শিশুর অধিকার ও সর্বজনীন শিশুদিবস

16 Nov 2021, 01:43 PM শিশুভুবন শেয়ার:
শিশুর অধিকার ও সর্বজনীন শিশুদিবস

শিশুদের জন্য ২০ নভেম্বর একটি স্মরণীয় দিন। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে শিশু অধিকার ঘোষণা গৃহীত হয়। আবার এই একই দিনে ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে গৃহীত হয় শিশু অধিকার সনদ। তারও অনেক আগে ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ অধিবেশন এই মর্মে সুপারিশ করে যে, বিশ্বের দেশগুলো একটি দিন সর্বজনীন শিশুদিবস হিসেবে পালন করবে, যার উদ্দেশ্য হবে বিশ্বের সব শিশুর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠা এবং শিশুদের কল্যাণে উন্নয়ন। সাধারণ পরিষদ শিশু অধিকার ঘোষণা ও শিশু অধিকার সনদ গৃহীত হওয়ার দিনটিকে অথবা কোনো একটি সুবিধাজনক দিনে এ দিবস পালনের পরামর্শ দেয়।

‘জাতি-বর্ণ, নারী-পুরুষ, বা ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য মানবিক অধিকার মৌলিক স্বাধীনতার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অর্জনই হলো জাতিসঙ্ঘের অন্যতম লক্ষ্য’- জাতিসঙ্ঘ সনদের ১ নম্বর ধারায় এ কথাই বলা হয়েছে। জাতিসঙ্ঘ সনদের এই মৌলিক ধারার ভিত্তিতে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর সাধারণ পরিষদের মানবাধিকার সংক্রান্ত সর্বজনীন ঘোষণা গৃহীত হয়। এ ঘোষণার ১ ও ২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, মর্যাদা ও অধিকারের দিক দিয়ে সকল মানুষই স্বাধীন ও সমান এবং প্রতিটি মানুষই জাতি-বর্ণ, নারী-পুরুষ, ভাষা-ধর্ম, রাজনৈতিক ও অন্যান্য মতাদর্শ, জাতীয় ও অন্যান্য সামাজিক পটভূমি, সম্পত্তি, জন্মগত বা অপরাপর মর্যাদা তথা যেকোনো প্রকার বিভিন্নতা নির্বিশেষে ঘোষণায় উল্লিখিত সব ধরনের অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগের অধিকারী। মানবাধিকার হলো সেসব অধিকার, যা মানুষ হিসেবে জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয়। প্রত্যেকেরই সুন্দর ও পরিপূর্ণ জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে। এর অর্থ হলো অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা ও মৌলিক চাহিদা পূরণ। মানবাধিকার প্রতিটি ব্যক্তির বিকাশ লাভ এবং সামর্থ্য উন্নয়নের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়। শিশুরাও এসব অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। তাদের জন্য মানবাধিকারের অর্থ হলো নিরাপদ পরিবেশ, শিক্ষা, অবসর সময়, স্বাস্থ্যযত্ন এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে অংশগ্রহণের সুযোগ। আর তাই মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে রক্ষা পেতে শিশুদের জন্য জাতিসঙ্ঘের বিশেষ ব্যবস্থাই হলো শিশু অধিকার সনদ। 

জাতিসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই শিশুদের অধিকারের বিষয়ে ছিল অত্যন্ত যতœবান। জাতিসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার আগে শিশুদের অধিকার অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনো সংগঠন ছিল না। ফলে জাতীয় পর্যায়েও এ ব্যাপারে ছিল নি®প্রভ। সাধারণ পরিষদ ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে তার প্রথম অধিবেশনকালেই যুদ্ধপরবর্তী ইউরোপ ও চীনের শিশুদের খাদ্য, ওষুধ ও বস্ত্রের প্রয়োজনীয়তার দিকে লক্ষ্য রেখে গঠন করে ‘দ্য ইউনাইটেড নেশনস ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেনস ইমার্জেন্সি ফান্ড’। মানব হিতৈষী ও উন্নয়নমূলক উভয় ধরনের লক্ষ্য সামনে রেখে ইউনিসেফ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের শিশুদের রক্ষা করা এবং শিশুদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের প্রচেষ্টায় সহযোগিতা করে আসছে। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে সাধারণ পরিষদ গৃহীত শিশু অধিকার ঘোষণা মোতাবেক প্রতিটি শিশুর মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করাই হলো এই সহযোগিতার লক্ষ্য। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ইউনিসেফ এজন্য নোবেল শান্তি পুরস্কারও লাভ করেছে। বড়োদের মতো শিশুদেরও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষ রক্ষাব্যবস্থা শিশু অধিকার সনদ জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি বা কনভেনশন। কনভেনশনটির ৫৪টি ধারায় ১৮ বছরের কম বয়সী যেকোনো ব্যক্তির ক্ষুধা ও অভাব মুক্ত, অবহেলা এবং অন্যান্য নিপীড়ন মুক্ত পরিপূর্ণ জীবন বিকাশের স্বতন্ত্র অধিকারের কথা বলা হয়েছে। শিশুদের জীবনযাত্রা উন্নয়নে এ সনদটি বিশ্বের সর্বত্র রাষ্ট্রগুলোকে সুনির্দিষ্ট পথ নির্দেশনা দিয়ে থাকে।

