বাজপাখির থাবা -কানিজ পারিজাত

26 Apr 2022, 12:13 PM সাহিত্যভুবন শেয়ার:
বাজপাখির থাবা  -কানিজ পারিজাত

ঘুম ভাঙার পর বিষয়টি খেয়াল করলো দুলারী, নাহ! অন্যদিনের মতো ঘরের বাতাসে আঁশটে গন্ধটা নেই- কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়ে গেছে মানুষটা। অন্যদিন সে বেরিয়ে গেলেও বাতাসে রেখে যায় তার অস্তিত্ব। আঁশটে গুমোট এক গন্ধের অস্তিত্ব। যেন চলে গিয়েও থেকে যায় মানুষটি। আজ গন্ধটি একদম নেই। বাতাস একেবারে হালকা। একটু ধীরে বিছানা থেকে নামে দুলারী। মেঝেতে শোয়া মানুষটা বিছানাটা উঠিয়ে ভাঁজ করে রেখে গেছে একপাশে। ভাঁজটা বেশ গোছানো। ছ্যাদাড়ে স্বভাবের মানুষটি প্রায় দিনই তেলচিটে পড়া বালিশ আর পুতিয়ে যাওয়া তোশকটা কেমন দলামুচড়ানো করে রেখে যায়। আজ দলামুচড়ানো ভাবটা নেই। বেশ স্বস্তি বোধ করে দুলারী। আসলে আঁশটে গন্ধঅলা মানুষটার বিছানাতেও কেমন আঁশটে গন্ধ। সে এলোমেলো রেখে গেলে দুলারীকেই ভাঁজ করতে হয়। আর সঙ্গে সঙ্গেই আঁশটে গন্ধটা এসে লাগে নাকে- মাথাটা ঘুরিয়ে বমি আসতে চায় তার। আজ এসবের কিছুই ঘটলো না। বেশ ফুরফুরে লাগে দুলারীর। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করলেও মনটা কেমন ফুরফুরে লাগছে। সোজা পায়ে ঘরের আবছা আলোয় টিনের বেড়ায় ঝোলানো ঘষা কাচের ঘোলা আয়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় দুলারী। আয়নার সামনের দানিতে একটা চিরুনি, কাচের বয়ামে স্নো, এইটা জমে যাওয়া খয়েরিরঙা নেইলপলিশ, কয়েকটা চুলের ক্লিপ, দুটো লাল রঙের লিপস্টিক- আর সেই জিনিসটা, দুলারীর প্রিয় জিনিসটা- গোল সাদা ছোট্ট কৌটায় পোড়ামাটির রঙের পাউডার, মুখে মাখলেই মুখ উজ্জ্বল। পাউডারটা ঘষে ভালো করে মুখে মেখে নেয় দুলারী, কলপাড়ে যাওয়ার সময় যদি দেখা হয় ! এমনিতে দুলারী ফর্সা, হালকা, ছিপছিপে শরীর। বছর বাইশের দুলারী হেঁটে গেলে মানুষ আড়চোখে একবার হলেও তাকায়। দাদি বলত, দুলারীর রূপ নাকি বাড়ির আঙিনায় লাগানো হলুদের ফুলের মতো। এমনিতেই হলুদের ক্ষেতে চোখ যায় না। গাঢ় হলুদ রঙের ফুল ফুটলেই হলুদের ক্ষেতের আসল রূপটা খোলে- মানুষের নজর একবার হলেও যায়। মানুষের নজর পড়ে কি না জানে না দুলারী। তবে, দুলারীর নজর সবসময় আটকে থাকে কলপাড়ে যাওয়ার আগে হাতের বাঁয়ের ঘরটার দিকে- ঘরের মানুষটার দিকে। ভুরভুরে সুবাসওয়ালা এক মানুষ- তার মনের মানুষ।


দরজায় দাঁড়িয়ে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দুলারী। তার নজর তার ঘর থেকে ষোলো পা দূরে, হাতের বাঁয়ের ঘরখানার দিকে। দরজাটা খোলা, আছে- মানুষটা ঘরেই আছে। যাবেই-বা কোথায় ? বাঁচতে হলে মানুষকে ঘরে থাকতে হয়। ঘরে থাকতে গিয়ে কত মানুষকে যে ঘর ছাড়তে হয়, সে খবর কে রাখে ? অত খবর রেখে কাজ নেই দুলারীর, সে শুধু খবর রাখে ওই ঘরটার- আর ঘরে থাকা সুবাসওয়ালা মানুষটার। খুব দ্রুত খাটের দিকে এগিয়ে যায় দুলারী। একটু নিচু হয়ে খাটের নিচ থেকে হাতে তুলে নেয় একটা আলু। আশেপাশে তাকিয়ে খুব সন্তর্পণে আলুটা ছুঁড়ে মারে নিশানা বরাবর- খোলা দরজাটার সামনে। নড়ে উঠল একটা মানুষ। আহ ! কী কাঁপুনি ! সমস্ত শরীরে ঝাঁকি দিয়ে একটা কাঁপুনি ওঠে দুলারীর। এমনটা হয় ! বার বার হয় ! মানুষটাকে দেখলে, মানুষটা কাছে এলে, নিঃশ্বাসটা গায়ে পড়লে, তার গায়ের সুবাসটা নাকে লাগলে, শরীরটা কাঁপে, বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে দুলারীর। আজ বুক মোচড়ের সাথে সাথে পেটটাও কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। কেমন একটা অস্বস্তি হয় দুলারীর। কাঁপা হাতে পানির জগ নিয়ে কলপাড়ের দিকে এগোয়। বাঁয়ের ঘরটার সামনে এসে গতি শ্লথ করে ঘরের ভেতর আবছা আলো আঁধার, তারই ভেতর থেকে একটা ছায়া মানুষ ফিসফিসিয়ে ওঠে- ‘ভিতরে আসো’। কেঁপে ওঠে দুলারী, ইতস্তত করে। কণ্ঠটি আরো ঘন, আরো চাপা স্বরে ফিসফিস করে বলে- ‘কেউ নাইতো, কেউ দেখলে বলবা তরকারি নিতে আসছ’। শিহরিত হয় দুলারী। এদিক ওদিক তাকায়। কেমন একটা ঘোর আসছে তার। একটা হলুদ রঙের মুরগিছানা যেন খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে আধার। একটা বাজপাখি উড়ছে আকাশে, সাঁই-সাঁই-সাঁই। হঠাৎ উড়ে এল বাজপাখিটা, ছোঁ মেরে একঝটকায় তুলে নিল মুরগিছানাটিকে তার থাবার ভেতর। আহ ! শিহরণ ! একটা ঝাঁকি। আবার কাঁপুনি, সমস্ত শরীর কাঁপছে দুলারীর। কাঁপা শরীরে ঘোরগ্রস্ত দুলারী আড়ষ্ট পায়ে এগোয় ঘরের আবছা আঁধারে। বাজপাখিটা আসুক, মারুক একটা ছোঁ, একঝটকায় তুলে নিক মুরগিছানাটিকে তার থাবার ভেতর। চোখ বন্ধ করে একটা শিরশিরে শিহরণে কাঁপতে থাকে দুলারী। বাজপাখিটা ছোঁ মারার আগেই একটা শোরগোল উঠল। বেশ জোরালো শোরগোল- উত্তর দিকের বাদশা মিয়ার ঘরের পাশ থেকে। চমকে ওঠে দুলারী। ছিটকে সরে আসে ঘরের বাইরে। হতচকিত হয় মানুষটাও। সতর্ক দুলারী কলপাড়ের দিকে দ্রুত এগোয়। তাড়াহুড়োর ভেতর হঠাৎ তার খেয়াল হয়- আজ সে পায়নি। এত কাছে গিয়েও পায়নি তার আকাক্সিক্ষত ঘ্রাণ- সুবাসওয়ালা মানুষটার গায়ের ঘ্রাণ।


জটলা, বেশ ঘন জমাট জটলা। শোরগোল উঠে আসছে সেখান থেকেই। থেকে থেকে শোরগোলটা বেশ জোরালো হচ্ছে। অনেকটা কুণ্ডুলী পাকানো ধোঁয়ার মতোই থেকে থেকে শোরগোলের আওয়াজও পাক খেয়ে খেয়ে উঠছে উপরে। সেই পাক খেয়ে ওঠা আওয়াজ থেকে কিছুৃ কথা ভেসে আসছে কানে।

- তুমি মরবা, মর, একলা মর। আমাগো মারবা ক্যান ?

আবার শোনা যায়-

‘কীসের মায়া ? মায়া বলতি এহন কিছু আছে নাহি ? বউ স্বামীরে চেনে না, স্বামী বউরে চেনে না, আপন বাপ-মারে ছেলেমেয়ে কবর পর্যন্ত দেয় না ! সময়টা ভিন্ন। নিজে মরলে মর। অন্যগো মারবা ক্যান ?’ নিজের ঘরের পাতলা খাটে থম মেরে বসে আছে দুলারী। সকাল থেকেই আজ সবকিছু কেমন যেন অন্যরকম। মাথাটা ধরে আছে তার। মনটাও কেমন যেন দমে আছে- দমে যাওয়া মনের বিস্বাদ ভাবটা চলে এসেছে মুখে। মুখটা কেমন তেতো তেতো লাগছে, একটা হন্তদন্ত মানুষের ছায়া এসে পড়ে দরজায়। দুলারী মুখ তুলে তাকায়- শেফালি। উত্তর পাশের বাদশা মিয়ার ঘরের পাশে থাকে। দুলারীর চেয়ে বছর পাঁচেক বড়ো। এই একটা মানুষ, বস্তির যাবতীয় খবর জমা থাকে তার ভাণ্ডারে। অনেকটা যেন কাঁচাপাকা বড়ই ভর্তি গাছের মতো। বড়ই গাছে ঝাকি দিলে যেমন ঝুপ ঝুপ করে ঝরে পড়ে বড়ই তেমনি শেফালিকে ঝাকি দিলেও ঝুপ ঝুপ করে ঝরে পড়ে খবর।

দরজায় দাঁড়িয়ে ব্যস্ত মুখে প্রশ্ন করে শেফালি-

‘ঘটনা দেখছ দুলারী ভাবি’?

- কী ?

নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জানতে চায় দুলারী।

আবু কাকায় তো ফিরা আসছে। বিমার। কেউ তারে ঘরে ঢুকতে দিব না। এমনিতে বস্তিতে লোক নাই। অথচ আবু কাকারে ঠেকাইতে আশেপাশের থিকাও মানুষ আসছে। বেচারি, পাওডা ফুইলা ঢোল, ভ্যানের উপরে শোয়ানো, তারে কেউ ভিতরে ঢুকতেই দিতাছে না। বেচারা এহন হাঁপাইতাছে। কাকী অনেক কানতাছে। সবাই কেমন নির্দয় হইয়া গেছে গো। পেশায় ফুচকা বিক্রেতা আবু মিয়া কিডনি রোগে ভুগছিল বহুদিন ধরে। বাদশা মিয়ার ঘরের দুই ঘর পরেই তার ঘর। বস্তিতে মোট ২৪টি টিনের ঘর। বাদশা মিয়া মাতবর গোছের, প্রবাসী মালিকের ভাড়া গেলা থেকে শুরু করে বস্তির যাবতীয় দেখভালের দায়িত্ব তার। আবু মিয়ার ফিরে আসার বিষয়ে তাই তারই নেতৃত্বে প্রতিরোধ চলছে।

দুলারী হঠাৎ প্রশ্ন্ করে- আবু কাকায় ফিরা আসলো ক্যান, এই জায়গায় মরতে ?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, যাইব কই, এক মাইয়া ছাড়া তো কেউ নাই। সবকিছু বন্ধ, ফুচকার ব্যবসাও বন্ধ, মাইয়ার বাড়ি বেড়াইতে গেছিল, সেই জায়গায় গিয়া পায়ের ফোলাডা বাড়ছে, ডাক্তার দেখাইতে তাই ফিরা আসছে। সব তো বন্ধ। ভ্যানের ওপর শোওয়াইয়া বহু কষ্ট কইরা আনছে। এহন বেচারি সকাল থেইকা রাস্তায় ভ্যানের উপর- গলা শুকাইয়া কাঠ। তাও এক ফোঁটা পানি কেউ দিতাছে না।

দরজায় দাঁড়িয়ে আবারও বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলে শেফালি। ‘সময়ডা বড়ো নির্দয় গো। তাগো তো বিমার মনে কইরা ঘরে ঢুকতে দিতাছে না। আর কতজনের যে বিমার ছাড়াও ঘর ছাড়তে হইব, কে জানে!’ কথাটা বলে বেদনাক্লিষ্ট চোখে দুলারীর ঘরের বাম পাশের ঘরখানার দিকে তাকায়। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে- ‘আমাগোই যে কপালে কী আছে, কে জানে ? আর কয়দিন টিকে থাকতে পারব জানি না !’ সত্যিই সময়টা বড়োই খারাপ। টিকে থাহাটা যেন এক বড়ো ধরনের লড়াই। এই লড়াইয়ে কেউ থাকবে কেউ হারিয়ে যাবে।

হঠাৎ দুলারী শেফালিকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলে ওঠে,

‘এত চিন্তা করো ক্যান- ভাইজানের সবজির ব্যবসাটা তো আর বন্ধ হইব না।’

-কী যে কও তুমি, একজনের আয়ে কী আর চলে ? আমার তিন বাসার ছুডা কামও বন্ধ। আর সারাদিন সে ভ্যানে সবজি নিয়া বাসা বাড়ির সামনে দাঁড়াইয়া থাকে কেউ কিনতেও আসে না। বড়লোকেরা একবারে সব সদাই কিন্না দরজায় খিল আঁটছে।

শুকনো চোখে তাকায় দুলারী। হঠাৎ দুলারীর দিকে নজর পড়ে শেফালীর। ‘তোর মুখ শুকনা ক্যান ? মানু ভাই এখন কাম করে। এই কামতো থামব না। তোমাগোও তো আর কষ্ট হইব না।’

একটু ধীরে উত্তর দেয় দুলারী- ‘সবারই অবস্থার পরিবর্তন হইছে।’

মানু মিয়ার সাথে বাঁধা পড়েছিল দুলারী। তার দাদির শ্যাওলা পড়া উঠোনে, ছয় বছর আগের এক সন্ধ্যায়। লাউডগার মতো লকলকিয়ে বেড়ে ওঠা দুলারীর বয়স তখন ষোলো। দাদির জীর্ণ ঘরে ভাঙা বেড়ার ছিদ্র দিয়ে নওশা সাজে উঠোনে বসা বেঁটেখাটো গাট্টাগোট্টা মানু মিয়াকে দেখার পর হতাশ, শুকনো কিশমিশের মতো চুপসানো দুলারীকে দাদি এই বলে আশ্বস্ত করেছিল - ‘সোনার আংটি বাঁকাও ভালো’। আমাগো তো তেমন কিছু নাই, ভালোই থাকবি। শুনছি আয় ইনকাম মেলা, শহরে থাকবি। তেল-সাবান কাপড় নিয়া চিন্তা নাই। আরো পাবি বাসনাওয়ালা ভাত। বাসনাওয়ালা ভাতের কথায় চুপ হয়ে গিয়েছিল দুলারী। মা মরা দুলারীর বাপ বিয়ে করে দেশান্তরী। দাদির আঁচলতলে গায়ে ধুলো মেখে, তেলহীন চুলে জটা বেধে আকর্ষণহীন জীবনে বড়ো হয়ে উঠলেও একটা বিষয়ে ছিল দুলারীর তীব্র আকর্ষণ ঘ্রাণ। ছোট থেকেই ঘ্রাণ বড়ো টানত তাকে। গাছের নিচের ঝরা বকুল, শিউলি, কদমের ঘ্রাণ, মিয়া বাড়ির উঠোনের ধান মাড়াইয়ের ঘ্রাণ, দাদির মুখের ছেচা পানের ঘ্রাণ, স্নো পাউডার ঘষা নতুন বাউয়ের গায়ের ঘ্রাণ- আর পোলাওয়ের ঘ্রাণ। দাদির ভাষায় বাসনাওয়ালা ভাত।

একবার তাদের গ্রামের বড়ো বাড়ি ‘খন্দকার বাড়ি’তে উৎসব। মানুষ খাওয়াবে অনেক। সারাদিনের রান্নায় তার দাদি টুকটাক যোগানও খেটেছিল। দুলারী সেদিন সে বাড়ির উঠোনে অন্য ছেলেমেয়েদের সাথে মাটিতে ছক কেটে কখনো এক পায়ে, কখনো দু’পায়ে কত কী খেলে খেলে সময় পার করেছিল কখন খেতে বসবে, কখন পাবে ওই ঘ্রাণ !

