চিত্তদাহ -জাহাঙ্গীর আলম জাহিদ

14 Oct 2021, 12:40 PM সাহিত্যভুবন শেয়ার:
চিত্তদাহ  -জাহাঙ্গীর আলম জাহিদ


[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


দুই ভাই নাপিতের দোকানে যায়। বারবার আয়নায় মুখ দেখে। ত্যাড়া সিথি করে চুল আঁচড়ায়। শেভ করার জন্য চেয়ারে বসে। নাপিতকে বলে, ঘন ঘন শেভ করলে চাপদাড়ি উঠবে। ছাগলা দাড়ি হলে বন্ধুরা হাসাহাসি করবে। নাপিত বিরক্ত হয়। মাতব্বরের ছেলে। কিছু বলতে পারে না।

লিজার আর সিজার বড়ো হয়েছে। তারাই এখন টেলিভিশন চালায়। ঢাকা আর কলকাতার অনুষ্ঠান দেখার জন্য বারবার বাঁশ ঘুরিয়ে অ্যান্টেনা ঠিক করে।

লিজার পাট বিক্রি করা টাকা দিয়ে তিন ব্যাটারি টর্চ লাইট কিনেছে। অন্ধকার রাতে তিন ব্যাটারি লাইটের আলো অনেক দূর পর্যন্ত যায়। মাঝে-মধ্যে শুভ আকাশের দিকে লাইট জ্বালিয়ে বড়ো ভাইকে বলে, ভাই, দ্যাখো দ্যাখো, আকাশ দেখা যাচ্ছে ! শুভর কথা শুনে বড়ো ভাই দাঁত বের করে হাসে।

কিছুদিন হলো, শুভকে স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে। শুভর মায়ের ভয়, বড়ো দুভায়ের মতো শুভও যদি না পড়ে ? বড়ো দুই ছেলের জন্য মাতব্বরের দুঃখ হয়। মাতব্বর ছোটো ছেলের হাত ধরে প্রাইমারি স্কুলে গেল। হেড মাস্টারকে মাতব্বর বলল, ছোটো ছেলে। বড়ো দুই ছেলের মতো যেন না হয়। 

হেড মাস্টার শুভকে চকলেট দিল। ক্লাস রুম থেকে দৌড়ে রিমি মাস্টারের কাছে এসে দাঁড়ালো। রিমির হাতেও মাস্টার চকলেট দিল।

কার মেয়ে ? বড়ো মিষ্টি চেহারা ! মাতব্বর বলল। 

চেনেন না ? আপনার বাড়ির পাশেই তো বাড়ি। করিমের মেয়ে। হেড মাস্টার বলল। 

মাস্টার ছেলের দিকে নজর দিও। ওর মা খুব করে বলেছে। মাতব্বর বলল। 

কোনো চিন্তা করবেন না। মাস্টার বলল। 

বড়ো দুই ছেলেকে তো পড়াতে পারোনি। মাতব্বর বলল। 

মাতব্বর শুভকে নিয়ে দর্জির দোকানে গেল। শুভর জন্য প্যান্ট আর শার্টের অর্ডার দিল। গ্রামের স্কুল। স্কুলের নির্ধারিত কোনো ড্রেস নেই। যার যা খুশি তাই পরতে পারে। স্কুল ছুটির পর শুভ রিমির সাথে রাস্তার ধুলো ওড়াতে ওড়াতে বাড়িতে এল। বাড়িতে এসে শুভ মায়ের কাছে স্কুলের গল্প বলল। রিমি শুভকে দিল্লির লাড্ডু খেতে দিয়েছিল। সে কথা বলল।

পড়ালেখার প্রতি শুভর আগ্রহ দেখে মাস্টার বেশ খুশি। পরীক্ষায় শুভ প্রথম হলো। মাতব্বরের আনন্দের সীমা থাকে না। মাতব্বর হেড মাস্টারের রুমে যায়। খোশ-গল্প করে।

লিজার আর সিজারের টু-ইন-ওয়ান কেনার ভারি শখ। দুই ভাই মায়ের পিছে পিছে টাকার জন্য ঘোরে। ছয় ব্যাটারির টু-ইন-ওয়ান। বেশ দাম। শুভর মা বিষয়টি মাতব্বরকে বলল। মতব্বর বলল, এত টাকা আমি দিতে পারব না। 

শুভর মামা এসেছে। মামাকে দেখে তিন ভাই ভারি খুশি। তিন ভাই মামাকে জাপটে ধরল। ভাগ্নেদের নিয়ে মামা গল্পে মেতে উঠল। লিজার আর সিজার মামাকে টু-ইন-ওয়ানের কথা বলল। শুভর মামা দুই ভাগ্নের শখের কথা বোনকে জানাল। শুভর মা বলল, তোর দুলাভাইকে ক্যাসেটের কথা বলেছিলাম। তোর দুলাভাই বলল, ক্যাসেট কেনার টাকা নেই। রাতে খাওয়ার সময় শুভর মামা মাতব্বরকে টু-ইন-ওয়ানের কথা বলল। মাতব্বরের এককথা। ক্যাসেট কেনার টাকা নেই। শেষ পর্যন্ত মামা ভাগ্নের জন্য কুষ্টিয়া থেকে টু-ইন-ওয়ান কিনে আনল। টু-ইন-ওয়ান পেয়ে লিজার আর সিজার খুব খুশি হলো। 

