যক্ষ্মা রোগের কারণ, লক্ষণ এবং প্রতিকার -ডা. আকলেছুর রহমান খান তুহিন

21 Jun 2022, 11:52 AM স্বাস্থ্যভুবন শেয়ার:
যক্ষ্মা রোগের কারণ, লক্ষণ এবং প্রতিকার -ডা. আকলেছুর রহমান খান তুহিন

যক্ষ্মা একটি সংক্রামক ব্যাধি। যা প্রধানত ফুসফুসকে আক্রান্ত করে থাকে। তাছাড়া যক্ষ্মা বলতে সাধারণত আমরা ফুসফুসের যক্ষ্মাকেই বুঝি। তবে ফুসফুস ছাড়াও শরীরের বিভিন্ন স্থানে যক্ষ্মা বাসা বাঁধতে পারে। যেমন : লসিকাগ্রন্থি, হাড় ও গিট, অন্ত্র, হৃদপিণ্ডের আবরণ ও মস্তিষ্কের আবরণ ইত্যাদি। অতীতে মানুষের যক্ষ্মা ধরা পড়লে হতাশ হয়ে জীবন যাপন করত। কারণ, তখন যক্ষ্মার কোনো ওষুধ ছিল না। যার কারণে মানুষ খুবই ভয় পেত। এখন আর সেই দিন নেই, এখন নিয়মিত যক্ষ্মার ওষুধ সেবন করলে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল হয়ে যায়। এবার জেনে নেওয়া যাক যক্ষ্মা রোগের কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার এবং যক্ষ্মা কীভাবে ছড়ায় সে সম্পর্কে...

যক্ষ্মা শুধুমাত্র ফুসফুসের রোগ নয় যক্ষ্মার জীবাণু যে কেবল ফুসফুসকে আক্রান্ত করে তা নয়, এটি মস্তিষ্ক থেকে শুরু করে ত্বক, অন্ত্র, লিভার, কিডনি হাড়-সহ যেকোনো অঙ্গপতঙ্গকে সংক্রমণ করতে পারে। ফুসফুসে যক্ষ্মা হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি হওয়ায় সবার ধারণা যে, যক্ষ্মা মানেই ফুসফুসের রোগ। কিন্তু আসলে তা নয়। মানবদেহের এমন কোনো অর্গান [অঙ্গ] নেই, যেখানে যক্ষ্মা হতে পারে না। যক্ষ্মা হচ্ছে একটি বায়ুবাহিত ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রামক ব্যাধি যেটা মাইক্রোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস জীবাণুর সংক্রমণের দরুন হয়ে থাকে। আর এই জীবাণুর সংক্রমণ যেকোনো অঙ্গেই হতে পারে।

যক্ষ্মা হওয়ার ঝুঁকিতে কোন শ্রেণির মানুষ বেশি থাকে
দেশের মোট জনসংখ্যার একটি অংশ জন্মগতভাবেই যক্ষা রোগের জীবাণু বহন করে। তবে শরীরে জীবাণু থাকা মানেই এই নয় যে, তিনি যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত। তবে জীবাণুর বাহক নিজে আক্রান্ত না হলেও তার মাধ্যমে অন্যের শরীরে যক্ষ্মা ছড়াতে পারে। আর সেটা শরীরের যেকোনো অঙ্গে হতে পারে। এই জীবাণু থেকে তাদেরই রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে, যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই দুর্বল। এছাড়া ডায়াবেটিকস আক্রান্ত রোগীদের এই জীবাণুতে সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। এছাড়া পরিবেশ দূষণ, দারিদ্র্য, মাদক-আসক্তি, অপুষ্টি যক্ষ্মার হার বাড়ার অন্যতম কারণ।
শরীরের অন্যান্য অঙ্গের যক্ষ্মা রোগের লক্ষণগুলোফুসফুসে যক্ষার জীবাণু সংক্রমিত হলে টানা কয়েক সপ্তাহ কাশি থাকে। এছাড়া কফের সঙ্গে রক্ত যাওয়ার মতো সাধারণ কিছু লক্ষণের কথা কমবেশি সবারই জানা। তবে শরীরের অন্য কোনো অংশে যক্ষ্মার জীবাণু সংক্রমিত হলে জানা যাবে কীভাবে ? তারও কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ রয়েছে :
শরীরের যে অংশে যক্ষ্মার জীবাণু সংক্রমিত হবে সেই অংশ ফুলে উঠবে। যেমন গলার গ্ল্যান্ড আক্রান্ত হলে গলা ফুলবে এবং মেরুদণ্ড আক্রান্ত হলে পুরো মেরুদণ্ড ফুলে উঠবে।
ফোলা অংশটি খুব শক্ত বা একদম পানি পানি হবে না। সেটি সলিড হবে। ফোলার আকার বেশি হলে ব্যথাও হতে পারে।
লিভারে যক্ষ্মা হলে পেটে পানি চলে আসে, তাই পেট অস্বাভাবিক ফুলে যায়।
মস্তিষ্কে সংক্রমিত হলে সেখানেও পানির মাত্রা বেড়ে যায়। অর্থাৎ মানুষের মস্তিষ্ক যে ইডিমা বা পানির মধ্যে থাকে, সেটার পরিমাণ বেড়ে যায়।
এছাড়া চামড়া এবং অন্য যেখানেই হোক না কেন, সেই অংশটিও ফুলে ওঠে।
এছাড়া ক্ষুধামন্দা, হঠাৎ শরীরের ওজন কমে যাওয়া, জ্বর জ্বর অনুভব হওয়া, অনেক ঘাম হওয়া ইত্যাদি যক্ষ্মার কিছু সাধারণ লক্ষণ।