- সারা উঠোন ম ম করছে যে ঘ্রাণে।

- সুবাসওয়ালা ভাতের ঘ্রাণ, ম ম করা ঘ্রাণের মাঝে দুলারীদের মত আরো অনেকের খাবার পালা যখন এল, তখন তাদের পাতে ভারি তরকারি জুটলেও সুবাসওয়ালা ভাতের বদলে জুটেছিল সুবাসহীন নিত্যদিনের ভাত। সুবাসওয়ালা ভাত নাকি বরাদ্দ ছিল শুধুমাত্র বিশেষ মানুষদের জন্য। সেদিন রাতে দাদির সাথে হেঁটে হেঁটে দুলারী যখন বড়োবাড়ির আঙিনা ছেড়ে নিজেদের জীর্ণ ঘরে ফিরছিল, তখন পুকুর পাড়ের তালগাছের নিচে এসে বেশ লজ্জা পাওয়া মুখে দাদি দুলারীর দিকে তাকিয়ে নিজের আঁচলের নিচ থেকে একটা পোটলা দেখিয়ে বলেছিল ‘এই দেখ, কতখানি তরকারি দিছে, দুইদিন খাওয়া যাবে।’ পরে দুলারীর ভার মুখের দিকে তাকিয়ে সান্ত¡না দেওয়ার ভঙ্গিতে আরো বলেছিল ‘সুবাসওয়ালা ভাতে কী হয় ? চিকন, ছোটো দানা। ওতে তো আর এই ভাতের মতো পেটটা ভরে না। তাই তো ওগো ওই ভাতে কম পড়ছে। দাওয়াতিগো না দিলে ওগো সম্মানডা যাইত, তাই তো দিতে পারে নাই।’

দুলারী কোনো উত্তর দেয়নি, শুধু থেকে থেকে তার গলার কাছে আটকে থাকা অভিমানের দলাটা ক্রমশ শক্ত হয়ে তার চোখ দুটো খরখরে আর মুখটা থমথমে করে দিচ্ছিল। ভাতেরও যে ভাগ হয় সেই প্রথম সে জেনেছিল। সেদিন রাতে বড়ো বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলা দাদির পিঠে পিঠ লাগিয়ে শুয়ে দুলারী বুঝেছিল- তার মতোই তার দাদিরও পেট ভরলেও মনটা ভরেনি। ওই সুবাসওয়ালা ভাত তার এবং তার দাদির শুধু সে রাতেই নয়, আরো বহু, বহু রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল।

একটি লাল রঙের পিছল শাড়ি, একটি সোনার নাকফুল, সোনা নয় অথচ সোনার মতো ঝকঝকে কতগুলো অলঙ্কারে গা মুড়ে দুলারী উঠে এসেছিল শহরে বাদশা মিয়ার বস্তির এক কামরার ঘরে, মানু মিয়ার সংসারে। দাদির কথাই ঠিক। মানু মিয়ার সংসারে মাঝে মাঝে দেখা মিলে সুবাসওয়ালা ভাতের। তবে সুবাসওয়ালা ভাতের ঘ্রাণ মাঝে মধ্যে নাকে এসে লাগলেও আরো একটি ঘ্রাণ নিত্য এসে লাগে নাকে- মানু মিয়ার গা থেকে ভেসে আসা ঘ্রাণ-আঁশটে গুমোট মাছের ঘ্রাণ।


ছোট্ট কড়াইয়ে পেঁয়াজ মরিচের কুচিসহ ডিমের গোলাটা ঢেলে অদ্ভুত এক ঘুর্ণি দিতেই সেটি একটি ছড়ানো থালার মতো হলো। সেদিকে তাকিয়ে দুলারী বলে ওঠে- ‘আপনে এত সুন্দর ডিম ভাজি করেন, আমরা মহিলারাও তো এমন পারবো না। পাশে দাঁড়ানো মানুষটা চাপা স্বরে উত্তর দিয়েছিল- ‘ডিম ভাজি কি এমনেই সুন্দর হয় ? পাশে দাঁড়ানো মানুষটা যদি এমন সুন্দর হয় তাইলে সে ডিমভাজি সুন্দর হইবোই।’

লজ্জা পেয়েছিল দুলারী, লাজুক মুখে বলেছিল-

- কী যে কন !

মানুষটা আরো গাঢ় স্বরে বলেছিল- সত্যই, আপনার পাশে দাঁড়াইলে কেমন যেন একটা তাপ লাগে। কুসুম কুসুম তাপ।

- মানে ?

লাজুক মুখে খানিকটা চঞ্চল হয়ে জানতে চেয়েছিল দুলারী।

- মানে, শীতকালে আগুন পোহাইছেন কোনোদিন ? নাড়া, খড় দিয়ে আগুন জ্বালাইলে যে তাপটা আসে, ওই তাপে কেমন আরাম লাগে দেখছেন, গাডা গরম হয়। সুখ সুখ লাগে, ওইডারে কয় কুসুম কুসুম তাপ।

তারপর লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে থাকা দুলারীর দিকে তাকিয়ে গলাটা আরও একটু নামিয়ে ফিসফিস করে বলেছিল মানুষটা-

‘এই চুলা যদি নাও জ্বলে, তাও আপনে পাশে দাঁড়াইলে, আপনার ওই কুসুম কুসুম তাপেই আমার ডিমভাজি হইয়া যাইব।’

দুলে উঠেছিল দুলারী- দুলে উঠেছিল রান্নাঘরের পাশের পেঁপেগাছটা, গাছের পাতারা, দুলারীর খুন্তি-ধরা হাতটা, শরীরটা- আর শরীরের ভেতর অনেকদিনের ঘুমিয়ে থাকা মনটা।

