আনন্দময় শৈশব চাই

01 Jun 2022, 12:51 PM শিশুভুবন শেয়ার:
আনন্দময় শৈশব চাই

আজকের শিশু আগামীদিনের সুনাগরিক। শিশু পরিবার ও রাষ্ট্রের সম্পদ। জাতিসঙ্ঘের শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী সকলেই শিশু। জন্মের পর থেকে ১৮ বছর বয়সের মধ্যে দুই/তিন বছর থেকে ১২/১৩ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর শৈশবকাল। শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে এই সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশু আনন্দময় শৈশব কাটালে তার মানসিক ও শারীরিক বিকাশ ঠিকভাবে হবে। শিশুর উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য শৈশবে শিশুর প্রতি যত্নশীল হওয়া জরুরি। মনে রাখতে হবে, এই সময়েই শিশুর সুঅভ্যাসগুলো গড়ে তুলতে হয়।
শিশুর সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সত্য ও সুন্দরের চর্চা করতে হবে। কেবল পাঠ্যবইয়ের বুলি মুখস্থ করালেই চলবে না। প্রাথমিক শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত বিনিয়োগ দরকার। নানাধরনের ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে শিশুদের আনন্দের সাথে নানা বিষয়ের সাথে যুক্ত করতে হবে প্রত্যেকের নিজস্ব আগ্রহ অনুযায়ী। যেমন, ছবি আঁকা, আবৃত্তি করা, গল্প বলা, বিতর্ক করা, অভিনয় করা, প্রকৃতি পাঠ, সুন্দর করে কথা বলা, মনোসংযোগ প্রভৃতি বিষয়ে ক্লাব গঠন করতে হবে।


শিশুর জন্য বিনিয়োগ করুন
শিশুর নির্ভার সুন্দর শৈশবের জন্য সবার প্রথমে দরকার বিনিয়োগ। বিনিয়োগ ছাড়া কোনো কিছুই অর্জন করা যায় না। আপনার শিশুর উন্নত মানসিকতা ও সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য শ্রম, নিষ্ঠা, অর্থ ও সময় বিনিয়োগ করুন। সবার আগে শিশুকে নৈতিকতা ও নিয়মাণবর্তিতা শেখান। অন্যের মতামতের গুরুত্ব সম্পর্কে জানান। আর সেটা পরিপূর্ণভাবে বোঝাতে হলে শিশুর মতামতের গুরুত্ব দিন। শিশুকে ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝতে শেখান।

শিশুকে গুণগত সময় দিন
আপনার শিশুর জন্য প্রতিদিন কিছু সময বরাদ্দ রাখুন। তার পছন্দ-অপছন্দের বিভিন্ন বিষয়ে মনোযোগী হোন। তার সাথে সময় কাটান। গল্প শোনান। তার কথা মনোযোগের সঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে শুনুন। তার ছেটো ছোটো সমস্যাগুলোর সমাধান করুন। তাকে গুরুত্ব দিলে সে যে একজন ব্যক্তি তার যে আলাদা একটি সত্তা আছে, তা সে বুঝতে শিখবে।


বাড়ির পরিবেশ সুন্দর রাখুনবাড়ির সুন্দর পরিবেশ শিশুর বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। শিশুরা সবসময় বড়োদের অনুকরণ করে। বাড়ির বড়োদের আচরণ থেকে শিশুরা প্রভাবিত হয় সবচেয়ে বেশি। আপনি বই পড়লে সে বই পড়তে শিখবে। আপনি মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকলে সেও সেটি করতে চাইবে। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে সম্মান করলে ভালোবাসলে শিশু-ও সেটি শিখবে। পারতপক্ষে শিশুর সামনে ঝগড়া-বিবাদে জড়াবেন না। মুখে খারাপ কথা উচ্চারণ করবেন না। আপনি যা বলবেন, আপনার শিশু তা অনুকরণ করবে।

শিশুকে মাঝে মাঝে বেড়াতে নিয়ে যান
শহরের শিশুরা চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে ওঠে। আপনার শিশুকে নিয়ে মাঝে মাঝে বাইরে বের হোন। বাড়ির ছাদে ওঠেন। পর্কে ঘুরতে যান। ব্যস্ত জীবন থেকে সময় বের করে দূরে কোথাও নদীর ধারে বা কোনো ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থানে ঘুরে আসুন। এতে শিশু দৈনন্দিনের একঘেয়ামি থেকে মুক্তি পাবে।


