আমার আমি -মীর মাসরুর জামান রনি

17 Nov 2021, 02:26 PM অন্যান্য শেয়ার:
আমার আমি -মীর মাসরুর জামান রনি

আমি মীর মাসরুর জামান রনি। পুরো নাম মীর আত্তাকী মাসরুরুজ্জামান। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁওয়ে। ময়মনসিংহ শহরে নানার বাড়িতে জন্ম। জন্ম তারিখ ২০-এ ডিসেম্বর। চার ভাই দুই বোনের মধ্যে আমি সবার বড়ো। বাবার কাজের সুবাদে সে-সময়ের ময়মনসিংহ ও বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরবে আমাদের বেড়ে ওঠা।

শৈশব থেকেই আমি সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। পছন্দ ছিল আবৃত্তি, বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা, রচনা লেখা আর অভিনয়। সবকিছুর আগে করা হয়েছে আবৃত্তি। ভৈরবে বাংলাদেশ রেলওয়ে উচ্চবিদ্যালয়ে পড়তাম। স্কুলের সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে আবৃত্তির শুরু। নজরুলজয়ন্তীতে কাজী নজরুল ইসলামের ‘খুকি ও কাঠবেড়ালি’ প্রথম মঞ্চে আবৃত্তি। ওই কবিতার মধ্য দিয়ে মা হোসনে আরা জামান বাবা মীর নূরুজ্জামানের কাছে আবৃত্তিতে হাতেখড়ি। প্রতিযোগিতায় সব শ্রেণির শিক্ষার্থীরা একই গ্রুপে অংশ নেয়। আমি তখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি, আবৃত্তি করে সেবার আমি পুরস্কারও পেয়ে যাই। আনুষ্ঠানিকভাবে ওটিই আবৃত্তির শুরু। শিশু সংগঠন কাকলি খেলাঘর আসরের সাথে যুক্ত হওয়ার পর প্রথম বিতর্কে অংশ নিই। মা-বাবার পরই যিনি সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আমার গুরু, তিনি শরীফ উদ্দিন আহমেদ। বর্তমানে ভৈরবের রফিকুল ইসলাম মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ। তাঁরই অনুপ্রেরণা ও নির্দেশনায় বিতর্কের শুরু। দলীয় আবৃত্তির সঙ্গে পরিচয়ও তাঁর সুবাদেই। উপস্থিত বক্তৃতা, রচনা লেখা এবং অভিনয়ও নিয়মিত করতে থাকি সে-সময়। পাশাপাশি লেখালেখি করি- মূলত ছড়া। স্থানীয় এবং জাতীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান কিংবা প্রতিযোগিতায় তখন নিয়মিত অংশ নিই ও পুরস্কার পাই।

ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজে এইচএসসি পড়ার সময় মূলত প্রতিযোগিতাভিত্তিক সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হই। সে-সময় লেখালেখিও করেছি নিয়মিত। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ১৯৮৮-৮৯ শিক্ষাবর্ষে অনার্সে ভর্তি হই। আমাদের মাস্টার্সের সেশন ছিল ১৯৯২ ; সেশনজটের কারণে পাস করে বের হয়েছি ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে। আমার হল- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল। হলেই থাকতাম। সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, ছাত্র-রাজনীতি এবং সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। বিতর্ক ও নাটক করতাম। আবৃত্তি আর লেখালেখি তো এখনো সঙ্গী। ডাকসু সাংস্কৃতিক দল এবং হলের জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক দলের সদস্য ছিলাম। বিভাগের বিতর্ক দলের নেতৃত্ব দিয়েছি। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং পরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচার ও শাস্তির দাবিতে আন্দোলনে মাঠে ছিলাম।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ডাকসু সাংস্কৃতিক দলের আবৃত্তি বিভাগে যোগ দেওয়ার পর থেকেই মঞ্চ এবং টেলিভিশনে নিয়মিত আবৃত্তির শুরু। বিশিষ্ট আবৃত্তিশিল্পী ও বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মো. আহ্কাম উল্লাহ্ ছিলেন ডাকসু সাংস্কৃতিক দলের আবৃত্তি বিভাগের অন্যতম সমন্বয়কারী। তিনি তখন থেকেই আবৃত্তি সংগঠন স্বরশ্রুতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। একপর্যায়ে আমাকেও তিনি স্বরশ্রুতিতে নিয়ে আসেন। এখানে যুক্ত হওয়ার পরপরই প্রথম বড়ো কাজ ছিল মো. আহ্কাম উল্লাহ’র গ্রন্থনা ও নির্দেশনায় সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যনাট্য ‘গণনায়ক’ এর পাঠাভিনয়ে অংশ নেওয়া। বর্তমানে স্বরশ্রুতি’র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি।