অদ্ভুত এক দুলুনীর দোলায় ভাসতে ভাসতে কাঁপা হাতে তরকারির হাঁড়িটা নিয়ে ঘরে ফিরেছিল দুলারী। বাদশা মিয়ার বস্তিতে উত্তর ও দক্ষিণ পাশে দুটো রান্নাঘর, কল দুটো। দুলারীরা দক্ষিণ পাশের কলঘর লাগোয়া রান্নাঘরে রান্না করে। গ্যাসের চুলোয় দুটি মানুষ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রান্না করতে পারে। অধিকাংশ সময় রান্নার জন্য লাইনে দাঁড়াতে হয়। তবে দুলারীর অত তাড়া নেই। মানু মিয়া বের হয় সেই ভোরে যখন বাদশা মিয়ার পোষা লাল মোরগটা কক কক করে ডেকে ওঠে তারও আগে বের হয় মানু মিয়া। কাছের বড়ো বাজারে মাছ কাটার কাজ তার, ফেরে গভীর রাতে। দুলারীর কাজ তাই নিরিবিলি ও গভীর রাতেই হয়। গত কিছুদিন ধরেই বস্তিতে নতুন আসা মানুষটা গভীর রাতে রান্নাঘরে আসে, দুলারীর পাশে দাঁড়িয়ে ডিমভাজি করে। শেফালির কাছে শুনেছে দুলারী- মানুষটার নাম ইমরান। বাদশা মিয়ার বস্তি পার হলে দুটো গলি পরে ব্যাটা ছেলেদের যে চুল দাড়ি কামাবার দোকান- ‘সাজন হেয়ার কাটিং’ সেখানে প্রায়শই দেখা হে পেহেলি বার, ‘সাজন কি আঁখোমে পেয়ার’ গানটি বাজতে থাকে সেখানেই কাজ করে মানুষটি। মানুষের চুল দাড়ি কেটে সুন্দর করে দেওয়া মানুষটা নিজেও ভারি সুন্দর- লম্বা, ফর্সা, চুলে টেরি ছাটা। রঙিন পোশাকে ফিটফাট বছর পঁচিশের মানুষটির গা থেকে হরদম ভেসে আসে ঘ্রাণ ! বেশ ভুরভুরে মিষ্টি এক ঘ্রাণ। শেফালির ভাষায়, ‘দোকানের শিশি কয়ডা পুরা বাসনাই ছেমড়াডা গতরে ঢাইলা হাঁটে নিজেরে নায়ক ভাবে নাকি ? ওর মালিকে এইসব দেখে না ?’

অত কিছু বোঝে না দুলারী। সে দেখে মানুষটাকে ভুরভুরে সুবাসওয়ালা মানুষ, ঘ্রাণ সওদাগর। তার খালি মনে হয়, বস্তির ভাঙা বেড়া আর ঘিঞ্জি ঘরগুলোর উপর যেন নেমে এসেছে চাঁদ- অপূর্ব রূপের পসরা নিয়ে, বাহারি আবেশ নিয়ে। বাম পাশের ঘর থেকে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ আসছে, তানজিনাদের ঘর। তানজিনা কাঁদছে, মৌলি কাঁদছে, এই কান্নার সাথে দুলারী পরিচিত। হেরে যাওয়ার কান্না। টিকে থাকার লড়াইয়ে হেরে গিয়ে অনেকেই এমন কান্নায় ভেঙে পড়ে ছেড়েছে ঘর।


আমরা কি বাদশা মিয়ারে বলমু আর কয়টা দিন দ্যাখতে’ ? চিন্তিত মুখে বলে শেফালি।

- ‘তাতে কী লাভ ? সব তো বন্ধ- কাজ বন্ধ, বিমার কবে থামব আর সবকিছু কবে খুলব, কে জানে ? ততদিন কেমনে চলব ?’

- হতাশ ও চিন্তিত গলায় বলে তানজিনা।

তানজিনাদের ঘরে বিছানায় বসা তানজিনা, মৌলি, শেফালি, দুলারী। দুয়েক দিনের মধ্যে ঘর ছেড়ে যাচ্ছে তানজিনারা। ঘর নিয়েছিল দুইবোন- তানজিনা ও মৌলি। মাঝে মাঝে এক ভাইও আসত। ছিপছিপে শ্যামলা মেয়ে দুটি কুড়ির কোঠায় বয়স। একটি দোকানে সেলস গার্লের কাজ করে। একটু চুপচাপ, সবার থেকে আলাদা থাকা মেয়ে দুটি সকালে বেরিয়ে রাতে ফিরতো। যদিও তাদের দু’বোনকে নিয়ে বস্তিবাসীর কৌতূহলের অন্ত ছিল না- কী করে ? কই যায় ? কাজটা কী ? ভাইটা কেমন ভাই- এসব নিয়ে দফায় দফায় অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে, রিপোর্ট পেশ করাও হয়েছে কয়েক বার- অনুসন্ধান কমিটির অগ্রভাগে শেফালিই ছিল বরাবর।

- জানো, দুলারী ভাবি, তানজিনাগো আসল নাম কী ? হন্তদন্ত মুখে দুলারীর দরজায় দাঁড়িয়ে একদিন বলেছিল শেফালি।

- কী ?

নির্লিপ্ত মুখে জানতে চায় দুলারী।

- তানজিনার আসল নাম হইল তবলা আর মৌলির আসল নাম হইল বিদুরন।

- তাই নাকি ? হালকা কৌতূহল দেখায় দুলারী।

- হয়, তারা নিজেগো মইদ্দে একজন আর একজনরে এই নামেই ডাকে। দেহোনা, চেহারায়ও তো কোনো মিল নাই। তারা দুইবোন না- এক গ্রামের দুই মাইয়া। এরপর বিষ্ফোরিত দুই চোখে উল্লাস ফুটিয়ে শেফালি বলে-

- কাজটা কী করে জানো ?

