সুগন্ধি-কথা

14 Aug 2022, 01:53 PM অভোগ শেয়ার:
সুগন্ধি-কথা

মানুষের পঞ্চইন্দ্রীয় শক্তির একটি অন্যতম ইন্দ্রীয় হলো ঘ্রাণ। গবেষণা থেকে দেখা গেছে মানুষ প্রায় ৫ থেকে ১০ হাজার ঘ্রাণ সনাক্ত করতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় হঠাৎ কোনো গন্ধ নাকে এলে পুরনো কোনো স্মৃতি মনে পড়ে যায়। তার মানে ঘ্রাণের সঙ্গে আবেগের একটা সম্পর্ক রয়েছে। ঘ্রাণ নির্দিষ্ট কোনো বিশেষ স্মৃতিকে তাজা করে তুলতে পারে। সেই প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ প্রসাধনী হিসেবে সুগন্ধি ব্যবহার করে আসছে। আতর, বডি স্প্রে, পারফিউমÑ এই সবকিছুরই চাহিদা কিন্তু দিন দিন বেড়েই চলেছে। শরীরের দুর্গন্ধ এড়াতে মানুষ সুগন্ধি বা পারফিউম ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু এই সুগন্ধি কীভাবে এলো, প্রথম কারা ব্যবহার করেছিল এই সুগন্ধি ! এমন কিছু বিষয় নিয়ে এবারের অঁ ভোগ আয়োজন...

ল্যাটিন শব্দ ‘পার ফুমাম’ থেকেই মূলত ইংরেজি শব্দ ‘পারফিউম’র উদ্ভব। পার ফুয়াম বলতে মূলত বোঝায় ধোঁয়া থেকে উৎপন্ন সুবাস। সেই প্রাচীনকালে মূলত সুগন্ধি গুল্ম পুড়িয়ে পারফিউম উৎপাদিত হতো। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ প্রসাধনী হিসেবে সুগন্ধি ব্যবহার করে আসছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে সুগন্ধি ব্যবহার ছিল আত্যাবশ্যকীয়। যেকোনো আবিষ্কারের তথ্য নিয়ে বেশ কিছু মতবাদ দেখা যায় ইতিহাসে। সুগন্ধির প্রথম ব্যবহার বা আবিষ্কার নিয়েও বেশ কিছু মতবাদ রয়েছে। তবে এ তথ্যটি নিশ্চিত যে, বিভিন্ন সভ্যতায় একসঙ্গেই সুগন্ধি ব্যবহারে উল্লেখ পাওয়া যায়।
প্রাচীন মেসোপটেমিয়াম সভ্যতায় প্রথম সুগন্ধি ব্যবহার করার প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায়। এরপর মিসর হয়ে সুগন্ধির বিকাশ ঘটে গ্রিস এবং বাকি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে। সুগন্ধির প্রচীন ব্যবহার কোন সভ্যতায় কেমন ছিল তা একটু জেনে নেওয়া যাক !
ইতিহাসে তাপুতি নামে এক রসায়নবিদের উল্লেখ পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, তিনিই প্রথম সুগন্ধির প্রস্তুতকারক। তিনি বিভিন্ন অ্যারোমেটিক্সের সঙ্গে ফুল, তেল এবং ক্যালামাসের পাতন করেছিলেন, তারপরে ফিল্টার করে বেশ কিছু সময়ের জন্য সেগুলো রেখে দিতেন। এভাবইে তিনি সুগন্ধি বের করতেন।
মিশরীয়রা তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে সুগন্ধি তৈরি করত। তারা সুগন্ধহীন তেলের সঙ্গে বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান মিশিয়ে প্রক্রিয়া করে সুগন্ধি তৈরি করত। বেশি সুগন্ধ পেতে তারা স্থানীয় ফুল, ফল বিভিন্ন সুগন্ধি কাঠের ওপর নির্ভর করত। তারা ধূপও সুগন্ধিতে ব্যবহার করত। তাই সে সময় ধূপ ও গন্ধরস ব্যবসার মাধ্যমে মিশরীয়রা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। মিশরীয় রানি ক্লিওপেট্রার সুগন্ধিপ্রীতির কথা ইতিহাসের সুবাদে সকলেই জানে। শুধু ক্লিওপেট্রা নয়, রানি হাটসেপসুটের মতো অনেক মিশরীয় নেতারা সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। এমনকি তাদের বিভিন্ন কক্ষে বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধির ঘ্রাণ পাওয়া যেত। এমনকি তাদের সমাহিত করা সমাধিতেও সুগন্ধি ব্যবহার করা হয়েছিল। আগে যেহেতু লাশকে মমি করে রাখার একটা রীতি ছিল। সেখানেও তারা বেশ দামি সুগন্ধি ব্যবহার করত।
এরপর আসে পার্সিয়ান সভ্যতার কথা। পার্সিয়ানরা সুগন্ধি ব্যবহারে বেশ এগিয়ে ছিল। সেখানে সুগন্ধি সামাজিক মর্যাদার একটি বিষয় ছিল। পার্সিয়ান রাজারা তাদের নিজস্ব স্বাক্ষরযুক্ত সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। যেটা তারা ব্যতীত তাদের সঙ্গী এবং আত্মীয়স্বজনদের ব্যবহারের অনুমতি ছিল না। আসলে পার্সিয়ান সাম্রাজ্যে সুগন্ধি তৈরির সরঞ্জাম, কারখানা, দক্ষ শ্রমিক প্রচুর ছিল তাই তারা সুগন্ধি নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করার সুযোগ পেত। তাই অনেক ধরনের দামি সুগন্ধি পার্সিয়ান সাম্রাজ্যে পাওয়া যেত। প্রাচীন রোমান আর গ্রিকরা বেশ দূরদর্শী ছিল। তারা তাদের সুগন্ধি তৈরির প্রক্রিয়াগুলো নথিভুক্ত করে রাখতেন। এখন সেই ফমুর্লা ব্যবহার করে রোমান আর গ্রিকরা সুগন্ধি তৈরি করছে। এই সুগন্ধিগুলো নাকি একটি ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের আগে বিশ্বের প্রাচীনতম পারফিউম কারখানায় তৈরি হতো। ইউরোপে সুগন্ধি জনপ্রিয় হওয়ার আগেই ভারতীয়রা পুরোদমে সুগন্ধিতে আসক্ত ছিল। মোঘল রানি নূরজাহান সুগন্ধি বিস্তারে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি গোলাপের তেল ও গোলাপজল দিয়ে গোসল করতেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ৭ম শতকে বাগদাদ ছিল সুগন্ধি ব্যবসায়ের কেন্দ্র। আরবের সুগন্ধি বণিকরা পুরো আরব সাম্রাজ্যে সুগন্ধি বিক্রি করত। ব্রিটিশ ধর্মযোদ্ধারা আরব থেকে ফিরে আসার সময় ক্রয় করে নিয়ে আসত আরবের বিখ্যাত সুগন্ধি। এভাবেই ইংরেজদের হাতে আসে সুগন্ধি। এরপর তারা আবিষ্কার করে বিখ্যাত সব সুগন্ধি।
ততদিনে ইতালীয়রা সুগন্ধি তৈরির প্রক্রিয়াটি বেশ নিখুঁতভাবেই শিখে গিয়েছিল। তারা লিকুইড সুগন্ধি উৎপন্ন করেছে ততদিনে। যার জনপ্রিয়তা ছিল অনেক। ইতালিয়ান পর্যটক মার্কো পোলো এবং তার দল তাদের বিভিন্ন জায়গার ভ্রমণ থেকে অনেকগুলো অ্যারোমেটিকস এনেছিল ভেনিসে যা শহরটিকে সুগন্ধির বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত করেছিল। আঠারশো শতাব্দীর শেষের দিকে পারফিউমের বাজারজাতকরণ শুরু হয়। এভাবেই ধীরে ধীরে সুগন্ধি ফ্যাশনের অনুষঙ্গ হতে শুরু করে।