তবে শিশুদের অধিকারের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া বা না নেওয়ার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র বা জনগণের ওপরই নির্ভর করে।

জাতিসঙ্ঘে শিশু অধিকার সনদ গৃহীত হয় ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে আর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশুদের অধিকার রক্ষায় শিশু আইন প্রণয়ন করেন ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে। তারই আলোকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকার ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে ‘জাতীয় শিশু নীতি’ প্রণয়ন করে।

জাতীয় শিশু সুরক্ষা নীতি ২০১১ এবং শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী শিশুর সুরক্ষা ও আইনি সহায়তা প্রদানে সরকার বদ্ধপরিকর ও অঙ্গীকারবদ্ধ। সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায় থেকে শিশুর প্রতি নির্যাতন প্রতিরোধে অধিকার সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্ব পাচ্ছে। জুভেনাইল জাস্টিস-এর ব্যাপারে জাতীয় টাস্কফোর্স গঠিত হয়েছে যা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতাধীন। এক্ষেত্রে নিগৃহীত ও নির্যাতিত শিশুর সর্বোত্তম সেবা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। 

২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ ফেব্রুয়ারি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘শিশু নির্যাতনের ঘটনা যেখানেই ঘটুক না কেন মামলা নিয়ে অভিযোগের বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর তা না করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শিশুর পরিবারকে হয়রানি করা যাবে না।’

কোনো শিশু বিভিন্ন অপরাধে পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হলে তাকে কারাগারে প্রেরণ করা যাবে না। তাকে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে প্রেরণ করতে হবে। শিশু আইন ২০১৩-এর ধারা ২৬। (১) বিচারকালীন শিশুকে নিরাপদ হেফাজতে রাখার বিষয়টি সর্বশেষ পন্থা হিসাবে বিবেচনা করিতে হইবে, যাহার মেয়াদ হইবে যথাসম্ভব স্বল্পতম সময়ের জন্য। (৩) শিশুকে নিরাপদ হেফাজতে রাখা একান্ত প্রয়োজন হইলে শিশু-আদালত, সংশ্লিষ্ট শিশুকে উক্ত আদালত হইতে যুক্তিসঙ্গত দূরত্বের মধ্যে অবস্থিত কোনো প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ করিবার জন্য আদেশ প্রদান করিবে : তবে শর্ত থাকে যে, এই উপ-ধারার অধীনে কোনো শিশুকে প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ করা হইলে উক্ত প্রতিষ্ঠানে অবস্থানকারী অধিক বয়স্ক শিশুদের হইতে প্রেরিত শিশুকে পৃথক করিয়া রাখিতে হইবে।

ধারা ৫৯। (১) সরকার, বিচার প্রক্রিয়ায় আটকাদেশপ্রাপ্ত শিশু এবং বিচারের আওতাধীন শিশুর আবাসন, সংশোধন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে, লিঙ্গভেদে, প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও রক্ষণাবেক্ষণ করিবে।

(২) উপধারা (১) এর প্রাসঙ্গিকতাকে ক্ষুণ্ন না করিয়া সরকার, যেকোনো সময়, উহার যেকোনো ইনস্টিটিউট বা প্রতিষ্ঠানকে শিশু অপরাধীদের অবস্থানের জন্য উপযুক্ত মর্মে প্রত্যয়ন করিতে পারিবে। 

তবে এক্ষেত্রে শর্ত রয়েছে ধারা ৬৩। (৩) দণ্ডবিধির ধারা ৮২-এর উদ্দেশ্যপূরণকল্পে ৯ (নয়) বছর বয়সের কম বয়সী কোনো শিশুকে কোনো প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠানে রাখা যাইবে না : 

তবে শর্ত থাকে যে, কোনো কারণে ৯ (নয়) বছর বয়সের কম বয়সী অভিভাবকহীন কোনো শিশুকে কোথাও পাওয়া গেলে তাহাকে অধিদফতর বা উহার নিকটস্থ কোনো কার্যালয়ে প্রেরণ করিতে হইবে এবং অধিদফতর বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বোর্ডের গোচরীভূত করত : সংশ্লিষ্ট শিশুকে সুবিধাবঞ্চিত শিশু গণ্যে, ক্ষেত্রমতো, ধারা ৮৪ বা ধারা ৮৫-এর বিধান অনুযায়ী পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে। 

মডেল : ইনায়া, জায়ান, আরিব, সিনজন, রাফিদ