- কী ? আবারও নির্লিপ্ত মুখে জানতে চায় দুলারী।

- অরা কোনো দোকানে কাম করে না। অরা করে আসল কাজ- ঘণ্টাচুক্তিতে ! তারপর চোখ টিপে ইশারায় একটি তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত দেয় শেফালি।

- তাতে কী হইছে, আবারও উদাসীন মুখে বলে দুলারী।

- হইছে মানে, এহনও বুজলা না তুমি দুলারী ভাবি ? অরা ওই কাম করে অগো দুইজনরে দেহা গেছে ‘রূপসী’ সিনেমা হলের সামনে। আরে অগো ভাইডা আসলে ভাই না, হে অইল অগো দুইজনের শো-এর টিকিট বেচাঅলা। অরা দুইজনও তো একরকম সিনেমার শো। তারপর না বোঝা দুলারীর মুখের দিকে তাকিয়ে যেন সম্পদভর্তি এক সিন্দুকের ডালা খুলছে এমন ভঙিতে বলে- ‘শোনো অরা দুইজন সিনেমা হলের সামনের ওভার ব্রিজের উপরে নয়, নিচে দাঁড়াইয়া থাকে, ভাইডা আস্তে আস্তে মানুষ ডাকে, সিনেমা হলের আন্ধারে অগো লইয়া যারা ঢুকবো হেই টিকিট মানে অগো দুইজনের টিকিট ভাইডার থেইকা নেয়। একঘণ্টা-দুইঘণ্টা-তিনঘণ্টা- এক এক সময়ের এক এক দাম। আরো আছে কাজের টাইপ বুইঝা।

- মানে ?

বিস্মিত দুলারীর প্রশ্নের উত্তরে শেফালি ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হেসে বলে- ধরো তুমি চিপস খাইলা তার এক দাম, আইসক্রিম খাইলা তার আর এক দাম- আর পোলাও বিরিয়ানি খাইলে তার আর এক দাম। এই কাজেও তাই- সিনেমা হলের আন্ধারে যদি বইসা থাকে তাইলে এক দাম, যদি রিকশায় ঘোরে তাইলে আর এক দাম- যদি এর থেইকাও বেশি কিছু করে মানে দূরে লাইয়া যায় তাইলে দাম আরো চড়া।

শুনতে শুনতে কান ঝাঁ ঝাঁ করছিল দুলারীর। চমকে উঠে জিজ্ঞেস করেছিল- ‘কারা যায় অগো কাছে ?’

শব্দ করে হেসে উঠেছিল শেফালি। কারা আবার যাইব- আমাগো আশেপাশে যাগো দেহো, অল্প পয়সার বেশি পয়সার সব ধরনের ব্যাডাই যায়। যাগো এট্টু অন্য ক্ষুধা আছে। তানজিনাগো তো ভাতের ক্ষুধা কিন্তু এইসব মানুষগো তো অন্য ক্ষুধা।

বুকের মধ্যে একটা বাড়ি দিয়ে উঠেছিল দুলারীর। তবে কি ওই মানুষটাও যায় ? তার মানুষ- তার মনের মানুষ, ঘ্রাণ সওদাগর। সেদিন রাতে রান্নাঘর থেকে ফেরার পর দুলারীর দুলুনি আর থামেনি। কেউ তাকে দেখে আলাদা করে দেখে। অদ্ভুত এক ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হয় দুলারীর মন। রাতে রান্নাঘরে দেখা হলে আড়ষ্ট দুলারীর বুক ঢিপঢিপ করত, লজ্জায় আড়ষ্টতায়, মানুষটার চোখে কথা বলতে পারত না। কথা বলেনি মানুষটাও শুধু চাক চাক চাক করে পেঁয়াজ কাটতে কাটতে গান গেয়ে উঠত গুন গুন- ‘তুই যদি আমার হইতিরে- কোলেতে বসাইয়া তোরে করিতাম আদর।’

অদ্ভুত এক শিহরণে কান গরম হওয়া, বুক ঢিপঢিপ করা, আড়ষ্ট দুলারীর সেই দুলুনি ঝড়ের তাণ্ডবে রূপ নিয়েছিল সেদিন, যেদিন রাতে তরকারির হাঁড়িটা নিয়ে ফেরার সময় মানুষটা নিচু অথচ গাঢ় স্বরে বলে উঠেছিল-মনডায় কয়, তোমারে ছিনাইয়া লই।

- মানে ?

কাঁপা স্বরে অস্ফুটে বলেছিল দুলারী। মানুষটা অনায়াসে আপনি থেকে তুমিতে নেমেছে।

গাঢ় অথচ দৃঢ় স্বরে দুলারীর চোখে গভীর দৃষ্টি ফেলে মানুষটা থেমে থেমে বলেছিল- ‘ওই বাইট্টাটার সাথে তুমি কেমনে আছো ? বান্দরের গলায় মুক্তার মালা। মনডায় কয় বাজপাখির লাহান তোমারে ছো মাইরা লইয়া আই নিজের কাছে।’

ঝড় উঠেছিল, তীব্র ঝড়। সে ঝড়ের তাণ্ডবে কেঁপে উঠেছিল রান্নাঘরের পাশের পেঁপে গাছের পাতা, রান্নাঘরের চালা, বাদশা মিয়ার বস্তির সবগুলো ঘরের টিন আর দুলারীর মন। দিগভ্রান্ত দুলারী ভুলে যায় নিত্যদিনের হিসাব, এক কামরার ঘর, মানু মিয়ার সংসার- সে শুধু শুনতে পায় শব্দ- বাজপাখির ওড়ার শব্দ- সাঁই-সাঁই-সাঁই।

মানু মিয়া বেঁটেখাটো গাট্টাগোট্টা, মোটা, ঢ্যাপা আঙুলে সে মাছ কাটে চপাচপ, ভাত খায় গপাগপ, হাঁটে থপাথপ।

লম্বা ফর্সা মানুষটা চিকন চিকন আঙুলে পেঁয়াজ কাটে চাক চাক, তার গুনগুন গানে দুলারীর বুক করে ধক্ধক্। মানুষটা তাকায়- দুলারী অবশ হয়, মানুষটা হাসে, দুলারী কাঁপে, মানুষটা কাজে যায় দুলারী উদাস হয়, মানুষটা কাজ থেকে ফেরে অস্থির দুলারী আলু ছোড়ে, পটল ছোড়ে।

- বাড়িতে তো কিছুই নাই। তাইলে অহন কী করবা, কই যাবা ? বেশ দরদী গলায় তানজিনাদের উদ্দেশ করে বলে শেফালি। এতদিন তানজিনাদের পেছনে উন্মুখ হয়ে লেগে থাকা উৎসুক শেফালি একেবারেই বদলে গেছে, বদলে গেছে বস্তির বাকিরাও, তানজিনাদের কাজ নিয়ে আর কেউ প্রশ্ন করে না। বিপন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন মানুষকে বড্ড আপন করে দেয়।

চিন্তিত ও হতাশ গলায় তানজিনা বলে, কী করবো জানি না, ঘরে অসুস্থ মা। আর ছোটো ভাইটা কেমনে চলব, কী করব কিচ্ছু জানি না। এক বিমারে সব কিছু এলোমেলো কইরা দিল। হঠাৎ ঘরের ভারি পরিবেশ স্বাভাবিক করতেই শেফালি একটু আগে বানিয়ে আনা চালতা মাখার বাটিটা এগিয়ে দেয় সবার দিকে। তেল, লবণ আর হলুদ মাখানো কাটা চালতা থেকে এক ধরনের ঘ্রাণ আসে- বুনো বুনো একটা ঘ্রাণ। দুলারীর বেশ পছন্দের। চালতা মাখার বাটিতে হাত ডুবিয়ে দুলারী প্রশ্ন করে তোমাগো ওই ভাইডা কোনো সাহায্য করতে পারে না ?

- কেমনে হরবো ? তারেও তো ওই বিমারে ধরছে।

মুখ খোলে মৌলি, চাইর-পাঁচদিন আগে খবর দিছে তারও নাকি জ্বর, গাও ম্যাজ ম্যাজ, খাবারে স্বাদ নাই, কোনো কিছুর ঘ্রাণ নাই।

একটুকরো চালতা মুখে পুরে হঠাৎ চমকে ওঠে দুলারী- মেরুদণ্ড দিয়ে একটা ঠান্ডা হিম স্রােত বয়ে যায়- তার চিরচেনা চালতা মাখার ঘ্রাণ সে পাচ্ছে না।

তলিয়ে যাচ্ছে দুলারী। একটা ডিঙি নৌকায় মাঝ গাঙে বসে আছে দুলারী। ডিঙ্গি দুলছে দুলারী দুলছে তলিয়ে যাচ্ছে কি দুলারী ? দূর থেকে দাদির ঘুমপাড়ানি গান শোনা যাচ্ছে- ‘থালিতি ভাত, ঘটিতি পানি, ভাত খাইয়ে যাও, হিরেধ্বনি।’

তন্দ্রা ভাঙে দুলারীর। ভেজানো দরজা দিয়ে অল্প আঁচের রোদ আসছে। বেলা পড়ে এসেছে। সুনসান বস্তি। একে একে ঘর ছেড়েছে অনেকেই। মাত্র দু’-চারটে ঘর ছাড়া। গত কয়েকদিন অধিকাংশ সময় শুয়ে থাকে দুলারী। মুখে স্বাদ নেই, নাকে ঘ্রাণ নেই- শরীর দুর্বল। দুর্বল তার মনটাও। বেশ কয়েকদিন মানুষটির সাথে দেখা নেই, তার প্রাণের মানুষ- তার ঘ্রাণ সওদাগর। আহা, কত স্বপ্নের পাটি বুনেছিল মানুষটা দুলারীকে নিয়ে। দূরে চলে যাবে দুজন, চেনা সীমানা ছাড়িয়ে অনেক অনেক দূরে। দুলারীও দেখেছিল স্বপ্ন-বাজপাখির থাবায় লুকিয়ে উড়াল দেওয়ার স্বপ্ন। সে স্বপ্ন পূরণের রসদও জোগাড় করছিল ঘরের বাঁশের খুঁটির ভিতরে গোপন গর্তে। বিমার এসে সব এলোমেলো করে দিল। দুলারী নিজে মরতে পারে, প্রাণের মানুষটাকে নয়। তাই মানুষটা থেকে দূরে থাকে, ঘরে থাকে। শুধু মাঝে মাঝে বুক মুচড়ে একটা হাহাকার ওঠে- আহা, কাছে না থাক দুলারী, বাতাসে মানুষটার ঘ্রাণ যদি পেতো। কোনো কিছুরই ঘ্রাণ নেই দুলারীর, না বাতাসে মানুষটার সুবাসের, না ঘরে আঁশটে গুমোট মাছের। মাছ কাটার কাজ বাড়িয়ে দিয়েছে মানু মিয়া। সেদিন তানজিনাদের ঘর থেকে ফিরে রাতে মানু মিয়ার বিমার নিয়ে সন্দেহের কথাটা বলতেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল মানু মিয়া। দুলারী ভেবেছিল, গেছে- গাট্টাগোট্টা, বেঁটেখাটো, সারা গায়ে মাছের গন্ধঅলা মানুষটা পালিয়েছে। দুঃসময়ে বেশ হালকা লেগেছিল দুলারীর। মনে হয়েছিল একটা দমবন্ধ ঘর থেকে বেরিয়ে সে যেন খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিচ্ছে- একটা মুরগিছানার মতো হালকা গুটিগুটি পায়ে যেন হাঁটছিল দুলারী- বাজপাখি কখন আসবে কখন দেবে থাবা- তবে, বাজপাখি এসে থাবা দেবার আগেই ফিরে এসেছিল সে- মানু মিয়া, হাতে একটা স্টোভ ও ফ্লাস্ক নিয়ে। ছোঁয়াচে বিমার। জানাজানি হলে বিপদ- ঘর ছাড়তে হবে। তাই ঘরেই সব গোপন ব্যবস্থা। দুটো বাজারে মাছ কাটার দায়িত্ব নিয়েছে মানু মিয়া, পয়সা বেশি দরকার, অনেক কিছু লাগবে, বিমার সারাতে। ভোররাতে ফ্লাক্সে চা আর স্টোভে খাবার রান্না করে রেখে বেরিয়ে যায় মানু মিয়া, ফেরে মধ্যরাতে। দুলারী দুর্বল শরীরে কখনো অবসন্ন হয় কখনো তন্দ্রাচ্ছন্ন- তন্দ্রার ভেতর প্রায়ই শোনে শব্দ- বাজপাখির ডানা ঝাপটানোর সাঁই-সাঁই-সাঁই।