করণীয় কী
যক্ষ্মার লক্ষণগুলো দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগীকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। যদি শরীরের কোনো অংশ ফুলে ওঠে আর কয়েক দিনেও ফোলা না কমে। এছাড়া ফুসফুসের যক্ষ্মার লক্ষণগুলোর মধ্যে হাচি-কাশি-সহ লক্ষণগুলোর কোনো একটি যদি দেখা দেয়, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। ডাক্তারি পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে যে, তিনি যক্ষ্মায় আক্রান্ত কি না। ঠিক সময়ে চিকিৎসা নিলে যক্ষ্মা পুরোপুরি নির্মূল হয়ে যায়। তাই দেরি না করে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। যক্ষ্মা দীর্ঘমেয়াদি রোগ হওয়ার কারণে দীর্ঘমেয়াদি ওষুধ সেবন করতে হয়। যেটা ৬ থেকে ৯ মাস পর্যন্ত হয়ে থাকে। রোগীদের ধৈর্যের সঙ্গে ওষুধ খেয়ে যেতে হয়। অনেক সময় দুই থেকে তিন মাস ওষুধ খাওয়ার পর রোগী খুব ভালো অনুভব করে। তার শরীর থেকে রোগের সব লক্ষণই চলে যায়। এমন অবস্থায় অনেকেই সেরে উঠেছেন বলে ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দেন। এরকম অবস্থায় রোগীর আবারো যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং আগে যে ওষুধ খেয়েছে সেটা কোনো কাজে লাগে না। পুনরায় আবার শুরু থেকে ওষুধ খেতে হয়। ঠিক সময়ে চিকিৎসা না নিলে এই জীবাণু শরীরের অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে গিয়ে রোগীর মৃত্যু হতে পারে এবং চিকিৎসা না নেওয়ার কারণে তার মাধ্যমে আরো অনেকের মধ্যে জীবাণুটি ছড়িয়ে পড়তে পারে।
শরীরের অন্য অংশের যক্ষ্মা কতটা ছোঁয়াচেপৃথিবীতে যত প্রকার যক্ষ্মা রয়েছে তার মধ্য ৮০ ভাগই ফুসফুসে হয়ে থাকে এবং এটি সবচেয়ে গুরুতর এবং ভীষণ রকমের ছোঁয়াচে। ফুসফুসের যক্ষ্মায় আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে সুস্থ মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে যেতে পারে। মূলত হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এমনকি কথা বলা থেকেও যক্ষ্মার জীবাণু দ্রুত একজনের কাছ থেকে আরেকজনের ভেতরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তবে শরীরের অন্য অঙ্গপ্রতঙ্গের যক্ষ্মা এতটা ছোঁয়াচে নয়। তাই সেগুলো ফুসফুসের যক্ষ্মার মতো এতটা ঝুঁকিপূর্ণ নয়। শুধু আক্রান্ত ব্যক্তি যদি তার আক্রান্ত স্থান সুস্থ ব্যক্তির শরীরের কেটে যাওয়া বা ক্ষত হয়ে যাওয়া কোনো অংশ স্পর্শ করে, তাহলে এই রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি থাকে। তবে যক্ষ্মার চিকিৎসা শুরুর এক মাসের মধ্যে এই জীবাণু ছড়ানোর প্রকোপ কমে যায়।

ক্ষ্মা ছড়ানোর প্রতিরোধের উপায়
ক্ষ্মার জীবাণু ছড়ানো প্রতিরোধে কিছু বিষয়ে সতর্ক হওয়া প্রয়োজনÑ
হাঁচি-কাশির সময় মুখে রুমাল ব্যবহার করা, না হলে অন্তত হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বা সবার থেকে দূরে গিয়ে কাশি দেওয়া।
যেখানে সেখানে থুথু-কফ না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে ভালোভাবে জায়গাটি পরিষ্কার করা বা মাটিচাপা দেওয়া।
কারো মুখের সামনে গিয়ে কথা না বলা অথবা যক্ষ্মার জীবাণুমুক্ত রোগীর সঙ্গে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলা।
যক্ষ্মা রোগীর আক্রান্ত স্থান, সুস্থ ব্যক্তির ক্ষতস্থানের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখা।
পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হবে
রোগী যক্ষ্মার জীবাণুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে।

যক্ষ্মা রোগের পরীক্ষা
যক্ষ্মা নির্ণয়ের জন্য সাধারণত এমটি টেস্ট, স্পুটাম টেস্ট, এক্স রে, স্মিয়ার টেস্ট, সিটিস্ক্যান, কালচার টেস্ট, এফএনএসি এবং বর্তমান রোগের সবচেয়ে আধুনিক পরীক্ষা জিন এক্সপার্ট করানো হয়ে থাকে। তাছাড়া রোগের ধরন বুঝে নমুনা হিসেবে রোগীর কফ, লালা, হাড় বা গ্ল্যান্ড থেকে তরল সংগ্রহ করা হয়।

লেখক : ডায়াবেটোলজিস্ট, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল