চিত্তদাহ -জাহাঙ্গীর আলম জাহিদ

21 Sep 2021, 12:05 PM সাহিত্যভুবন শেয়ার:
চিত্তদাহ -জাহাঙ্গীর আলম জাহিদ

আকাশ ভরা রুপালি আলো। দূর গাছ-পালার ভেতর থেকে উঠে আসা, গোল থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদখানি, মাতব্বর বাড়ির আঙিনায় এসে রূপের সুরভি ছড়াচ্ছে। রজনীগন্ধা আর কাঠালি চাঁপার গন্ধভরা মিষ্টি বাতাস মাতব্বর বাড়িটিকে বারবার আলিঙ্গন করছে। শুভ একবার আকাশের দিকে তাকালো। পূর্ণিমা তিথি সে ঠিক মনে রাখে। মাঝে-মধ্যে হিসাবের গড়মিল হয়। তাও চেষ্টা করে দু’নয়ন মেলে পূর্ণিমা রাতের অপরূপ দৃশ্য প্রাণভরে উপভোগ করতে। 

রাতের আকাশ দেখার অভ্যাস শুভর কখন থেকে হয়েছিল, ঠিক মনে নেই। এসএসসি পরীক্ষার আগে রিমি আর সে এক টেবিলে বসে পড়ত। রিমি ঘুমোতে গেলে, সে একা একা উঠানে পায়চারি করত। তখন সে আকাশের দিকে তাকাত। গভীর রাতে চাঁদ, তারা আর নক্ষত্রের মিষ্টি আলোর দিকে সে তাকিয়ে থাকত। কখনো খ- খ- মেঘ চাঁদ আড়াল করে উড়ে যেত। শুভ সেদিকে তাকিয়ে থাকত।

দিনের আলো মুছে যাওয়ার সাথে সাথেই ঝিঁঝি পোকার ডাকে কান ঝালাপালা হয়ে যেত। শুভ ঝিঁঝি পোকার গর্ত খুঁজে পানি ঢালত। বদনা বদনা পানি ঢেলে ঝিঁঝি পোকা বের করত।

শান্ত সুন্দর নির্মল কৃষ্ণপুর গ্রামে তখনও বিদ্যুতের আলো আসেনি। বিকাল হলেই হ্যারিকেন ও চেরাগ মোছার ধুম পড়ে যেত। হ্যারিকেন ও চেরাগের সলতে ঠিক করা হতো। তেল ঢালা হতো। হেঁশেল ঘরে কেরোসিনের টিন থাকত। কারো দরকার হলে তেল নিতে পারত। সন্ধ্যা হতেই হ্যারিকেনের আলোয় শুভর রুমটি ঝলমল করত। 

খেটে খাওয়া মানুষেরা সাঁঝরাতেই ঘুমিয়ে পড়ত। কেউ বাঁশি বাজাত, গান গাইত, লুডু খেলত, তাস খেলত। রাতের শান্ত প্রকৃতি গ্রামটিকে স্বর্গীয় স্বপ্নের রাজ্যে নিয়ে যেত। শীতকালে গ্রামে যাত্রার দল আর সার্কাস পার্টি আসত। ধর্মীয় সভা হতো। শুভ বড়োদের চোখ ফাঁকি দিয়ে যাত্রাগান দেখতে যেত। শুধু রিমির চোখ সে ফাঁকি দিতে পারত না। 

গ্রামে যাত্রার দল এলে মাইকে ঘোষণা হতো, হৈ-হৈ কাণ্ড আর রৈ-রৈ ব্যাপার! আসিতেছে! আসিতেছে! কৃষ্ণপুর সোনালি সঙ্ঘ ও পাঠাগারের উদ্যোগে দেশবিখ্যাত ‘নয়নতারা’ যাত্রাপালা। হ্যাঁ ভাই! আজ রাতে অভিনীত হবে, বাংলার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘চিত্তদাহ’। সে সাথে আলোক উজ্জ্বল রঙ্গমঞ্চ মাতাবে একঝাক ডানাকাটা পরি। এ সুযোগ হেলায় হারাবেন না। আপনারা সবাই আমন্ত্রিত। হ্যাঁ ভাই, আজ রাতে... 

একবার যাত্রা দেখার সময় শুভ দেখল, পাশে বসা তার বড়ো ভাই। সে জড়োসড়ো হয়ে চাদরমুড়ি দিয়ে বসলো। একটু পরে দেখলো, বড়ো ভাইও চাদরমুড়ি দিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। 

আষাঢ় মাসে দুই গ্রাম পেরিয়ে খোকসায় রথযাত্রা হতো। গড়াইয়ের পাড় ঘেঁষা ছোট্ট শহর খোকসা। অনিন্দ্য সুন্দর শহরটি। খোকসাতে কোনোদিনও রিকশা চোখে পড়েনি। শুভ ভ্যানে গাদাগাদি করে বসত। গল্প করতে করতে মেলায় যেত।