শিশুর পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন
বই পড়া অভ্যাসের ব্যাপার। বই পড়ে শিশুর ভাষাগত দক্ষতা বাড়ে, শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়। অজানাকে জানে, অদেখাকে মনের চোখে দিয়ে দেখতে পায়। স্মার্টফোনের গেম, টেলিভিশনের কুটিল চরিত্রের দাপাদাপি শিশুর শৈশবকে বিষাক্ত করে তোলে। বই পড়লে শিশুর কল্পনার জগত সৃষ্টি হবে। সে স্বপ্নবান মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে। তাই শিশুকে দামি দামি খেলনা কিনে না দিয়ে সুন্দর সুন্দর বই কিনে দিন। বই থেকে ভালো ভালো গল্প পড়ে শোনান।

শিশুকে প্রতিদিন খেলতে পাঠান
খেলাধুলা শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে অবদান রাখে। খেলার মাঠে, বাড়ির আঙিনায়, বাসার পাশের খালি জায়গায় শিশুকে খেলতে পাঠান। এতে সে অন্যদের সাথে মেশার সুযোগ পাবে। বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে। পারস্পরিক যোগাযোগ বাড়বে ও সহানুভূতি তৈরি হবে। শিশু নিজেকে সমাজের একজন বলে ভাবতে শিখবে। নিয়মিত খেলাধুলা করলে শরীরে রক্ত চলাচল বাড়ে। ফলে শরীর ও মন উভয়ই চাঙ্গা থাকে।
অন্য শিশুর সঙ্গে তুলনা করবেন না
প্রত্যেক শিশুর মধ্যে কিছু-না-কিছু প্রতিভা থাকে। আপনার শিশুর কী করতে ভালো লাগে, সেটি জানুন এবং তাকে সেটি করতে উৎসাহ দিন। কখনো অন্য শিশুর সাথে তুলনা করবেন না। সে নিজেই অনন্যÑ এটি তাকে বুঝতে দিন। আরেকজন ক্লাসে প্রথম হয়, কিংবা সুন্দর ছবি আঁকে তাই তাকেও প্রথম হতে হবে বা ছবি আঁকতে হবে এমন কথা কখনো শিশুকে বলবেন না। এতে শিশুর ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি হয় এবং সে হীনমন্যতায় ভোগে।

শিশুর মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলুন
আপনার শিশুকে দায়িত্ব দিন। তাতে তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠবে। পড়ার চেবিল, স্কুলের ব্যাগ গোছানো, নিজের কাপড় ঝুড়িতে রাখা, আপনি যখন রান্না করেন তখন তরকারির ডালা, বাটি ও চামচ ইত্যাদি এগিয়ে দেওয়ার মতো কাজগুলো দিন। এর ফলে শিশু নিজেকে বাড়ির গৌরবান্বিত সদস্য মনে করবে।

শিশুর কৌতূহল মেটান
শিশুরা অনেক বেশি কৌতূহলী হয়। তারা সবসময় প্রশ্ন করে। এটা কী ? ওটা কী ? কেন হয় ? জানতে চায়। এ সময় তাদের ধমক দিয়ে থামিয়ে দেবেন না। বিরক্তি প্রকাশ করবেন না। তার প্রশ্ন মনোযোগ দিয়ে শুনুন এবং তাকে বুঝিয়ে বলুন।

স্পর্শ সম্পর্কে সচেতন করুন
আপনার শিশুকে নিরাপদ ও অনিরাপদ স্পর্শ সম্পর্কে সচেতন করুন। বাবা-মাকে অন্য কারও কাছে শিশুকে ছাড়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে। তার ব্যক্তিগত বা স্পর্শকাতর অঙ্গ কোনগুলো তা তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে, কেউ যদি অযাচিতভাবে স্পর্শ করে তাহলে সে যেন লজ্জা পেয়ে তা গোপন না করে প্রকাশ করে দেয়। স্পর্শ সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকলে শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হতে পারে। এমনকি ছেলে শিশুও অনিরাপদ স্পর্শের সম্মুখীন হতে পারে। তাই এ বিষয়ে সর্বেচ্চ সচেতন থাকতে হবে।

