শিশুর মানসিক বিকাশ ও আপনার করণীয়

14 Oct 2021, 12:35 PM শিশুভুবন শেয়ার:
শিশুর মানসিক বিকাশ ও আপনার করণীয়

‘আজ যে শিশু 

পৃথিবীর আলোয় এসেছে

আমরা তার তরে একটি সাজানো বাগান চাই’


আমরা কি এই পৃথিবীকে শিশুর নিরাপদ বসবাসের জন্য সাজানো বাগান হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছি ? মনে হয় না। কারণ, পৃথিবী দিন দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। তবে, বাবা-মা ইচ্ছে করলেই তাদের ঘর, তাদের সংসার শিশুর জন্য সাজানো বাগানে পরিণত করতে পারেন। নিজের পরিবার ও বাড়ি যদি নিরাপদ ও পরিচ্ছন্ন হয়, তাহলে তা শিশুর মানসিক বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। শিশুর বিকাশ একটি সচল প্রক্রিয়া। একক বয়সে শিশুর একেক ধরনের বিকাশ ঘটে। যে বয়সে যা হওয়া দরকার সেটি ঠিকমতো হচ্ছে কি না, সেদিকে নজর রাখা দরকার। তবে সব শিশুর বিকাশ যে একই গতিতে হবে এমন নয়, একটু আগে-পরে হতে পারে। এতে বাবা-মায়ের চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।

আমাদের দেশে প্রায় সব বাবা-মা-ই শিশু কবে নিজে নিজে বসতে পারল, হামাগুড়ি দিতে পারল, হাঁটতে ও কথা বলতে পারল এসব বিষয় খেয়াল করেন। এগুলো নিঃসন্দেহে শিশুর বিকাশ তবে এগুলো শারীরিক বিকাশ। মায়ের গর্ভ থেকে শিশুকাল, শৈশব, কৈশোর, বয়োসন্ধিকাল পেরিয়ে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বিকাশ লাভ করার প্রতিটি পর্যায়ে শারীরিক বৃদ্ধির পাশাপাশি শিশুর মানসিক পরিবর্তনও ঘটে। আর এই প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে ক্রমান্বয়ে দক্ষ হয়ে ওঠাকেই শিশুর মানসিক বিকাশ বলে।

শিশুর স্বাভাবিক শারীরিক বিকাশের জন্য প্রয়োজন গর্ভকালীন মায়ের যত্নে  মায়ের পুষ্টি ও তার গর্ভের শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করা, শিশু জন্মের পর প্রথম ছয় মাস মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো, ছয় মাস বয়সের পর থেকে বুকের দুধের পাশাপশি নিয়মিত অন্যান্য পুষ্টিকর ও সুষম খাবার খাওয়ানো, শিশু বড়ো হতে হতে তার খাবারের পরিমাণ বাড়ানো ইত্যাদি। অন্যদিকে শিশুর সুস্থ মানসিক বিকাশের জন্য বাবা-মাসহ চারপাশের মানুষের আচরণ এবং শিশুর চারপাশের পরিবেশ সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখতে হবে। অস্বাভাবিক পরিবেশে বেড়ে উঠলে শিশুর সুস্থ ও স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ ঘটে না।

শিশুদের মন অত্যন্ত কোমল ও অনূভুতিপ্রবণ হয়ে থকে। তারা যেন কোনোভাবে ভয় না পায় সেদিকে অভিভাকবদের খেয়াল রাখা উচিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুদের কোনো কাজ করানোর জন্য ভয় দেখালে তা তার মনে গেঁথে যায়। এর ফলে ওই শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয় এবং আত্মবিশ্বাস কমে যায়। এতে শিশুর সৃজনশীলতার বিকাশ ব্যাহত হয়। 

অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক কলহের চাপে শিশুর স্বাভাবিক জীবনই অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের ঘটনায় শিশুদের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যেসব শিশু মা-বাবার মনোমালিন্য দেখতে দেখতে বড়ো হয়, তারা হতাশ, অসামাজিক ও সহিংস হয়ে ওঠে। নানা অনিশ্চয়তায় ভুগতে থাকে। তাদের মধ্যে একধরনের অস্থিরতা কাজ করে সবসময়। 

‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ ২০১২’ শীর্ষক এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের ১৮.৩৫ শতাংশ মানসিক রোগে ভুগছে। এক্ষত্রে আবার মেয়েশিশুর তুলনায় ছেলেশিশুর সংখ্যা বেশি। মেয়েশিশুর ১৭.৪৭ শতাংশের পাশাপাশি ১৯.২১ শতাংশ ছেলেশিশু মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। গবেষকদের মতে, ‘শিশুদের ওপর মানসিক আঘাতের প্রভাব অনেক দীর্ঘস্থায়ী ও ক্ষতিকর। যেকোনো ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় মানসিক আঘাত শিশুর পরবর্তীজীবনকে বাধাগ্রস্ত করে, আবেগজাত সমস্যায় আক্রান্ত করে।’

গর্ভকালে যে-মায়েরা নির্যাতনের শিকার হন অথবা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকেন, তাদের সন্তানও জন্মের পর নানা জটিলতায় ভোগে। মাতৃগর্ভে থাকার সময় যাদের মা মানসিক আঘাতের শিকার হয়েছিলেন, সেই শিশুরা সহজেই মানসিক চাপে ভেঙে পড়ে এবং তাদের মধ্যে অ্যাংজাইটি বা পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিস-অর্ডার হওয়ার আশঙ্কা বেশি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক গবেষণায় এমন তথ্যই উঠে এসেছে।

ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পারিবারিক কলহের মধ্যে বেড়ে ওঠা অথবা মাকে নির্যাতিত হতে দেখা শিশুদের জীবনের প্রথম দিকের বছরগুলোতে তারা অরক্ষিত থাকে ও অসহায় বোধ করে। এসব শিশু পরবর্তীকালে হিং¯্র ঝুঁকিপূর্ণ বা অপরাধমূলক আচরণ করতে পারে। এরা বিষন্নতা  বা তীব্র দুশ্চিন্তায় ভোগার ঝুঁকিতেও পড়তে পারে।’

শিশুর মানসিক বিকাশে বাবা-মায়ের ভালোবাসা ও সান্নিধ্যের কোনো বিকল্প নেই। পরিবারে মাকে নির্যাতিত হতে দেখলে শিশু নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। শিশুর বাবা-মায়ের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ ও মধুর সম্পর্ক শিশুর মধ্যে পরম সুখ ও নিরাপত্তাবোধ জাগায়। বাবাকেও তাই শিশুর মানসিক বিকাশে ভূমিকা রাখতে হবে। 

শিশুর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের যথাযথ বৃদ্ধি হলো শারীরিক বিকাশ। আর মানসিক বিকাশ হলো আচার-ব্যবহার, চিন্তা-চেতনা, কথা বলা, অনুভূতি ও ভাবের আদান-প্রদানের ক্ষমতা অর্জন। শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ছাড়া শিশু তথা মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। 

শিশুর স্বাভাবিক বিকাশে হচ্ছে কি না

তা বুঝবেন যেভাবে :

একমাস বয়স হলে শিশু মাথা একদিকে ফিরিয়ে চিৎ হয়ে শুতে পারে। হঠাৎ কোনো শব্দ হলে চমকে ওঠে অথবা শরীর স্থির হয়ে যায়। হাতের মুঠো বন্ধ করে থাকে। হাতের তালুতে কিছু ছোঁয়ালে সেটা ধরার চেষ্টা করে।

দুই থেকে তিন মাস বয়সে শিশু শিশু তার মাকে চিনতে পারে এবং মায়ের গলার আওয়াজ পেলে সাড়া দেয়। নিজের মাথা স্থির করতে শেখে। কোনো জিনিসের ওপর নিজের চোখের দৃষ্টি স্থির করতে পারে। চিৎ হয়ে শুয়ে দুই হাত-পা সমানভাবে নাড়তে পারে। কান্নার আওয়াজ ছাড়াও মুখ দিয়ে নানারকম শব্দ করতে পারে। 

 ছয় মাস বয়সে শিশু আশপাশের শব্দ শুনলে মাথা ঘুরিয়ে তাকাতে চেষ্টা করে। চিৎ হওয়া থেকে উপুড় বা উপুড় থেকে চিৎ হতে পারে। অবলম্বনে ঠেকা দিয়ে অল্প সময়ের জন্য বসতেও পারে। উঁচু করে ধরলে পায়ে কিছু ভার নিতে পারে। উপুড় হয়ে শুয়ে হাত-পা ছড়িয়ে নিজের শরীরের ভার নিতে পারে।

নয় মাস বয়সে শিশু কানো অবলম্বন বা ঠেকা ছাড়াই কিছু না ধরে বসতে পারে। হামাগুড়ি দিতে পারে।

বারো মাস বয়স হলে শিশু উঠে দাঁড়াতে চায়। ‘মা-মা’ বলতে শুরু করে। ঘরের আসবাবপত্র ধরে হাঁটতে পারে।

আঠারো মাসে শিশু সাহায্য ছাড়াই একটা গ্লাস ধরতে পারে এবং তার থেকে পানি পান করতে পারে। কোনো অবলম্বন ছাড়াই হাঁটতে শেখে। দু-একটা শব্দ বলতে পারে। নিজে নিজে খেতে পারে।

দুই বছর বয়স হলে শিশু নিজে নিজে দৌড় দিতে পারে, পড়ে যায় না। পায়জামা ধরনের জামাকাপড় খুলে ফেলতে পারে। ছবির বইয়ে ছবি দেখলে আনন্দ পায়। নিজের চাহিদার কথা বলতে পারে। অন্যদের বলা কথা নকল করতে শুরু করে। তার শরীরের কিছু কিছু অংশ চেনাতে পারে।

তিন বছর বয়সে শিশু কাঁধের ওপর হাত তুলে বল ছুঁড়ে মারতে পারে। সাধারণ কিছু প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারে। 

চার বছর বয়স হলে শিশু পা দিয়ে সাইকেলের প্যাডেল ঘোরাতে পারে, বইয়ে, পত্রিকায় বা ম্যাগাজিনের পাতায় দেখা ছবির নাম বলতে পারে।

পাঁচ বছর বয়স হলে শিশু নিজের জামাকাপড়ের বোতাম লাগাতে পারে। পা বদল করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারে। শিশুর বিকাশের ধারায় এর কয়েকটি যদি বাদ পড়ে তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। সাধারণভাবে এই দক্ষতাগুলোর মধ্যে ২৫ শতাংশ প্রকাশ না পেলে ল শিশুর বিকাশ দেরিতে হচ্ছে বলে ধরে নেওয়া হয়।হ