রথযাত্রার দিনে বিশাল বড়ো মেলা বসত। মেলায় পাঁপড় ভাজা, জিলাপি, ছাঁচের খাজা, মুড়ি-মুড়কি ইত্যাদির সমাহার ছিল। খেলনা বাটি, বাঁশি, পুঁতির মালা, কাচের চুড়ি, নানান রঙের আংটি, গয়নার সাজ, চশমা, মার্বেল, নাগরদোলা, কাঠের রথসহ অনেক কিছু পাওয়া যেত। প্রচ- ভিড়ের মিলনমেলা শুভ ও রিমি বন্ধুদের সাথে উপভোগ করত। 

শুভদের গ্রামটি অপূর্ব সুন্দর। চারদিকে মাঠ আর মাঠ। মাঠের মাঝখানে উঁচু ঢিবির উপর গ্রামটি যেন একখ- স্বর্গ। গ্রামের দুদিকে বিশাল বড়ো দুটি বিল। গাড়িসহ মহিষ হারিয়ে যাওয়ার জন্য একটি বিলের নাম মোষগাড়ির বিল। আর মাছ ধরতে গিয়ে মানুষ ফিরে না আসায় আরেকটি বিলের নাম আদমগাড়ির বিল। এখন আর আগের মতো বিলে পানি থাকে না। শুভ দুটি বিলেই গিয়েছিল। ঘটনা সত্যি কি না অনেককে জিজ্ঞেসও করেছিল। মুরুব্বিরা বলেছিল, তারাও পূর্ব-পুরুষদের কাছ থেকে শুনেছে। এখন বিলভরা ফসল আর ফসল। শুভ মাঝে-মধ্যে মাঠের ফসল দেখতে যেত। ফসলের কচি পাতায় হাত বোলাতে তার খুব ভালো লাগত। 

শুভদের বাড়িতে কৌলীন্যের ছাপ আজও আছে। চল্লিশ ইঞ্চি গাঁথুনির পুরাতন দালান। বহু আগে বাইরের আস্তর খসে গেছে। ইটের খাজে খাজে আগাছা। বসবাস করার জন্য ভেতরটা মাঝে-মধ্যে চুনকাম করা হয়। 

বাড়িটি তাদের পূর্ব-পুরুষদের। এলাকার প্রাচীন বাড়ি এটি। দালানের পাশেই একটি মরিচা ধরা আটচালা টিনের ঘর। বাড়িটির তিনদিকে রাস্তা। নানাধরনের ফলদ ও বনজ গাছ বাড়িটিকে ছায়া দেয়। বাড়ির দক্ষিণ দিকে বিরাট বড়ো দিঘি। দিঘির পাড়ে সারিসারি নারিকেল, তাল, আম আর কাঁঠাল গাছ। আটচালা ঘরের ঠিক পেছনে আতাফল আর মেওয়া ফলের গাছ। একটু দূরে বড়ো একটি শজিনা, সোনালু আর জাম গাছ। 

নানাধরনের পাখি সারাদিন কিচির-মিচির করে। বৈশাখ মাসে গোলাপি রঙের আতা, পাতাহীন শাখায় ভরে থাকে। বাড়ির কেউ আতাফল খায় না। তবে দু-চারটা মেওয়াফল খায়। ঝড়-বৃষ্টির দিনে শজিনার সাদা ফুল, আমের মুকুল আর গাছের পাতায় ভরে যায় আঙিনা। শুভর খুব ভালো লাগে। বাড়ির পশ্চিমে ছিল বিশাল বড়ো বাঁশবাগান। বাঁশবাগানের মাঝে সরু-সরু দেবদারু গাছ। একটু দূরে ঝোপ ঘেঁষে কলাবাগান। বিচি কলা। কলাবাগানের দিকে কেউ তাকায় না। বিচি কলা কেউ খায় না। বাড়িটি কত বড়ো শুভ জানে না। 

এ বাড়ির লোকেদের গ্রামের সবাই সম্মান করে। বংশ পরম্পরায় এ বাড়ির ছেলেই গ্রামের সালিশ-দরবার করে। শুভর বাবা গ্রামের মাতব্বর। সালিশ দরবার করেই তার দিন যায়। তিন ভাইয়ের মধ্যে শুভ ছোটো। 

শুভর মায়ের বড়ো শখ ছেলেরা পড়ালেখা করবে। তারা বাবার মতো গ্রামের মাতব্বর হবে না। শুভর বড়ো ভাই লিজার, মেজো ভাই সিজার। মাতব্বর কৃষ্ণপুর প্রাইমারি স্কুলে লিজার আর সিজারকে ভর্তি করে দিল। 

মা দু’ছেলের মাথায় সরিষার তেল লাগিয়ে দেয়। সুন্দর করে চুল আঁচড়ে দেয়। কাছে বসিয়ে গরম ভাত খাইয়ে স্কুলে পাঠায়। মাঝে মধ্যে মাতব্বরকে বলে, শুধু সালিশ-দরবার! ছেলেদের দিকে কোনো নজর নেই! 

মেয়ে মানুষ বেশি কথা বলে! শুভর বাবা বলত। 

একদিন স্কুল থেকে এসে লিজার আর সিজার বলল, মা পড়ালেখার জন্য দুজন লোক রেখে দাও।

কি ? মা হেসে বলল। 

বাবার কাজ তো অন্যরা করে। সিজার বলল। 

কোন কাজ ? মা বলল। 

মাঠের কাজ। সিজার বলল। 

পড়া-লেখা নিজেকেই করতে হয়। মা বলল।

যে কাজ লোক দিয়ে করানো যায় না। সে কাজ করবো না। সিজার বলল। 

কী হয়েছে ? মা বলল। 

মাস্টের বকা দিয়েছে। সিজার বলল। 

ভালো করে পড়লে মাস্টের বকা দেবে না। মা বলল। 

মাতব্বর বাড়িতে আসল। গায়ের জামা খুলল। মাথায় সরিষার তেল নিল। গোসল করবে। শুভর মা মাতব্বরের পিঠে তেল লাগিয়ে দিল।

আয়না আর ছোটো কাইচি আনো। মাতব্বর বলল।

মাতব্বর আয়নায় মুখ দেখছে। নাকের লোম বড়ো হয়েছে। মাতব্বর কাইচি দিয়ে নাকের লোম কাটছে। 

তোমার ছেলেরা পড়ার জন্য লোক রেখে দিতে বলেছে। শুভর মা বলল।

প্রাইভেট মাস্টের রেখে দেব। মাতব্বর বলল।

প্রাইভেট মাস্টের না। শুভর মা বলল।

তাহলে কী ? মাতব্বর জানতে চাইল।

পড়া পারেনি। মাস্টের বকা দিয়েছে। শুভর মা বলল।

পড়া না পারলে বকা তো দেবেই! মাতব্বর বলল।

তোমার ছেলেদের পড়া, অন্যদের দিয়ে পড়ানোর কথা বলেছে। শুভর মা বলল। 

সম্মানী ঘরের সন্তান! মাতব্বর হো হো করে হেসে বলল।

শেষ পর্যন্ত দু’ভাইয়ের আর পড়া-লেখা হয় নি।

মাতব্বর দ্ইু বিঘা জমি বিক্রি করল। জমি বিক্রি করা টাকা দিয়ে একটি টেলিভিশন কিনল। সাদা-কালো টেলিভিশন। অ্যান্টেনায় ক্যাবল সেট করল। বাঁশঝাড় থেকে লম্বা সরু একটি বাঁশ কাটল। বাঁশের মাথায় শক্ত করে অ্যান্টেনা বাঁধল। 

গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। টেলিভিশন দেখার জন্য মাতব্বর রিচার্জেবল দুটি ব্যাটারি কিনল। ব্যাটারি চার্য দিতে খোকসায় যেতে হয়। মাতব্বর একটি ভ্যান কিনল। কাজের লোক চার্য দেয়ার জন্য একটি ব্যাটারি দিয়ে আসে। অন্যটি নিয়ে আসে। সন্ধ্যায় মাতব্বর লোকজনের সাথে টেলিভিশন দেখে। লোড শেডিংয়ের কোনো ভয় নেই। টেলিভিশন দেখার জন্য অনেক রাত পর্র্যন্ত মাতব্বর বাড়িতে লোক গমগম করে। 

শুভদের বাড়িতে সারাবছর কাজ লেগেই থাকে। শত শত বিঘা-জমির ফসল। গরুর গাড়ি ও মহিষের গাড়িতে করে আনা হয়। সবকিছুর দায়িত্ব শুভর মায়ের। মাতব্বর সালিশ-দরবার আর চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেয়। লিজার আর সিজার সারাদিন খেলায় মেতে থাকে। মার্বেল, ডাংগুলি, কানামাছি ভোঁভো, চোর-ডাকাত-দারোগা, সাতগুটি বাঘমারা, ষোল পাতে, হাডুডু কোনো কিছুই বাদ যায় না। শুভ মাঝে-মধ্যে বড়ো ভাইদের খেলা দেখে। কখনো বন্ধুদের সঙ্গে খেলার চেষ্টা করে। 

সময় চলে যায়। লিজার আর সিজার বড়ো হতে থাকে। খেলাধুলার ধরনও পাল্টাতে থাকে। তারা এখন হাই স্কুলে যাওয়া মেয়েদের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকায়। পূর্ব-পুরুষদের জমিদারি স্বভাব তাদের রক্তে। আড়ালে-আবডালে বসে বিড়ি টানে। সিগারেট খায়। গোল্ডলিফ। বেনসন। দামি সিগারেট টেনে গৌরব বোধ করে। মাঝে মধ্যে মিষ্টি পান খায়। পান খাওয়ার সময় সিগারেট ধরায়। সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে তাকিয়ে দেখে। বন্ধুদের সাথে সিগারেট টেনে নিজেদের সাবালক মনে করে।