আগে নিয়মিত আবৃত্তি পরিবেশনা করলেও আবৃত্তি প্রযোজনার গ্রন্থনা ও নির্দেশনা এবং কর্মশালা পরিচালনা করা স্বরশ্রুতিতেই শুরু। স্বরশ্রুতিতে আমার গ্রন্থনা ও নির্দেশনায় আবৃত্তি প্রযোজনাগুলোর মাঝে রয়েছে- ‘মানুষেরা মানুষের পাশে’, ‘দুই পৃথিবীর গল্প’, ‘ধরিত্রী’, ‘দেশের মানুষ’, ‘সবুজ করুণ ডাঙায়’ এবং ‘ফুট কড়াই’ [প্রক্রিয়াধীন]। এছাড়া শ’খানেক দলীয় আবৃত্তির গ্রন্থনা ও নির্দেশনা দিয়েছি। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিসহ কয়েকটি সংগঠন থেকে প্রকাশ করা মিশ্র অ্যালবামে আবৃত্তি করেছি ; ‘সূচিপত্র’ এবং ‘বহুদিন পর একটি কবিতা’ নামে দু’টি একক অ্যালবাম প্রকাশের কাজ চলছে। আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের আয়োজন ‘এই তো জীবন এই তো মাধুরী’তে আরো দু’জন শিল্পীর সঙ্গে একক পরিবেশনা ; আবৃত্তি সংগঠন ‘মুক্তবাক’র আয়োজনে একক পরিবেশনা ; নোয়াখালী আবৃত্তি একাডেমি’র আয়োজনে নোয়াখালীতে একক আবৃত্তি পরিবেশনা মঞ্চে দীর্ঘ একক পরিবেশনা হিসেবে উল্লেখযোগ্য।

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার ছাত্র হিসেবে যোগাযোগের দৃষ্টিকোণ থেকে জানি, স্বর ও শব্দের অর্থপূর্ণ প্রক্ষেপণের শক্তি অনেক। আমি সেই শক্তিতে বিশ্বাস করি। আর আবৃত্তি এ শক্তিকে কাজে লাগানোর শিল্পিত উপায়। আবৃত্তি মানে শুধু কবিতার শব্দগুলো আওড়ানো [recitation] নয় ; আবৃত্তি মানে ব্যাখ্যা করা [interpretation]। আবৃত্তিশিল্পী কবিতা কিংবা যে রচনাটি বলেন, সেই রচনায় কবি কিংবা লেখকের চিন্তাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করেও তা তিনি নিজের মতো ব্যাখ্যা করেন। আবৃত্তিশিল্পী শব্দের ছবি আঁকেন। স্বর দিয়ে সেই ছবি শ্রোতাকে দেখান। 

পেশাগত জীবনে আমার বর্তমান কর্মস্থল বেসরকারি টেলিভিশন স্টেশন ‘চ্যানেল আই’। এখানে আমি সিনিয়র নিউজ এডিটর হিসেবে কাজ করছি। পাশাপাশি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করছি। গণমাধ্যম উন্নয়ন সংস্থা ‘সমষ্টি’র আমি একজন প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। সংস্থার অনলাইন পত্রিকা ‘দেশের খবর ডট নেট’-এর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি। পেশাগত জীবনে এর আগে বিভিন্ন দৈনিক ও অনলাইন পত্রিকা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করেছি।

টেলিভিশন টক শো’র সঞ্চালনাও করে থাকি। এর মধ্যে আছে- চ্যানেল আইয়ের ‘আজকের সংবাদপত্র’ ও ‘সংবাদপত্রে বাংলাদেশ’ ; বাংলাদেশ বেতারের বিভিন্ন অনুষ্ঠান, একুশে টেলিভিশনের নিয়মিত অনুষ্ঠান ‘আজকের পত্রিকা’ সঞ্চালনা করেছি একসময়। বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘মা ও শিশু বিষয়ক বিতর্ক’ প্রতিযোগিতায় বিচারকের দায়িত্ব পালন করছি দীর্ঘদিন ধরে। এখানে বিভিন্ন আবৃত্তি অনুষ্ঠানও উপস্থাপনা করে থাকি। বাংলাদেশ টেলিভিশনে আমি আবৃত্তিশিল্পী হিসেবে উচ্চ শ্রেণিতে তালিকাভুক্ত।

সাংবাদিকতা ও যোগাযোগসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ পরিচালনা করা আমার একটি পছন্দের এবং উল্লেখযোগ্য কাজের ক্ষেত্র। জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট [নিমকো] ও প্রেস ইনস্টিউট বাংলাদেশ [পিআইবি]-সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণ এবং ডিপ্লোমা কোর্স পরিচালনায় যুক্ত। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্মসাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি।