লিজার আর সিজার এখন টু-ইন-ওয়ানে গান শোনে আর বন্ধুদের সাথে তাস খেলে। মাঝে-মধ্যে ক্যাসেটের ফিতা জড়িয়ে যায়। শুভকে পেন্সিল আর ছোট স্ক্রু ড্রাইভার আনতে বলে। ক্যাসেটের ফিতা ঠিক করে আর গুনগুন করে গান গায়। 

বড়ো দু-ভাই মাঝে-মধ্যে কুষ্টিয়াতে সিনেমা দেখতে যায়। রক্সি সিনেমা হলের পাশের হোটেলে বন্ধুদের সাথে খাওয়া-দাওয়া করে। টুমটুমে দোকান থেকে ভিউকার্ড কেনে। বিভিন্ন নায়ক নায়িকাদের ভিউকার্ড কিনে বারবার দেখে। থরেথরে সাজিয়ে রাখে। শুভর মা-বাবা কেউই সন্তানদের কিছু বলে না। মাতৃ স্নেহ ও পিতৃ স্নেহ স্বর্গের সুখ এনে দেয়। 

শুভ এখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। সে পাড়ার ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলে। মার্বেল খেলে। হাডুডু খেলতে পারে। লাটিম খেলার চেষ্টা করে। মাঝে-মধ্যে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ঘর বানায়। দিঘির পাড়ে জন্মানো আস্টেল আর ভাটি কেটে ঘরের ছাউনি দেয়। কলার পাতা দিয়ে ঘরে বেড়া দেয়। রিমি মেয়েদের সাথে কুতকুত খেলে। শুভকেও খেলতে বলে। বৃষ্টি হলে দৌড়ে শুভর ঘরে যায়।

রিমির পিছে পিছে অন্যরাও যায়। ঘরে জায়গা হয় না। চাপাচাপি করে বসতে গিয়ে ঘর ভেঙে পড়ে। শুভর মন খারাপ হয়। রিমি শুভর হাত ধরে বলে, চল বৃষ্টিতে ভিজি আর খেলি! শুভ খুশি হয়। 

ক্লাস ফাইভে শুভ আর রিমি বৃত্তি পরীক্ষা দিয়েছিল। দুজনই বৃত্তি পেল। শুভ আর রিমির কথা সারাগ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। মাতব্বর স্কুলের শিক্ষককে মিষ্টি খাওয়াল। বাড়িতে দোয়ার ব্যবস্থা করল। ছোটো ভাইয়ের সাফল্যে লিজার আর সিজার খুশি হলো। ছোটো ছেলের কৃতিত্বে শুভর মায়ের মুখ উজ্জ্বল হাসিতে ভরে গেল।

শুভ ডাঁশা হাইস্কুলে ভর্তি হবে। শুভর জন্য একটা সাইকেল কিনে দাও। শুভর মা মাতব্বরকে বলল।

লিজার কুষ্টিয়া গিয়ে সাইকেল কিনে আনবে। হাসিমুখে মাতব্বর বলল। 

শুভদের হাইস্কুল অনেক বড়ো। দোতলা দালান। বড়ো খেলার মাঠ। স্কুলে শুভ আর রিমি একসাথে ভর্তি হলো।

রিমির প্রতি শুভর অজানা টান আছে। রিমির উপর মাঝেমধ্যে সে অধিকারও খাটায়। রিমির সাথে বই-খাতা বিনিময় করে। 

মাতব্বর সাইকেল কেনার জন্য লিজারের হাতে টাকা দিল। লিজা নতুন সাইকেল কিনে আনল। চায়না ফনিক্স। ভারি চমৎকার ! সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারে বই বেঁধে শুভ স্কুলে যায়। রাস্তায় লোক দেখলে বেল বাজায়। রিমি ছেলে-মেয়েদের সাথে দল বেঁধে স্কুলে যায়। পেছন থেকে শুভ সাইকেলের বেল বাজালে রিমি মুখ টিপে হাসে। 

বৃষ্টির দিনে শুভ হেঁটে স্কুলে যায়। বন্ধুদের সাথে হাঁটার প্রতিযোগিতা করে। কখনো রিমির সাথে কথা বলতে বলতে স্কুলে যায়। এঁটেল মাটি। কাঁচা রাস্তা। হাঁটু পর্যন্ত কাদা। রাস্তার ধারে কেউ কেউ প্রাকৃতিক কর্ম করে। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় লোকজন বিড়বিড় করে বকে। হঠাৎ পা পিছলে পড়লে নাপাক জিনিস গায়ে লাগে। তখন পাশের ডোবায় গিয়ে ধোয় আর চিৎকার করে বকে। 

