শিশুকে মায়ের বুকের দুধ পান করানোই সবচেয়ে নিরাপদ

25 Aug 2021, 03:33 PM শিশুভুবন শেয়ার:
শিশুকে মায়ের বুকের দুধ পান  করানোই সবচেয়ে নিরাপদ

শিশুর খাবারদাবার নিয়ে মা-বাবার ভাবনার অন্ত নেই। কী খাওয়াবেন , না খাওয়াবেন তা নিয়ে জল্পনাকল্পনার শেষ নেই। শিশুকে কোন বয়সে কোন খাবার খাওয়ানো উচিত, তা জানা থাকা দরকার। শিশুর জন্মের পর থেকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধই একমাত্র ও আদর্শ খাবার। এসময় অন্য কোনো খাবার এমনকি পানি পান করানোরও কোনো আবশ্যকতা নেই। শিশুর বয়স ছয় মাস হওয়ার পর থেকে শিশুর পুষ্টিচাহিদা পূরণের জন্য তথা স্বাভাবিক শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশের জন্য বুকের দুধের পাশাপাশি পরিপূরক খাবার খাওয়ানো উচিত। তবে শিশুর দুই বছর বয়স পর্যন্ত দুধ হিসেবে কেবল মায়ের বুকের দুধ পান করানোই সবচেয়ে নিরাপদ। গোরুর দুধ বা কৌটার দুধ খাওয়ানো শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এগুলো খাওয়ানোর কোনো দরকার নেই। মায়ের দুধে সবধরনের খাদ্য উপাদানই থাকে। এ ছাড়া জন্মের পরপরই মায়ের স্তন থেকে যে হলুদ রঙের শালদুধ বের হয়, তা নবজাতকের প্রথম টিকা, রোগ প্রতিরোধে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নবজাতকে শালদুধ খাওয়ানো নিয়ে নানারকম কুসংস্কার প্রচলিত। তাই অনেকে শালদুধ পান করানো নিয়ে দ্বিধায় থাকেন। কিন্তু এ-কথা মনে রাখতে হবে, শালদুধই শিশুর জন্য প্রথম প্রতিরক্ষা হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

মায়ের বুকের দুধ বিশুদ্ধ, সহজে হজম হয় এবং এতে রোগ প্রতিরোধী সবধরনের উপাদান থাকে বলে যেকোনো সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকাংশেই কমে যায়। মায়ের দুধ পানকারী শিশুর হাঁপানি, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, স্থূলতা, টাইপ-১ ডায়াবেটিস, কানের প্রদাহ, ডায়রিয়া, বমি, সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোম ইত্যাদির আশঙ্কা কম থাকে। যে মায়েরা শিশুকে বুকের দুধ পান করান ; তাদেরও উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্তন ও জরায়ুর ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক কমে যায়। কিন্তু বাজারে যেসব শিশুখাদ্য পাওয়া যায়, সেগুলো মায়ের দুধের মতো এতটা সুরক্ষা দিতে পারে না। ফলে এসব ফর্মুলা দুধ পান করালে শিশু ও নবজাত’র নানারকম রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

নবজাতকে দুধ পান করানোর ক্ষেত্রে মায়েদের কিছু বিষয়ে খেয়াল রাখা জরুরি। নবজাতের পুষ্টি নিশ্চিত করতে মাকে অবশ্যই সুষম খাবার খেতে হবে। প্রতিবার শিশুকে দুধ দেওয়ার আগে মাকে এক থেকে দুই গ্লাস পানি অথবা অন্য কোনো তরল গ্রহণ করতে হবে। শিশুকে দুধ দেওয়ার সময় কোনোরকম তাড়াহুড়া করা উচিত নয়। প্রশান্ত মনে ও ধৈর্যসহকারে শিশুকে বুকের দুধ দিতে হবে। মা যদি বসে বসে শিশুকে দিতে চান, তাহলে পিঠের পেছনে এবং কোলের নিচে বালিশ নিয়ে আরাম করে বসবেন। মা শুয়ে শুয়ে দুধ দিতে চাইলে শিশুকে মায়ের দিকে পাশ ফিরিয়ে এমনভাবে শুইয়ে দিতে হবে, যেন মা হাত দিয়ে শিশুর পশ্চাদ্দেশ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেন। বুকের দুধ পান করার সময় খেয়াল রাখতে শিশুর নাক যেন চাপে না পড়ে। নাক চাপা পড়লে শিশুর নিঃশ্বাস নিতে অসুবিধা হবে।