পরিবারে আমরা চারজন। আমার স্ত্রী সাহিদা সুলতানা মনস্তাত্তি¡ক কাউন্সেলর। দুই মেয়ে- লিনুন ওয়ার্দা ধী ও লাইয়িন লাবিবা লীন স্কুলশিক্ষার্থী। 

আমার প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে আছে- মানবিক আবেদনমূলক প্রতিবেদন ও ফিচার, তৃণমূল সাংবাদিকতা : ধারণা ও কলাকৌশল [যৌথভাবে রচনা ও সম্পাদনা], জনসাংবাদিকতা : স্বরূপ ও পদ্ধতি [যৌথভাবে রচনা ও সম্পাদনা], বৃত্তের বাইরে [যৌথভাবে সম্পাদনা], জেন্ডার সাংবাদিকতা [যৌথভাবে রচনা], সুশাসন সাংবাদিকতা, বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে গণমাধ্যম সহায়িকা, কৃষি সাংবাদিকতা [যৌথভাবে রচনা], সহিংস উগ্রবাদ বিষয়ে সাংবাদিকতা সহায়িকা [যৌথভাবে রচনা], দুর্যোগ বিষয়ে রেডিও অনুষ্ঠান নির্মাণ নির্দেশিকা [যৌথভাবে রচনা], এসডিজি বিষয়ে রিপোর্টিং, আবৃত্তির কবিতা সংকলন ‘সব কবিতাই আবৃত্তির’ [প্রক্রিয়াধীন] সম্প্রচার সাংবাদিকতা [যৌথভাবে রচনা, পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত] এবং সাংবাদিকতা, গণমাধ্যম, উন্নয়ন ও প্রশিক্ষক-প্রশিক্ষণ বিষয়ে বেশ ক’টি প্রশিক্ষণ নির্দেশিকা।

চলচ্চিত্র ও নাটকে আমার সম্পৃক্ততার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ফিচার ডকুমেন্টারি ‘অপরাজিতা’ [গল্প, চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনা এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক শেখ নিয়ামত আলীর সঙ্গে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করা ও অভিনয়] ; টেলিভিশন নাটক ‘ট্রেন’ [গল্প, চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনা], বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচার ২০০৯ ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক মধুর ক্যান্টিনের ওপর গবেষণাধর্মী নাটক ‘কাগজের কম্পাস’ [রচনা ও অভিনয়], মধুর ক্যান্টিনে ৫দিন মঞ্চায়ন, ১৯৯৪ ; গল্প থেকে নাটক ধারাবাহিকে ভাষা আন্দোলনের ওপর নাটকে অভিনয়, চ্যানেল আইয়ে প্রচার ২০০১। 

উল্লেখযোগ্য পুরস্কারগুলোর মধ্যে রয়েছে-জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় বিতর্কে স্বর্ণ পদক ও উপস্থিত বক্তৃতায় ব্রোঞ্জ পদক [১৯৮৩], বিতর্ক ও উপস্থিত বক্তৃতায় স্বর্ণ পদক ও রচনায় ব্্েরাঞ্জ পদক [১৯৮৪], শ্রেষ্ঠ বক্তা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তঃবিভাগ বিতর্ক প্রতিযোগিতা [১৯৯২], ছড়া লেখায় প্রথম পুরস্কার, খেলাঘর আসর আয়োজিত জাতীয় শিশু সাহিত্য প্রতিযোগিতা [১৯৮২ ও ১৯৮৩], গল্প লেখায় প্রথম পুরস্কার, খেলাঘর আসর আয়োজিত জাতীয় শিশু সাহিত্য প্রতিযোগিতা [১৯৮৪] এবং নির্বাচিত তারকা সম্মাননা, ঊষশী পরিষদ, ঢাকা।

জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কিছু ডিপ্লোমা ও উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছি। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ড্যানিশ স্কুল অব জার্নালিজম-এর পরিচালনায় প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ, সাউথ এশিয়া ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস-এর পরিচালনায় নেপালে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস স্টাডিজ কোর্স, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের স্টেট ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে ইন্টারন্যাশনাল ভিজিটরস লিডারশিপ প্রোগ্রাম- আইভিএলপিতে অংশগ্রহণ, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন, হংকংয়ের পরিচালনায় মানবাধিকার কোর্সে অংশগ্রহণ, স্প্রিংফিল্ড ট্রেনিং সেন্টারের পরিচালনায় থাইল্যান্ডে মার্কেট ডেভেলপমেন্ট কোর্স এবং সুইডিশ সরকারের সহযোগিতায় গণমাধ্যম বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল ট্রেনিং প্রোগ্রাম- আইটিপিতে অংশগ্রহণ।