গেজেট ব্যবহারে সতর্ক থাকুন
বাড়িতে স্মার্টফোন, ট্যাব-সহ অন্যান্য গ্যাজেটের ব্যবহার সীমিত রাখুন। ডিভাইসে আসক্তি তৈরি হলে শিশুর আচরণ অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। অনেকে শিশুকে স্মার্টফোন দিয়ে খাওয়ার অভ্যাস করে। এটি বিপজ্জনক প্রক্রিয়া। কারণ, কিছুদিন পর আর স্মার্টফোন ছাড়া সে কোনোভাবেই খেতে চাইবে না। পড়ালেখার প্রয়োজনে স্কুলগামী শিশুরা স্মার্টফোন ব্যবহার করতে পারবে, তবে তা অভিবাবকের সম্মতি নিয়ে এবং খুবই সীমিত সময়ের জন্য।

স্কুলভীতি সম্পর্কে সচেতন থাকুন
বিভিন্ন কারণে শিশুর মধ্যে স্কুল ভীতি তৈরি হতে পারে। সহপাঠী বা সঙ্গীদের কটাক্ষ, বন্ধুদের দ্বারা অপমানিত হওয়া, শিক্ষকদের কড়া শাসন, পরীক্ষায় ভালো করতে না পারা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্বিক পরিবেশ ইত্যাদি নানা কারণে আপনার শিশুর মধ্যে স্কুলভীতি জন্মাতে পারে। এমন কিছু হলে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে শিশুর স্কুলভীতি দূর করতে হবে। পরীক্ষায় খারাপ করলে বকাঝকা না করে বুঝিয়ে বলতে হবে। পরের বার যেন ভালো করতে পারে তার জন্য উৎসাহ দিতে হবে।
শিশুর আবেগ-কে গুরুত্ব দিন
আবেগ হচ্ছে আলোড়িত বা উত্তেজিত অবস্থা। শৈশবকাল থেকেই শিশুর মধ্যে ভালোবাসার মতো আবেগের প্রকাশ দেখা যায়। শিশুরা বাবা-মা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব, স্কুল বা গৃহশিক্ষককে ভালোবাসে। ঘৃণা, আগ্রহ বা কৌতূহল ভয়-ভীতি, ক্রোধ বা রাগ, আনন্দের মতো আবেগগুলোও শৈশবেই বিকাশ লাভ করে। তাই এ পর্যায়ে শিশুর লালন-পালনে বিশেষ যত্ন নিতে হবে।

জ্ঞান বিকাশে সাহায্য করুন
শৈশবেই শিশুরা কোনো কিছুর সমাধান করতে শেখে। এ সময়ে তাদের ভাষার, শব্দের ও বুদ্ধির বিকাশ ঘটে। শিশুর বুদ্ধির বিকাশে বংশগতি ও পরিবেশ উভয়ই ভূমিকা রাখে। কে তার মা-বাবা, মা রাগ করে না স্বাভাবিকভাবে কথা বলে, তা বুঝতে পারে। এ সময় সংখ্যা, ছোটো-বড়ো ইত্যাদি বিষয়ে ধারণা লাভ করে। বিভিন্ন প্রাণী ও বস্তুর পার্থক্য করতে পারে। কোনো বস্তু বা কোনোকিছু লুকিয়ে রাখলে খুঁজে বের করতে পারে। আবার কোনোকিছু স্পর্শ করে, দেখে, নাড়াচাড়া করে ওই বস্তু সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। অর্থাৎ শিশুর জ্ঞানের বিকাশ ঘটে। তাই এ সময়ে এসব বিষয়ে তাকে বাধা না দিয়ে সহযোগিতা করুন।
আপনার শিশু পরীক্ষায় ভালো ফল করছে, আর কিছুই করছে না। এতে খুশি হওয়ার কিছু নেই। ভালো ফল নিশ্চয়ই করবে। কিন্তু এর পাশাপাশি তার শারীরিকে ও মানসিক বিকাশ ঠিকভাবে হচ্ছে কি না খেয়াল রাখুন। শিশুকে আনন্দময় শৈশব উপহার দিন।