সুগন্ধির ইতিহাসের সঙ্গে জেনে নিন সুগন্ধির কিছু গুণাগুণ
দুর্গন্ধ দূর করার পাশাপাশি সুগন্ধি সারাদিন আপনাকে সতেজ ও ফুরফুরে রাখে
সুগন্ধি বাড়ায় আত্মবিশ্বাস। সুন্দর পোশাকের মতো সুগন্ধিও মনোবল চাঙ্গা করে তুলতে পারে
শুধু সুন্দর গন্ধের জন্য অন্যের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতে পারেন। সুগন্ধির জাদুতে আপনিও আকর্ষণ করতে পারেন অন্যদের
সুগন্ধি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, এমন কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। তবে সুগন্ধি ভালো অনুভূতি দেয়, যা পরোক্ষভাবে স্বাস্থ্যের উপকার করতে পারে
লেবু জাতীয় ফল, পুষ্পশোভিত বা শীতের মসলাদার সুগন্ধি মনকে শান্ত করতে সাহায্য করে। এই সুগন্ধিগুলো আপনার চাপের স্তর নিয়ন্ত্রণ করে
সুগন্ধির আরেকটি কাজ হলো অনিদ্রা দূর করায় সহায়তা করা। যেসব সুগন্ধিতে অ্যাসেনশিয়াল ওয়েল থাকে সেগুলো এ কাজে বেশ কার্যকর। রাতের ঘুম আরামদায়ক ও উপভোগ্য করে তুলতে পারে এ ধরনের সুগন্ধি।
সুগন্ধি মাথা ব্যথা প্রশমিত করে।
ঐশ্বরিয়া রাই : ক্লিনিক হ্যাপিবিশ্বসুন্দরী ঐশ্বরিয়া রাই কোন সুগন্ধিটি ব্যবহার করেন, এটা জানার ইচ্ছে নিশ্চয় অনেকেরই আছে। এটি উচ্চবিত্ত নারীদের বেশ পছন্দের একটি সুগন্ধি, নাম ক্লিনিক হ্যাপি। এই ব্র্যান্ডটি ঐশ^রিয়ার দারুণ প্রিয়। বেশ সতেজ ও হালকা ধরনের সুগন্ধিটি বেশ ব্যয়বহুল।
কঙ্গনা রানাউত : চ্যানেল নম্বর ৫অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাউত বলিউডের অন্যতম সাহসী ও জনপ্রিয় অভিনেত্রী। তার আত্মবিশ^াস ও ঠোঁটকাটা কথার জন্য তিনি বেশ সুপরিচিত। নাম করা পারফিউম চ্যানেল নম্বর ৫ দারুণ পছন্দ কঙ্গনার। এই সিরিজটি হলো বিলাসবহুল ব্র্যান্ড চ্যানেলের সর্বাধিক বিক্রিত পারফিউম। গোলাপ আর জেসমিনের মন মাতানো গন্ধ মানুষকে বেশ তাজা আর পরিষ্কার একটি অনুভূতি দেয়।

ক্যাটরিনা কাইফ গুচি রাশঅভিনেত্রী ক্যাটরিনা কাইফের পছন্দের সুগন্ধি হলো গুচি রাশ। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে লঞ্চ করা জনপ্রিয় সুগন্ধি গুচি রাশে রয়েছে গার্ডেনিয়া ফুলের নির্যাস। মন মাতানো এক রহস্যময় সুগন্ধি এটি।
সানি লিওন : ডিওর ফরএভার অ্যান্ড এভারবলিউড অভিনেত্রী সানি লিওন-এর প্রিয় পারফিউম হলো ডিওর ফরএভার অ্যান্ড এভার। বুলগেরিয়ার গোলাপের সঙ্গে জেসমিন পাপড়িকে একত্র করে এই পারফিউমটি তৈরি করা হয়, যা বেশ হালকা কোমল সুগন্ধ ছড়ায়। বলিউড অনেক নায়িকাদের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে এটি। শ্রীদেবী কন্যা জাহ্নবীও এই ডিওর ফর এভার অ্যান্ড এভার-এর দারুণ ভক্ত।

সোনাম কাপুর এবং লারা দত্ত : টম ফোর্ড ব্ল্যাক অর্কিড
বলিউড অভিনেত্রীরা সোনাম কাপুর এবং লারা দত্ত উভয়ই এই পারফিউমটির দারুণ ভক্ত। এটি নারী পুরুষ উভয়ের জন্যই তৈরি। কারণ, নানা মসলা এবং ধূপের বেশ গাড় একটা গন্ধ রয়েছে এতে। যা বেশ আকর্ষণীয়। এটি বেশ ব্যয়বহুল। এর কালো কাচের বাঁশিযুক্ত বোতলটি বেশ সুন্দর।


আলিয়া ভাটআরমানি কোডআরমানি কোড মূলত পুরুষদের সুগন্ধি। কিন্তু বলিউড অভিনেত্রী অলিয়া ভাট এই সুগন্দিটি বেশি পছন্দ করেন। এই জনপ্রিয় সুগন্ধিটি একটি রোমান্টিক অনুভূতি দেয়, যার মধ্যে একটি ধোঁয়াটে কাঠ কাঠ হালকা গন্ধ আছে।

কারিনা কাপুর : জিন পল গালটিয়ার ক্লাসিক
বলিউড অভিনেত্রী কারিনা কাপুর তার ফ্যাশন সচেতনতার জন্য দারুণ জনপ্রিয়। তার আত্মবিশ^াসকে আরো বাড়িয়ে দেয় তার প্রিয় সুগন্ধি জিন পল গালটিয়ার ক্লাসিক। বেশ প্রাচীন আমেজে তৈরি এই সুগন্ধি কমলা ফুল, আদা, চালের গুঁড়া এবং ভ্যানিলা মিশিয়ে তৈরি করা হয়। নারীদের প্রিয় এই সুগন্ধিটি ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বাজারে পাওয়া যায়।