প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর শিশুকে বুকের দুধ দিতে হবে। প্রতিবার দুধ দেওয়ার সময় একটি স্তন থেকেই ভালোভাবে দিতে হবে। কারণ, একই স্তন থেকে প্রথমদিকে পাতলা এবং পরে ঘন দুধ বের হয়। তবে রাতে ঘুমানোর সময় একটানা চার ঘণ্টা বিরতি দিলেও কোনো সমস্যা নেই। কর্মজীবী মায়েরা কাজে থাকাকালীন শিশুর যাতে বুকের দুধের অভাব না হয়, সে জন্য বুকের দুধ সংরক্ষণ করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে কাজ থেকে ফিরে যতবার শিশুকে দুধ দিবেন ততবার স্তন থেকে দুধ পাম্প করে তা ফ্রিজে সংরক্ষণ করবেন। তবে ফ্রিজ থেকে বের করে সঙ্গে সঙ্গেই ঠান্ডা দুধ শিশুকে দেওয়া যাবে না। একটি পাত্রে গরম পানিতে দুধের পাত্র রেখে নেড়ে নেড়ে শিশুর খাওয়ার জন্য সহনীয় তাপমাত্রায় আনতে হবে।

বর্তমান করোনাকালে মা যদি কোভিডে সংক্রমিত হন, সেক্ষেত্রেও কিন্তু শিশুকে বুকের দুধ পান করানোতে কোনো বাধা নেই। এরকম ক্ষেত্রে মা ভালো করে সাবান-পানি দিয়ে হাত ধুয়ে মাস্ক পরে শিশুকে দুধ পান করাবেন। তবে মা যদি সক্রিয় যক্ষ্মা, এইডস, হিউম্যান টি সেল লিম্ফোট্রফিক ভাইরাস ইত্যাদিতে সংক্রমিত থাকেন কিংবা কোনো মাদকদ্রব্য সেবন করেন বা ক্যান্সারের জন্য কেমোথেরাপি চিকিৎসা নেন, তাহলে শিশুকে স্তন দান থেকে বিরত থাকা উচিত। শিশু যদি গ্যালাক্টোসেমিয়া, ফিনাইলকিটোনিউরিয়া বা ম্যাপল সিরাপ ইউরিন ডিজিজ ধরনের জন্মগত মেটাবলিক রোগে ভোগেন, তাহলেও শিশুকে মায়ের দুধ দেওয়া থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। এরকম ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শমতো শিশুকে বিশেষায়িত ফর্মুলা দুধ খাওয়ানো যেতে পারে।

ছয় মাস থেকে এক বছর বয়সী শিশুদের মায়ের দুধের পাশাপাশি তিন বেলা বাড়তি খাবার দেওয়া দরকার। তবে এ বয়সেও শিশুর মূল খাবার মায়ের দুধ। অর্থাৎ বাড়তি খাবারের পরিমাণ হবে কম। তিন বেলা খাবারের মধ্যে দুই বেলা খিচুড়ি বা নরম ভাতের মতো হালকা ভারি খাবার দেওয়া যেতে পারে। বাকি একবেলা হালকা কোনো খাবার [ফলের রস বা নরম ফল, যেমন : কলা] দিতে পারেন। আধা সিদ্ধ ডিম, সবজির স্যুপ বা ছোটো দেশি মুরগির স্যুপও শিশুর জন্য উপকারী। বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানমিশ্রিত খাবার বাইরে থেকে কিনে আনার চেয়ে ঘরেই বিভিন্ন পুষ্টিকর উপাদান দিয়ে সুস্বাদু খাবার তৈরি করে খাওয়ানো উত্তম। একবছরের বেশি বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে মায়ের দুধের পরিমাণ ধীরে ধীরে কমিয়ে আনতে হবে। এ বয়সে দিনে পাঁচবার বাড়তি খাবার প্রয়োজন। কোনো অবস্থায়ই শিশুকে জোর করে বেশি পরিমাণ খাবার দেওয়া ঠিক নয়। বাড়ন্ত শিশু কোনো একটি খাবার খেতে পছন্দ না করলে, সেটির পরিবর্তে একই পুষ্টিমানের অন্য খাবার দেওয়া যেতে পারে।