একটা শোরগোল উঠল। দক্ষিণ দিকের কলঘরের ওদিক থেকে। কিছু কথা ভেসে আসছে কানে- বস্তির ঘরগুলোর সামনে দেওয়া হয়েছিল বাঁশের বেরিকেড- বিমারের প্রকোপ কমাতে আরো সাবধানতা আগের মতো শেফালিও আর আসতে পারে না ঘরে। দরজার কাছে গিয়ে কান পাতে দুলারী।

- দেখছ কত বড়ো শয়তান। উপরে ফিটফাট মইদ্দে সদরঘাট।

আবার শোনা যায়Ñ এমন কাম নাকি আগেও করছে। ওর নাকি এইডাই অভ্যাস।

কেমন শঙ্কা আসে দুলারীর। দরজাটা ফাঁকা করে শেফালিকে দেখা যায়। দুলারীকে দেখে বাঁশের বেরিকেডের কাছে আসে শেফালি- ‘শুনছো কাণ্ড, আমি কই ছিলাম না, ওই ছেমড়া একটা আস্ত শয়তান। বাদশা কাকার ঘরের দুই মাসের ভাড়া না দিয়া ভাগছে। কয়েকজনের কাছ থেকে নাকি টাকাও ধার নিছে।

দড়াম করে বুকের ভেতর বাড়ি দিয়ে ওঠে দুলারীর। কই যাইব ? আসবো নিশ্চয়ই।

- আরে আসব কী ? কায়দা কইরা ভাগছে। রাস্তার মোড়ের পার্লারে কাম করে ওই যে সাবিনা, সাবিনারে নিয়া ভাগছে। ওই দোকানের লোকে কইল ও নাহি আগে থেইকাই বিভিন্ন মাইয়াগো সাথে এমন করত, সাবিনার কপালে কী আছে কে জানে। পা টলছে, ঘর দুলছে দুলারীর। সে শুধু অস্ফুটে কাঁপা ঠোঁটে বলে- একা এত মাইয়াগো সাথে কেমনে ?

শেফালি আরো চড়া গলায় বলে- পুরুষ মানুষের মন আর বাজারে কাচকি মাছের ভাগা একই। কাচকি মাছের যেমন ছোটো, বড়ো, মাঝারি ভাগ হয়, পুরুষ মানুষও তার মনডারে ভাগে ভাগে এরে এট্টু অরে এট্টু দেয় বুঝছো !

দরজাটা ভিজিয়ে দিয়ে টলতে টলতে বিছানায় শুয়ে পড়ে দুলারী। বাজপাখিটা থাবা দিয়েছে- সত্যিই থাবা দিয়েছে বাজপাখিটা। এক থাবায় সে নিয়ে গেছে দুলারীর স্বপ্ন, স্বপ্নের রসদ- বাঁশের খুঁটির গোপন গর্তে জমানো টাকা, দুলারীর নাকফুল, দুটো কানের দুল। সেদিন তানজিনাদের ঘর থেকে এসে স্বপ্নের রসদ পোটলায় বেঁধে মুখে কাপড় বেঁধে দুলারী গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ঘ্রাণ সওদাগর, সেই ছায়ামানুষের দরজায়- পোটলাটা ছুঁড়ে বলেছিল- বেঁচে থাকলে লাগবে, রাখেন আপনার কাছে। পোটলাটা নিয়ে গেছে সে সাথে করে নিয়ে গেছে দুলারীর মনটাও।

ঘর অন্ধকার। অন্ধকার ঘরে অদ্ভুত এক শূন্যতা নিয়ে স্তব্ধ হয়ে থাকে দুলারী। একটা গান ভেসে আসছে দূর থেকে- বাদশা মিয়ার ঘরের ওপাশ থেকে-

মন ভালা না, তোর পিরিত ভালা না রে বন্ধু

মন ভালা না- তোর পিরিত ভালা না।

গানের লাইনগুলো অন্ধকার ঘরে দুলারীকে ক্রমশ ঘন অন্ধকারে তলিয়ে দিতে থাকে।


সাত

হঠাৎ করেই বিষয়টি খেয়াল করলো দুলারী। ঘুট করে শব্দ হয়েছিল দরজায়। মানু মিয়া ঢুকছে ঘরে। হঠাৎ একটা চেনা ঘ্রাণ এসে লাগল দুলারীর নাহে- আশটে, গুমোট, মাছের ঘ্রাণ। মধ্যরাত। ভেজানো দরজা দিয়ে চিলতে চিলতে চাঁদের আলো ঢুকে পড়ছে মেঝেতে, ঘরে। বিহ্বল দুলারী খাট থেকে নেমে আসে, নিচে পাতা বিছানায় শুয়ে পড়ে আস্তে- মানু মিয়া শশ ব্যস্ত হয়- আহা, নিচে ক্যান ? ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে দুলারী উত্তর দেয় নিচেই ভালা।

হঠাৎ করেই আঁশটে, গুমোট, মাছের ঘ্রাণ কেন যেন ভালো লাগছে তার ! 

অলঙ্করণ : মনিরুজ্জামান পলাশ