশন করে। হাঁড়ির সাইজও বেশ সুন্দর। 

পরিমাণে বেশি থাকায় আমরা সব খেতে পারিনি, তাই বাকিটুকু পার্সেল করে নিয়ে ফিরলাম সকালের নাস্তা এতেই হয়ে যাবে। তবে ফিরতি পথে আমরা একটা সুপারশপে ঢুকলাম, এটা অনেকটা রথদেখা আর কলা বেচার মতো, আমাদের অস্থায়ী আবাসনের মালকিন এই স্টোরেরও মালিক, আমরা তার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ সেরে টুকটাক কেনাকাটা করে ঘরে ফিরলাম। যেহেতু সারাদিনের ধকলটা ছিল মাত্রাতিরিক্ত, যতটা শারীরিক তার দ্বিগুণ মানসিক তাই অবসাদটাও বেশি কাজ করছিল, বিছানায় যেতেই ঘুমটা বেশ জেঁকেই এল।সকালে ঘুম ভেঙেই দেখি সুস্মা সকাল সকাল উঠে নাস্তার আয়োজন করছে, নাস্তা বলতে রাতের বেঁচে যাওয়া বিরিয়ানি আর সবার জন্য ডিম ভাজা। ডিম, কাঁচামরিচ আর পেঁয়াজ রাতেই কেনা হয়েছিল, আর কিচেনেই কফির সকল সরঞ্জাম থাকায় নাস্তায় কফিও ছিল। যেহেতু রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষে আমাদের আর কারোই এনার্জি ছিল না সকালে কী করব বা কোথায় যাব এই পরিকল্পনা করার, তাই খেতে খেতে আমরা প্ল্যান করলাম, কী করা যায়। নেট ঘেটে আমরা কিছু ডে-ট্যুরের বিষয়ে জানালাম যার কিছু দিনব্যাপী, কিছু আধাবেলার আবার কিছু রয়েছে তিন/চার ঘণ্টার। সময় এবং এরিয়া কাভারেজের ওপর ভিত্তি করে এদের চার্জ ভিন্ন হয়ে থাকে। আমার আধা বেলার একটা ট্যুর করব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম, বারোটা থেকে সন্ধে ছ’টা। হাতে বেশ কিছুটা সময় থাকায় কাছাকাছি একটি দোকান থেকে ঘুরে এলাম প্রয়োজনীয় কিছু টুকিটাকি কেনাও হলো। আগেই ভেবে নিয়েছি, দুপুরের খাবারটা কোথাও থেকে পার্সেল নিয়ে নেব, সেটাও হলো। তারপর অনেকটা তড়িঘড়ি করে গোসল সেরে তৈরি হয়ে নিলাম। সাড়ে এগারটা নাগাদ ট্যুর কোম্পানির বাস আমাদের হোটেল থেকে তুলে নিল। আমরা প্রায় সাড়ে এগারোটা নাগাদ নির্দিষ্ট পয়েন্টে গিয়ে টিকেট কেটে নিলাম। আদতে আমাদের এই ট্যুরে বাস জার্নি খুব অল্প সময়ের জন্যই ছিল, বাকিটা সময় হেঁটেই চলতে হয়েছে, আসলে এর আগে এ ধরনের প্রাইভেট সিটি ট্যুরের অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রথমে কিছুটা হতাশ হলেও দিন শেষে হিসাবটা মন্দ ছিল না।

শুরুটা ছিলো চার্লস ব্রিজ থেকে, নদীর নাম ভল্টাভা অর্থাৎ চার্লস ব্রিজটি ভল্টাভা নদীর এপার-ওপারকে সংযুক্ত করেছে। ইউরোপের এ একটি ভালো লাগার বিষয়, নদীকে যেন তারা প্রাণ দিয়ে আগলে রাখে, হয়ত তারা এ সত্যটা উপলব্ধি করতে পারে যে, তাদের এ সম্পদ সীমিত তাই যা আছে তাকে অতি যত্নেই রাখতে হবে। আমাদের দেশে তো শিরা-উপশিরার মতো নদীÑ যেন এর বিনাশ নেই তাই এর যত্নও নেই। প্রকৃতি কিন্তু হিসাব ভুলে না- সেদিন কি খুব দূরে যখন আমাদের উত্তরসূরিরা বইয়ের পাতায় পড়বে এক সময় বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ বলা হতো। আসলে প্রকৃতির প্রতি ইউরোপবাসীর হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা দেখলে নিজেদের জন্য করুণা হয়। যাই হোক, ফিরে আসি চার্লস ব্রিজে, ব্রিজটি খুব বড়ো নয়, টানা হেঁটে গেলে ছয় থেকে আট মিনিটের মতো সময় লাগে। ব্রিজটি বেশ পুরনো ১৫শ’ শতকের প্রথম দিকে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। সেতুর থাম বা খিলানগুলো পাথরের তৈরি। সময়টা দুপুর হলেও রোদের তেজ না থাকায় ব্রিজের উপরে পর্যটকদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো, আসলে আমাদের মতো আরো কিছু ছোটো ছোটো দল ছিল, যারা গ্রুপ ট্যুরে এসেছে। এখানটায় আমাদের জন্য মিনিট বিশেক সময় নির্ধারিত ছিল, যা ছবি তুলতেই শেষ হয়ে যায়। ব্রিজের উপর বাহারি স্থানীয় পণ্যের পসরা ছিল, যাতে দৃষ্টি আটকে গেলেও সময়ের অভাবে আর সেদিকে মনোযোগ দেওয়া গেল না। এরপর আবার পায়ে হাঁটা, পথে যেতে যেতে কিন্তু আমরা আমাদের গাইডের কাছ থেকে চলতি পথের বিবরণ শুনছি, উল্লেখযোগ্য কোনো স্থাপনা থাকলে সেখানে থামছি টুকটাক ছবি তুলছি আবার এগুচ্ছি। গাইডেরও তেমন কোনো তাড়া নেই আমাদেরও নেই অনেকটা রিল্যাক্স মুডেই আমরা হেঁটে বেড়াচ্ছি। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ওয়েইনস্লাস স্কয়ার, শহরের প্রাণকেন্দ্র বলা যায় এটিকে, যা অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। এখন এ স্কোয়ারটি একই সাথে শহরের সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে সমাদৃত। এখানটায় আমরা বেশ কিছুটা সময় কাটালাম সাথে আনা খাবারের সদ্ব্যবহারও হলো এখানে বসেই। তারপর এদিক সেদিক ঘুরে এটাসেটা কেনাও হলো। তারপর আবার হাঁটা, নতুন গন্তব্য প্রাগ ক্যাসেল। নবম শতাব্দীতে নির্মিত এ ক্যাসেলটি বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতির দপ্তর কক্ষ। আদতে এটিকে একটি ক্যাসেল বা দুর্গ না বলে বলা যায় দুর্গগুচ্ছ, এর বেশিরভাগেই প্রবেশ সংরক্ষিত, তবে দুর্গ সংযুক্ত চার্চটি, যার নাম সেন্ট ভিটাস ক্যাথড্রাল, এটি সবার জন্য উন্মুক্ত।