শুভ কোনো দিন রাস্তায় পড়েনি। রিমি একবার পড়ে গিয়েছিল। পিছলা খেয়ে পায়ের স্যান্ডেলও ছিঁড়ে গিয়েছিল। হাতের বই, খাতা আর লেডিস ছাতা কাদার মধ্যে ছিটকে পড়েছিল। শুভ রিমিকে হাত ধরে উঠিয়ে দিয়েছিল। বই, খাতা আর ছাতা গুছিয়ে দিয়েছিল। 

রিমি পড়ে গিয়ে যতটা ব্যথা পেয়েছিল তার থেকেও বেশি পেয়েছিল লজ্জা। রিমি ক্লাস এইটে পড়ে। বয়সটা লজ্জা আর ব্যক্তিত্ব বিকাশের। রিমি কোনো কথা না বলে চুপচাপ বাড়িতে ফিরে গিয়েছিল। সেদিন শুভও স্কুলে যায় নি। 

হাইস্কুলে যেতে একটি নদী পার হতে হয়। মরা নদী। নাম ডাকুয়া। এলাকার লোক ডাকো নদী বলে। কালীগঙ্গা নদীর শাখা। গড়াই নদী হতে কালীগঙ্গা নদীর উৎপত্তি। উৎপত্তি স্থল থেকে কালীগঙ্গা নদী আটকানো। নদীটি সমতল ভূমির বুক চিরে আঁকাবাকা হয়ে চলে গেছে। নদীর পাড়ে কোনো পাহাড় নেই। কোনো পাথর নেই। বালিও নগণ্য।

এককালে ডাকুয়া নদীতে প্রচ- ঢেউ ছিল। স্রোতের বেগ ছিল। ধারালো স্রোতের তোড়ে দুপাড় ভেঙে পড়ত। দুকুল ছাপিয়ে বন্যা হতো। পাল তোলা নৌকা তরতর করে চলত। রং-বেরঙের পাল তোলা বাহারি সব নৌকা। বাতাস পড়ে গেলে গুন টানা হতো। নদীকে ঘিরেই চলত ব্যবসা-বাণিজ্য। জেলেরা মাছ ধরত। ঢেউয়ের তালে তালে জীবনের স্বপ্ন বোনা হতো।

এখন নদীতে পানি নেই। ঢেউ নেই। নৌকা চলে না। নদীতে মাছ নেই। জেলেরা নদীতে নামে না। নদী কেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। ঢেউয়ে বোনা স্বপ্নগুলো শুকিয়ে গেছে।

নদীতে এখন কচুরি পানা। কচুরি পানার ফুলের দিকে শুভ মাঝে মধ্যে তাকায়। কচুরি পানার ফুল ছিঁড়ে শিশুরা খেলা করে। মাঝ নদীতে দাঁড়িয়ে গরু-মহিষ কচুরি পানা খায়। মাঝ নদীর কোনো কোনো জায়গা শুকনো। শুকনো খটখটে জায়গায় কচুরি পানাও মরে গেছে। নদী তীরে গড়ে ওঠা আগের হাট-বাজার ও প্রতিষ্ঠান আজও আছে।

নদীর পাড় ঘেঁষা জমির মালিকেরা সৌভাগ্যবান। পাড় ভাঙার ভয় নেই। নদীর উর্বর প্রশস্ত জমি। চাষের উপযোগী। নদী দখল করে অনেকেই চাষাবাদ করছে। কেউ কেউ পাড় ভরাট করে বাড়ি বানিয়েছে। প্রভাবশালী হলে তো কথাই নেই। নদীর মুঠি মুঠি খোলা বাতাসটুকু নির্জীবভাবে আজও বয়ে চলে। প্রাণ জুড়িয়ে যায়। দখল করা জমিতে বাস করার মজাই আলাদা!

বর্ষাকালে নদীতে বেশ পানি জমে। ঢেউহীন। মরা নদীর নিথর পানি। নদীর উপর বাঁশের সাঁকো। বৃষ্টি হলে দুপাড় পিচ্ছিল হয়। সাবধানে পা টিপে টিপে বাঁশের সাঁকো পার হতে হয়। শুভ স্যান্ডেল হাতে করে স্কুলে যায়। স্কুলে গিয়ে টিউবওয়েলের পানিতে হাত-পা ধোয়। 

শুভ ও রিমি প্রাইভেট পড়তে শুরু করেছে। ক্লাস এইটে বৃত্তি পরীক্ষা দেবে। অঙ্ক আর ইংরেজি পড়ে। স্কুল থেকে এসে শুভ বন্ধুদের সাথে ফুটবল, ভলিবল খেলে। রিমি সেজে গুঁজে বাড়ির আঙিনায় হাঁটাহাঁটি করে। [চলবে]