যে শিশু খিচুড়ি খেতে চায় না, তাকে নরম ভাতের সঙ্গে ডাল, সবজি, মাছ বা মাংস ভালোভাবে মিশিয়ে ফিসফাস তৈরি করে খেতে দিতে পারেন। শিশুকে দুই বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে। দুই বছর পূর্ণ হওয়ার আগ পর্যন্ত শিশুকে গোরুর দুধ বা কৌটার দুধ খাওয়ানো যাবে না। শিশুকে শক্ত খাবার, যেমন বিস্কুট বা শক্ত ভাত দেওয়া ঠিক নয়। শক্ত খাবার খেতে গেলে শিশুর গলায় আটকে যেতে পারে। অল্প অল্প করে শিশুর খাবারের পরিমাণ বাড়াতে হবে। প্রথমদিকে প্রতিবেলায় স্যুপের বাটির তিন ভাগের একভাগ পরিমাণ খাবার দেওয়া যেতে পারে। ধীরে ধীরে খাবারের পরিমাণ আধা বাটি, পৌনে একবাটি এবং এভাবে একবাটি পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে। উদ্ভিজ আমিষ শিশুর জন্য বেশি উপযোগী। তাই মাছ বা মাংস শুরু করার আগে শিশুর খাবারে ডাল যোগ করুন।

শিশুর জন্য খিচুড়ি তৈরি করতে চাল ও ডাল সমপারিমাণ নেওয়া উচিত। ছয় মাস বয়সী শিশুকে সামান্য ডিমের কুসুম দেওয়া যায়, শিশুর বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ডিমের কুসুমের পরিমাণ ধীরে ধীরে বাড়াতে হবে। সিদ্ধ বা পোচ করা ডিমের কুসুম, দুটোই শিশুর জন্য উপকারী। ডিমের কুসুম খেয়ে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার কিছুদিন পর থেকে ডিমের সাদা অংশ খাওয়ানো শুরু করতে পারেন। ছয় মাস বয়স থেকে শিশুকে পানি পান করানো উচিত। নুডলস স্যুপ বা জাউভাতও দিতে পারেন শিশুকে। যেকোনো একটি খাবার শুরু করার পর একটানা তিন থেকে পাঁচ দিন খাবারটি দেওয়া উচিত। ওই খাবারে শিশুর অ্যালার্জি আছে কি না বা সেটি খেলে শিশুর অন্য কোনো সমস্যা হয় কি না, তা এ সময়ের মধ্যেই ধরা পড়বে।

একেবারে ছোটো শিশুদের টকজাতীয় ফল দেওয়া ঠিক নয়। নয় মাস বয়সের পর সামান্য পরিমাণে টকফল দেওয়া যেতে পারে। মিষ্টি ফলগুলো শিশুদের জন্য বেশি উপযোগী। শিশুদের খাবারে বেশি লবণ দেওয়া ঠিক নয়। আর চিনির পরিবর্তে মধু বা গুড় ব্যবহার করা ভালো। গড়ে একবছর বয়সের মধ্যেই শিশু পরিবারের বাকিদের মতো খাবার খেতে পারে, তবে এটি নির্ভর করে শিশুর দাঁত ওঠার সময়ের ওপর। যে শিশুর আগে দাঁত উঠবে, সে একটু আগে আগেই স্বাভাবিক খাবারে অভ্যস্ত হতে পারবে। আর যেসব শিশুর দাঁত উঠতে একটু দেরি হয়, তাদের সম্পূর্ণ স্বাভাবিক খাবারে অভ্যস্ত হতে একটু বেশি সময় লাগবে। তবে, এতে ভয়ের কিছু নেই।

শিশুর খাবারদাবার নিয়ে অযথা উদ্বিগ্ন না হয়ে শিশুর পুষ্টিচাহিদা পূরণে মা-বাবার সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিত।